Thursday, January 5, 2017

মিশরে ইখওয়ানুল মুসলেমীন, বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার এবং জামায়াতে ইসলামী


১৯২৮ সালের মার্চ মাসে মিশরের ইমাম হাসান-আল-বান্না শহীদ রহ: এর নেতৃত্বে ইখওয়ানুল মুসলেমীন (মুসলিম ব্রাদারহুড) যাত্রা শুরু করে। তাঁর নেতৃত্বে ইখওয়ানুল মুসলেমীন পঞ্চাশের দশকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। টাইমস অব লন্ডন পত্রিকার মতে- ১৯৪৮ সালে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা লাভের মাত্র ২০ বৎসর সময়ের মধ্যে ইখওয়ানের সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা দাড়ায় নুন্যতম পাঁচ লক্ষ। 
১৯৪৮ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনীকে বিতারিত করা হয় নিজ আবাস ভূমি থেকে। শতকরা ৯২ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আমেরিকা ও বৃটেনের বর্বরতার চরম নিদর্শন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেনি ইখওয়ানুল মুসলেমীন। তারা ফিলিস্তিন যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করে। এ যুদ্ধের বিবরণ ভুলে ধরেছেন ইখওয়ানের অন্যতম নেতা ওস্তাদ কামেল শরীফ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইখওয়ানুল মিসলেমীন ফি হরবে ফিলিস্তিন অর্থাৎ ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইখওয়ানুল মুসলেমীন গ্রন্থে। মুসলমানরা যখন ইসরাইলের সাথে একের পর এক পরাজয় বরণ করছিল তখন ইখওয়ানের মুজাহিদ বাহিনী অসাধারণ সফলতা অর্জন করে। ইখওয়ানের তীব্র আক্রমনের মুখে ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়। কখন ইহুদীদের মদদগার বৃটেন-রাশিয়া-আমরিকার চাপে তৎকালীন পুতুল রাজতান্ত্রিক সরকার ইখওয়ানের বিপ্লবী মুজাহিদ বাহিনীকে ফিলিস্তিন থেকে ফিরিয়ে আনে। পরে ইখওয়ানুল মুসলেমীনকে মিশরে বেআইনী ঘোষণা করে এবং কঠোর অত্যাচার নির্যাতন চাপিয়ে দেয়। ১৯৪৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী ইমাম হাসান-আল-বান্নাকে প্রকাশ্যে গুলি করে শহীদ করা হয়। এরপর দীর্ঘ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতালিপ্সু সামরিক চক্র বিদেশী শক্তির সহযোগিতায় মিশরে ইসলামী আন্দোলনের সাফল্য তখনকার মত তছনছ করে দেয়। নেতৃবৃন্দের শাহাদাত বরণ, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মীর কারাবরণ ও দেশত্যাগে বাধ্যকরণ এবং নির্যাতনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সম্ভাবনাময় এ ইসলামী আন্দোলন স্তিমিত করে দেয় সম্রাজ্যবাদী-ইহুদীবাদী শক্তির দোসররা। ১৯৭১ সালের পর বর্বর নির্যাতন প্রশমিত হলেও ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি দিয়ে সর্বদা বিচলিত রাখা হয়েছে। এরপরও সে আন্দোলন জীবন্ত ও গতিশীল। এরপর পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলেমীন নিজ নামে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। এজন্য তারা হিজবুল আহরাব ও হিজবুল আমলে ইশতারাফী নামক দুটি দলের সাথে জোটবদ্ধ হন। এ জোটের টিকেটে তারা ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেন এবং ৪২টি আসল লাভ করেন। বিজয়ী সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইখওয়ানুল মুসলেমীনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসান-আল-বান্না শহীদের সুযোগ্য পুত্র এডভোকেট সাইফুল ইসলাম এবং ইখওয়ানুল মুসলেমীনের মুরশীদ আম হাসান আল হুদাইবীর সুযোগ্য পুত্র এডভোকেট মামুন আল হুদাইবী। উপরোক্ত দুইজন সংসদ সদস্যই মিশরের রাজধানী কায়রোর নির্ধারিত নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত। এছাড়া মিশরের বৃহৎ ও প্রভাবশালী পেশাজীবি সংগঠন সমূহে ইখওয়ান সদস্যরা অত্যন্ত সক্রিয় থাকেন । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নেতৃত্ব দেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিয়ন, মেডিকেল ইউনিয়ন, ফার্মাসিষ্ট ইউনিয়ন, ল'ইয়ার্স ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনে ইখওয়ান সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে। এ সাফল্য ইখওয়ান স্বাভাবিক পরিস্থিতেতে অর্জন করেনি। বরং সকল প্রকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এ সাফল্য এসেছে। এরপর ২০০৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইখওয়ানের প্রার্থীরা মিসরের পার্লামেন্টের এক পঞ্চমাংশ আসন লাভ করেন। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটে ইখওয়ানের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে মিসরের স্বৈরশাসক হোসনী মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইখওয়াননুল মুসলিমিন আবার রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শাখার নাম দেয় ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। ২০১২ সালের ৩০ জুন দেশটির প্রথম অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ মুসলিম ব্রাদারহুড  ৫১.৭৩ শতাংশ ভোট পায় এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ব্রাদার হুড নেতা মোহাম্মদ মুরসি। এই প্রথম দেশটিতে অবাধ ও  সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর বছর খানেকের মধ্যে ইহুদী ও খৃষ্টান ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর নীরব সম্মতিতে এবং সৌদি আরবসহ আরবের রাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালের জুলাই এ মিসরের অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতা গ্রহণ করেন জেনারেল সিসি। এরপর মুরসীকে বন্ধী করা হয় এবং ইখওয়ানুল মুসলিমিনের উপর পূণরায় বর্বর নির্যাতন চাপিয়ে দেয়া হয়। একে ধ্বংশ করতে আগেও ব্যর্থ হয়েছিল এবং এবারও ব্যর্থ হবে ইনশাল্লাহ। 

বিস্তারিত জানার জন্য এই লিংকগুলো ব্রাউজ করুন :    
1) ইখওয়ানুল মুসলিমীন এক জীবন্ত ইতিহাস! 2) প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির হত্যাকাণ্ড ও একটি বিভ্রান্তি 3) গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-১ 2) গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-২

ইখওয়ানুল মুসলেমীন ও জামায়াতে ইসলামী একই দেহে দুটি চোখ বা একই বৃক্ষে দুটি শাখার মত সংগঠন। এদুটি সংগঠন নানাভেবে একে অপরের দ্বারা শক্তিশালী হয়। সামান্য সামান্য বিপর্যয়ে যারা নানাভাবে নিরুৎসাহ বা হতাশবোধ করেন তাদের উচিত মিশরে ইখওয়ানের উপর আরোপিত নানা প্রতিকূলতা ও অত্যাচার-নির্যাতন থেকে শিক্ষা গ্রহন করা। 

মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলেমীন বাহরাইন, ইরান, তুরস্ক, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, সিরিয়া, আরব আমিরাত, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়। ইউরোপের জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ব্রাদারহুড ইসলাম ও রাজনীতির ওপর প্রকাশ্যে মত প্রকাশ এবং বিভিন্ন প্রকাশনা করে থাকে। মুসলিম ব্রাদারহুডের বহুল প্রচলিত স্লোগান হলো: ‘ইসলামই সমাধান’ এবং ‘বিশ্বাসীরা ভাই ভাই’। মিশরে ইখওয়ানুল মুসলেমীন আত্মপ্রকাশ করে সেখানে নির্যাতনের কারণে তারা সহজে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা ইখওয়ানুল মুসলেমীনকে ধ্বংশ করতে চেয়েছিলো তাদের সে প্রচেষ্টা তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।      

No comments:

Post a Comment

Popular Posts