Thursday, May 30, 2019

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গম্বুজ এবং দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট সুন্দর মসজিদ হচ্ছে টাঙ্গাইলে


২০১ গম্বুজ মসজিদ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গম্বুজ এবং দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। এই মসজিদের নকশা করা হয়েছে ২০১টি গম্বুজ ও ৯টি মিনার দিয়ে সজ্জিত একটি পূর্নাঙ্গ মসজিদ কমপ্লেক্স হিসেবে। মসজিদটি এখনো নির্মাণাধীন। ২০১ গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে অবস্থিত।


২০১৩ সালের জানুয়ারি এই মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মসজিদটি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। এ কাজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মা রিজিয়া খাতুন। মসজিদ নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ কাজ এখনো চলছে। নির্মাণ শেষ হলে কাবার ইমাম এসে নামাযের ইমামতি করে মসজিদটি উদ্বোধন করবেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো এত সংখ্যক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ তৈরী হয়নি।অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের ছাদে ৮১ ফুট উচ্চতার একটি গম্বুজ রয়েছে। এই বড় গম্বুজের চারপাশে ছোট ছোট গম্বুজ আছে ২০০টি। এদের প্রত্যেকের উচ্চতা ১৭ ফুট। মূল মসজিদের চার কোণায় রয়েছে ৪টি মিনার। এদের প্রত্যেকের উচ্চতা ১০১ ফুট। পাশাপশি আরও চারটি মিনার আছে ৮১ ফুট উচ্চতার। সবচেয়ে উঁচু মিনারটি মসজিদের পাশেই অবস্থিত। এর উচ্চতা ৪৫১ ফুট। ১৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪৪ ফুট প্রস্থের দ্বিতল এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন।
মসজিদের দেয়ালের টাইলসে অংকিত রয়েছে পূর্ণ পবিত্র কোরআন শরিফ। যে কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে মসজিদের দেয়ালে অংকিত কোরআন শরিফ পড়তে পারবেন। মসজিদের প্রধান দরজা নির্মাণে ব্যবহার করা হবে ৫০ মণ পিতল। আজান দেওয়ার জন্য মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনারে বানানো হবে। মসজিদটি সম্পুর্ন শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও এতে সহস্রাধিক বৈদ্যুতিক পাখা যুক্ত করা হবে।
See this video:

বোমাবাজরা দেশ গণতন্ত্র এবং ইসলামের শত্রু-- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

Tuesday, May 28, 2019

জঙ্গিবাদ ইস্যুতে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতকার

(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

দেশের প্রথম কুরআন ভাস্কর্য:দূর-দূরান্ত থেকে আগত কুরআন প্রেমিকদের ঢল

 বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা পৌরসভায় দেশের প্রথম কুরআন ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র ভাস্কর কামরুল হাসান শিপন।কসবা পৌরসভার মেয়র এমরানুদ্দীন জুয়েলের তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে নেমে পবিত্র নগরী মক্কার প্রবেশদ্বারে কুরআনের আদলে তৈরি যে বিশাল তোরণ রয়েছে। সে তোরণের ডিজাইনের আলোকেই কসবা উপজেলা সদরের ব্যস্ততম কদমতলা মোড়ে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যের উচ্চতা ১৬ ফিট এবং প্রস্থ ৮ ফিট। ভাস্কর্য নির্মাণকারী ঠিকাদার রতন সরকার জানান, এটি তৈরিতে ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম কুরআনের ভাস্কর্যটি দেখতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় করছে স্থানীয় ও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগত কুরআন প্রেমিক জনতা। কুরআনের আদলে তৈরি এ ভাস্কর্যটি যেন কুরআন প্রেমিক জনতার হৃদয়ের তাজমহল। ব্যতিক্রমধর্মী এ অসামান্য ভাস্কর্য নির্মাণের সাথে জড়িতরা জেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশের আলেম সমাজও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। পাশাপাশি কুরআনের এ ভাস্কর্যের প্রতি যেন অবমাননা না হয় সেদিকেও নজর রাখার বিশেষ আহ্বান জানিয়েছে আলেম সমাজ।
See this video:

Monday, May 27, 2019

ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা

- ড. মুহাম্মদ আবু ইউসুফ
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ শত বছর আগে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক পরিবেশে যখন মানুষের সার্বিক আচার-আচরণ পশুদের আচরণকে অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে যুগটি আখ্যায়িত হয়েছিল অন্ধকার যুগ হিসেবে। মানবাধিকারের বদলে পাশবিকতা ছিল যে সমাজের মূলমন্ত্র। অমানবিক ও পাশবিক যাবতীয় কাজ তৎকালীন সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌলিন্যের বিষয় ছিল। সে সময়ের অনাকাক্সিক্ষত কার্যকলাপের কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। এমন একটি সমাজকে রাসূল (সা) তার নৈতিক আদর্শ, মহানুভবতা, সহনশীলতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। গড়ে তোলেন সর্বোত্তম একটি মানবীয় সমাজ।
চরমপন্থা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Extremism, যার অর্থ হলো Holding extreme views বা চরম মনোভাব পোষণকারী বা উগ্রপন্থী। এ শব্দটার ইংরেজি হলো  Extremist যার অর্থ হলো Diehard fantic, militant vadical, terrorist, ultraconservative, zealot। অতএব চরমপন্থা সমার্থক অর্থবোধক শব্দ। সন্ত্রাস শব্দের অর্থ হলো অতিশয় ত্রাস, ভয়ের পরিবেশ। আর সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন। সন্ত্রাস শব্দটিকে নানা জন নানা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন সে অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিপক্ষ চরমপন্থা ও সন্ত্রাস হিসেবে যেমন আখ্যায়িত করে থাকেন ঠিক তেমনি স্বাধীনতাকামীরা আবার তাদের প্রতিপক্ষকে চরমপন্থা অবলম্বনকারী, সন্ত্রাস বিস্তারকারী অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে সন্ত্রাসের নি¤œরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, সন্ত্রাস হলো ব্যক্তি বা সামষ্টিক অপরাধের মনোবৃত্তি হতে সংঘটিত নিষ্ঠুর কাজ বা কাজের হুমকি, তা যে লক্ষ্যেই হোক না কেন। তা দ্বারা মানুষের মনে ভয়ভীতি সঞ্চার করা হয় বা তাদেরকে কষ্টে ফেলার হুমকি দেয়া হয়, বা তাদের জীবন, স্বাধীনতা বা নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয় বা পরিবেশকে ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়া হয় বা সাধারণ জনগণের বা সরকারি সম্পত্তি ছিনতাই, জবর দখল, নষ্ট করা হয়। সম্মেলনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এভাবেই দেয়া হয়েছে, সন্ত্রাস হল ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য হিংসাত্মক কাজ সংঘটিত করা অথবা এর হুমকি প্রদান করা। সন্ত্রাসীরা হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, বিমান হাইজাক, বোমা হামলাসহ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধের কাজ করে। কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও বিচারকরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা হত্যা ও অপহরণের শিকার হন। সন্ত্রাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যখন সে শাসকের আসনে বসে, তখন পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে ব্যাপৃত হয় এবং ফসল ও প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে দিতে প্রবৃত্ত হয় অথচ আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।” পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, “আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর যারা তা ভেঙে দেয় এবং আল্লাহ সেসব সম্পর্ক দৃঢ় করার আদেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে ও পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ব্যাপৃত করে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিশাপ, তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট ঠিকানা।

পাশ্চাত্য দেশ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণে আগ্রহী নয়, কেননা যদি এর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় তবে তাদের পক্ষে হয়ত এর ইচ্ছামতো ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। সন্ত্রাস বা চরমপন্থা মানব ইতিহাসের মতোই পুরনো। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম চরমপন্থার বিস্তার ঘটানো হয় উগ্রবাদী ইহুদি কর্তৃক। উগ্রবাদী ইহুদি ধার্মিকগণ তাদের ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য  সন্ত্রাসের আশ্রয়  নেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিস্টপূর্ব  প্রথম শতাব্দী ও তার সমসাময়িক কালে  রোমান সম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রবাদী এসব ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্দ্র্যবোধ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপসহীন ছিল। যে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এবং তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। তারা কখনই প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না, প্রয়োজনে তারা আত্মহত্যা করত। এ জন্য তারা শিকারি বা ছুরি মানব হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল।

ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৪৯-১৭৯৯) কতিপয় বিপ্লবী তাদের প্রতিপক্ষের বিষয়ে হিংসাত্মক বা চরমপন্থার আশ্রয় নিত। এ কালকে সন্ত্রাসের সময় বা জবমরড়হ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎ বলা হয়। প্রথম দিকে সংঘটিত চরমúন্থী সন্ত্রাস ঘটনার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করার মত। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের পর পুনরায় উনিশ শতকে কুক্ল্যাক্স ক্ল্যান নামক একটি শেতাঙ্গ গ্রুপ কৃষ্ণাঙ্গ ও তাদের প্রতি সহানভূতিশীলদের ওপর বণবাদী সন্ত্রাস চালায়। মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার পাল্টা সংস্কারের যুগে ক্যাথিলক ও প্রটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ হত্যাকাণ্ড এমনকি যুদ্ধবহির্ভূত অসংখ্য সন্ত্রাস ও চরমপন্থী তৎপরতায় দেখা যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকারী হাজার হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জার্মানিতে হিটলার ইতালিতে মুসোলিনি এবং সোভিয়েতে ইউনিয়নে জোসেফ স্ট্যালিন  বিরোধী পক্ষকে দমনের নামে অবর্ণনীয় নারকীয় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইহুদিরা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম সন্ত্রাস পরিচালনা করে ফিলিস্তিনে। পরাশক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত তাদের সন্ত্রাস পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করে রেখেছে। এ সন্ত্রাসের লক্ষ্য ছিল স্বীয়ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে, স্বীয় ভূখন্ড রক্ষায় তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পৃথিবীর সকল মানদন্ডে বিচার করলে ইসরাইলি কর্মকান্ড সন্ত্রাস হিসেবে এবং ফিলিস্তিনিদের তৎপরতায় মুক্তি সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত। অনুরূপভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্ভব ঘটে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে (ওজঅ ওৎরংয ৎবঢ়ঁনষরপধহ ধৎসু)। একইভাবে সত্তরের দশকে ক্যারিবিয়ান সাগরের পোর্টোরিকোতে ঋঅখঅঘ নামে স্বাধীনতা গ্রুপের উদ্ভব ঘটে আমেরিকান শাসনের বিরুদ্ধে। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়।
জিহাদ আরবি শব্দ। যাহা জুহুদ ধাতু থেকে এসেছে। যার শাব্দিক অর্থ চেষ্টা সাধনা করা। আর ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার সংজ্ঞা পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি। ‘তোমরা ততক্ষণ লড়াই করতে থাক, যতক্ষণ না জমিন থেকে ফেতনা দূর হয় এবং সর্বত্র আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তাহারা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয় তবে জালিম ব্যতীত কারো প্রতি কঠোরতা আরোপ করা হয় না। অর্থাৎ যারা জিহাদের কাজ থেকে বিরত থাকবে তারা জালেম এবং তাদের ওপর আল্লাহ কঠোরতা আরোপ  করবেন। পবিত্র কুরআনে আলোচ্য আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা জিহাদ করা মুসলমানদের ওপর অবশ্য কর্তব্য।
জিহাদ মানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নানাবিধ প্রচেষ্টা। এটা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ প্রচেষ্টা বক্তব্যের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে, সেবামূলক কাজ, সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় কাজ এমনকি চুড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক তৎপরতা, সরকার পরিবর্তন ও যুদ্ধও হতে পারে। তবে এ যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি থাকবে।  ইসলামে যেমন হঠকারিতার স্থান নেই, ঠিক তেমনি আল্লাহর নির্দেশ এড়িয়ে যাবার সুযোগও নেই। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি এ পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করতে ইচ্ছুক। আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব হলো এ পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা সাধনা বা জিহাদ করা। ইসলামে জিহাদ ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত কর্তব্য। জিহাদের আসল উদ্দেশ্য হলো, মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করা সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের মূলোৎপাটন করা। এর মাধ্যমে এদের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা। রাসূল (সা)-এর ওপর অসংখ্য নির্যাতন হয়েছে কোথায়ও তিনি আগে আক্রমণ করেছেন এমন নজির নেই। যতটুকু ভূমিকা ছিল তা নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক ছিল। জিহাদের সাথে কোন অবস্থ’ায় সন্ত্রাসকে এক করে দেখার কোন সুযোগ নেই কেননা জিহাদ হলো প্রতিরক্ষার জন্য এবং সন্ত্রাস নির্মূল করে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
ইসলাম প্রতিটি মানুষের জান মাল ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা দানকে অপরিহার্য করেছে। ইসলামে মানুষের প্রাণ ও রক্ত পবিত্র এবং সম্মানার্হ। বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবি রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমর বিন রবিয়ার খুনের দাবি রহিত করলাম। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আমার পরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে কাফেরসুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিও না। কাউকে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় বা সামরিক স্বার্থ ব্যতীত হত্যা করা পৈশাচিক ও ঘৃণ্য কাজ।
ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক কেবলমাত্র অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা যে নিষিদ্ধ তা নয় বরং নিজেকে বা আত্মহত্যা করাও নিষিদ্ধ। কোন অবস্থায় নিজেকে ধ্বংস করা যাবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, তিনি মুমিনদের জান ও মালকে বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। যেহেতু মুমিনের জান ও মালকে আল্লাহ কিনে নিয়েছেন অতএব তিনি এর মালিক। আল্লাহর মালিকানাধীন বস্তু বিনষ্টের অধিকার বান্দার থাকতে পারে না। আত্মহত্যা নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য নি¤œরূপ পথ- পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’ সূরায়ে বাকারায় আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন কর না।’ সূরা নিসায় আরো বলা হয়েছে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত তিনটি থেকে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেখানে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই।
রাসূল (সা)-এর হাদিস থেকে আত্মহত্যার নিষিদ্ধতার বিষয়টি আরো বেশি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ ধরনের লোকেরা যে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে সে সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন,
১.    যে ব্যক্তি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, দোজখে বসেও সে অনবরত উচ্চ স্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে বসেও অনন্তকাল বিষপান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়ে নিজেকে কোপাতে থাকবে।
২.    যে ব্যক্তি নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামের মধ্যে নিজের শ্বাসরুদ্ধ করবে। আর যে নিজেকে আঘাত করবে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামেও নিজেকে আঘাত করবে। তিনি আরো বলেন,
৩.    তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই সে একখানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করল, ফলে রক্তপাত হয়ে সে মারা গেল। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দা আমাকে ডিঙিয়ে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার জান্নাত হারাম করে দিলাম।
চরমপন্থীরা ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার পেছনে যে সব কারণগুলো রয়েছে তা নি¤œরূপ- ক. গোঁড়া মনোভাব, খ. সমন্বিত জ্ঞানের বা ব্যাপক জ্ঞানের অভাব, গ. অহঙ্কার, ঘ. বক্র স্বভাব ও চিন্তাÑ এ ধরনের লোকেরা খুবই অপরিণামদর্শী হয়ে থাকে। তাদের বক্র চিন্তার কারণে তারা যেমন নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে ঠিক তেমনি ইসলামী জীবনব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে একমাত্র আল্লাহর খাস বান্দা বলে মনে করে, যা তাদের অহঙ্কারের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়, ফলে তারা তাদের মত যারা চলতে পারে না তাদেরকে কাফের বলে মনে করে এবং তাদেরকে হত্যা করা সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করে। এ ধরনের অহঙ্কার ও একপেশে মানসিকতা পরিহারের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) কঠোর ভাষায় তাগিদ দিয়েছেন। ‘যখন কেউ বলবে যে, লোকজন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, সে ব্যক্তি নিজকেই ধ্বংস করলো।
ঈমানদার ব্যক্তিকে কাফির বলা এক ধরনের ফিতনার সৃষ্টি করে যা সামাজিক অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ। এর বিষময় ফল সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত তার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। ফিতনা বা বিপর্যয়ের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মজিদে বলেছেন, ‘ফিতনা বা বিপর্যয় হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ’। একই প্রসঙ্গে আল্লাহর নবী (সা) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা তাদের দু’জনের ওপর বর্তাবে। যদি তার ভাই সত্যিকার কাফির হয় তবে তো ঠিক অন্যথায় কাফির আখ্যায়িতকারীর ওপরই কুফর প্রযোজ্য হবে।

রাসূল (সা)-এর জীবন ছিল সহনশীলতা ও ক্ষমার এক অনুপম আদর্শ। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনো তিনি কাউকে আঘাত করেননি, কখনো কটু কথা বলেননি। কোন বিষয়ে তার অপছন্দ হলে বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখমন্ডল লাল হয়ে যেত কিন্তু কখনো তাঁকে দেখা যেত না কাউকে কোন ধরনের কটু কথা বলতে। তিনি ছিলেন সত্যিই বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর রহমত ও দয়ার সাগর। তাঁরই হাদিসের ভাবানুবাদ করে কবি বলেছেন, কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত গিয়ে লাগে কাবার ঘরে। ‘ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রার ঔদার্যের ও মহানুভবতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি ইসলামের একটি সার্বজনীন নীতি। তাই ক্ষমাধর্মের প্রতিই ইসলামের সর্বাধিক অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। যতক্ষণ না তদ্বারা অন্য কারো হক বিনষ্ট হয়, কিংবা বাতিল শক্তি পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টির কোন প্রকার আশ্রয় প্রশ্রয় লাভ করে। কিংবা এর অপব্যবহারের মাধ্যমে মানবতার ভয়াবহ সমূহ বিনাশ সাধনের কোন পরিস্থিতি পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, অবাধে অন্যায় অবিচার, অনাচার, পাপাচার, নৈরাজ্য ও ধ্বংস সাধনে লিপ্ত মানবরূপী হিংস্র পশুদের সাথে আপস করার মানসিকতাকে কোনভাবেই মহানুভবতা বলা যায় না, তা হচ্ছে নিছক কাপুরুষতা, ভীরুতা, আত্মগ্লানি ও সত্যের অবমাননা।

অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারকে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দূরীভূত করার মাধ্যমে স্পল্পসংখ্যক জালেমের হস্ত ও কণ্ঠ স্তব্ধ করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মজলুমের মুখে হাসি ফোটানো অবশ্যই মহৎ কাজ। রাসূল (সা)-কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্যায়ের জবাব ন্যায়ের মাধ্যমে দানের কথা বলেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়, আর আপনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দিন। তখন আপনি দেখবেন এ পন্থায় আপনার পরম শত্রুরাও পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেছে। এ আয়াতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে আল্লাহর নবীর (সা) জীবনে। তিনি আজীবন মন্দের জবাব দিয়েছেন উত্তম পন্থায়। এ কারণে অমুসলিমরা দলে দলে তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তাঁকে হত্যা করতে এসে তরবারি রাসূলের (সা) পদতলে লুটিয়ে দেন।

যেখানে আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর প্রাণের শত্রুকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার সাথে সাথে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন একইসঙ্গে চরমপন্থা ও কঠোর আচরণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। অতএব তার অনুসারী হিসেবে কারো সাথে কঠোর ব্যবহার করার সুযোগ আমাদের কোথায়?

মানবজাতির ইতিহাসে চরমপন্থী দলের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদি উগ্রবাদী ধার্মিকগণ, ধমীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীন যুগের প্রসিদ্ধতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রপন্থী এ সকল ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য  আপসহীন ছিল। সে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। এ জন্য এরা ছুরিমানব হিসেবে পরিচিত ছিল। এরা এতখানি চরমপন্থী ছিল যে, তারা প্রয়োজনে আত্মহত্যা করত কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না। তাদের উওরসূরি এ ইহুদি জাতি কিভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ডকে অন্যায়ভাবে দখল করে কয়েক যুগব্যাপী পাখি শিকারের ন্যায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে তা বিশ্ব বিবেক দেখছে।
মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। পোপ ও স¤্রাটের  দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে এ সময়কে অরাজনৈতিক যুগ বলা হয়। অন্যদিকে এ যুগটি অন্ধকার যুগ হিসেবেও খ্যাত। এ সময়ে রাজনীতি, ক্ষমতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে চর্চারত প্রায় ৩৫ হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার কথা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়। এ সময়ের ক্যাথলিক ও পোটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ও যুদ্ধবহির্ভূত সন্ত্রাসের অসংখ্য ঘটনা ঘটে।
১৯৬০ সালের দিকে আরেকটি চরমপন্থী আন্দোলনের ঢেউয়ের কথা ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি। এসময় সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে ইতালির রেড ব্রিগেড এবং জার্মানির রেড আর্মি অন্যতম। ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কথা কে না জানে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী দল হিসেবে খারেজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ওসমান (রা) এর শাহাদতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দলের আগমন ঘটে। হযরত আলী (রা) ও আমিওে মোয়াবিয়ার (রা) মধ্যে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটলে হযরত আলী সালিসির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার  উদ্যোগ গ্রহণ করলে তারই অনুসারীদের মধ্য থেকে চরমপন্থী একটি দল বেরিয় যায়। এদেরকে খারেজি বা দলত্যাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরা ছিল ইসলামের দ্বিতীয় যুগের মানুষ। যারা রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরই ইসলাম গ্রহণ করে। এদের প্রায় সকলেই ছিল যুবক।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি ইসলাম মানবতার ধর্ম, যার মূলভিত্তি সহনশীলতা, ভালোবাসা ও ক্ষমা। কোন ব্যক্তির বক্তব্য ইসলামের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে না। প্রাধান্য পাবে কেবল কুরআন ও হাদিস বিশেষত মুহাম্মদ (সা) এর কৃতকর্ম। এ থেকে আমরা দেখতে পাই ইসলামে চরমপন্থার কোনো স্থান নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

Saturday, May 25, 2019

মাদরাসায় নয় বরং ইংলিশ মিডিয়ামে জঙ্গি তৈরি হয়: শেখ হাসিনা

জাতীয় সংসদে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ কেউ বলেন, মাদ্রাসা জঙ্গিবাদ সৃষ্টির কারখানা, এটা সঠিক নয়। হলি আর্টিজানে যে হামলা হলো সেখানে কারা জড়িত? তারা তো কেউ মাদ্রাসা শিক্ষিত না। সবাই তো উচ্চ শিক্ষিত।’
‘আমার মনে হয়, তাদের জীবনে পাওয়ার আর কিছু বাকি নেই। পাওয়ার জায়গাটি হারিয়ে গিয়ে তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য শুধু মাদ্রাসা শিক্ষিতদের দোষারোপ করলে হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মাদ্রাসা জঙ্গিবাদ সৃষ্টির কারখানা নয়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অন্যদের দ্বারা ব্যবহার হতে পারেন।
সোমবার রাতে জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। একাদশ জাতীয় সংসদের সমাপনী ভাষণ দেন সংসদ নেত্রী।
গত ৩ মার্চ জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ওপর দেয়া ভাষণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘বিষবৃক্ষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়ারও সমালোচনা করেন। তার এই বক্তব্যের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। হেফাজতে ইসলাম রাজপথে বিক্ষোভ করেছে এবং কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কি তাদের ফেলে দেব? তারা তো আমাদের দেশেরই নাগরিক। বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা কেন পিছিয়ে থাকবে। তাদের মেধাকে আমরা কেন কাজে লাগাবো না?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল। তারা দেওবন্দের কারিকুলাম অনুসরণ করছে। দেওবন্দ ভারতে স্বীকৃত একটি কারিকুলাম।’
এ সময় তিনি দেওবন্দি ধারার প্রশংসা করে বলেন, ‘এই দেওবন্দ কারা? তারা কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সিপাহি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে কোনো অন্যায় করিনি।’

Thursday, May 23, 2019

প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ : ফকীর বিদ্রোহ - আ বু সা ঈ দ মু হা ম্ম দ ও ম র আ লী


উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বা কারা প্রথম শুরু করে এবং কখন তা শুরু হয়, এককালে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাংলার ‘ফকীর বিদ্রোহের ইতিহাস’ উদ্ঘাটিত হবার পর এ বিতর্কের একটা সুরাহা হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষাণার প্রয়োজন যে নেই তা নয়, বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনার স্বার্থেই সে ইতিহাস খুঁজে বের করবার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী স্তরগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত ‘ত্রিপুরার শমশের গাজীর বিদ্রোহ’, ‘সিরাজগঞ্জের বিদ্রোহ’, ওহাবী আন্দোলন’, ‘ফারায়েজী আন্দোলন’, স›দ্বীপের বিদ্রোহ’, ‘১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব’ ও ‘নীল বিদ্রোহের’ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংকলন করা দরকার, দরকার তা ভবিষ্যৎ বংশদরদের হাতে তুলে দেবার।
সুদীর্ঘ ৭০০ বছল ধরে ভারতের বুকে যে মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল- পলাশীর বিয়োগান্ত প্রহসনের মাধ্যমে তার হাতবদল মুসলমানরা স্বাভাবিক কারণেই মেনে নিতে পারেনি। মেনে নেয়া সম্ভবও ছিল না। আর কোনো আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষেই রাতারাতি এই পরিবর্তনকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। পলাশীর আম্রকাননের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত এই ভাগ্য বিপর্যয়ে বাংলার মুসলমান সাময়িকভাবে দিশেহারা ও মুহ্যমান হয়ে পড়লেও সম্বিৎ ফিরে পেতে তাদের বেশি দেরিও হয়নি। সিরাজউদ্দৌলার পর শাসকদের পক্ষ থেকে মীর কাসেম আপ্রাণ চেষ্টা চালান দেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে। কিন্তু তাঁর এ চেষ্টা ফলবতী হয়নি। পরাধীনতার অভিপাশ সম্বন্ধে জনগণের চেতনা প্রথমেই জাগেনি। তার কারণ প্রথম দিকে আপামর জনসাধারণে একে শাসকের পালাবদল হিসেবে ধরে নিলেও মাত্র কিছুদিননের ভেতরই তারেদ সামনে এ সত্যও ধরা পড়ল- শাসকের পালাবদলের সংগে তাদের ভাগ্যেরও পালাবদল ঘটেছে। আর এই সত্য উপলব্ধির সংগেই শুরু হল প্রতিরোধ সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসকেরা একে বিদ্রোহ বলে চালাতে চাইলেও এবং এসব বিদ্রোহকে (অবশ্য তাদের ভাষায়) নির্মম হস্তে দমন করতে সমর্থ হলেও স্বাধীনতাকামী সুসলমানদের কাছে তা স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই সম্মান ও শ্রদ্ধার সংগে স্মরণীয় হয়ে রইল-আর সেসব ‘বিদ্রোহ’ (?) যারা অংশ নিতে এগিয়ে গেলেন, নির্যাতন সইলেন, প্রাণ বিলিয়ে দিলেন, সা¤্রাজ্যবাদী শাসক ও শোষকদের লেখায় তারা দস্যু, তস্কর, লুটেরা ও সন্ত্রাসীবাদী হিসেবে আখ্যায়িতত হলেও এদেশের মানুষ কিন্তু তাদের ঠিকই স্বাধীনতার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদ হিসেবেই হৃদয়ে ঠাঁই দিলো।
এখানে অনিবার্যভাবেই একটি প্রশ্ন মনে না জেগে পারে না তাহল- পলাশী প্রহসন অনুষ্ঠিত হবার যে দিনটিতে অক্রকাননের কিছু দূরেই ভূমি কর্ষণরত যে কৃষকের হাতে লাঙলের মুঠি ধরা রইল, এতটুকু ভাবান্তর যাবে বিব্রত করল না, -হস্তীপৃষ্ঠে শহীদ সিরাজের লাশ দৃষ্টেও যে মুর্ষিদাবাদবাসী ফ্যাফফ্যাল করে চেয়ে রইল, লাশ বহনকারী হাতীর সামনে আলুথালুবেশী নবাব মাতা আমিনার ভূলুণ্ঠিত চেহারা যাদের চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রæ ভিন্ন আর কিছু দিতে পারল না, হঠাৎ এমন কি ঘটল যে, সেই লাঙলের মুঠি ধরা হাতই প্রতিরোধের শাণিত অস্ত্র তুলে নিল? সে এক ইতিহাস; বড় করুণ, বড় নির্মম।
ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ক্ষমতা দখল করলেও দেশের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে তারা প্রথমেই সাহসী হয়নি। সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের সাদা চামড়ার শাসন এদেশবাসী সহজে কিংবা আদৌ মানবে কিনা এই ভয় তাদের গোড়াতেই ছিল। নির্লজ্জ শোষক ও লোভী হায়েনার চেহারা নিয়ে হঠাৎ করে দেশের সাধারণ মানুষের সামনে হাজির হতে প্রথমে তাদের সংকোচ বেধেছিল। তাই তারা মীরজাফর প্রমুখ কতিপয় সাক্ষী-গোপালের আড়ালে নিজেদের হিংস্র ও লোভী চেহারা লুকিয়ে রাখার ভেতর নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবেছিল। পর্দার আড়ালে থেকে চালিয়ে যেতে থাকল শাসন, শোষণ এবং উৎপীড়ন। বাংলার অফুরন্ত ধন-সম্পদ লুট করবার মূল চাবিকাঠি কোম্পানী নিজ হাতে রেখে এদেশের মানুষের অর্বণনীয় দুঃখ-কষ্টের কারণ হিসেবে এদেশের কতিপয় কুলাংগারের মাথায় সব দোষের বোঝা তুলে দিলো। রবার্ট ক্লাইভ সব অপকর্মের নায়ক হয়েও চতুর্যের বদৌলতে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে রইলেন।
“বিজয়ের সাথে সাথে ক্লাইভ ও তার অনুচরেরা সমগ্র দেশের কায়েম করল লুণ্ঠন ও অত্যাচারের বিভীষিকা। পলাশী যুদ্ধের পর ক্লাইভ মীরজাফরের নিকট থেকে উৎকোচ স্বরূপ লাভ করলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড। রাতারাতি লর্ড ক্লাইভ গণ্য হলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী বলে। নবাবী লাভের ইনাম স্বরূপ মীরজাফরের কাছ থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা গ্রহণ করলো ৩০ লক্ষ পাউন্ড এবং চব্বিশ পরগণা জেলার জমিদারী। এরপর একটানা চললো উৎকোচ গ্রহণ, লুণ্ঠন ও ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব আদায়। ১৭৬৬ সালে (ব্রিটিশ) পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি ইংরেজ কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তাতে দেখা যায়, “১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্চচারীরা বাংলাদেশ ও বিহার থেকে মোট ৯ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিল।”
লুণ্ঠনের এমন দুঃখজনক ইতিহাস দুনিয়াতে বোধকরি অল্পই আছে। এই শোষণ-নির্যাতনের রূপ যে কত ঘৃণীত ও ভয়াবহ ছিল তা তাদেরই একজন লর্ড মেকলের ভাষায় শুনুন;
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্বার্থে নয়, নিজেদের জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা এদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যক্ষেত্রে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় লোকদের তারা দেশীয় উৎপন্ন দ্রব্য অল্প দামে বিক্রয় এবং ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করলো। কোম্পানির আশ্রয়ে প্রতিপালিত দেশীয় কর্মচারীরা সমগ্র দেশে সৃষ্টি করেছিল শোষণ ও অত্যাচারের ভয়াবহ বিভীষিকা। কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার প্রভুর শক্তিতে শক্তিমান, আর এইসব প্রভুর শক্তির উৎস ছিল স্বয়ং ইষ্ট ইন্ডি’া কোম্পানি। কোলকাতায় ধন-সম্পদের পাহাড় তৈরি হল, অপরদিকে তিন কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার শেষ স্তরে উপনীত হল। সত্য কথা যে, বাংলার মানুষ শোষণ-উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যন্ত; কিন্তু এমন ভয়াবহ শোষণ ও উৎপীড়ন তারা কোনোদিন দেখেনি।” (ঊংংধুং রহ খড়ৎফ ঈষরাব).
এদেশ দখলের পর এদেশের বুকে তাদের শাসন ও শোষণের পাকাপোক্ত ও কায়েমী করবার লক্ষ্যে বেনিয়া কোম্পানী প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দিল। পূর্ব থেকে চালু সমষ্টিগতভাবে গ্রাম্য সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদয়ের প্রথা বাতিল করে চাষিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করল। মোগল আমল থেকে প্রচলিত উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও বাতিল হলো। পরিবর্তে চালু করা হলো মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধের জন্য মুদ্রা সংগ্রহ করা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিলো। আর সেই মুদ্রা সংগ্রহের প্রয়োজনে ফসল বিক্রি করা ছাড়া চাষির অন্য কোনো উপায় রইল না।
চাষির ফসল ক্রয় করার জন্য ইংরেজ বণিকেরা বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে ক্রয়কেন্দ্র খোলে। শুধু তাই নয়, বেশি মুনাফার আশায় এসব ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য গুমামজাত করা শুরু করল। পরে সুযোগ-সুবিধামতো এসব খাদ্যই চড়ামূল্যে সেই চাষিদের নিকট আবার বিক্রি করত। ফলে খাদ্য গুদামজাতকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির কারণেই এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে এলো। ১৭৬৯ সালে ক্রয়কৃত সমস্ত ফসল ১৭৭০ সালেই আবর বেশি দামে বিক্রি হল। বাংলার চাষি তা ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়ে নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষের শিকার হলো। মারা গেল কয়েক লক্ষ আদম সন্তান। বাংলা ১১৭৬ সালের এই দুর্ভিক্ষই ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে ইতিহাস খ্যাত। ইংরেজ ঐতিহাসিক ‘ইয়ং হাজব্যান্ড’- এর ভাষায় :
“তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফার পরবর্তী উপায় ছিল চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এ দ্রবটির জন্য তারা যে মূল্যই চাইবে, তা পাবে।........ চাষিরা তাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফল অপরের গুদামে মজুদ থাকতে দেখে চাষাবাস সম্বন্ধে এক রকম উদাসীন হয়ে পড়ল। ফলে দেখা দিলো ভয়ানক খাদ্যাভাব। দেশে যেসব খাদ্য ছিল, তা ইংরেজ বণিকদের দখলে। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে থাকল, ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃখময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।’
“এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোনো অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নয়। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিলো, তা ভারতবাসীরাও আর কোনো দিন চোখে দেখেনি বা কানে শোনেনি। চরম খাদ্যাভাবের এক ভয়াবহ ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিলো ১৭৬৯ সাল। সঙ্গে বাংলা-বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক তাদের সকল আমলা, গোমস্তা রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান-চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায়ে মুনাফা এত শীঘ্র ও এত বিপুল পরিমাণে পেয়েছিল যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এ ব্যবসায় করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) দেশে পাঠিয়েছিল।’
ব্রিটিশ বেনিয়া রাজের সৃষ্ট ভয়াবহ এই দুর্ভিক্ষ কেবল বাংলাদেশের নয়-গোটা মানব জাতির ইতিহাসের একট কলংকিত অধ্যায়। মানব শিক্ষা ও সভ্যতার ইতিহাস থেকে বাংলার ভয়ঙ্কক এই দুর্ভিক্ষের তান্ডবলীলার কথা কোনদিন মুছবার নয়।
ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা করে লিখেছেন:
“১৭৭০ সালের সারা গ্রীষ্মকালব্যাপী লোক মারা গিয়েছে। তাদের গরু-বাছুর, লাংগল-জোঁয়াল বেচে ফেলেছে এবং বীজধান খেয়ে ফেলেছে। অবশেষে তারা ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক সময় আর ক্রেতাও পাওয়া গেল না। তারপর তারা গাছের পাতা ও ঘাস খেতে শুরু করে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, জাতির মানুষ মরা মানুষের গোশ্ত খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট, কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই সংক্রামক রোগ শুরু হয়েছিল। মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদে পানি বসন্ত দেখা দেয় এবং বহুলোক এই রোগে মারা যায়। শাহজাদা সাইফুতও এই রোগে মারা যান। মৃত ও মরণাপন্ন রোগী স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের মেথর, কুকুর, শিয়াল ও শকুনের পক্ষেও্র এত বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।” (পল্লী বাংলার ইতিহাস; সুপ্রকাশ রায়)।
হান্টারের লেখায় আরও জানা যায় যে, সরকারি হিসেবে ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসের প্রতি ষোলজনের ৬ জন মারা গিয়েছিল। শেষাবধি জমিতে আবাদ করার মত পর্যাপ্ত লোকও আর অবশিষ্ট ছিল না।
এত বেশি রায়ত মারা গিয়েছিল এবং জমি পরিত্যাগ করেছিল যে, তাদের পক্ষে বকেয়া খাজনা আদায় করার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছিল।
“কোম্পানি সরকারের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তবুও মেটেনি, শোষণ-পীড়ন গতিতেই। শকুনের মতো লাশের ওপর বসেও কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল মৃতপ্রায় চাষিদের ওপর। তাই দেখা যায়, দুর্ভিক্ষের পূর্বে (১৭৬৮) যেখানে বাংলাদেশের রাজস্ব, ১,৫২,০৪,৮৫৬ টাকা, দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ সালে সমগ্র দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মরে যাওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ১,৫৭,২৬,৫৭৬ টাকায়।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ পৃ. ০৯-১১)
এ তো গেল কৃষি ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের দুরবস্থার কথা। এবার আসুন, আমরা পলাশী যুদ্ধোত্তর আমাদের শিল্পী ও কারিগরদের অবস্থার দিকে তাকাই : ব্রিটিশ বেনিয়া রাজ এদেশে শিল্প-পণ্যের ওপর কি পরিবর্তন চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তার ফল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এর আগে এদেশের গ্রামীন অর্থ-ব্যবস্থা ছিল কৃষি ও শিল্প পেশানির্ভর। তাঁত এবং চরকাই ছিল একমাত্র অর্থকরী শিল্পের মূল ভিত্তি। বেনিয়া শাসক ও শোষকেরা সেখানেও ছোবল হানল। তাঁত ভেঙে ছারখার করল, চরকা করল ধ্বংস। যে দেশের শিল্প-পণ্য সম্ভার দিয়ে ইংল্যান্ডে ব্যবসায় চলত, ইউরোপের কোনো দেশের পণ্য সম্ভার এদেশের বাজারে বিক্রি করার কথা যখন কেউ কল্পনাও করেনি- বাংলাদেশের তথা উপমমহাদেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার কল্পনাও যখন ইউরোপ করেনি; পলাশী যুদ্ধ সেই ইউরোপের ভাগ্য ফিরিয়ে দিলো। ব্রুক এডামস-এর ভাষায় : ১৭৫০ সালে যখন বার্ক ইংল্যান্ডে আসেন, তখন সমগ্র প্রদেশে বারটার বেশি ব্যাংক ছিল না। অথচ ১৭৯০ সালে শহরের প্রত্যেকটি বাজারেই ব্যাংক ছিল। বাংলাদেশ থেকে রৌপ্য আসার পর শুধু অর্থের প্রচলন বেড়ে যায়নি, (ব্যাংক) আন্দোলনও জোরদার হয়েছে। কারণ হঠাৎ দেখা গেল, ১৭৫৯ সালে ব্যাংক ১০ পাউন্ড ও ১৫ পাউন্ডের নোট বাজারে ছেড়েছে।
শিল্প বিপ্লবের পূর্বকার ইংল্যান্ডের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রæক এডামস অন্যত্র বলেছেন :
“পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের লুণ্ঠিত ধন-রতœ ইংল্যান্ডে আসতে লাগল এবং তখনই এর চাক্ষুস ফল বোঝা গেল। পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। তারপর থেকে (ইংল্যান্ডে) যে পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল তার তুলনা বোধহয় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে না। ১৭৬০ সালে আগে ল্যাংকাশায়ারে বস্ত্র-শিল্পের যন্ত্রপাতি এদেশের মতোই সহজ-সাধারণ ছিল এবং ১৭১০ সালে ইংলন্ডে লৌহ শিল্পের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়।..... .ইংল্যান্ডে ভারতের ধন-সম্পদ পৌঁছার এবং ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত প্রয়োজন অনুরূপ শক্তি (মূলধন) ইংলন্ডের ছিল না।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ : পৃ. ৫৫-৫৬)
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের মুকাবিলায় টিকাতে না পেরে যেখানে ব্রিটিশ বস্ত্র-শিল্পের মালিকরা তাঁতের অনুন্নত বস্ত্র-শিল্প বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে আন্দোলন শুরু করে, সেখানে ১৭৬০ সালের পর দেখা দিল বিস্ময়কর পরিবর্তন।’ ৬০ সালে এল তাঁতের উড়ন্ত মাকু, ’ ৬৪ ও ’৭৬ সলে তৈরি হল সুতা কাটার যন্ত্র ‘জেনি’ ও ‘সিউল’। ‘৬৮ সালে আবিষ্কৃত হল বাষ্পীয় যন্ত্র। এসব আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত হল ভারতবর্ষের অফুরন্ত লুণ্ঠিত সম্পদ। ফলে অঢেল অর্থ আর বাষ্পীয় শক্তির যৌথ সহযোগে অসম্ভব সম্ভব হলো। ইংল্যান্ডের বস্ত্র-শিল্পের মান ও পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাজারে এদেশের বস্ত্র-শিল্পের চাহিদা কেবল কমেই গেল না-অধিকন্তু তাদের উদ্ধৃত্ত কাপড় এদেশে রফতানি করবারও প্রয়োজন বোধ করল ইংলন্ডের বস্ত্র-শিল্প মালিকরা। এরপরও দেশীয় বস্ত্র-শিল্পের চাহিদাকে শূণের কোটায় নামিয়ে আনার এবং সেই সংগে বিলেতী বস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে বেনিয়া শোষক গোষ্ঠী দেশী পণ্যের উপর ট্যাক্সের গুরুভার চাপিয়ে দিল। কিন্তু তদ্সত্তে¡ও দেশী পণ্যের মুকাবেলায় টিকতে না পেরে অবশেষে বস্ত্রের ওপর ৭০-৮০ ভাগ শুল্ক চাপিয়ে দিলো আর বিলেতী মালের ওপর থেকে শুল্ক উঠিয়ে নিলো। ফলে দেশীয় শিল্প আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেল। একই অবস্থা হলো অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও। অতএব এসব শিল্প ধ্বংস হবার সংগে শিল্পের সংগে জড়িত বিরাট শ্রম ও জনশক্তি গেল ধ্বংস হয়ে। দৈনিক অত্যাচার ও অর্থনৈতিক দরবস্থায় পড় তাঁতীরা তাঁত ছেড়ে দিল। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে তাঁতীদের সংগে অন্যান্য শিল্পের লোকেরাও কৃষির দিকে হাত বাড়াল শেষ সম্বল হিসেবে। অথচ সেখানেও যে তাদের জন্য কোন আশ্বাস ছিল না- তা পূর্বেই বলা হয়েছে।
ব্রিটিশ বেনিয়া শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর নির্মম শাসন ও শোষণেল যাঁতাকালে পিষ্ট হয়ে এদেশের কৃষক, তাঁতী, মজুরসহ সর্বশ্রেণীর মানষের বাঁচার নূনতম পথও আর খোলা রইল না। কেবল তখনই দুটো পথ তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিল। এক, শোষণ-নির্যাতনের চাপে তিল তিল করে অনিবার্য ধ্বংসে পরিণত হওয়া। দুই. বাঁচার শেষ চেষ্টায় বিদ্রোহের মাঝে মরণ আঘাত দেওয়া, বিপ্লবের মাধ্যমে শোষক বেনিয়া গোষ্ঠীর উচ্ছেদ সাধন করে আজাদী ও মুক্তির স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাব ছিনিয়ে আনা। বাংলা বিহারের মানুষ দ্বিতীয় পথকেই বেছে নিল। শোষণ-নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ ও মরণোন্মুখ এদেশের শ্রমজীবী মানুষ, চিরকালের নিরীহ মানুষ মুখ বুঁজে মার খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করে হয়ে উঠল বিদ্রোহ ও প্রতিবাদমুখর। যে হাত ছিল একদিন লাঙলের মুঠোয়, যে হাত সৃষ্টি করত বিখ্যাত মসলিন, সে হাত উঠিয়ে নিলো সুতীক্ষè অস্ত্র। শত্রুকে ক্ষমা না করার এবং ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র নীতি গ্রহণ করল সে হাত শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয় ধ্বজা উড়িয়ে যিনি সর্বপ্রথম মজলুম মানুষের মুক্তি মিছিলের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসলেন- তিনিই ইতিহাস খ্যাত ফকীর মজুন শাহ। আমাদের আযাদী সংগ্রামের সর্বপ্রথম সৈনিক। ফকীর মজনু শাহ বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের নেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদরী-বেরিহানা তরিকার ফকীর বা দরবেশ ছিলেন। এই তরিকার ফকীরদের সম্পর্কে মরহুম নওয়াবজাদা আবদুল আলী বলেন : “তারা মাথায় লম্বা চুল রাখে, রঙিন কাপড় পরে এবং লোহার শিকল ও লম্ব চিমটা ব্যবহার করে। প্রধানত আতপ চাল, ঘি ও নুনই তাদের খাদ্য। তারা মাছ- গোশ্ত খায় না এবং কিছুকাল আগেও তারা কৌমার্যব্রত পালন করত। সফরের সময় তারা মৎস্যশোভিত পতাকা বহন করে এবং বিরাট দলবল নিয়েই তারা চলাফেরা করে। তাদের উপাধি ‘বোরহানা’ এসব ফকীর ‘বসরিয়া’ তরিকার ‘তৈফুরিয়া খানেওয়াড়ো’ ও ‘তাবাগাতি’ ঘরের অন্তর্ভুক্ত।............শাহ মাদার হচ্ছেল এ তরীকার প্রবর্তন।” (বাঙলার ফকীর বিদ্রোহ : পৃ. ৬)
১৬৫৯ সালে বাংলার তদানীন্তন সুবেদার শাহ সুজা বোরাহানা ফকীর শাহ সুলতান হাসান মুরিয়া বোরহানাকে এক সনদ দান করেন। উক্ত সনদবলে বোরহানা ফকীরগণ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার যে কোনো স্থানে যাতায়াতে তাদের পতাকা, বাদ্যযন্ত্র, অন্যান্য জিনিসপত্র বহনের অধিকার লাভ করে। সনদে মালিকবিহীন ভূ-সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকারও তাদের দান করা হয়। অধিকন্তু তারা যেখানেই যাক, সেখনাকার জমিদার কিংবা প্রজা তাদের খাওয়া খরচ বহন করবে এবং তাদের কোনোরূপ কর দিতে হবে না বলেও উক্ত সনদে উল্লেখ করা হয়।
এরা এক সময় দল বেঁধে ভারতবর্ষের নানা স্থানে বসবাস ও ইতস্তত ঘোরাফেরা করে আসলেও কালক্রমে এরা দেশের নানা স্থানে পতিত ও খাস জমি দখল করে কিংবা মুসলিম শাসকদের থেকে ‘দান’ প্রাপ্ত জমিতে চাষাবাদ শুরু করে। কালক্রমে স্থায়ী কৃষকে পরিণত হলেও পোশাক-আশাকে এরা কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। ব্রিটিশ বেনিয়া শাসন হঠাৎ করেই এদের যাতায়াতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে (দ্র. পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ, পৃ. ৮৫-৮৬)। এমনকি তীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্য যাতায়াতকারী ফকীরদের উপরও বিরাট কর ধার্য করে। যে জমি তারা নিষ্কর ভোগ করত,তার উপরও অতিরিক্ত কর প্রয়োগ করা হল। ফলে একদিকে জীবিকা, অপরদিকে ধর্মীয় অধিকারের উপর এই বাধা-নিষেধ তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর এই ক্ষোভই তাদরকে বিদ্রোহের পেছনে মদদ যোগায়। অতএব জীবিকার স্বাভাবিক তাগিদে একদিকে খাদ্যশস্য গুমামজাতকারী মহাজন ও কুঠিয়ালদের উপর তারা আক্রমণ চলাতে শুরু করে এবং অধিক মুনাফার আশায় মজুদ করা খাদ্য লুট করতে শুরু করে, অপরদিকে এই জালিম শাসক ও শোষকদের সহযোগী যেকোন লোকদের তারা আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করতে থাকে।
১৭৬৩ সালে ফকীর বাহিনী সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির আক্রমণ করে। সে সময় ঢাকা কুঠির ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মি. র‌্যালফ লিসেস্টার নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ ফকীর বাহিনীর আগমনে ভীত হয়ে কোনোরূপ প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই বুড়িগঙ্গার বুকে আশ্রয় নেন। ফলে বিনা বাধায় ফকীরদের লুণ্ঠন ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর কুখ্যাত লর্ড ক্লাইভ মি. র‌্যাফল লিসেস্টারকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে ফকীরদের ‘ছোট লোকের দল’ হিসেবে অভিহিত করে।
ঢাকা কুঠির থেকেই ফকীর বাহিনীকে অব্যাহত অগ্রাভিযানে লিপ্ত দেখা যায়। এসব অভিযানের সবগুলোকেই লক্ষ্যস্থল হিসেবে দেখা যায় কোম্পানি কুঠি এবং তাদের খাজনা আদায়কারী অত্যাচারী পাষন্ড জমিদারদের কাছারিগুলো। অনেক সময় তারা জমিদারদের নিজস্ব বসতবাটি এবং সুদখোর-মহাজন ও দালাল-ফড়িয়াদের বাড়িতেও আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ অভিযানগুলোর অধিকাংশই যে দলপতি ফকীর মজনু শাহ্র নেতৃত্বে পরিচালিত হতো- এ ব্যাপারে সকল বর্ণনাই একমত এবং আরও একমত যে, মুসা শাহ্, পরাগল শাহ্, চেরাগ আলী শাহ্, সোবহান শাহ্, করিম শাহ্ প্রমুখ এক্ষেত্রে ফকীর মজনু শাহ্র বিশিষ্ট শাগরেদ ও সহচর ছিলেন। মূসা শাহ্ ছিলেন তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা এবং দক্ষিণ হস্তস্বরূপ। প্রধানত তাঁর সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তিনি অভিযানের সকল পরিকল্পনা তৈরি করতেন। অধিকন্তু এই মুসা শাহ্ই ফকীর মজনু শাহ্র মৃত্যু-পরবর্তী বহু বছর ফকীর বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে এ আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
মজনু শাহ্ ভারতের কানপুর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মকানপুর নামক শাহ্ মাদারের দরগায় বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি প্রতি বছর সহস্রাধিক অনুচরসহ বেনিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করতেন। বিহারের পূর্নিয়া, কুচবিহার, বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, জলপাইগুড়ি, মালদহ, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অধিকাংশ সময়ে এবং ঢাকা ও সিলেট জেলায় মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতেন তারা। এসব অভিযানে ফকীরদের সঙ্গে উট, ঘোড়া, হাউই, গাদা-বন্দুক, বর্শা, কয়েকটি ঘূর্ণায়মান কামান থাকত। এই ঘূর্ণায়মান কামানটিকে ‘ভেলা’ বলা হতো। এর সঙ্গে একটা চক্র যুক্ত ছিল এবং চক্রটি ঘূর্ণনের ফলে চতুর্দিকে অজ¯্র ধারায় অগ্নিবর্ষিত হতো। হয়তো এ জন্যই লোকে একে ‘ঘূর্ণায়মান কামান’ বলে জানত।
ফকীর মজনু শাহ্ পরিচালিত অভিযানগুলোর ভেতর আমরা ১৭৬৩ সালের ঢাকা কুঠি আক্রমণ ছাড়া, পরবর্তী কয়েক বছর অন্য কোনো আক্রমণ অভিযানের সংবাদ অবগত নই। ১৭৬৯ সালে ফকীর বাহিনীর বিরুদ্ধে লে. কীথের নেতৃত্বাধীনে একটি সেনাদল প্রেরিত হয়। পূর্নিয়ার উত্তরে বোরাং অঞ্চলে ফকীর দলের সঙ্গে সংঘর্ষে কীথ নিহত হন। এবং অন্যরাও মারা যান। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরে ফকীরদের বিরুদ্ধে ১০ জন সিপাই ও ১০০ বরকন্দাজের সমস্বয়ে একটি কোম্পানি পাঠানো হয়। ফকীরদের সংখ্যাধিক্যে তারা ভয় পেয়ে ফিরে আসে। পরের বছর ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাবনার বেলকুচি ও লক্ষীনামপুর নামক স্থানে ফকীরদের আগমন ঘটেছিল বলে ক্যাপ্টেন রেনেল মুুর্শিদাবাদ কর্র্তৃপক্ষকে জানান। পরে তারা সেখানে থেকে ময়মনসিংহ জেলার পুখরিয়া পরগনাার দিকে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ক্যাপ্টেনের চিঠি পেয়ে লে. টেইলরের নেতৃত্বে দু’দল সিপাই পাঠানো হয়। তার সঙ্গে লে. ফেলথামের নেতৃত্বে আর দুটো দল ফকীরদের পথরোধ করার জন্য ঘোড়াঘাট (রংপুর) পাঠানো হয়। গোবিন্দগঞ্জ (রংপুর) থেকে ১২ মাইল দূরে কাজীপাড়া নামক স্থানে ফকীর বাহিনী ফেলথাম বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। ফকীর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের নেতা মজনু শাহ বগুড়ার মস্তানগড়ের দিকে পালিয়ে যান। পরে দলবল সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়। মস্তানগড়ে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়।

Popular Posts