পূর্ব ইউরোপ থেকে কম্যুনিস্ট শাসন অবসানের পর যুগোশ্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে কসোভা নামের আরেকটি রাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করে। বসনিয়া-হারর্জেগোভিনা রাস্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক আন্দোলনের নেতা আলী ইজ্জত বেগভিটস ইখওয়ানুল মুসলেমিন প্রভাবিত আল আজহার থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রখ্যাত আলেম ও মোহাদ্দিস মোহাম্মদ খানজীর ছাত্র। ৯ টি উপদলের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম মুজাহিদ ফ্রন্টের অধিনায়ক ছিলেন সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ:) এর পরিকল্পনা ও তত্ত্ববধানে প্রতিষ্ঠিত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত মাহমুদ কারজিতস। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের সাবেক নায়েবে আমীর মরহুম খলিল আহম্মদ হামেদী (রহ:) বলেন, “বসনিয়া মুসলিম তরুনদের মাঝে ইসলামী জিহাদের উদগ্র বাসনার ফলশ্রুতিতে সেখানে শুরু হয় সার্ব বিরোধী সশস্র সংগ্রাম। এ জিহাদে সেই যুবকরাই অগ্রণী ভূূমিকা পালন করেন যারা আরব বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অধ্যায়নরত ছিলেন। তারা মাওলানা মওদূদী (রহ:), শহীদ হাসান আল বান্না (রহ:) ও শহীদ সাইয়েদ কুতুব (রহ:) - এ সকল মহান সাধক পুরুষদের জিহাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত হন” (ইসলামী আন্দোলনের অতীত বর্তমান, পৃষ্ঠা ২৭)।
পূর্ব ইউরোপ থেকে কম্যুনিস্ট শাসন অবসানের পর যুগোশ্লাভিয়ার প্রদেশগুলো যেমন শ্লোভানিয়া, সার্বিয়া, ক্রোশিয়া, মন্টেনিগ্রো, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং মেসিডোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ১৯৯২ সালের ১লা মার্চ যুগোশ্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতার সপক্ষে অনুষ্ঠিত গণভোট সংখ্যালঘু সার্বরা ব্যতীত অধিকাংশ লোক তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ সবনিয়া বসনিয়া মুসলমান ও সংখ্যালঘু খৃষ্টান ক্রোয়েমিয়ানরা ভোট প্রদান করে। ১৯৯২ সালে ইউরোপীয় জোট ও যুক্তরাষ্ট্র সবনিয়া-হার্জেগোভিনাকে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৯২ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর পূর্বে ১৯৯০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল নিম্নরূপ: ১) ইসলামী ডেমোক্রেটিক আন্দোলন ৮৬ আসন, ২) সার্ব ডেমোক্র্যটিক পার্টি ৭০ আসন, ৩) ক্রোয়েশিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন ৪৫ আসন, ৪) অন্যান্য সম্প্রদায়ের ও দল পেয়েছে ৩৯ আসন। ইসলামী ডেমোক্র্যাটিক আন্দোলনের প্রেসিডেন্ট আলী ইজ্জত বেগভিটসকে দেশের প্রেসিডেন্ট, সালাম সাবিতসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ক্রোশিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনের নেতা জিওরলিভিয়ানকে প্রধানমন্ত্রী, আরো ৪ জন ক্রোশিয়ান মন্ত্রী এবং দুইজন সার্বমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। পার্লামেন্টের স্পীকার হয় সার্ব সম্প্রদায়ের লোক।
১৯৯২ সালে সবনিয়া হারর্জেগোভিনা যুগোশ্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর যুগশ্লাভিয়ার সার্ব সম্প্রদায় একে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধ ঘোষনা করে। সার্ব শাসিত যুগোশ্লাভিয়ার বৃহৎ প্রদেশ সার্বিয়া বসনিয়া-হারর্জেগোভিনার অভ্যন্তরে দেড় লাখ সদস্যবিশিস্ট সার্ব মিলিশিয়া তৈরী করে। সংখ্যালঘু সার্ব সম্প্রদায় বসনিয়া-হারর্জেগোভিনার ভেতর সার্ব প্রজাতন্ত্র কায়েম করে তাকে সার্বিয়ার সাথে যুক্ত করতে চায়। বসনিয়ার সার্ব নেতার নাম হচ্ছে রাদুভান কারাজিতস। অপরদিকে সার্ব শাসিত যুগোশ্লাভিয়া বৃহত্তর সার্বিয়া কায়েমের উদ্দেশ্যে বসনিয়া-হারর্জেগোভিনা দখল করতে চায়। এলক্ষ্যে সার্বরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামষ্টিক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে এবং ভয়াবহতম গণহত্যা, নারী-ধর্ষণ ও নির্যাতন চাপিয়ে দেয়। আর যুদ্ধের শুরুতেই জাতিসংঘ বসনিয়া-হারর্জেগোভিনার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে। এ দিকে মুসলমানদের হাতে অস্ত্র আসার পথ বন্ধ, অন্যদিকে বসনিয়া হারর্জেগোভিনায় সার্বরা সাবেক যোগোশ্লাভিয়ার বৃহৎ প্রদেশ সার্বিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লাভ করতে থাকে। এ অবস্থায় বসনিয়া মুসলমানদের নিরাপদ অঞ্চলের প্রতিরক্ষার জন্য পাকিস্তান তিন হাজার সৈন্য পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু EC অর্থাৎ ইউরোপের গোষ্ঠী তা প্রত্যাখ্যান করে বসে। বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ঘোষণা দেয় ইউরোপের বুকে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সহ্য করা হবে না। রাশিয়ান পার্লামেন্ট সার্বিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে জাতিসংঘকে বিরত রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েৎসিনের প্রতি আহ্বান জানায়। কৃ্ষ্ঞ সাগর ও দানিয়ুব নদী দিয়ে রাশিয়ািন জাহাজগুলো সার্বিয়ায় সমরাস্ত্র ও খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেয়। অথচ ন্যাটো জাহাজগুলো এড্রিয়াটিক সাগরে পাহারা বসায়। কেননা এ পথে মুসলমানদের জন্য অস্ত্র আসতে পারে। এভাবে সম্মিলিত খৃস্ট শক্তি একটিি ক্ষুদ্র মুসলিম জাতিসত্বার বিরুদ্ধে ধ্বংশ অভিযান পরিচালনা করলেও পাশ্চাত্যের সেবাদাস মুসলিম সরকারসমূহ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। বসনিয়া-হারর্জেগোভিনার মুসলমানদের উপর ভয়াবহতম গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংশ অভিযান চরমে পৌঁছলে এবং অপর দিকে নিতান্ত অসহায় অবস্থার মধ্যে মুসলমানদের সাহসী প্রতিরোধ সংগ্রামের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী মুসলামানদের মধ্যে বিক্ষোভ ও ঘৃণা জেগে উঠে। এ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী সহ বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনসমূহ। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতসহ বিশ্বের অনেক স্থান থেকে বিপুল পরিমান অর্থ সংগ্রহ করে বসনিয়া মুসলমানদের সাহায্যার্থে প্রেরণ করে। এ অবস্থায় তুরস্কসহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্যোগে ওআইসি জাতিসংঘ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার ঘোষণা দেয়। বসনিয়ার নিপীড়িত মুসলিমদের পাশে দাড়ানোর সাহস যখন কেউ পাচ্ছিলো না তখন তুরস্কের প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান বিরোধীদলে থেকেও সব রকমের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। বসনিয়ার বিখ্যাত নেতা আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচ যখন তার কাছে সাহায্যের জন্য আসেন এক মাসের মধ্যে ৩৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সেসময়ে বসনিয়ার একটি স্ট্র্যাটিজিক পজিশনে অবস্থিত মার্সিডিজ ফ্যাক্টরীকে অস্ত্র ফ্যাক্টরীতে রূপান্তর করেন, তাও মাত্র ১১ মাসের মাথায়, তার উপর বিরোধীদলে থেকে। বসনিয়ার স্বাধীনতায় প্রফেসর এরবাকানের অবদান অনেকটা উহ্যই থেকে গিয়েছে, কারণ তিনি ডাক-ঢোল পিটানোর চেয়ে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন।ক্ষমতায় থেকে হোক আর না থেকেই হোক, আমেরিকা, ইসরাঈল, ন্যাটো কাউকে পরোয়া না করে মুসলিমদের সহায়তায় সর্বদা পাশে দাড়িয়েছেন। বর্তমান সময়ের তার্কির সবচেয়ে বড় দাতব্য সংস্থা(IHH) তিনিই গড়েছিলেন ১৯৯২ সালে বসনিয়ায় সাহায্য প্রেরণের জন্য। এছাড়া সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলন সমূহের বহু সংখ্যক জিন্দাদিল মুজাহিদ বসনিয়ান মুসলমানদের সাথে প্রত্যক্ষ জিহাদে অংশগ্রহণ করে। তখনই ইউরোপীয় জোটসমূহ বসনিয়া-হারর্জেগোভিনার সমস্যার কোন প্রকার একটি সমাধানের ব্যবস্থা করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, যুদ্ধ তীব্র রূপ নিলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর আওতায় ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশী সৈন্যরা বসনিয়া-হারজোগোভিনাতে প্রেরিত হন। তারা সার্বদের থেকে তুলনামূলক কম যুদ্ধ-উপকরণ দিয়ে সার্বদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ফজলুর রহমান বসনিয়ার বাংলাদেশী কন্টিংজেন্ট কমান্ডার সেলিম আক্তারের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখতেন। পরে সার্বরা পরাজিত হয়। বসনিয়াবাসীরা এখনো বাংলাদেশেীদের এই অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
এখানে আমি (শাহাদাতুর রহমান সোহেল) আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। সেসময় সারা বাংলাদেশ জুড়ে বসনিয়াবাসীর জন্য ও বাংলাদেশী সৈন্যদের জন্য মসজিদে মসজিদে দোয়া করা হচ্ছিল। তার সাথে সাথে অত্যাচারী সার্বদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হচ্ছিল। সেসময় আমি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় জামায়াতে ইসলামীর একজন থানা পর্যায়ের দায়িত্বশীল। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ নাইক্ষ্যংছড়ি থানা সদরে আমার সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতির বক্তব্যে আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ দেই। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে বিপুল অর্থ কালেকশনে করে পাঠাই বসনিয়াতে পাঠানোর জন্য। এভাবে সারা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা বসনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে।
Please browse these link:
No comments:
Post a Comment