Friday, April 27, 2018

ঘরে ঘরে হতে হবে পাঠাগার হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে বই -সালাহউদ্দিন আইউবী


মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে জ্ঞানের দিক থেকে। যে জ্ঞানের সূচনা হয়ে থাকে পড়ার মাধ্যমে। যে কারণে পৃথিবীতে আগত যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলের জীবনগঠনের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রথম বাণী ছিল ‘পড়’। পৃথিবীর যেসব মহামানব আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের কর্মের শুরু সেই পড়া থেকেই। অসভ্য, বর্বর জাতিগুলোর সভ্যতার দিশা দেয়া হয়েছে যুগে যুগে পড়ার নতুন নতুন কৌশলের মাধ্যমে। পড়া মানুষকে এক উচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সবখানে পড়ুয়া শ্রেণীর কদর সম্পূর্ণই আলাদা। দিকভ্রান্ত জাতির পথের দিশা হয়ে বারবার সুন্দর সমাধান দিয়েছে পড়–য়া জাতি।
বই পড়তে পারাটা একটা ম্যাজিকের মতো। হাজার বছরের সমস্ত মানুষের কথা ইচ্ছে করলেই জানা যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই বেড়ানো যাচ্ছে মিসর, বেবিলন মেসোপটেমিয়া, ভারতবর্ষের সেই প্রাচীন সভ্যতায়।
পড়ার অভ্যাস করতে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা খুবই দুর্ভাগা যাদের পড়তে শেখার সুযোগ হয়নি। তাদের চেয়েও দুর্ভাগ্য তাদের যারা পড়তে শিখেও পড়ল না।
মানুষ সাধারণত খুব নিকট অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না। জৈবিক ধারণাতেই তাদের জীবন চালিত। অতীত বলতে তাদের থাকে কিছু স্বার্থগত স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ বলতে কিছু সঞ্চয় পরিকল্পনা। খাওয়া খাদ্য বাসস্থানের স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প কিছু ইতর শ্রেণীর প্রাণীর থাকে। জ্ঞানের শুরু থেকে মানুষ খুঁজে গেছে মানুষের সাথে পশুর পার্থক্যটা আসলে কত দূর? সেই পার্থক্যের সত্যিকারের উপলব্ধির জন্য আল্লাহর বাণী পাঠালেন পড়ো তোমার প্রভুর নামে। জানিয়ে দিলেন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। তাই সক্রেটিস বলেছিলেন তুমি নিজেকে জানো।
বই মানুষের চিন্তার খোরাক। বই পড়ে মানুষ চিন্তার জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। বই না পড়ে যে মানুষ নিগূঢ়তম চিন্তার জগতে ঢুকতে পারে না, তা নয়। কিন্তু ওটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যথোপযুক্ত লোক খুঁজে নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলাপ চালানো হতে পারে এক ধরনের চিন্তার খোরাক। বই হচ্ছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে সহজতম পদ্ধতি হাজার বছরের মানুষের চিন্তার ইতিহাসকে সংযুক্ত করার। হয়ত ভবিষ্যতে এর চেয়ে সহজ কোনো উপায় বের হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব সুন্দর করে বলেছেন, মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরবতা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবতার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া ওঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয় মাথার ওপরের কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত বন্যা বাঁধ আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!

জীবন বদলে দিতে পারেন
আপনি যদি প্রতিদিন ৩০-৬০ মিনিট স্টাডি করেন তবে প্রতি সপ্তাহে আপনার একটি বই সম্পন্ন হয়। প্রতি সপ্তাহে একটি বই সম্পন্ন হলে প্রতি বছর সম্পন্ন হয় ৫০টি বই। আর আপনি যদি সিলেকটিভ ফিল্ডে ৫০টি বই সম্পন্ন করেন তবে প্র্যাকটিকেল ফিল্ডে একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হয়। কারণ মেজর ইউনিভার্সিটিতে একটি পিএইচডি প্রোগ্রামে সিলেবাসে ৪০ থেকে ৫০টি বই পড়ানো হয়ে থাকে। যদি এভাবে বছরে ৫০টি বই স্টাডি ধারা অব্যাহত রাখেন তবে পরবর্তী ১০ বছরে আপনার পঠিত বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০তে। যেখানে বিশ্বের মানুষ গড়ে মাত্র একটি বইয়ের কম স্টাডি করেন সেখানে সিলেকটিভ ফিল্ডে আপনি যদি ৫০০ বই স্টাডি করেন তবে আপনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কতটা উচ্চমার্গে উত্তীর্ণ হবেন, ভাবতে পারেন?
সত্যি বলতে আপনি যদি প্রতিদিন ভোর বেলায় ৩০-৬০ মিনিট স্টাডি করার অভ্যাস করতে পারেন তবে এটি আগামী দশ বছরের মধ্যে আপনাকে আপনার ফিল্ডের smart reader, most knowledgeable, most expert, highest paid successful person এ উন্নীত করবে আপনি পৃথিবীর এমন কোন successful person পাবেন না যারা daily study habit এর মাধ্যমে নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনেননি।
আমার পরিচিত বইপড়–য়া একজন ব্যক্তিত্ব হলেন অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের নির্বাচিত সাবেক ভিপি, একসময়ের রাজপথ কাঁপানো তুখোড় ছাত্রনেতা। যিনি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই সরকারি অর্থায়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানাবিধ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। তাকে আমি তার ব্যক্তিজীবনের অবিস্মরণীয় এই যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম- তিনি শুধু বলেছিলেন ‘আমি কখনো দিনের বেলা ঘুমাই না। সবাই যখন ঘুমাতো আমি তখন পড়ালেখা করতাম। ফজরের নামাজের পর সবসময় কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পড়ালেখার অভ্যাস আমার ছিল ; এখনো যেটা আমি অব্যাহত রেখেছি।’

ব্যবহারিক টিপস
১.আপনার study field সিলেক্ট করুন ও সিলেবাস তৈরি করুন।
২.টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ও সকল প্রকার ইলেকট্রিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার একটি নিয়মতান্ত্রিকতার আওতায় নিয়ে আসুন এবং সময় অপচয় রোধ করুন।
৩.দিনের সকল কাজের লিস্ট করুন এবং সময় ও অগ্রাধিকার অনুযায়ী শিডিউল তৈরি করুন।
৪.প্রতিদিন ফজরের আগে ঘুম থেকে জাগুন।
৫.পড়ালেখার মাধ্যমে দ্বীনের কাজ শুরু করুন এবং আপনার মনে ইনভেস্ট করুন।
আগামীকাল থেকে তো অনেক কিছুই শুরু করলাম, এবার না হয় আজ থেকে শুরু করি, কেমন?

বই পড়ার কৌশল
সবার পড়ার ধরন এক রকম নয়। একেকজনের পড়ার ধরন একেক রকম। অভিজ্ঞতার আলোকে শেয়ার করছি : নতুন কোনো বই পেলেই বই ও লেখকের নাম এবং কতটা ভালো করে দেখি। লেখক পরিচিতি থাকলে একনজর দেখা উচিত। অনেক সময় মূল মলাট উল্টালেই লেখকের কথা চোখে পড়ে । এটা অবশ্যই পড়তে হবে। তাতে বইয়ের মূল বক্তব্যটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
এরপর পড়া শুরু হয় সূচিপত্র থেকেই। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন অধ্যায় পেলে সেখানেই কৌতূহলী মন নিয়ে আগে ঢু মারি। তা না হলে সকল অধ্যায় সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে প্রথম অধ্যায় থেকেই করতে থাকি। হাতের কাছে লাল কালির কলম থাকতেই হবে। লাল কালির কলম ছাড়া মার্কিং করা কঠিন। সচরাচর লাল, নীল এবং সবুজ তিনটি কলম এবং অনেক ক্ষেত্রে text liner অথবা marker pen ব্যবহার করা যায়।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলোতে বা কোন বিখ্যাত ব্যক্তি বা মনীষীর উক্তি পেলে লাল কালি দিয়ে underline বা text liner দিয়ে mark করে রাখি। তবে অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলিতে সবুজ, কখনো নীল কালি ব্যবহার করি; যাতে বিষয়ের ভিন্নতা সহজেই চোখে পড়ে। এতে করে পরবর্তীতে এই বিষয়টা খুঁজে বের করতে অনেক সহজ হয়।
কোন নতুন বই ও লেখকের নাম উল্লেখ থাকলে লাল কালি দিয়ে গোল চিহ্ন দিই। ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশি কোনো শব্দ পেলে গোল চিহ্ন দিয়ে ডিকশনারি থেকে অর্থ বের করে পাশের ফাঁকা জায়গায় অ্যারো চিহ্ন দিয়ে রাখি। নতুন কোন পারিভাষিক শব্দ তার এ টু জেড অভিধান ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করি বা পড়ে ফেলি (ব্যস্ততা না থাকলে)!
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর পাশে তারকা চিহ্ন ব্যবহার করি। খুব বেশি হলে তিন তারকা অপেক্ষাকৃত কম হলে দু’টি বা তার চেয়েও কম হলে একটি তারকা চিহ্ন ব্যবহার করি।
মজার হাসির কোন প্রসঙ্গ পেলে হাসির emoji আটকানোর চেষ্টা করি অথবা হা-হা-হা লিখে রাখি।
বিস্ময়কর অবাস্তব ঘটনা বা প্রসঙ্গ এলে!!! দিই। ভালোলাগা লাইনটুকু তৎক্ষণাৎ আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। কোন বিষয়ে লেখকের মতের সাথে অমিল হলে পরে নিজস্ব মতামত লিখে রাখি কালো কালিতে। অত্যধিক ভালো লাগলে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাসূচক কথাবার্তাও লেখার চেষ্টা করি।
আর একটি কথা বই পড়া যখন শুরু করি তখন পৃষ্ঠার উপরে নিজের স্বাক্ষর বানানসহ বাংলা ইংরেজি ও হিজরি তারিখ- সন – বারের নাম এবং সময় লিখে রাখি। সম্পূর্ণ বই তাড়াহুড়ো করে শেষ করার জন্য কখনোই খুব বেশি তাড়া অনুভব করি না বলেই স্বাভাবিক গতিতে ধীর-স্থিরভাবে তা পড়ার চেষ্টা করি। তবে কখনো কখনো বই সাইজে ছোট এবং অত্যধিক ভালোলাগার হলে এক বৈঠকে শেষ হয়ে যায়।
বই পড়ার সময় আরেকটি কাজ খুবই জরুরি তাহলো নোট রাখা। অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি হাতের কাছে রাখার নোটবুকে তৎক্ষণাৎ টুকে রাখা পৃষ্ঠা নম্বরসহ। বইয়ের রিভিউ লেখা বা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনে নোটবুকে চোখ বুলালেই যথেষ্ট। যদিও এটা আমার সবসময় করা হয়ে ওঠে না। তবে চেষ্টা করছি নিয়মিত করার। বই পড়া শেষ হলে শেষ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর দিন-তারিখ সময়ের উল্লেখপূর্বক নিজস্ব মতামত সংক্ষেপে লিখে ফেলি।
আর একটা কথা, সচরাচর ধার করে বই পড়ি না । বই ধার করা ও ধার দেয়া যদিও পছন্দের কাজ।
আমার সংগ্রহে বেশকিছু গ্রন্থের পিডিএফ ফাইল রয়েছে। ল্যাপটপ বা মোবাইলের মাধ্যমে মাঝে – মধ্যে তা থেকে পছন্দসই বই পড়ে থাকি । তবে সত্য বলতে- হার্ডকপি পড়ার মজাই অন্যরকম।
নতুন বা পুরাতন বইয়ের গন্ধে অন্যরকম এক আকর্ষণ বোধ করি যা আমার কাছে খুবই ভালো লাগার। তবে কখনও দীর্ঘ সময় বা স্বল্প সময়ে সফরে থাকলে সেখানে হার্ডকপি বহন করা সম্ভব না হলে pdf file থাকলেও পড়ার ক্ষুধা মেটানো যায়! সময়টাও বেশ সুন্দর কাটে। সে হিসাবে পছন্দের কয়েকটি বইয়ের পিডিএফ ফাইল সব সময় মোবাইলে রাখি। টুকটাক পড়িও!
সর্বোপরি, বন্ধুদের আড্ডায় বা কারো সাথে গল্পের সময় বইয়ের অনুরূপ প্রসঙ্গ এলে পরে ওইসব বইয়ের শিক্ষণীয় বিষয় বা লব্ধ জ্ঞান তাদের সাথে নিজের মতো করে শেয়ার করি এবং তাদের কেউ বইটি পড়তে উৎসাহিত করি।
‘বাঙালির বই পড়ার আগ্রহ প্রবল কিন্তু বই কেনার বেলায় এসে অবলা।’- সৈয়দ মুজতবা আলী।
কিন্তু বর্তমানে, আমাদের বই কেনার বেলায় যেমন অবহেলা! facebook আসার পরে অনেক ক্ষেত্রে facebook আসক্তির কারণে বই পড়ার বেলায়ও তেমনি অবহেলা।
আসুন! নিজে বই পড়ি, সুন্দর জীবন গড়ি এবং অন্যদেরকেও বই পড়ায় উৎসাহিত করি।

শিশুদেরকেও বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত
গবেষণায় দেখা গেছে যেসব বাচ্চাকে ছোটবেলায় বই পড়ে শুনানো হয় তারা তাদের counterpart বা অন্য বাচ্চারা যাদেরকে বই পড়ে শুনানো হয় না, তাদের চেয়ে ভালো পাঠক হয়। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা বই পড়ার সাথে পরিচিত হয়। যাদের বাসায় ছোটখাটো লাইব্রেরি থাকে তাদেরও ভালো পাঠক হিসেবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কেবল বই পড়া যথেষ্ট নয়, কিশোরদেরকে বইয়ের আলোচনায় যুক্ত করতে হবে। সে একটা বই পড়ে কি বুঝতে পারল, কি নতুন তথ্য শিখলো, কোন জিনিসটার সাথে সে একমত, কোন জিনিসটার সাথে একমত নয় তাদেরকে এই ধরনের প্রশ্ন করতে হবে। অবশ্যই প্রথম দিনেই কোন শিশু এই পদ্ধতিতে অসাধারণ কিছু করে ফেলতে হয়ত পারবে না, কিন্তু ২-১ বছরের মধ্যেই তারা ভালো পাঠক হয়ে উঠবে, চিন্তা করতে শিখবে। নিজের মতো করে অ্যানালাইসিস করবে। বেশিরভাগ সময়েই আমরা বাচ্চাদেরকে এই প্রশ্নগুলি করি না। আমরা নিজেরাও এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত নই। কিন্তু একবার এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত হলে এটা কি সূর্যের ভবিষ্যৎ সময়ের জন্য অনেক ফলপ্রসূ কিছু হবে।
শিশু-কিশোরদেরকে যাচ্ছেতাই শিখতে দেয়া যাবে না। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে কেবল বইটি পড়লেই কোনো জিনিস সত্য হয়ে যায় না। যেকোনো বিষয়কে যুক্তি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দিয়ে যাচাই বাছাই করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যেকোনো দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভালো reference লাগে এটাও তাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো উচিত।
সূত্র মতে, যেসব শিশু-কিশোর কোন কিছু শেখার পরে অন্যদের সাথে শেয়ার করছে, তার বন্ধুদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যে কোন জিনিসের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছে তারা অনেক ভালো শিখছে, তাদের analytical skill বাড়ছে। যারা আলোচনা করে শিখছে, অন্যের মত এবং চিন্তার সাথে পরিচিত হচ্ছে, কয়েক বছরের ব্যবধানে যারা কেবল নিজে নিজে পড়ছে তাদের তুলনায় অনেক গভীর জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠছে। শিশু-কিশোররা বই পড়ার পরে তাদেরকে এই বইয়ের ওপর নিজের ভাষায় একটা summary লিখতে বলা যেতে পারে, ৫ মিনিট এই বইয়ের ওপর কথা বলতে দেয়া যেতে পারে। এটাও তাদের বুঝ শক্তিকে আরও শাণিত করবে। তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে তাদের নিজের মতকে ডিফেন্ড করার কৌশল শেখাতে হবে। এই জিনিসগুলো রাতে খাবার টেবিলে গল্প বা আড্ডার সময় করা যেতে পারে। কোন একটা ছুটির দিনে পরিবারের সবাই নিজের পছন্দমত বই পড়বেন এবং পারস্পরিক knowledge sharing session করবে এরকম কিছু একটা করা যেতে পারে।
শুধু বিনোদনের জন্য নয়, তাদেরকে ধীরে ধীরে জ্ঞানমূলক বই এবং নিজের লেভেলের চেয়েও কিছুটা কঠিন বইয়ের দিকে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই শুরু হতে হবে আনন্দের কিছু দিয়ে, সহজ কিছু দিয়ে। তাদেরকে feedback দিতে হবে। কি ভালো করেছি কি আরো ভালো করা যেত এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদেরকে একটা কাজ আরও সুন্দর করে করার, শেখার সুযোগ দিতে হবে। এই বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে- হ্যাঁ তুমি চেষ্টা করছো এবং উন্নতি লাভ করছো। ভালো কিছু করা যে সহজ না এবং উন্নতি একটা নিয়মিত পদ্ধতি- এ বিষয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন।
সবশেষে তাদের সাথে অন্তরঙ্গতার কোনো বিকল্প নেই। আপনি কয়েকটা মজার বই দিয়ে তাদের সাথে আপনার সম্পর্কের সূচনা করতে পারেন। এই বই হয়তো তার জীবন বদলে দেবে একজন কিশোর হয়ে উঠবে আগামীর ভালো পাঠক, লেখক কিংবা অ্যানালিস্ট।

লেখালেখির পূর্বশর্ত গভীর অধ্যয়ন
পড়ার মাধ্যমে পুঞ্জীভূত জ্ঞানের সমষ্টি একসময় লেখনীশক্তি দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলাও প্রথমে মানুষকে পড়তে বলেছেন এর পরেই কলমের ব্যবহার করতে বলেছেন অর্থাৎ লেখার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। শুধুমাত্র পড়ার জন্য পড়ার চেয়ে অনেক উত্তম হলো লেখার জন্য পড়া। লিখতে না পারলেও অন্তত কোন একটা বিষয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা থাকা এবং সে বিষয়ে নলেজ শেয়ার করা এবং সম্ভব হলে অবশ্যই লেখা উচিত। আর লেখালেখি করতে হলে গল্পের বইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানমূলক বই পড়া খুবই দরকার। ধরুন আপনি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তে ভালোবাসেন। বিনোদনের জন্যই উনার বই খুবই সুপাঠ্য কিন্তু গেম তৈরিতে অংশগ্রহণের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। পশ্চিমা সভ্যতার উন্নতির পেছনে একটা বড় নিয়ামক হলো গেম তৈরি। তারা প্রতিদিন নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। এটা তখনই সম্ভব যখন আপনি জ্ঞানমূলক বই পড়বেন।
পৃথিবীর সেরা গ্রন্থ দিয়ে
পাঠাভ্যাসের উন্মোচন হোক

যুগে যুগে বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে কিছু গ্রন্থ। আর যারা পাল্টাতে চেয়েছে তারাও সবার আগে চেষ্টা করেছে সেই গ্রন্থগুলোর আদি-অন্ত পড়ে ফেলার।
মোঙ্গলরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে বাগদাদের কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। পুরো বাগদাদকে শ্মশান বানিয়ে দিয়েছিল। তারা মুসলিম উম্মাহ সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা করেছিল তা হলো তারা কয়েক লক্ষ বই সংবলিত ‘দারুল হিকমাহ’ নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটা ধ্বংস করেছিল। মানবসভ্যতা মহামূল্যবান বইগুলো এক এক করে ফোরাত নদীতে ফেলে দিয়েছিল। ফুরাতের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বইয়ের স্তূপের কারণে! দীর্ঘদিন ফুরাতের সেই পানি বাগদাদ বাঁশি ব্যবহার করতে পারেন কারণ, তা ঐসব বইয়ের কালি আর মন্ডতে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল!
মঙ্গলবার সেই কয়েক লক্ষ বই এ জন্যই ধ্বংস করেছিল যে, তারা শুনেছিল, তখনকার দিনের দুই বিশ্ব পরাশক্তি, superpower, রোমান ও পারস্য সভ্যতার ধ্বংস করতে পেরেছিল যে যাযাবর, পশ্চাৎপদ, বর্বর আরবরা, তাদের মূল শক্তি নিহিত ছিল এই বইয়ের মধ্যেই। এই কারণেই তাদের সমস্ত রাগ ছিল বইয়ের ওপরে!
বস্তুত তাদের বিশ্বাস আর ধারণা অমূলক ছিল না। মুসলমানরা একটামাত্র বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপদটা সাধন করতে পেরেছিল। সেই বই তথা আরবি ভাষায় সেই কিতাবটা হলো ‘আল কুরআন’। মহাবিশ্ব al-quran! এটা এমন একটা বই যে, এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ সংশয় নেই, থাকার উপায় নেই।
এই একটিমাত্র বই বর্বর অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ আরব জাতিকে মহা ক্ষমতাধর করে তুলেছিল। এতটা ক্ষমতাধর যে, তারা ছয় হাজার বছরের ঐশ্বর্য ও শক্তিসমৃদ্ধ পারস্য সাম্রাজ্যকে, সাড়ে চার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মহাশক্তিধর রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে তাদের ওপরে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
সঙ্গত কারণেই মোঙ্গল তাতাররা ভীত ছিল তাদের ক্ষমতা, নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে, তাই তারা মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করার পাশাপাশি তাদের সমাজ থেকে সব বই ধ্বংস করেছিল।
ইতিহাস কিন্তু সেই মুঘল সেই বর্বর তাতারদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছে। বাগদাদ আক্রমণ ও সেখানে তাদের দ্বারা পরিচালিত পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞের মাত্র ৪০ বছরের মধ্যেই তাতাররা, মোগলরা নিজেদের অজান্তেই ইসলামের কাছে তথা বিস্ময়কর গ্রন্থ, আল কুরআনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দেয়। মোগলরা, তাতাররা মুসলমান হয়ে যায়!
এর কারণটা কী ছিল? একমাত্র দৃশ্যমান কারণ এটা ছিল যে, তারা প্রায় ১১ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা ও তাদের সমাজ তাদের সমস্ত বইপত্র ধ্বংস করার পরেই যে গুটিকতক মুসলমানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তার বেশিরভাগই তাদের হাতে বন্দিনী নারী ও মুসলিম নারী। এই নারীদের প্রায় সবাই ছিলেন শিক্ষিতা। তারা প্রত্যেকেই নিজের মন-মগজে শত শত বই এবং মহা বিস্ময়কর গ্রন্থ আল কুরআনের শিক্ষাকে ধারণ করে রেখেছিলেন।
তাতাররা বই ধ্বংস করেছিল বাগদাদের ১১ লক্ষ বই পাঠককে হত্যা করেছিল বটে কিন্তু তারপরেও যে একটি বই পাঠক পাঠিকা কি নিজেদের বিকৃত লালসা মেটানোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই মাত্র গুটিকতক বই পাঠিকার হাতে মাত্র চল্লিশ বছরের মধ্যে তারা নিজেদের লালিত ঐতিহ্য সাম্রাজ্য সভ্যতাকে বিসর্জন দেয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমান হয়ে যায়! কি অসাধারণ ক্ষমতা সেই বইয়ের! ভাবতে গেলেও বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়।
আজ মুসলমান তরুণ যুবকদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে কম। কুরআন তেলাওয়াত এর কিছুটা অভ্যাস থাকলেও যথাযথভাবেই মহাগ্রন্থ অধ্যয়নের কোন ইচ্ছাই আজ যুবসমাজের নেই।
কী লজ্জা! কী নির্মম পরিণতি! নিদারুণ মানসিক বিকৃতি!!
মুসলমান যুবক তরুণদের শোচনীয় মানসিক বিপর্যয় নিয়ে ভাবতে গেলে ক্রোধে-আক্রোশে, অনুতাপে আর অনুশোচনায় চেতনা বিবশ হয়ে আসে যেন, চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসে, চোখ ভিজে যায়!
নিজেদের বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে, করাতে হলে সকল কিছুর আগে আশ্রয় নিতে হবে সেই বইয়ের কাছে, ডুবতে হবে বইয়ের সাগরে, এর পাতায় পাতায়, বিচরণ করে বেড়াতে হবে, নিজেদের সজ্জিত করতে হবে নতুন করে। তাই আমার প্রতিদিনের সকালটা শুরু হোক পৃথিবীর সেরা গ্রন্থ আল কুরআন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে।

প্রিয় বন্ধুরা
যুগে যুগে জ্ঞানচর্চাকারীরাই মসনদে সমাসীন ছিলেন। আজ মুসলমানরা বসনিয়া থেকে আরাকান পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে নির্যাতিত, অত্যাচারিত, ক্ষমতাচ্যুত, বিচ্যুত। কিন্তু এই মুসলমানরাই এক সময় ছিল পৃথিবীর সেরা জাতি। সোনালি সেই ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই। মুসলমানদের ঘরে ঘরে ছিল বই পড়ার অভ্যাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি উদ্যোক্তা ও পরিচালক ছিল মুসলমানরা। বাগদাদের দারুল হিকমা পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগারটি ছিল গ্রানাডায়। গ্রানাডার এই লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ। ঐ একই সময়ে ইউরোপ জুড়ে সবচেয়ে বড় যে পাঠাগারগুলো ছিল তা ছিল মূলত খ্রিস্টান পাদ্রীদের মঠে বা গির্জায়। আর ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতে, পুরো ইউরোপব্যাপী কোন গির্জা বা মঠে চার শতের বেশি বই ছিল না। (সূত্র : History of the reign of Ferdinand and Isabella the Catholic. William H prescott, 1837, pp.188)
সে সময় মুসলিম জনমানসই এমন ছিল যে, ছেলে-বুড়ো নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিব সবাই বই-পাগল ছিলেন। প্রতিটি বাড়িতে ছিল গ্রন্থাগার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি। কে কার চেয়ে বেশি বই জোগাড় করতে পারে, তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত সমাজবাসীর মধ্যে। একে অপরকে উপহার হিসেবে তারা বই দেয়া নেয়া করতেন। কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলেও উপহার হিসেবে বই নিয়ে যেতেন। ইতিহাসে দেখা যায় স্বয়ং খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম উপহার হিসেবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন বই। তার নিজের যে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল সেখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ষাট হাজার।
আর পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের গবেষণায় এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ১০ শতাব্দীতে ইউরোপের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি অবস্থান ও বইয়ের বাজার বসতো মুসলিম আন্দালুস তথা স্পেনে।
সেই সমাজে কেবল পুরুষদের বেলাতেই যে এরকম মনোজাগতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটে ছিল তাই নয়, নারীদের বেলাতেও এরকম একইভাবে উত্তরণ ঘটেছিল। তার প্রমাণ আমরা পাই খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের আমলে এ ঘটনায়।
রাজ পরিবারের এক যুবকের বিয়ে দেয়ার জন্য খলিফা উপযুক্ত পাত্রী খুঁজছিলেন। তিনি নিজে অত্যন্ত বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী, তেমনি তিনি রাজ পরিবারের জন্য সেরকমই একটি পাত্রী খুঁজছিলেন।
তাই খলিফা এক বিস্ময়কর ঘোষণা জারি করলেন পাত্রীর খোঁজ চেয়ে। তিনি ঘোষণা করলেন; গ্রানাডা শহরে যে বাড়িতে বিবাহযোগ্য এমন পাত্রী রয়েছে, যে পাত্রী একদিকে পুরো আল কুরআন মুখস্থ করেছে অর্থাৎ কুরআনে হাফেজ এবং এর পাশাপাশি ইসলামের যে কোন একটি হাদিসশাস্ত্র যার মোটামুটি জানা আছে সেরকম পাত্রীর অভিভাবকরা যেন তাদের বাড়ির বারান্দা বা বেলকুনির বাইরে রাতের বেলায় প্রজ্জ্বোল্যমান বাতি টাঙিয়ে রাখেন।
কেবল খলিফাকেই নয়, পৌর গ্রানাডাবাসীকে অবাক করে দিয়ে সে রাতে শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বেলকুনিতেই প্রজ্জ্বোল্যমান বাতি টাঙানো হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কেমন যুবতী মেয়ের উপস্থিতি ছিল, যে মেয়েটি একাধারে কুরআনে হাফেজ আবার অন্যদিকে হাদিস শাস্ত্রেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।
প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন, মুসলমান হিসেবে মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যারা ভাবেন, মুসলিমদের একটি স্থায়ী ও অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য যারা নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। হতাশাগ্রস্ত মুসলিম যুবসমাজের আগামীর আলোর দিশারি হিসেবে যারা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটনের স্বপ্নধারা বিভোর। বিপ্লব বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক সোনালি সমাজের কারিগর হিসেবে যাদের গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই মানুষগুলোকে স্বপ্ন দেখতে হবে এক নতুন বিপ্লবী জ্ঞানচর্চাময় সমাজের। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে পাঠাগার, হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে বই, নিজে অধ্যয়ন করে জানিয়ে দিতে হবে, আবার সেই সোনালি সমাজ আমরা গড়ব এই বই হাতে নিয়ে- পৃথিবীকে আলোকিত করব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

Wednesday, April 25, 2018

তুরস্কে মাওলানা মওদুদী ও তাফহীমুল কুরআনের প্রভাব



লিখেছেনঃ এরবাকান



সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহঃ )বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ যার ক্ষুর ধার লেখনী ও বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার তাঁকে আজও আমাদের মাঝে জীবন্ত রেখছে। তুরস্ক আজ যে ইসলাম পন্থী একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে এটা তৈরিতে মাওলানার সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম।


ডঃ নাজমুদ্দিন এরবাকনের উপর মাওলানা মওদুদীর প্রভাব-
ডঃ নাজমুদ্দিন এরবাকান হলেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান সিপাহ সালার। তিনি তার বক্তব্যে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে মাওলানা মওদূদীর (রহঃ)নাম নিতেন। তিনি মাওলানাকে ইমাম বলে অবহিত করতেন এবং তার সাহিত্য পড়ার জন্য তার জনশক্তিকে উৎসাহ যোগাতেন। তার মৃত্যুর আগে এরজুরুম শহরের একটি সমাবেশে বলেছিলেন আমি দেখতে পাচ্ছি নিকট ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে জিহাদ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হবে তাই আপনারা মাওলানা মওদূদীর (রহঃ) 'আল জিহাদু ফিল ইসলাম' বইটি পড়ে নিবেন। তিনি হয়তবা আজকের আইএস এর কথাই বলেছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন 'মিল্লি গুরুশে' এর সিলেবাসে মাওলানা মউদূদীর (রহঃ) অনেক বই রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল-

১।তাফহীমূল কোরআন

২। ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী

৩।ইসলামি রেনেসাঁ আন্দোলন

৪।কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা

৫। আ্ল কুরআনের মর্ম কথা।

৬। সমস্যা ও সমধান

৭।আসুন মুসলিম হই।

৮। আসুন দুনিয়াকে পরিবর্তন করি।

৯। খিলাফাত ও রাজতন্ত্র

১০। ইসলাম পরিচিতি।

তুরস্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে নিয়মিত তাফহীম পাঠ করা হয়ে থাকে। কিছু কিছু রয়েছে যারা এক যুগের ও বেশী সময় ধরে নিয়মিত ভাবে তাফহীম পাঠ করে আসছেন। প্রতি বছর বিভিন্ন সংগঠের উদ্যোগে তাফহীমুল কোরআন পাঠ প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে।

তুরস্কে ২ টি প্রকাশনা থেকে তাফহীম প্রকাশিত হয়ে থাকে। একটি ৭০ এর দশকে প্রকাশিত হয়েছে অপরটি হয়েছে ২০০০ সালের পর। বর্তমান সময়ে চিন্তার দ্বন্দে মাওলানা মওদূদীর (রহঃ) সাহিত্যের যেন কোন জুড়ি নেই। যিনি শত বছরের সকল জঞ্জাল কে মুছে ফেলে আমাদের সামনে এক নিরেট ইসলাম পেশ করার লক্ষে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশ জামায়াতেে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের শাহাদাত এবং এই দলটিকে ঘিরে ইয়াহুদি ও সাম্রাজ্য বাদীদের মাথা বাথা যেন তুরস্কে মাওলানা মউদূদীর (রহঃ) সাহিত্যের প্রভাবে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে

Source: Facebook page

তুরস্কের শীর্ষ আলেম , তুরস্ক সরকারের ধর্মবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং তুরস্কের গ্র্যান্ড মুফতি শায়েখ ড. আলি আরবাশ হাফিঃ বলেন -
" তাফহিমুল কোরআন হলো তুরস্কের যুবকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য তাফসীর। আমরা তুরস্কের যুবকদেরকে এই তাফসীর পড়তে উৎসাহিত করি "।

Friday, April 20, 2018

কাব্যের দায় মিটিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ এগিয়ে গেছেন আদর্শের ঝাণ্ডা হাতে -তৌহিদুর রহমান



বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচেক, সব্যসাচী লেখক, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর পর কবিকে নিয়ে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা অসম্ভব রকমের খারাপ অভ্যাস আছে। তা হচ্ছে, আমরা বেঁচে থাকতে কাউকে যথাযথ মূল্যায়ন করি না, আবার মরণের পরে তাকে নিয়ে কিছুদিন উৎসাহ দেখাই। তারপর সব ভুলে যাই। আমাদের মধ্যে আরো একটা বিষয় প্রকটভাবে আটকে আছে, তা হচ্ছে রাজনীতি। আমরা সবকিছুর সাথে রাজনীতি যুক্ত করে ফেলি। সৈয়দ আলী আহসান আমাদের বড় কবিদের মধ্যে একজন। সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে তার মৃত্যুর পরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল এখন তা নেই। আমরা ইতোমধ্যেই তাকে ভুলতে বসেছি। কেন এটা হবে? তার কবিতা তখনও যা ছিল এখনও তাই আছে। একই কথা প্রযোজ্য কবি শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রে। সৈয়দ আলী আহসানের মুত্যুর পরে তাকে নিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ ভালো একটা কবিতা লিখেছিল। আমাদের উচিত অগ্রজদের নিয়ে কাজ করা। তাদের বাঁচিয়ে রাখা।’

আজ যেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাহিত্য সমালোচকের কথার প্রতিফলন আমরা পরতে পরতে দেখতে পাচ্ছি। আজ আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজেই নিজের উদাহরণ হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। এত বড় একজন লেখক, কবি, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ অথচ তাকে আমরা একদম ভুলে গেছি। গুণী এই লেখক বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে যে আমরা কতভাবে খেদমত গ্রহণ করেছি তার ইয়ত্তা নেই! তিনি টানা দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড সম্পাদনা করেছিলেন। আর তাই হয়তো কবি গোলাম মোহাম্মকে আমরা কিছুটা হলেও চিনতে পেরেছি। তা না হলে কবি গোলাম মোহাম্মদও অনেকের মতো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতেন। তাই কবি গোলাম মোহাম্মদকে বাঁচিয়ে রাখার সম্পূর্ণ কৃতিত্বটা দিতে চাই অত্যন্ত উদার ও বড় মনের মানুষ কবি আবদুল আবদুল মান্নান সৈয়দকে। কবি গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচেক, সব্যসাচী লেখক, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দকে।
পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্যের জন্য সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা কবি গোলাম মোহাম্মদের ‘আলোকদিয়ার আলোর ছেলে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
আলোকদিয়ার আলোর ছেলে কোথায় চলে যায়,
সেই বেদনা বুকের ভেতর কেবল মোচড় খায়।
আলোকদিয়ার সবুজ জুড়ে কিসের বিষাদ নামে
নবগঙ্গা ব্যথায় কাঁপে বরুনাতৈল গ্রামে
পাখিগুলোর কণ্ঠে করুণ সুর
কোথায় গেল সেই ছেলেটি সে আজ কত দূর
নীল আকাশে কাঁপন জাগে সেই ছেলেটি কই
আকাশ নীলে ব্যথার প্রলেপ কষ্টে ফোটে খই
গ্রামে গ্রামে বৃক্ষলতায় কান্না ঝরে পড়ে
সেই ছেলেটির জন্য কাঁদে মানুষ ঘরে ঘরে
মাঠে মাঠে বাতাস কাঁদে ফসল ওঠে কেঁদে
সেই ছেলেটির জন্য কত ব্যথার গাঁথা বেঁধে
মানুষ তারে ভালোবাসে ফেলে চোখের পানি
মাগফেরাতের দোয়া করে স্মৃতির আঁচল টানি।
কবি গোলাম মোহাম্মদকে আমি পুরোপুরি পাঠ করেছি। কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড প্রস্তুত করেছিলাম প্রায় দুই বছর ধরে। সে সময় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ সার্বক্ষণিক পাশে থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা পালন করেছি। তখন দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে, তার কাব্য নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে। তখনই আমরা বুঝেছি যে গোলাম মোহাম্মদ একজন বড় মাপের কবি। তার সমগ্র রচনা জাতির সামনে উপস্থাপিত করার দায়িত্বটা আমাদেরই ছিল, কিন্তু আমরা তা পারিনি। আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা ছিল, আছে। তা আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সম্প্রতি কবি গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গীত সমগ্র পুরোটা সম্পাদনা করেছি। সাধারণ ভাষায় লেখা অতি অসাধারণ অসংখ্য গান মুগ্ধ করার মতো। রচনা সমগ্র প্রথম খণ্ডের কাজ করার সময় আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছ থেকে যে দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম তা এখন পাথেয় হিসেবে কাজে দিচ্ছে। আমি জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশের প্রথিতযশা লেখক, কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকের সাথে কাজ করেছি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শিখেছি। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের সাথে এক বছর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদের সাথে অনেকগুলো বইয়ের কাজ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কবি বেনজীর আহমদের ‘হেমন্তিকা’ ও ‘জিন্দেগী’ কাব্যগ্রন্থ এবং শাহাবুদ্দীন আহমদের ‘চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা’। বিভিন্ন লেখকের অন্তত দুই হাজারের অধিক গ্রন্থ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে সম্পাদনা, সংশোধন, পরিমার্জন করেছি। কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে, ভুল হলে অগ্রজদের কাছ থেকে শিখেছি। এখনো প্রতিনিয়ত শিখছি অনেকের কাছ থেকে। এই সব উঁচুস্তরের মানুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে মণি-মাণিক্য সঞ্চয় হয়েছে অনেক। যা মনের মণিকোঠায় তুলে রেখেছি সযতনে। আজ আমাদের মাথা আছে কিন্তু সেই মাথার উপরে আচ্ছাদন নেই। কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে সহসা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কয়েকটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম। আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব, একেএম নাজির আহমদ, অধ্যক্ষ আব্দুর রব, কথাশিল্পী জামেদ আলী, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ ছিলেন এক একটি নক্ষত্র। কথাশিল্পী জামেদ আলী ছাড়া খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অন্যদেরকে আমরা হারিয়েছি। তাদের অভাব এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের মতো বহুভাষাবিদ একই সাথে কুরআন-হাদিস, বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফেকাহ, কবিতা, ছন্দ, অর্থনীতি, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তাই বলছিলাম যে, আজ আর আমাদের মাথার উপরে ছাতা নেই। আমরা যে হাজার হাজার কাজ করেছি কিন্তু কোথাও নিজের নামটা পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। আমরা নাম-জসের পাগল ছিলাম না, ছিলাম কাজের পাগল। আবদুল মান্নান তালিব প্রায়ই বলতেন, মুসলমানরা দুনিয়াতে এমন বড় বড় কাজ করেছেন অথচ নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। না জানি আত্মপ্রচারের দায়ে দণ্ডিত হয়ে পরকালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় কিনা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পাল্টেছে অন্যের ওপরে নিজের নামটা না দেখলে অনেকে মনোক্ষুণœ হয়, কাজ করা ছেড়ে দেয়, এমনকি সংগঠন ত্যাগ করে। নিজের গলা থেকে আল্লাহর রজ্জু পর্যন্ত খুলে ফেলে।
কবি গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কবি ছিলেন কাজপাগল একজন মহৎ মনের মানুষ। কাজের গন্ধ পেলে তিনি আদেশের অপেক্ষা করতেন না। ঝাঁপিয়ে পড়তেন কাজে। নীরবে নিভৃতে অসংখ্য গান কবিতা লিখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি শুধু লিখেই গেছেন কিন্তু তা প্রকাশের কোনো পেরেশানি তার মধ্যে লক্ষ করিনি। আমাদের উচিত তার সমগ্র কর্মকাণ্ড জাতির সামনে উপস্থাপিত করা, তুলে ধরা।
কবি গোলাম মোহাম্মদের প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন আমেজের। তার প্রতিটি কবিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভিন্ন। তবে আশর্দিক দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে তা অভিন্ন। তার কবিতার অন্তর্গত ভাব একগুচ্ছে জমা করলে বুঝা যায় তা এক একটি তসবিদানার মতো, কিন্তু অবিচ্ছন্ন সূত্রে একত্র করলে দেখা যাবে তা জমাট ঈমানী শক্তিতে একতাবদ্ধ। তার প্রতিটা কবিতার আলাদা স্বাদ স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করা খুবই সহজ। তার এক একটি কবিতা পাঠ করে, তার গান শুনে মুগ্ধ হতে হয়। তাকে পাঠ করে ও শুনে কাটিয়ে দেয়া যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিংবা বছর। পাঠক শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করার বিমোহিত করার ক্ষমতা যে লেখক বা কবির যত বেশি সেই লেখক বা কবির কালোত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফল বলে আমরা মনে করি।
উপমা, অলঙ্কার, ভাববিন্দু মিলে সৃষ্টি হয়েছে তার কবিতার শরীর। তার কবিতা বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্ন ভাব অলঙ্কারে প্রকাশিত হলেও তার যোগফল কিন্তু একটাই। আর তা হলো আদর্শ। এই আদর্শিক বুনন সহজে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তার মতো অধিক সহজ সরল সাবলীল ভাষায় কবিতার জমিন এত নিখুঁতভাবে ভরাট করতে ইতঃপূর্বে অন্য কোনো কবিকে দেখা যায়নি। সুচ সুতা, সেলাই বুনন, কারুকাজ সবই কবির একান্ত নিজের। সবক্ষেত্রেই কবির নিজের নিপুণতা নিজেই ধরে রেখেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামি গানের স্বতন্ত্র একটা ধারা তৈরি করেছেন, যা কালজয়ী। কবি মতিউর রহমান মল্লিক সেখান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসে আদর্শিক ও বৈপ্লবিক নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করেছেন। মল্লিক থেকে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে কবি গোলাম মোহাম্মদ অতি সহজ সরল ও মোলায়েম ভাব-ভাষায় সৃষ্টি করেছেন তার গীতিকাব্য। যা পাঠক-শ্রোতাকে আবিষ্ট করে। ধরে রাখে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোহাম্মদের বিশেষ কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি সব সময় একদম পরিচিত শব্দে তার কাব্য-গানের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। চেনা শব্দে এভাবে কাব্য ভাষা ও বিষয় অাকর্ষণ করতে ইতঃপূর্বে খুব কম কবিকেই দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরল। তার প্রতিটা কবিতা গান পরস্পর থেকে আলাদা তবে তা নতুন আঙ্গিকে নতুন কাব্যভাবনায় সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে পাঠকের আকর্ষণ তার প্রতি।
পথহারা জনগণকে জাগিয়ে তোলার সেরা হাতিয়ার হচ্ছে কবিতা। সেই আদিকাল থেকে তাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে কবিতাই সব সময় আদৃত হয়ে আসছে। কবিতা মানুষকে সুন্দরের স্বপ্ন দেখায়। মনকে করে তোলে সতেজ। কবিতার মাধ্যমে খুব সহজে মানুষের মনে আদর্শের বীজ বুনে দেয়া যায়।
গত শতাব্দী থেকে বলা যায় দুনিয়া জুড়ে মানুষের মধ্যে আত্মোপলব্ধি ও আত্মানুসন্ধানের ঢেউ জেগে উঠেছে। মানুষ খুঁজতে শুরু করেছে আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক ঠিকানা। নিজের যা আছে তাই নিয়ে সে জেগে উঠতে চাই। বেঁচে থাকতে চাই আপন ঐতিহ্য নিয়ে। আমরা জানি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক রাস্তা ধরেই এগিয়ে চলে মানব সভ্যতা। আর সে কারণেই আজ মুসলিম জাতিও সামনে এগিয়ে যেতে চায় তার স্বর্ণখচিত দ্যুতিময় অতীত ঐতিহ্যের পথ ধরে। মুসলমানদের আছে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। আছে দেড় হাজার বছরের গৌরবময় সোনালি ইতিহাস। এরই ধারাবাহিকতায় যেসব মনীষী আদর্শিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষর রেখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ তাদের অনেকের মধ্যে একজন। আমাদের পূর্বসূরি কবি গোলাম মোস্তফা, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ হচ্ছেন সেই আদর্শের একেকজন সিপাহসালার।
আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতাকে নাস্তিক্যবাদ ও আদর্শহীনতার কবল থেকে মুক্ত করার একটা প্রয়াস শুরু হয়েছিল। এ প্রচেষ্টার অনেকখানিই সফল হয়েছে নব্বই দশকে এসে। একঝাঁক বিশ্বাসী কবি এই প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি সোলায়মান আহসান, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি মুকুল চৌধুরী, কবি হাসান আলীম, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি গাজী এনামুল হক প্রমুখ। এরা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করতে অনেকটাই সফল হয়েছেন। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া এই ধারা আজ অবধি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এটা দৃঢ়তার সাথে বলা যায়।
আদর্শবাদী কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন আশির দশক থেকেই। কিন্তু তার প্রায় সব কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে নব্বই দশকে এসে, কোন কোনটা তারও পরে। নব্বই দশকের শেষে কবি গোলাম মোহাম্মদের সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑঅদৃশ্যের চিল (১৯৯৭), ফিরে চলা এক নদী (১৯৯৮), হিজল বনের পাখি (১৯৯৯), ঘাসফুল বেদনা (২০০০) হে সুসূর হে নৈকট্য (২০০২), এছাড়া ছড়াগ্রন্থ ছড়ায় ছড়ায় সুরের মিনার (২০০১) এবং নানুর বাড়ী (২০০২)। কবির প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থই নন্দিত এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, যা সচরাচর হয় না।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলামী সাহিত্যের দিকনির্দেশক আবদুল মান্নান তালিব, বিদগ্ধ আলোচক নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, বর্তমান বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি আল মাহমুদ, বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সাহিত্য সমালোচক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কবি, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক গোলাম মোহাম্মদকে যখন কবি হিসেবে গ্রাহ্যের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং বিশেষভাবে তার কবিতাকে উচ্চকিত করেন তখন সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই এই কবিকে সমীহ না করে পারেন না। এ দিক দিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ সৌভাগ্যবান এবং সার্থক।
আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব বলেন, ‘ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। নিজের জীবন ও সাহিত্য কর্মকে এজন্য উৎসর্গিত করেছিলেন। এ ব্যাপারে তার সমগ্র কাব্যকর্মে কোনো জড়তা অস্পষ্টতা নেই। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক বিশ্বে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ কবিকণ্ঠ।’ (ভূমিকা, কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র)
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, ‘কবিতা লিখতেন গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫৯-২০০২), গান লিখতেন, ছবি আঁকতেন। তাঁর ছোট প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন শিল্পকোণ। মানুষটি ছিলেন যেন একটি বিজনতার অধিবাসী, স্মিতহাস্যময়, স্বল্পভাষী। ছন্দোবদ্ধ পদ লেখেন যাঁরা, তারা সবসময় পদ্যে পড়ে থাকে, কবিতায় উত্তীর্ণ হয় না। গোলাম মোহাম্মদের কবিতায় পেতাম কবিতারই আস্বাদ। আমার স্বভাব হচ্ছে, ভালো-লাগাটুকু অনেক সময় লিখে, অন্তত মুখে, জানানো। গোলাম মোহাম্মদকে একাধিকবার আমি জানিয়েছি, তাঁর কবিতা আমার ভালো লাগছে।’ (হিজল বনের পাখি, কবি গোলাম মোহাম্মদ স্মারক, পৃষ্ঠা ৭)
এরপর তার সমসাময়িক প্রায় সকলেই কবিকে নিয়ে লিখেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রায় সব কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সংগঠক তাকে পাঠ করেন, তাকে নিয়ে ভাবেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। এটা তার অনেক বড় পাওয়া। তার গানের ভক্ত শিশু, ছেলে, বুড়ো, যুবা সকলেই।
‘সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে
আমাকেই রাখিও রহমান
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভীক
নির্ভয়ে সব করে দান।’
(কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২১৩)
‘কাশেমের মায়ের কোল হয়নি খালি
খালি হলো কোটি কোটি মায়েদের কোল,
কোটি কোটি বুকে জ্বলে ব্যথার আগুন
শাহাদাত ভাঙছে সকল আগল।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১২)
‘হলদে ডানার সেই পাখিটি
এখন ডালে ডাকে না
মনের কোণে রঙিন ছবি
এখন সে আর আঁকে না।
এখন কেন হচ্ছে মানুষ খুন
দুঃখের আগুন জ্বলছে অনেক গুণ…।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৪)
‘হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি
দেয় না সাড়া নীরব গহিন বন
বাতাসে তার ব্যথার গুঞ্জরণ।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৫)
কবি গোলাম মোহাম্মদ এ ধরনের অজস্র গানের জনক। আসলে গানের মাধ্যমেই তার পরিচিতিটা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি- এই পঙ্ক্তি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই মনের মাঝে ভেসে উঠে একটি নাম একটি ছবি, তা হলো কবি গোলাম মোহাম্মদ। ‘পাঞ্জেরি’ শব্দটি শুনলেই যেমন মনের মাঝে ভেসে ওঠে কবি ফররুখ আহমদের কথা। ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি শুনলেই ভাবতে থাকি নজরুলের কথা। সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে- শুনলেই মন ছুটে যায় সাগর দাড়িতে- কবি মাইকেল মধুসূদনকে মনে পড়ে যায়। ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা- শুনলেই চিন্তা করি কবি গোলাম মোস্তফার কথা। এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে শুনলেই পল্লীকবি জসিম উদ্দীন সামনে এসে হাজির হয়। এমনিভাবে কে ঐ শুনালো মোরে আজানের ধ্বনি- শোনামাত্রই কায়কোবাদকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। আরো অনেক কবিই আমাদের অন্তরকে নাড়া দেয় গভীরভাবে। প্রত্যেক কবির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে আলাদা করে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। তেমনি কবি গোলাম মোহাম্মদের অনেক গান কবিতা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, সেসব চরণগুলো শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কবি গোলাম মোহাম্মদের নাম। লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি-(নজরুল) তেমনি লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা লিখেও অনেকেই পাননি কবি খ্যাতি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো অসংখ্য গানের স্রষ্টা কবি গোলাম মোহাম্মদ। সুর যত সহজে মানুষের মনে ঝংকার তোলে সাহিত্যের অন্য কোন মাধ্যমে অত সহজে মানুষের মনে স্থান করে নেয়া যায় না। এদিক দিয়ে গোলাম মোহাম্মদ এগিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে। আমার মনে হয় গান না লিখলে গোলাম মোহাম্মদ কখনো এতটা জনপ্রিয় ও কালজয়ী হতে পারতেন না।
কবি গোলাম মোহাম্মদ একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন- যেখানে থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা। স্বপ্ন দেখতেন মানবতার জয়গানের, স্বপ্ন দেখতেন কালজয়ী এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার। যে সভ্যতা ধারণ করেছিলেন সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হযরত মুহাম্মদ সা:। সুন্দর সেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান কবিতা। যা অনেক দিক থেকেই সাহিত্য আকাশে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। যা প্রতিনিয়ত অনেক আদর্শবাদী মানুষের মনে অনুরণিত হয়, হচ্ছে।
গানের মতো তার কবিতাও পাঠকমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যা শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন সুপণ্ডিত সাহিত্য সমালোচকরা। তার কবিতার কিছু উদাহরণ পেশ করা হলো-
‘পাখি
পাখিরে তোর ঈমান বড়ই পাকা
আহা!
তোর গানে যে মনের বিনয় মাখা।
(পাখিরে তোর, হিজল বনের পাখি)
‘হাতটারে সাফ কর সাফ কর দিল
মুছে যাবে যন্ত্রণা সব মুশকিল
তাল তাল আন্ধার পাপ কর দূর
পুষ্পিত দিন পাবে ঘ্রাণ সুমধুর।’
(হাসতো নিখিল, অদৃশ্যের চিল)
‘তৃতীয় বিশ্বের যুবক মাত্রই বিষণ্ণতার রোগী
তার সামনে অন্ধকার, মহানগরীর ডাস্টবিনের মতো
পচা রাজনীতির আস্ফালন!’
(ফসলহীন সময়ের কথা, ফিরে চলা এক নদী)
‘সেও তো ধ্বনির কাজ
তোমার প্রভুর নামে পড়
অনন্ত ভাবের ফুল ফুটে হলো
ভাষার বাগান।’
(হরফের সাঁকো, ঘাস ফুল বেদনা)
শব্দে-ছন্দে, ভাব-কল্পনায়, আদর্শ-উদ্দীপনায়, আশা-ভালোবাসায় গোলাম মোহাম্মদের অনেক কবিতা অতুলনীয়, অসাধারণ ও অনন্য। পাঠক পুলকিত, শিহরিত ও চমকিত হয় তা পাঠ করে। তার কবিতা পাঠক সহজেই হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। তার কবিতা মনকে আন্দোলিত করে, উদ্দীপিত করে, বিমোহিত করে। তার কবিতায় ছন্দের অপূর্ব দোলা আছে। তার কবিতায় কোথাও ছন্দের ভুল পরিলক্ষিত হয় না। পাঠক মাত্রেই মোহনীয় সেই ছন্দ দোলায় দুলতে থাকে এবং একজন আদর্শবান, বড় ও ভালো মানুষ হবার স্বপ্ন জাগে মনে। দায়িত্বশীল, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ গড়তে সহায়তা করে তার লেখা। স্বপ্ন ভরা উদ্দীপনাময় তার কবিতা নতুন প্রজন্মের পাথেয় হতে পারে।
আমি মনে করি গোলাম মোহাম্মদ একটি কালজয়ী প্রতিভা। বিশেষ করে গানের মাধ্যমে তিনি সুদীর্ঘকাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার গান আবেদন ছড়াবে যুগ যুগ ধরে। তার সৃষ্টিসম্ভার প্রকাশিত হলে পাঠক, সাহিত্যালোচক তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমাপের চিত্রশিল্পী। ছিলেন সংগঠক। সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ, বড় মাপের মানুষ। কবি, শিল্পী, সংগঠক হিসেবে তিনি যতটা পরিচিতি লাভ করেছেন, তার থেকে অধিক পরিচিতি পেয়েছেন গীতিকার হিসেবে। তার গান কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল এদেশে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার মুক্তি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক কবি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবতাবাদী কবি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

Wednesday, April 18, 2018

বাংলাদেশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ আকর্ষণীয় স্থান কোথায়?



নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। এ পর্যটন কেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলায় অবস্থিত।
বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। এ পর্বতের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত আদিবাসী সম্প্রদায় ম্রো-পল্লী। যাদের বিচিত্র সংস্কৃতি দেখার মত।
বর্ষা মৌসুমে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র থেকে মেঘ ছোয়ার দূর্লভ সুযোগ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নীলগিরি থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র এটি। এটি সেনা তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এর পাশেই রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প। নিরিবিলিতে স্বপরিবারে কয়েক দিন কাটাতে এটি একটি আর্দশ জায়গা।
যাতায়াত
পর্যটকদের নীলগিরি যেতে হলে বান্দরবান জেলা সদরের রুমা জীপষ্টেশন থেকে থানছিগামী জীপ অথবা বাসে করে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে যেতে হবে। বান্দরবনা জীপ ষ্টেশন থেকে জীপ, ল্যান্ড রোভার, ল্যান্ড ক্রুজারসহ অন্যান্য হালকা গাড়ী ভাড়ায় পাওয়া যায়। নীলগিরি যাওয়ার পথে সেনা চেকপোষ্টে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। বান্দরবান জেলা সদর থেকে সাধারণত বিকেল ৫ টার পর নীলগিরির উদ্দেশে কোন গাড়ী যেতে দেয়া হয় না।
ভাড়া
আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত ৫সিট বিশিষ্ট ছোট জীপ রয়েছে। এর ভাড়া ২৩০০ টাকা। এছাড়া ৮সিট বিশিষ্ট বড় জীপের ভাড়া ২৮০০ টাকা।
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান জেলা সদর থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায়। এ ছাড়া নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র রাত্রি যাপনের জন্য বান্দরবান সদর সেনা রিজিয়নে বুকিং দেয়া যায়। তাছাড়া নীলগিরি পর্যটনে গিয়ে সরাসরি বুকিং করা যায়। বান্দরবান জেলা সদর থেকে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় অধিকাংশ পর্যটক দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসেন।
কটেজ ভাড়ানীলগিরিতে রয়েছে বেশ কিছু কটেজ। যেমন- 'গিরি মারমেট' (ভাড়া-৭৫০০ টাকা, ধারণক্ষমতা-৮/১০ জন); 'মেঘদূত' (ভাড়া-৬৫০০ টাকা, ধারণক্ষমতা-৮/১০ জন); 'নীলাঙ্গনা' (ভাড়া-৫৫০০ টাকা, ধারণক্ষমতা- ৪/৬ জন)। এছাড়া কাপলরা ২৭৫০ টাকায় ১ রুম ভাড়া পাবেন।

See this video:



Please browse this link: http://nilgiriresort.com


Thursday, April 12, 2018

বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী এবং রিসালায়ে নুর -আলী আহমাদ মাবরুর


বিংশ শতকে মুসলিম বিশ্বে যে কয়জন বড় মানের শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় সংস্কারক আবির্ভূত হয়েছিলেন তুরস্কের বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার মধ্যে অন্যতম। তার গোটা জীবন, সংগ্রাম এবং সাধনা আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক। নুরসীকে তুরস্কের ইসলামের পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার জীবনের অনন্যসাধারণ কাজটি হলো রিসালায়ে নুর (ইংরেজিতে বলা হয় দ্য বুক অব লাইট)। মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে যেভাবে সাইয়্যেদ নুরসী তার রিসালায়ে নুরে পর্যালোচনা করেছেন, তা অন্য কোন বইতে আমরা সেভাবে আর পাই না। এই গ্রন্থে আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। রিসালায়ে নুর হলো সেই অসাধারণ সৃষ্টি যা বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীকে আজও চির অম্লান করে রেখেছে।

নুরসী তার জন্মভূমি তুরস্কে উস্তাদ বদিউজ্জামান হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি এমন একজন বিদ্বান ছিলেন যিনি শুধুমাত্র ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই নয় বরং একই সঙ্গে আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (সায়েন্স অব ন্যাচার বা ন্যাচারাল সায়েন্স) এবং এর অগ্রগতি সম্বন্ধেও দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, ধর্মীয় সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং মানুষের মুক্তি সংগ্রামের লড়াকু একজন সৈনিক। তার শিষ্য বা ছাত্র কয়জন কিংবা কতজন মানুষ তার কাজ থেকে উপকৃত হয়েছে তার কোন সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায় না। কেননা তুর্কি নামক জাতিটির আজকের এই উত্থানের পেছনেও বদিউজ্জামান এবং তার রচনাবলির ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রচন্ড ধরনের প্রতিকূল একটি ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে থেকেও পুরোটা জীবন জুড়েই তিনি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করে গেছেন। শত নির্যাতনেও তিনি আপস করেননি বরং সার্থকতার সাথে একটি সফল আন্দোলনের সূতিকাগার রচনা করার জন্য নিজ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
উস্তাদ বদিউজ্জামান ১৮৭৭ সালে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের বিটলিস নামক জেলার অধীনে নুরস্ নামক একটি গ্রামে জন্ম নেন। এই নুরস্ গ্রামে জন্ম নেয়ার কারণেই তার নামের শেষে নুরসী শব্দটি যোগ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সাইয়্যেদ অর্থাৎ রাসূলের (সা.) বংশধর। পিতার দিক থেকে বিচার করলে তার আদি পুরুষ ইমাম হাসান (রা.) আর মায়ের দিক থেকে তার আদি পুরুষ ইমাম হোসাইন (রা.)।
৯ বছর বয়স পর্যন্ত নুরসী তার পরিবারের সাথেই ছিলেন। সেই সময়ে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় বড় ভাই মোল্লা আব্দুল্লাহর কাছে। আব্দুল্লাহও ইসলাম সম্বন্ধে খুব ভালো জ্ঞান রাখতেন। পরে নুরসী খুব অল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসায় তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পান। ফটোগ্রাফিক মেমোরি (একবার পড়লেই সেটাকে মনে রাখার ক্ষমতা), উৎকর্ষ মানের বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহসের কারণে নুরসী অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আশপাশের মানুষও তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার জন্য তাকে সমীহ করতে শুরু করে। তৎকালীন সময়ের অটোম্যান আলেমরা শিশু-কিশোরদের জন্য যে সিলেবাস বা কারিকুলাম নির্ধারণ করেছিলেন নুরসী মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার পুরোটাই আত্মস্থ করে ফেলেন। তার প্রতিভা দেখে তার শিক্ষক মোল্লা ফেতুল্লাহ তাকে বদিউজ্জামান বা যুগের বিস্ময় নামে অভিহিত করতে শুরু করেন। তার মেধা ও মুখস্থ বিদ্যার কদর করতেন পূর্বতুরস্কের প্রায় সব আলেমই। সেই সময় পর্যন্ত ইসলামিক বিজ্ঞানের ওপর যে ৯০টি রচনাবলি ছিল বদিউজ্জামান নুরসী তার সবটাই বেশ কম সময়ের মধ্যে মুখস্থ করে ফেলেন। অথচ সাধারণভাবে তৎকালীন যে কোন সাধারণ ছাত্র এই একই কোর্সটি সুসম্পন্ন করতে গড়ে ১৫ বছর সময় নিতেন।
নিজ এলাকার পড়াশোনা শেষ করার পর নুরসী চলে যান ভ্যান নামক পূর্ব তুরস্কের একটি প্রদেশে। সেই সময়েই নুরসী প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন যে, বর্তমান সভ্যতার ক্রীড়নকেরা আধুনিক বিজ্ঞানের যে নানা দিক আবিষ্কার করেছেন সেগুলো আসলে মুসলমানদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে। কেননা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে ভিত্তি করে যদি ইসলামের বার্তা মানুষের কাছে না পৌঁছানো যায় অর্থাৎ ইসলামকে যদি বিজ্ঞানময় হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা না যায় তাহলে ইসলামের দাওয়াতি কাজ করে খুব একটা সফল হওয়া যাবে না। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখা ও নানা অগ্রগতিকে আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। এবারও বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গণিতশাস্ত্র, প্রাণিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল এবং দর্শনের ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ভ্যান প্রদেশে জীবনের যে ১৫টি বছর পার করেন তার পুরো সময়টাই তিনি স্থানীয় উপজাতি ও গ্রামবাসীদের শিক্ষক ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সেই এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালু করেন স্থানীয়ভাবে যার নাম দেয়া হয়েছিল হরহর। এই ১৫ বছর সময়ের মধ্যেই, নুরসী যুক্তিবিদ্যা বিশারদ ইসমাইল গেলেনবেভির বুরহান নামক বইটির উপর একটি নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণও রচনা করেন।
ইউরোপীয় আধুনিক বিজ্ঞান এবং ইসলামের প্রথাগত বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে উস্তাদ নুরসী এই উভয় ধারার বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই অনুভূতি থেকেই তিনি পূর্ব তুরস্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘মেদরেসেত-উজ জেহরা’। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য তার সরকারের সমর্থন দরকার ছিল। সরকারি মহলের কাছ থেকে এই সহযোগিতা পাওয়ার অভিপ্রায়েই নুরসী ইস্তাম্বুলে গমন করেন। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকার যেই বাড়িতে নুরসী সেই সময়ে থাকতেন তার দরজায় তিনি একটি পোস্টার লাগিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল ‘এখানে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়, সব প্রশ্নের উত্তরও এখানেই মিলে যায়- যদিও এখানে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।’
ধীরে ধীরে ইস্তাম্বুলের আলেমদের সাথেও নুরসীর পরিচয় হয়। তারা নুরসীর কাছে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা নিয়ে আসতেন, নুরসীও তার বেশ সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিতেন। তাই নুরসীর ব্যাপারে তারা সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ফলে চারিদিকে নুরসীর বেশ সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। আসলে নুরসী তার ঘরের দরজায় সেই পোস্টারটি লাগিয়েছিলেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আর তার সেই কৌশল বেশ কাজেও দিয়েছিল। কিন্তু যেই সরকারি মহলের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় তিনি ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন, তা তিনি পাননি, ফলে তার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও তখন পূরণ হয়নি। ইস্তাম্বুলের ক্ষমতাসীন খেলাফত সেই সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং বিংশ শতকের শুরুতে হুট করে সৃষ্ট হওয়া চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তাই নুরসীর ডাকে তারা সাড়া দিতে পারেননি। আর এর পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তারও পরে তুরস্কে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে পরিস্থিতি পুরোই পাল্টে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে নুরসীকে তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি স্থগিত করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নুরসী তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ রিসালায়ে নুর লেখার কাজে হাত দেন। এই বইটিতে ইসলামের বৈজ্ঞানিক চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে যেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘মেদরেসেত-উজ-জেহরা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার অনেকটাই এই রিসালায়ে নুরের মাধ্যমেই পূরণ হয়ে যায়।
ইস্তাম্বুলে নুরসী আরো বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেন। সেই সময়গুলোতে তিনি আসলে রাজনৈতিক ময়দানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিলেন। ইস্তাম্বুল থেকে আবার ভ্যানে ফিরে আসার পর তিনি স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে ইসলাম সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন। তিনি গ্রামবাসীকে সেই সময়ে যেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন সেগুলোকে পরবর্তীতে এক জায়গায় করে তিনি ‘আল মুনাজারাত’ নামক একটি বইও রচনা করেন। এরপর নুরসী চলে যান দামেস্কে। সেখানে তিনি উমাইয়াদ মসজিদে বেশ কিছু খুতবা প্রদান করেন। সেই খুতবাগুলো পরবর্তীতে ‘দ্য দামেস্কাস সারমন’ নামক একটি বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নুরসী এরপর যোগ দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তিনি ছিলেন একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার। আর ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সদস্যই ছিল তার ছাত্র। তুরস্কের পূর্বাঞ্চলকে রাশিয়ান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি সেই যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে যখন চারিদিকে গোলাগুলির বিকট শব্দ তখনও ট্রেঞ্চে বসে তিনি শ্রুতিলিখন এবং অনুলিখনের মাধ্যমে ‘সাইনস অব মিরাকুলাস ইনিমিটেবিলিটি’ বা ‘ইশারাত আল ইজাজ’ নামক একটি বই রচনা করেন যা পবিত্র কুরআনের পর্যালোচনা ও ভাষ্য হিসেবে আজও সবর্জন স্বীকৃত হয়ে আছে।
রাশিয়ার সেনারা যখন বিটলিস অঞ্চলটি দখল করে নেয়, তখন তারা নুরসীকে আহত অবস্থায় আটক করে এবং তারা তাকে সাইবেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একটি কারাগারে নুরসী আড়াই বছর বন্দী ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টাতে তিনি কাজ করার মত বা কিছু লেখার মত অবস্থায় ছিলেন না, পরিবেশও ছিলো না তেমন। কিন্তু সেই প্রতিকূলতার মধ্যেও নুরসী তার সহযাত্রী অন্যান্য বন্দীদের মাঝে নিয়মিতভাবে ধর্মীয় আলোচনা করতেন।
একদিন রুশ জেনারেল নিকোলাস বন্দিশিবির পরিদর্শনে এলে সকল বন্দী দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু বদিউজ্জামান নুরসী না দাঁড়িয়ে বসে থাকলেন। রুশ জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন- বোধ হয় তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছো? নুরসী বসেই উত্তর দিলেন- তোমাকে চিনবো না কেন! তুমি নিকোলাস। রুশ জেনারেল ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো- যদি তুমি জেনে-বুঝে আমাকে সম্মান প্রদর্শন না করে থাকো, তাহলে তুমি রাশিয়ার ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছো। এই কথা শুনার পর ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক বদিউজ্জামান নুরসী নির্ভীক কণ্ঠের এমন সাহসী উচ্চারণের কথা শুনে বন্দিশিবিরে বন্দীরা পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেল। রাগে-ক্ষোভে অপমানে রুশ জেনারেল নিকোলাসের চেহারা লাল বর্ণ হয়ে উঠলো। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো নিকোলাসের চোখে। এই পরিস্থিতিতে বন্দী শিবিরের অন্যান্য বন্দীরা ভাবলো এখনই বোধ হয় নুরসীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করার জন্য নেয়া হবে। কিন্তু উস্তাদ নুরসীর চোখে মুখে ছিল না কোন ভীতির চিহ্ন। তিনি চিন্তাহীন চিত্তে দুনিয়া ও আরশের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন। রুশ জেনারেল নিকোলাস রাগান্বিত হয়ে নুরসীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে প্রস্থান করলেন।
মৃত্যুদন্ডের আদেশেও নুরসীর মুখের স্নিগ্ধ হাসির সামান্যতম কমতি ছিল না। তিনি দৃপ্ত পায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বেদির দিকে এগিয়ে চললেন। রুশ জেনারেল আশ্চর্য হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সৌম্য-শান্ত সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে তাকে হত্যা করে হবে- এটা জানার পরও নুরসীর মুখে ফুটে ছিল স্বর্গীয় হাসি। তারপর উস্তাদ নুরসী মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চাইলেন। অন্যদিনের চেয়ে তিনি তুলনামূলক দ্রুততার সাথে নামাজ আদায় করলেন। রুশ জেনারেল অবাক হয়ে নামাজের ভেতরে উস্তাদ নুরসীর একাগ্রতা লক্ষ করছিলেন। নামাজ আদায়ের এই দৃশ্য রুশ জেনারেল নিকোলাসের মনে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অবশেষে নিকোলাস সাইয়্যেদ নুরসীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর সাইয়্যেদ বদিউজ্জামান নুরসীকে বললেন যে ইসলাম তোমাকে এতটা নির্ভীক ও আত্মমর্যাদাশীল করেছে, আমি সেই ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
শেষ দিকে অবশ্য নুরসী কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং সেইন্ট পিটার্সবার্গ, ওয়ারশ এবং ভিয়েনাকে পাড়ি দিয়ে তিনি ১৯১৮ সালের ২৫ জুন আবারও ইস্তাম্বুলে এসে পৌঁছান। এর পরপরই সেখানকার প্রশাসন তাকে দারুল হিকমাতে ইসলামিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সা¤্রাজ্য পরাজিত হয়। এর পরপরই সা¤্রাজ্যের বিশাল একটি এলাকা ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান এবং গ্রিকদের হাতে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে দখলদারদের হাত থেকে তুরস্ককে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। সেই যুদ্ধে নুরসী ‘কুভা-ই-মিল্লিয়ে’ বা ন্যাশনাল ফোর্সকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন, উৎসাহ প্রদান করেন। আংকারায় থাকা সরকারও নুরসীর এইসব কাজে খুশি হয়ে তাকে আংকারাতে আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণ পেয়ে নুরসী আংকারায় গেলে সেখানে তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তবে নিজে ভালো সংবর্ধনা পেলেও আংকারার প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরকে দেখে নুরসী মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি লক্ষ্য করেন যে, পার্লামেন্টে যেসব ডেপুটি কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই ধর্ম সম্বন্ধে খুবই অসচেতন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে তাদের তেমন একটা আগ্রহও নেই। এমনকি তাদের অধিকাংশই নিয়মিত নামাজও আদায় করে না।
এই পরিস্থিতি দেখে নুরসী তাদের সামনে একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন যাতে তিনি নামাজের গুরুত্ব ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এর পর দেখা যায় যে, পার্লামেন্টের অনেক ডেপুটি নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। কিন্তু নুরসীর এই কার্যক্রম এবং পার্লামেন্ট ডেপুটিদের ওপর তার এই প্রভাব সেক্যুলার নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে অসšুÍষ্ট করে তোলে। নুরসীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আতাতুর্ক তাকে প্রথমে পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার এবং গোটা পূর্ব তুরস্কের ধর্মীয় প্রকল্পগুলোর প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নুরসী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরই তিনি আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৪ সালে যখন অটোম্যান খেলাফতের পতন হয় তখন কুর্দিস্তান থেকে শায়খ সাইয়্যেদেও বিদ্রোহ নামক একটি বিদ্রোহের উত্থান হয়। যদিও এই বিদ্রোহে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না তথাপি এই বিদ্রোহে মদদ দেয়ার অভিযোগেই নুরসীকে ১৯২৫ সালে ইস্তাম্বুলে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইস্তাম্বুল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বুরদুর নামক একটি এলাকায়। এর পর তাকে নেয়া হয় ইসপার্তায়। একটা পর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক ইসপার্তার বারলা নামক একটি গ্রামে গৃহ অন্তরীণ করে রাখা হয়। গৃহবন্দী রাখার কারণে প্রশাসন যেমন তার ওপর নজরদারি করতে সক্ষম হয় এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষগুলোর সাথেও তার মেলামেশাটি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
১৯২১ সালের আগ পর্যন্ত নুরসীর যেই জীবন, তখন তিনি কিছুটা হলেও বিশ্বরাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিশ্লেষকরা এই সময়টাকে ‘সাইয়্যেদের প্রথম অধ্যায়’ নামে অভিহিত করেছেন। আর ১৯২১ সালের পরের থেকে জীবনের বাকি অংশটিকে তারা ‘সাইয়্যেদের দ্বিতীয় অধ্যায়’ নামে সংজ্ঞায়িত করেছেন। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টিতেই বদিউজ্জামান নুরসী অন্যসব বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে কুরআনের সাধনায় ব্যস্ত করতে শুরু করেন। এই সময়েই তার অনবদ্য সৃষ্টি রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিও তিনি রচনা করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নুরসী আসলে মুসলমানদের ঈমান সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে নাস্তিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবে মুসলমানদের ঈমান যেভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছিল তাকে প্রতিরোধ করে ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য তিনি বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, নির্বাসনে গিয়েছেন। তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েকবার। আর সবশেষে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালানোর মিথ্যা অভিযোগে তার বইগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন।
বারলাতে সাইয়্যেদ নুরসী দীর্ঘ ৮টি বছর নির্বাসনে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি রিসালায়ে নুরের তিন-চতুর্থাংশ রচনা করতে সক্ষম হন। তার এই বইটিতে গোটা তুরস্কে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি একটি নতুন ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেন। আজ অবধি এই ধরনের কৌশল দ্বিতীয়টি আর কোথাও দেখা যায়নি। তিনি শর্ত আরোপ করেন যে, যারাই তার ছাত্র হতে চাইবে তাদেরকে তার লেখা এই রিসালায়ে নুরের একটি কপি আরবি অক্ষরে লিখে দিতে হবে। সেই সাথে নতুন আরেকজন লোককেও খুঁজে নিয়ে আসতে হবে যেও কিনা একটি কপি লিখবে। অর্থাৎ একজন ছাত্রকে দিয়ে তিনি দু’টি কপি লিখিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইসপার্তা এবং বারলাতে তার যত ছাত্র ছিল, তারা সবাই তার ডাকে সাড়া দিয়ে রিসালায়ে নুরের একটি অনুলিপি লিখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রিসালায়ে নুরকে তারা গোপনে বিতরণ করতেও শুরু করেন। এভাবে শুধু বারলা বা ইসপার্তা নয়, একটা সময়ে গোটা তুরস্কেই রিসালায়ে নুর ছড়িয়ে পড়ে।
রিসালায়ে নুরের এই জনপ্রিয়তায় ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশাসন সাইয়্যেদ নুরসীকে বারলা থেকে ইসপার্তায় স্থানান্তর করে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। বরং তাকে আরো ১২০ জন ছাত্রসহ ‘এসকিসেহির’ নামক একটি কারাগারে প্রেরণ করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পতন ঘটাতে নতুন সংগঠন তৈরি করার অভিযোগ আনা হয়। লম্বা একটি সময় পর ‘এসকিসেহির’ কারাগার থেকে নুরসী মুক্তি পান। এরপর তাকে আবারও কাস্তামনু প্রদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানেও তিনি ৮টি বছর নির্বাসনে পার করেন। নুরসীকে থামানোর এত চেষ্টার পরও তার রিসালায়ে নুরের লেখা এবং বিতরণকে বন্ধ করা যায়নি। প্রতিটি ছাত্র নতুন নতুন ছাত্রকে দিয়ে একটার পর একটা অনুলিপি সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে একদিকে যেমন নুরসীর শিষ্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে ঠিক তেমনিভাবে গোটা আনাতোলিয়ার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে নুরসীর রিসালায়ে নুরও পৌঁছে যায়।
১৯৪৩ সালে সাইয়্যেদ নুরসী এবং তার ১২৬ জন ছাত্রকে ডেনিজলির হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আংকারার দক্ষ একদল শিক্ষাবিদ এবং বিচারপতিদেরকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয় যারা রিসালায়ে নুরের প্রতিটি তথ্য পর্যালোচনা করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে তারা বইটিতে কোনো ক্ষতিকর কিছু পাননি বলে জানান। এর পরই ১৯৪৪ সালে নুরসীকে সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। বিচার চলাকালীন সময়ে নুরসী ৯টা মাস জেলে ছিলেন। এই সময় তাকে তার কোন ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এবারও বেশ কয়েক দফা তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়। নুরসীকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় এমিরদাগে, সেখান থেকে আফইয়োনে। তবে যতই নির্বাসনে বা কারাবরণে নেয়া হোক, নুরসী এক মুহূর্তের জন্যও তার কাজ বন্ধ করেননি।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রশাসন তার বইগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৫০ সালে তুরস্কে বহুদলীয় প্রথা চালু হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনেই ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয় লাভ করে। এর পরই আসলে নুরসী এবং তার শিষ্যরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করেন। সারাটি জীবন কুরআনের চর্চায় লিপ্ত থাকার পর ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ ২৫ রমজান উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী ইন্তেকাল করেন। পরের দিন উলু মসজিদে লক্ষ লক্ষ মানুষ তার জানাজায় অংশ নেয়। তারপর তাকে হালিলুর রহমান নামক মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়। এর ঠিক দুই মাস পর তুরস্কে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় যার পরপরই তুরস্কে নতুন করে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়। একদল পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তা ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই আবারও উস্তাদ নুরসীর কবরকে আক্রমণ করে। তারা এই মহান কুরআন সাধকের মৃতদেহ সেই গোরস্থান থেকে উঠিয়ে নেয় এবং অজানা একটি জায়গায় নিয়ে যায়- যার পরবর্তী গন্তব্য সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু আর জানা যায়নি।
মৃত্যুর আগ দিয়ে বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ ছাত্র এবং রিসালায়ে নুর রচনার নেপথ্যের অন্যতম সহযোগী সাইয়্যেদ আহমেদ হুসরেভ এফেন্দিকে তার পরবর্তী দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান- যার একমাত্র দায়িত্ব হবে নুরসীর মৃত্যুর পর রিসালায়ে নুরের এই প্রকল্পটিকে পূর্বের গতিতেই অব্যাহত রাখা।
নুরসী যতদিন জীবিত ছিলেন, তখনই হুসরেভ এফেন্দি তার ঘনিষ্ঠ মহলে ‘উস্তাদ আল থানি’ বা দ্বিতীয় গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হুসরেভ এফেন্দি ছিলেন খুবই দক্ষ একজন ক্যালিওগ্রাফি শিল্পী। নুরসী জীবিত থাকা অবস্থায় হুসরেভ এফেন্দি ততদিন রিসালায়ে নুর অনুলিপিকরণ এবং বিতরণের মূল দায়িত্বে ছিলেন। সকল ছাত্রের মধ্যে নুরসী একমাত্র তাকেই রিসালায়ে নুরে কোন ধরনের সংযোজন, সংশোধন বা বিয়োজনের অধিকার দিয়েছিলেন। আর তিনি সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বিশেষ করে নুরসী যতদিন জেলে ছিলেন, তিনি তখন রিসালায়ে নুর নামক প্রকল্পটি যোগ্যতার সাথেই অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন।
উস্তাদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দি আগের মতই তার কাজ অব্যাহত রাখেন। তিনি রিসালায়ে নুরের মূল চেতনা রক্ষার ব্যাপারে একটুও আপস করেননি। বরং রিসালায়ে নুরকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং গোটা তুরস্কের মানুষের ঈমান ও আমলকে সুরক্ষা এবং তা আরো মজবুত করার ব্যাপারে তিনি কার্যকর উদ্যেগ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও উস্তাদ নুরসীর দিকনির্দেশনা মুতাবিক তিনি কুরআনের একটি তাফসির কপিও প্রস্তুত করেন। কুরআনের এই নতুন ধারার তাফসিরের নাম দেয়া হয় ‘তেভাফুকলু কুরআনে কারীম বা দ্য কুরআন ইন কনগ্রুয়াস অ্যালাইনমেন্ট’। উল্লেখ্য, কুরআন পড়তে পড়তেই উস্তাদ নুরসী একটা সময় আবিষ্কার করেন যে দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর সকল নাম, সিফাতি নামগুলো যেমন আল্লাহ, রব এবং কুরআন এবং কুরআনের অন্য সব শব্দ, একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। হয় একই পৃষ্ঠায় একটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলোকে পাওয়া যায় বা অন্য কোনো পৃষ্ঠায়। কুরআনের শব্দগুলোর এহেন মিল ও সাদৃশ্যকে উস্তাদ নুরসী কুরআনের আরেকটি মোজেজা হিসেবে সনাক্ত করেন।
যাহোক, উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দির হাত ধরেই পরবর্তীতে তুরস্কে হায়রাত ফাউন্ডেশনের জন্ম হয় যারা আজ অবধি উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর কার্যক্রম ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করছে এবং বিশ্বজুড়ে নুরসীর আবিষ্কার ও চেতনাকে বিশেষ করে রিসালায়ে নুরকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, রিসালায়ে নুর প্রসঙ্গে। রিসালায়ে নুর মহাগ্রন্থ আল কুরআনের উপর অনন্যসাধারণ একটি গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়ে আছে। ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের ওপর বিগত ২০০ বছরে যতগুলো পুস্তক রচিত হয়েছে রিসালায়ে নুর তার মধ্যে অন্যতম। এতদিন পশ্চিমের অনেক জায়গাতেই অবশ্য রিসালায়ে নুর তেমন একটা পরিচিত ছিল না। এমনকি অনেক মুসলমানও এই বিষয়ে ততটা অবগত ছিলেন না, তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এখন পাল্টাচ্ছে। মোট ১৩০টি অধ্যায়ে এই বইটি বিভক্ত এবং মোট পাতার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ধর্মতত্ত্ব, ধর্মদর্শন এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন তোলা হয় তার অনেকগুলোই পাওয়া যাবে এই বইটিতে। রিসালায়ে নুরটি রচনা করা হয় ১৯২৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে। রিসালায়ে নুর নিয়মিত অধ্যয়ন করেন এমন পাঠকেরা দাবি করেন যে, রিসালায়ে নুরের অধ্যয়ন তাদের মধ্যকার ঈমানের দৃঢ়তাকে মজবুত করেছে, আধ্যাত্মিক শক্তিকে বলিষ্ঠ করেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকেও শানিত করেছে। রিসালায়ে নুর অধ্যয়নে বিবেকের কাছে তারা আরো পরিষ্কার হয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইসলামকে আরো গভীরভাবে জানার আকাক্সক্ষাও তৈরি হয়েছে বলে এই পাঠকেরা জানান।
পাঠকদের মতে রিসালায়ে নুর কোন সাধারণ গ্রন্থ নয় বরং এটি ইসলামের শরিয়তের নির্দেশিত ইবাদতের একটি পদ্ধতি বা মেথোডোলোজি নিরূপণ করেছে। আর রিসালায়ে নুরের বিষয়বস্তু কোনদিনই সেকেলে হবে না, এটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বর্তমান সামাজিক ও বৈশ্বিক কাঠামোতেও বইটা একই রকম জীবন্ত হয়ে রয়ে গেছে। রিসালায়ে নুরকে আবার গতানুগতিক তাত্ত্বিক কোনো বই হিসেবেও বিবেচনা করা যাবে না বরং এটা ভীষণ রকমের ব্যবহারিক একটি বই। রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিতে অনেকগুলো ‘কেন’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তরও মিলবে। বইটিতে মহাবিশ্বের গঠন ও পরিচালনা নিয়েও ইসলামের ব্যাখ্যাগুলোকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিশেষ করে অসীমতা বা ইনফিনিটি বা কন্টিজেন্সি বিষয়ে বিজ্ঞান যেসব বিতর্ক উত্থাপন করেছে তারও উত্তর এই বইটিতে পাওয়া যাবে।
কুরআনের বিভিন্ন কালামকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে রিসালায়ে নুর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একক নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে প্রমাণ করেছে। শেষ বিচারের দিন এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থান নিয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তারাও তাদের কৌতূহল মিটাতে পারবেন এই বইটি থেকে। যারা নবী মোহাম্মাদ (সা.) সত্যিকারভাবেই আল্লাহর রাসূল কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখান তারাও খুব স্পষ্ট উত্তর এই বইটি থেকে পেয়ে যাবেন। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পৃথিবীর সৃষ্টি, বিবর্তনবাদ প্রভৃতি বিষয়ে ইসলামের অবস্থান ও মূল্যায়নও বইটিতে পাওয়া যাবে।
একই সঙ্গে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তরও মিলবে রিসালায়ে নুরে। বিশেষত সাধারণ প্রচলিত জ্ঞানের বাইরে ঐশ্বরিক জ্ঞান কিভাবে একজন মানুষকে পরিণত করে কিংবা বৈষয়িক জীবন দর্শন কিংবা অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবন ধারণ করার ব্যাপারে অথবা আল্লাহর নেয়ামতকে ব্যবহার করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করা যায় তার কিছু উপায় এই বইটিতে পাওয়া যাবে। বয়স হয়ে গেলে অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগেন, হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু এই বইটিতে প্রবীণদের নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, বয়স্ক হওয়াও আল্লাহ তায়ালার একটি নেয়ামত এবং তাই সেই বয়সে পৌঁছে হতাশা নয় বরং তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা দরকার।
পাশাপাশি, মুসলমানরা কেন সভ্যতার বিনির্মাণে এবং জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লো, ইসলামে নারীদের কি অবস্থান বা সম্মান নির্ধারণ করা হয়েছে, কিংবা হুদুদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি, দাস প্রথা নিয়ে ইসলামের বক্তব্য কি- সেগুলোও জানা যাবে এই রিসালায়ে নুর থেকে। আমরা কিভাবে অন্য ধর্মের মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করবো কিংবা কিভাবে তাদের সাথে সহাবস্থান করবো সেই প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও এই বইটি থেকে আমরা ধারণা পাবো। এক কথায় বলতে গেলে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী রচিত এই রিসালায়ে নুর বা বুক অব লাইটটি প্রকৃতার্থেই আলোকময় একটি বই, যা আলোর দিশারি হয়ে মুসলমানদেরকে আলোর পথে নির্দেশনা দেবে বহুযুগ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা, যিনি এই বইটি লিখেছেন, যারা এর অনুলিপি রচনা করেছেন কিংবা যারা প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগতভাবে বইটিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি যেন তাদের সবাইকে তাদের পরিশ্রমের এবং আত্মত্যাগের উত্তম জাজা দান করেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

Tuesday, April 10, 2018

আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধী জিহাদ, তা*লে*বান এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল


আমরা জানি আফগান মুজাহিদ সংগঠনগুলো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দীর্ঘ জিহাদের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়া পরাশক্তিকে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজিত করেছে। এই পরাজয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাংগনকে তরান্বিত করেছে। যার ফলে শধ্য এশিয়া ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীন অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছে। আফগানিস্তানের মুজাহিদ সংগঠনগুলোর  মধ্যে সবচেয়ে বড় দু'টি সংগঠন ছিল - (ক) হেজবে ইসলামী এবং (খ) জমিয়তে ইসলামী। এর মধ্যে জমিয়তে ইসলামী গড়ে তুলেছেন প্রফেসর বোরহানুদ্দীন রাব্বানী। তিনি এই সংগঠন গেড় তুলেছেন জামায়াতে ইসলামী রচিত বিপ্লবী ইসলামী সাহিত্য দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে। আর সবচেয়ে বড় মুজাহিদ সংগঠন, আফগান জিহাদের সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী, পশতুনদের সংগঠন এবং গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজবে ইসলামী জামায়াতে ইসলামীরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মুজাহিদ সংগঠন ছিল। পরবর্তীকালে তাদের কোন ভুলত্রুটি থাকলে ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের জিহাদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে বিজয়ে ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবদানই অবশ্যই অগ্রগামী। এখানে সাইয়েদ মুজতাবা হুসাইনের একটি উক্তি উল্লেখ্য: ‍‘‘বর্তমানে আফগানিস্তানে ইসলামী বিপ্লবের জন্য রুশের ন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তা মওলানা মওদূদী রহ: ইসলামী তাবলীগের ফলশ্রুতি” (দৈনিক জাসারাত, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদী, সংগ্রহে: সাইয়েদ রাফে সামনান)

               রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের পরবর্তীকালে উক্ত জিহাদকারী মুজাহিদ সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার পটভূমিতে গড়ে উঠা তালেবান আন্দোলনে সাবেক হেজবে ইসলামীর বেশীর ভাগ মুজাহিদ কমান্ডার ও মুজাহিদ সৈনিকরা রয়েছেন। তারা জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছেন। তালেবান হচ্ছে পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত সংগঠন। এই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দীর্ঘ বহু বৎসর যাবৎ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের সাথে জোটভুক্ত আছে। অনলাইন মুক্ত বিশ্বকোষ wikipedia.org-তে বলা হয়েছে:  আদর্শিক প্রভাবক: তালেবানের ধর্মীয়/রাজনৈতিক দর্শন, বিশেষ করে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার প্রথম শাসনামলে, প্রধান মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি এবং তার কাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে উপদেশ ও প্রভাবিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনের পরিচালিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নীতিগুলি অবশ্য আবুল আ'লা মওদুদী ও জামায়াত-ই-ইসলামী আন্দোলনের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল

                তালেবান নেতা আব্দুল হাকিম মুজাহিদ ১৯৯৮ সালে আগষ্ট নয়াদিল্লীর দাওয়াত পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়। ‘‘কিন্তু হেকমাতিয়ারের বিরুদ্ধে জিহাদী পদক্ষেপের দরুন আপনাদের অন্তরে কি কেবল কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে উক্ত তালেবানের নেতা বলেন: ওদের সংগে আমাদের কিসের বিবাদ?........আমরা আফগানিস্তানে শরীয়ত চালু করেছি। রাব্বানী-হেমতিয়ার-মাসুদ আমাদের সহযোগিতা করুন, আমরা ওদেরকে বুকে তুলে নেবো” ( দৈনিক সংগ্রাম, ৩০শে অক্টোবর ১৯৯৮ইং)।

                আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদী আন্তর্জাতিক সংবাদে মাধ্যমগুলো জোরালো অপপ্রচার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও সামগ্রিক প্রয়োজনে উক্ত তালেবান নেতার নারী শিক্ষার বিষয়ে একটি বক্তব্য উল্লেখ্য: ‘‘আমরা নবী করিম সা: এর এই বাণীকে উপেক্ষা  করতে পারি করে যাতে বলা হয়েছে শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা আবশ্যক। আমি তো আগোই বলেছি, আফগানিস্তানে এখন মেয়েদের শিক্ষা অর্জন ও চাকরী গ্রহণের অধিকার রয়েছে কিন্তু সীমা ও শর্তের মধ্যে। আমাদের কাছে আসলে কি চাওয়া হচ্ছে? আমর কি হেজা বিরোধিতার সূত্রপাত ঘটাব? এমনটা কেমন করে সম্ভব? (সূত্র পূর্বোক্ত) উক্ত তালেবান নেতার অপর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ্য যে: ‘‘মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম (সা:) কাবাঘরে গমন করেন এবং মকামে ইব্রাহীম এর আসল ভিত্তি ঠিক রেখে মুশরিকদের নির্মিত বাহুল্য ও সীমালংঘিত অংশগুলোকে অপসারনের ব্যাপারে বিবেচনা করেন। অতএব তিনি আপন সিদ্ধান্ত বদলে দেন এবং বাড়ী ফিরে উম্মৎ জননী হযরত আয়েশা (রা:) কে সম্বোধন করে বলেন,  হে হুমাইরাহ! আমি চাই মাকামে ইব্রাহীমকে কায়েম রেখে গোটা কাবাঘর পূণর্নির্মান করতে, কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, এমন করলে লোকেরা অসন্তোষ ছড়াবে। এঘটনা থেকে আপনি অনুমান করতে পারেন যে, ইসলাম প্রাচীন ঐতিহ্য বা সংস্কারকে শ্রদ্ধা জানায় এবং সে মানব সমাজের ধ্যান-ধারনাকে সামনে রেখে তাদের প্রতি মনোযোগ দেয় (সুত্র: পূর্বোক্ত)। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছোটখাট ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়েও যারা বিবাদ বা বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের জন্য উক্ত তালেবান নেতার উদার বক্তব্য অবশ্যই শিক্ষণীয়।

                  এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালের  নাইন - ইলেভেন-এর পর ন্যাটো জোটের সহায়তায় আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার তালেবানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার অনুগত হেজবে ইসলামীর মুজাহিদদেরকে তালেবানের সহায়তায় যুদ্ধের আহ্বান জানান। পরে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের পতন হয়। এরপর তালেবানরা আমেরিকা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখে। এদিকে ইসলামপন্থী নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বেশ কয়েক  মাস ধরে আলোচনা শেষে প্রায় ২০ বছর পর ২০১৭ সালে কাবুলে ফিরেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। এখানে উল্লেখ্য, তালেবানদের মতই গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার একই পশতুন গোষ্ঠীতুক্ত। পশতুনরা আফগানিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। 

পূর্ববর্তী তালেবান সরকারের প্রতি 
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন
            বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ পূর্ববর্তী তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তান সফরের  বর্ণনা দিতে যেয়ে বলেন: “আমরা প্রবেশ পথ দিয়ে আফগানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় প্রবেশ করে আফগানিস্তানস্থ সীমান্তের কাস্টমস অফিস থেকে যাবতীয় অনুস্ঠানাদি সেরে সোজা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী জালালাবাদের দিকে রওয়ানা হই। রাত আটটা নাগাদ জালালাবাদ উপস্থিত হয়ে প্রটোকল অফিসারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদেরকে সরকারী গেস্ট হাউসে পৌছিয়ে দেন। এখানেই আমাদের থাকার ও খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা এশার নামায আদায় করে রাতের খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি জালালাবাদ পৌঁছেই প্রটোকল অফিসারের কাছে কাবুল যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি বললেন, জালালাবাদ হতে সপ্তাহে মাত্র ১ দিন বিমান সার্ভিস চালু আছে। সুতরাং ৫/৬ দিনের আগে আপনি কোন বিমান পাচ্ছেন না। একথা শুনে আমি কাবুল সফরের পরিকল্পনা বাদ দেই এবং জালালাবাদের গভর্ণেরর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। ডেপুটি গভর্ণরের সাক্ষাৎ: পরের দিন ভোরে নামায, পায়চারী ও গোসল শেষ করে নাস্তা করে নেই। নাস্তার সময় প্রটোকল অফিসরা খবর দেন যে, আজই অর্থাৎ ২রা নভেম্বর বেলা ১১টায় গভর্ণর হাউসে ডেপুটি গভর্ণর জনাব মোল্লা সাদরে আমল আমাকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন। কেননা গভর্ণর ঐদিন জালালাবাদে ছিলেন না। আমি আমার সাথী সীমান্ত প্রদেশের আমীর এডভোকেট ইব্রাহীম সাহেবকে নিয়ে ১১টা বাজার সামান্য পূর্বে গভর্ণর হাউজে হাজির হই। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরেই ডেপুটি গভর্ণর আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেন। পারস্পরিক সালাম, মোসাফাহা, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের পরে ডেপুটি গভর্নরের সাথে আমার আলোচনা শুরু হয়। আমি আমীরে জামায়াতে জনাব গোলাম আযম সাহেব ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের সালাম তাকে পৌঁছাই এবং অনুরোধ করি তিনি যেন আমার এবং আমীরে জামায়াতের সালাম আফগানিস্তানের আমীরুল মোমেনীন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর আল মুজাহিদকে পৌঁছান। আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর এ পরিচয় তার কাছে থাকলেও ১৯৬২ সনের পাক পার্লামেন্টে আমি ও সীমান্ত প্রদেশের মুফতি মাহমুদ এক সঙ্গে সদস্য ছিলাম একথা তাকে অবহিত করি। আফগানিস্তানে মুফতি মাহমুদ এক সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি এক সময় সীমান্ত প্রদেশের চীফ মিনিস্টারও ছিলেন। ১৯৮৯ সনে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পর মুজহেদীনদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে আমরা যে খুবই মর্মাহত ছিলাম একথা তাকে বলি। অত:পর বর্তমান তালেবান সরকার কাবুলসহ দেশের প্রায় ৯৫% ভাগ ভূ-ভাগ দখল করে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বহাল করায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তালেবান সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দান করেছে সে কথাও তাকে অবহিত করি। আমি আরবী ভাষায় তার সাথে কথা বলছিলাম এবং তিনি আমার কথা বুঝতে ছিলেন।  অত:পর তিনি কথা শুরু করেন। তিনি প্রথমেই বলেন যে, অবশ্যই জামায়াতে ইসলাামী আফগান জিহাদে দেশকে রুশ কবল মুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে আমাদের বিশ্বাস জামায়াতের এই ভূমিকা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য ছিল না। ছিল নীতি ও আদর্শের জন্য ।  তালেবান সরকার গৃহযুদ্ধের অবসান করে ঐ নীতি ও আদর্শ অর্থাৎ শরিয়তের আইন সারাদেশে চালু করেছে যার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনসমূহ আফগান জিহাদে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছিল(`আফগানিস্তানে যা দেখেছিগ্রন্থ)

                   ইতিপূর্বে উল্লেখিত তালেবানদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমেরিকার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সমঝোতাকারী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তুর্কি প্রতিনিধিদল। আর বর্তমান তুরস্ক সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়েছে।  আর তালেবানদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কেন্দ্র কাতার।  কাতার হলো বর্তমানে জামায়াত-ইখওয়ানীদের সমাবেশস্থল। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে, প্রথম তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে উস্তাদ সম্মোধন করতেন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। 

Edited time: july-2020


আফগানিস্তানে তালিবান বিজয়ের পর নীচের অংশটুকু এড করলাম:

আমি ২০২১ সালের ১৬ই আগষ্ট এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করি। এরপর বিভিন্নজনে বিভিন্ন মন্তব্য করে, সেসবের জবাবও দিয়েছি । সেসব পরে দিচ্ছি। এখন পাকিস্তান জামায়াতের আমির মৌলানা সিরাজুল হক--এর প্রতিক্রিয়া এখানে দিচ্ছি। 

পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন: 
Jamaat-e-Islami Ameer Sirajul Haq has said the "peaceful taking over" of Kabul by Taliban insurgents was actually a defeat of the US and a victory of Afghan people and the Islamic world.
It is hoped that after the humiliating defeat, the US would not invade any more countries, he was quoted as saying by The News International while addressing the central training workshop for the JI leaders and workers at Mansoorah here.
He lauded the Taliban for declaring peace, non-retaliation against opponents, protection of diplomats and foreigners, and amnesty for rivals which, he said, was unprecedented in the modern civilized world.
Siraj was quoted as saying by the newspaper that the defeat of the Western colonist powers for the third time in history by Afghanistan has further strengthened the dream of the liberation of Kashmir and Palestine, hoping that the day was not far when the sun of freedom would rise there.
অর্থাৎ: জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন, তালেবান বিদ্রোহীদের দ্বারা কাবুলের "শান্তিপূর্ণ দখল" আসলে আমেরিকার পরাজয় আর আফগান জনগণ এবং ইসলামী বিশ্বের জয়। আশা করা যায় যে, লজ্জাজনক পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশে আক্রমণ করবে না। তিনি এখানে মনসুরায় জেআই নেতা ও কর্মীদের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন।
তিনি শান্তি ঘোষণা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়া, কূটনীতিক এবং বিদেশীদের সুরক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার জন্য তালেবানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এটা আধুনিক সভ্য বিশ্বে নজিরবিহীন।
আমীর সিরাজুল হক সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, আফগানিস্তানের কাছে ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তির পরাজয় কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপ্নকে আরও শক্তিশালী করেছে, আশা করে যে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন স্বাধীনতার সূর্য উঠবে সেখানে। 
Source: www.indiablooms.com

এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করার পর একটি গ্রুপে একজন কমেন্ট করে বলেন: সোভিয়েত হঠাও এর পরবর্তী ইতিহাসে জমিয়তে ইসলামী খারাপ পথ বেছে নিয়েছিল। এর পরিণতিতে আহমাদ শাহ মাসুদ এবং রব্বানী দুইজনকেই জীবন দিতে হয়েছে। এর জবাবে আমি জানাই: “গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামীর সাথেই জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক । সে সম্পর্কে এই পোস্টে লেখা হয়েছে।” নামের সাদৃশ্যের বা অন্য কোন কারণে অনেকের এই বিষয়ে ভুল ধারনা আছে। জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কযুক্ত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামী আমেরিকাবিরোধী জিহাদে তালেবানের পক্ষে ছিল। আরো উল্লেখ্য যে, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বর্তমান বিজয়ী তালেবান সরকারে অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন।
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের ইমামতিতে নামাজরত তালেবান নেতৃবৃন্দ

গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজল হকের সাথে সাক্ষাতের ভিডিও:

আরেকজন পোস্টের শেষে আমার এই বক্তব্যের রেফারেন্স চেয়েছেন - "জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।" আমি একটা লিংক দিয়েছি। তারা আসলে মৌখিক তীব্র প্রতিবাদের চেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। যে কেউ Bangladesh mission under Taliban threat - এই লংটেইল কীওয়ার্ড দিয়ে গুগুলে সার্চ করে দেখতে পারেন। ২০১৩ সালের অনেকগুলো লিংকে এসম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি আরো জানাই - আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে পাকিস্তান পার্লামেন্টসহ বিশ্বের বহু দেশের বহু ইসলামী সংগঠনই প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক শক্ত প্রতিবাদ যারা জানিয়েছিল তাদের মধ্যে বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অন্যতম। আমি এই লিংকটা শেয়ার করেছি: Resolution passed: Abdul Quader Molla was innocent, Imran Khan claims

বিশ্বখ্যাত ইসলামিক স্কলার, শায়খ আল্লামা ডঃ ইউসুফ আল কারযাভী (হাফিঃ) -এর সাথে কাতারে তালেবান নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ।

নীচে একজন তালেবান নেতার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেয়া হয়েছে। এটা তালেবান বিজয়ের আগের। তিনি সাতক্ষীয়া জেলায় জামায়াতের উপরে ভয়ংকর নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করেন। 
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

বিঃদ্রঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুসারে দাওয়াত, সংগঠন ও ইসলামের আলোকে গঠন এবং মানবসেবার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম (জিহাদ) অব্যাহত রেখেছে। মূলতঃ আফগান, ইরান, তুরান কেউই ইসলামের মডেল নয়, কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে নিজ দেশের অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।

Please browse these links:




সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ’র। মহান আল্লাহ অধিকতর সাফল্য অর্জনের তৌফিক দান করুন, আমিন

Popular Posts