Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts
Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts

Monday, May 27, 2019

ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা

- ড. মুহাম্মদ আবু ইউসুফ
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ শত বছর আগে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক পরিবেশে যখন মানুষের সার্বিক আচার-আচরণ পশুদের আচরণকে অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে যুগটি আখ্যায়িত হয়েছিল অন্ধকার যুগ হিসেবে। মানবাধিকারের বদলে পাশবিকতা ছিল যে সমাজের মূলমন্ত্র। অমানবিক ও পাশবিক যাবতীয় কাজ তৎকালীন সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌলিন্যের বিষয় ছিল। সে সময়ের অনাকাক্সিক্ষত কার্যকলাপের কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। এমন একটি সমাজকে রাসূল (সা) তার নৈতিক আদর্শ, মহানুভবতা, সহনশীলতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। গড়ে তোলেন সর্বোত্তম একটি মানবীয় সমাজ।
চরমপন্থা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Extremism, যার অর্থ হলো Holding extreme views বা চরম মনোভাব পোষণকারী বা উগ্রপন্থী। এ শব্দটার ইংরেজি হলো  Extremist যার অর্থ হলো Diehard fantic, militant vadical, terrorist, ultraconservative, zealot। অতএব চরমপন্থা সমার্থক অর্থবোধক শব্দ। সন্ত্রাস শব্দের অর্থ হলো অতিশয় ত্রাস, ভয়ের পরিবেশ। আর সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন। সন্ত্রাস শব্দটিকে নানা জন নানা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন সে অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিপক্ষ চরমপন্থা ও সন্ত্রাস হিসেবে যেমন আখ্যায়িত করে থাকেন ঠিক তেমনি স্বাধীনতাকামীরা আবার তাদের প্রতিপক্ষকে চরমপন্থা অবলম্বনকারী, সন্ত্রাস বিস্তারকারী অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে সন্ত্রাসের নি¤œরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, সন্ত্রাস হলো ব্যক্তি বা সামষ্টিক অপরাধের মনোবৃত্তি হতে সংঘটিত নিষ্ঠুর কাজ বা কাজের হুমকি, তা যে লক্ষ্যেই হোক না কেন। তা দ্বারা মানুষের মনে ভয়ভীতি সঞ্চার করা হয় বা তাদেরকে কষ্টে ফেলার হুমকি দেয়া হয়, বা তাদের জীবন, স্বাধীনতা বা নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয় বা পরিবেশকে ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়া হয় বা সাধারণ জনগণের বা সরকারি সম্পত্তি ছিনতাই, জবর দখল, নষ্ট করা হয়। সম্মেলনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এভাবেই দেয়া হয়েছে, সন্ত্রাস হল ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য হিংসাত্মক কাজ সংঘটিত করা অথবা এর হুমকি প্রদান করা। সন্ত্রাসীরা হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, বিমান হাইজাক, বোমা হামলাসহ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধের কাজ করে। কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও বিচারকরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা হত্যা ও অপহরণের শিকার হন। সন্ত্রাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যখন সে শাসকের আসনে বসে, তখন পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে ব্যাপৃত হয় এবং ফসল ও প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে দিতে প্রবৃত্ত হয় অথচ আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।” পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, “আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর যারা তা ভেঙে দেয় এবং আল্লাহ সেসব সম্পর্ক দৃঢ় করার আদেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে ও পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ব্যাপৃত করে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিশাপ, তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট ঠিকানা।

পাশ্চাত্য দেশ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণে আগ্রহী নয়, কেননা যদি এর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় তবে তাদের পক্ষে হয়ত এর ইচ্ছামতো ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। সন্ত্রাস বা চরমপন্থা মানব ইতিহাসের মতোই পুরনো। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম চরমপন্থার বিস্তার ঘটানো হয় উগ্রবাদী ইহুদি কর্তৃক। উগ্রবাদী ইহুদি ধার্মিকগণ তাদের ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য  সন্ত্রাসের আশ্রয়  নেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিস্টপূর্ব  প্রথম শতাব্দী ও তার সমসাময়িক কালে  রোমান সম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রবাদী এসব ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্দ্র্যবোধ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপসহীন ছিল। যে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এবং তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। তারা কখনই প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না, প্রয়োজনে তারা আত্মহত্যা করত। এ জন্য তারা শিকারি বা ছুরি মানব হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল।

ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৪৯-১৭৯৯) কতিপয় বিপ্লবী তাদের প্রতিপক্ষের বিষয়ে হিংসাত্মক বা চরমপন্থার আশ্রয় নিত। এ কালকে সন্ত্রাসের সময় বা জবমরড়হ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎ বলা হয়। প্রথম দিকে সংঘটিত চরমúন্থী সন্ত্রাস ঘটনার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করার মত। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের পর পুনরায় উনিশ শতকে কুক্ল্যাক্স ক্ল্যান নামক একটি শেতাঙ্গ গ্রুপ কৃষ্ণাঙ্গ ও তাদের প্রতি সহানভূতিশীলদের ওপর বণবাদী সন্ত্রাস চালায়। মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার পাল্টা সংস্কারের যুগে ক্যাথিলক ও প্রটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ হত্যাকাণ্ড এমনকি যুদ্ধবহির্ভূত অসংখ্য সন্ত্রাস ও চরমপন্থী তৎপরতায় দেখা যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকারী হাজার হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জার্মানিতে হিটলার ইতালিতে মুসোলিনি এবং সোভিয়েতে ইউনিয়নে জোসেফ স্ট্যালিন  বিরোধী পক্ষকে দমনের নামে অবর্ণনীয় নারকীয় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইহুদিরা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম সন্ত্রাস পরিচালনা করে ফিলিস্তিনে। পরাশক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত তাদের সন্ত্রাস পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করে রেখেছে। এ সন্ত্রাসের লক্ষ্য ছিল স্বীয়ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে, স্বীয় ভূখন্ড রক্ষায় তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পৃথিবীর সকল মানদন্ডে বিচার করলে ইসরাইলি কর্মকান্ড সন্ত্রাস হিসেবে এবং ফিলিস্তিনিদের তৎপরতায় মুক্তি সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত। অনুরূপভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্ভব ঘটে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে (ওজঅ ওৎরংয ৎবঢ়ঁনষরপধহ ধৎসু)। একইভাবে সত্তরের দশকে ক্যারিবিয়ান সাগরের পোর্টোরিকোতে ঋঅখঅঘ নামে স্বাধীনতা গ্রুপের উদ্ভব ঘটে আমেরিকান শাসনের বিরুদ্ধে। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়।
জিহাদ আরবি শব্দ। যাহা জুহুদ ধাতু থেকে এসেছে। যার শাব্দিক অর্থ চেষ্টা সাধনা করা। আর ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার সংজ্ঞা পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি। ‘তোমরা ততক্ষণ লড়াই করতে থাক, যতক্ষণ না জমিন থেকে ফেতনা দূর হয় এবং সর্বত্র আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তাহারা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয় তবে জালিম ব্যতীত কারো প্রতি কঠোরতা আরোপ করা হয় না। অর্থাৎ যারা জিহাদের কাজ থেকে বিরত থাকবে তারা জালেম এবং তাদের ওপর আল্লাহ কঠোরতা আরোপ  করবেন। পবিত্র কুরআনে আলোচ্য আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা জিহাদ করা মুসলমানদের ওপর অবশ্য কর্তব্য।
জিহাদ মানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নানাবিধ প্রচেষ্টা। এটা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ প্রচেষ্টা বক্তব্যের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে, সেবামূলক কাজ, সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় কাজ এমনকি চুড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক তৎপরতা, সরকার পরিবর্তন ও যুদ্ধও হতে পারে। তবে এ যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি থাকবে।  ইসলামে যেমন হঠকারিতার স্থান নেই, ঠিক তেমনি আল্লাহর নির্দেশ এড়িয়ে যাবার সুযোগও নেই। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি এ পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করতে ইচ্ছুক। আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব হলো এ পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা সাধনা বা জিহাদ করা। ইসলামে জিহাদ ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত কর্তব্য। জিহাদের আসল উদ্দেশ্য হলো, মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করা সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের মূলোৎপাটন করা। এর মাধ্যমে এদের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা। রাসূল (সা)-এর ওপর অসংখ্য নির্যাতন হয়েছে কোথায়ও তিনি আগে আক্রমণ করেছেন এমন নজির নেই। যতটুকু ভূমিকা ছিল তা নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক ছিল। জিহাদের সাথে কোন অবস্থ’ায় সন্ত্রাসকে এক করে দেখার কোন সুযোগ নেই কেননা জিহাদ হলো প্রতিরক্ষার জন্য এবং সন্ত্রাস নির্মূল করে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
ইসলাম প্রতিটি মানুষের জান মাল ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা দানকে অপরিহার্য করেছে। ইসলামে মানুষের প্রাণ ও রক্ত পবিত্র এবং সম্মানার্হ। বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবি রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমর বিন রবিয়ার খুনের দাবি রহিত করলাম। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আমার পরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে কাফেরসুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিও না। কাউকে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় বা সামরিক স্বার্থ ব্যতীত হত্যা করা পৈশাচিক ও ঘৃণ্য কাজ।
ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক কেবলমাত্র অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা যে নিষিদ্ধ তা নয় বরং নিজেকে বা আত্মহত্যা করাও নিষিদ্ধ। কোন অবস্থায় নিজেকে ধ্বংস করা যাবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, তিনি মুমিনদের জান ও মালকে বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। যেহেতু মুমিনের জান ও মালকে আল্লাহ কিনে নিয়েছেন অতএব তিনি এর মালিক। আল্লাহর মালিকানাধীন বস্তু বিনষ্টের অধিকার বান্দার থাকতে পারে না। আত্মহত্যা নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য নি¤œরূপ পথ- পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’ সূরায়ে বাকারায় আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন কর না।’ সূরা নিসায় আরো বলা হয়েছে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত তিনটি থেকে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেখানে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই।
রাসূল (সা)-এর হাদিস থেকে আত্মহত্যার নিষিদ্ধতার বিষয়টি আরো বেশি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ ধরনের লোকেরা যে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে সে সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন,
১.    যে ব্যক্তি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, দোজখে বসেও সে অনবরত উচ্চ স্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে বসেও অনন্তকাল বিষপান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়ে নিজেকে কোপাতে থাকবে।
২.    যে ব্যক্তি নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামের মধ্যে নিজের শ্বাসরুদ্ধ করবে। আর যে নিজেকে আঘাত করবে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামেও নিজেকে আঘাত করবে। তিনি আরো বলেন,
৩.    তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই সে একখানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করল, ফলে রক্তপাত হয়ে সে মারা গেল। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দা আমাকে ডিঙিয়ে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার জান্নাত হারাম করে দিলাম।
চরমপন্থীরা ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার পেছনে যে সব কারণগুলো রয়েছে তা নি¤œরূপ- ক. গোঁড়া মনোভাব, খ. সমন্বিত জ্ঞানের বা ব্যাপক জ্ঞানের অভাব, গ. অহঙ্কার, ঘ. বক্র স্বভাব ও চিন্তাÑ এ ধরনের লোকেরা খুবই অপরিণামদর্শী হয়ে থাকে। তাদের বক্র চিন্তার কারণে তারা যেমন নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে ঠিক তেমনি ইসলামী জীবনব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে একমাত্র আল্লাহর খাস বান্দা বলে মনে করে, যা তাদের অহঙ্কারের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়, ফলে তারা তাদের মত যারা চলতে পারে না তাদেরকে কাফের বলে মনে করে এবং তাদেরকে হত্যা করা সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করে। এ ধরনের অহঙ্কার ও একপেশে মানসিকতা পরিহারের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) কঠোর ভাষায় তাগিদ দিয়েছেন। ‘যখন কেউ বলবে যে, লোকজন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, সে ব্যক্তি নিজকেই ধ্বংস করলো।
ঈমানদার ব্যক্তিকে কাফির বলা এক ধরনের ফিতনার সৃষ্টি করে যা সামাজিক অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ। এর বিষময় ফল সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত তার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। ফিতনা বা বিপর্যয়ের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মজিদে বলেছেন, ‘ফিতনা বা বিপর্যয় হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ’। একই প্রসঙ্গে আল্লাহর নবী (সা) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা তাদের দু’জনের ওপর বর্তাবে। যদি তার ভাই সত্যিকার কাফির হয় তবে তো ঠিক অন্যথায় কাফির আখ্যায়িতকারীর ওপরই কুফর প্রযোজ্য হবে।

রাসূল (সা)-এর জীবন ছিল সহনশীলতা ও ক্ষমার এক অনুপম আদর্শ। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনো তিনি কাউকে আঘাত করেননি, কখনো কটু কথা বলেননি। কোন বিষয়ে তার অপছন্দ হলে বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখমন্ডল লাল হয়ে যেত কিন্তু কখনো তাঁকে দেখা যেত না কাউকে কোন ধরনের কটু কথা বলতে। তিনি ছিলেন সত্যিই বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর রহমত ও দয়ার সাগর। তাঁরই হাদিসের ভাবানুবাদ করে কবি বলেছেন, কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত গিয়ে লাগে কাবার ঘরে। ‘ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রার ঔদার্যের ও মহানুভবতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি ইসলামের একটি সার্বজনীন নীতি। তাই ক্ষমাধর্মের প্রতিই ইসলামের সর্বাধিক অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। যতক্ষণ না তদ্বারা অন্য কারো হক বিনষ্ট হয়, কিংবা বাতিল শক্তি পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টির কোন প্রকার আশ্রয় প্রশ্রয় লাভ করে। কিংবা এর অপব্যবহারের মাধ্যমে মানবতার ভয়াবহ সমূহ বিনাশ সাধনের কোন পরিস্থিতি পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, অবাধে অন্যায় অবিচার, অনাচার, পাপাচার, নৈরাজ্য ও ধ্বংস সাধনে লিপ্ত মানবরূপী হিংস্র পশুদের সাথে আপস করার মানসিকতাকে কোনভাবেই মহানুভবতা বলা যায় না, তা হচ্ছে নিছক কাপুরুষতা, ভীরুতা, আত্মগ্লানি ও সত্যের অবমাননা।

অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারকে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দূরীভূত করার মাধ্যমে স্পল্পসংখ্যক জালেমের হস্ত ও কণ্ঠ স্তব্ধ করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মজলুমের মুখে হাসি ফোটানো অবশ্যই মহৎ কাজ। রাসূল (সা)-কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্যায়ের জবাব ন্যায়ের মাধ্যমে দানের কথা বলেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়, আর আপনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দিন। তখন আপনি দেখবেন এ পন্থায় আপনার পরম শত্রুরাও পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেছে। এ আয়াতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে আল্লাহর নবীর (সা) জীবনে। তিনি আজীবন মন্দের জবাব দিয়েছেন উত্তম পন্থায়। এ কারণে অমুসলিমরা দলে দলে তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তাঁকে হত্যা করতে এসে তরবারি রাসূলের (সা) পদতলে লুটিয়ে দেন।

যেখানে আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর প্রাণের শত্রুকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার সাথে সাথে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন একইসঙ্গে চরমপন্থা ও কঠোর আচরণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। অতএব তার অনুসারী হিসেবে কারো সাথে কঠোর ব্যবহার করার সুযোগ আমাদের কোথায়?

মানবজাতির ইতিহাসে চরমপন্থী দলের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদি উগ্রবাদী ধার্মিকগণ, ধমীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীন যুগের প্রসিদ্ধতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রপন্থী এ সকল ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য  আপসহীন ছিল। সে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। এ জন্য এরা ছুরিমানব হিসেবে পরিচিত ছিল। এরা এতখানি চরমপন্থী ছিল যে, তারা প্রয়োজনে আত্মহত্যা করত কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না। তাদের উওরসূরি এ ইহুদি জাতি কিভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ডকে অন্যায়ভাবে দখল করে কয়েক যুগব্যাপী পাখি শিকারের ন্যায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে তা বিশ্ব বিবেক দেখছে।
মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। পোপ ও স¤্রাটের  দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে এ সময়কে অরাজনৈতিক যুগ বলা হয়। অন্যদিকে এ যুগটি অন্ধকার যুগ হিসেবেও খ্যাত। এ সময়ে রাজনীতি, ক্ষমতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে চর্চারত প্রায় ৩৫ হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার কথা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়। এ সময়ের ক্যাথলিক ও পোটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ও যুদ্ধবহির্ভূত সন্ত্রাসের অসংখ্য ঘটনা ঘটে।
১৯৬০ সালের দিকে আরেকটি চরমপন্থী আন্দোলনের ঢেউয়ের কথা ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি। এসময় সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে ইতালির রেড ব্রিগেড এবং জার্মানির রেড আর্মি অন্যতম। ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কথা কে না জানে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী দল হিসেবে খারেজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ওসমান (রা) এর শাহাদতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দলের আগমন ঘটে। হযরত আলী (রা) ও আমিওে মোয়াবিয়ার (রা) মধ্যে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটলে হযরত আলী সালিসির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার  উদ্যোগ গ্রহণ করলে তারই অনুসারীদের মধ্য থেকে চরমপন্থী একটি দল বেরিয় যায়। এদেরকে খারেজি বা দলত্যাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরা ছিল ইসলামের দ্বিতীয় যুগের মানুষ। যারা রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরই ইসলাম গ্রহণ করে। এদের প্রায় সকলেই ছিল যুবক।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি ইসলাম মানবতার ধর্ম, যার মূলভিত্তি সহনশীলতা, ভালোবাসা ও ক্ষমা। কোন ব্যক্তির বক্তব্য ইসলামের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে না। প্রাধান্য পাবে কেবল কুরআন ও হাদিস বিশেষত মুহাম্মদ (সা) এর কৃতকর্ম। এ থেকে আমরা দেখতে পাই ইসলামে চরমপন্থার কোনো স্থান নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

Thursday, January 24, 2019

ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করো । জাফর আহমাদ


ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করা আল-কুরআনের অনুসারীদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আচ্ছা তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তাকে যে ব্যক্তি সত্য মনে করে আর যে ব্যক্তি এ সত্যটির ব্যাপারে অন্ধ, তারা দু’জন সমান হবে; এটা কেমন করে সম্ভব? উপদেশ তো শুধু বিবেকবান লোকেরাই গ্রহণ করে। আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন হয় যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না। তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখার হুকুম দিয়েছেন সেগুলো তারা অক্ষুণ্ণ রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসাব না নেয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই।” (সূরা আর রাদ-১৯-২২)
আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন, “হে নবী সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকি দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।” (সূরা হা-মিম আস সেজদা : ৩৪)
উল্লেখিত আয়াতে বিবেকবান মু’মিনের কর্মপদ্ধতি, নীতি ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছো :
কর্মপদ্ধতি
“তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না।” এটি হচ্ছে অনন্তকালীন অঙ্গীকার যা সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ সমস্ত মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তিনি অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, মানুষ একমাত্র তাঁর বন্দেগি করবে। সূরা আরাফের ১৭২ নম্বর তা আরো স্পষ্ট আকারে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “আর হে নবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন: আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলে ছিলো: নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা তো জানতাম না।” প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকে নেয়া এ অঙ্গীকার তার প্রকৃতির মধ্যে মিশে আছে। মায়ের গর্ভ থেকে মৃত্যু অবদি অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব লাভ এবং তাঁর প্রতিপালন কর্মকাণ্ডের আওতাধীনে সে প্রতিপালিত হতে থাকে তখই এটি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর রিজিকের সাহায্যে জীবন যাপন করা, তাঁর সৃষ্ট প্রত্যেকটি বস্তুকে কাজে লাগানো এবং তাঁর দেয়া শক্তিগুলো ব্যবহার করা- এ গুলো মানুষকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে একটি বন্দেগির অঙ্গীকারে বেঁধে ফেলে। কোন সচেতন, বিবেককান ও বিশ্বস্ত মানুষ এ অঙ্গীকার ভেঙে ফেলার সাহস করতে পারে না।
নীতি
“তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষুণœ রাখার হুকুম দিয়েছেন সেগুলো তারা অক্ষুণœ রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসাব না নেয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে।” এমন সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও সাফল্য নিশ্চিত হয়। বিশ্ব মুসলিমদের মাঝে অশান্তির প্রধান কারণ হলো, তারা আজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শতধা বিভক্ত হয়ে গেছে। হোক তাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বা হোক তা ধর্মীয়। আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের কড়ায় গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে সে ভয়ও তাদেরকে বিচলিত করে না। অথচ স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা: এ হিসাবের ভয়েও বিচলিত হতেন। তিনি হযরত আয়েশা রা:কে নামাজে এ দো’আ করতে শিখিয়েছেন “আল্লাহুম্মা হাসিবনি হিসাবাই ইয়াসিরা” হে আল্লাহ! আমার হিসাব নিও সহজ করে।
কার্যক্রম বা বৈশিষ্ট্য
“তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই।” তারা সবর করে মানে নিজেদের প্রবৃত্তি ও আকাক্সক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, অনুভূতি ও ঝোঁক প্রবণতাকে নিয়ম ও সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখে, আল্লাহর নাফরমানিতে বিভিন্ন স্বার্থলাভ ও লোভ-লালসার চরিতার্থ হওয়ার সুযোগ দেখে পা পিছলে যায় না এবং আল্লাহর হুকুম মেনে চলার পথে যেসব ক্ষতি ও কষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয় সেসব বরদাশ্ত করে যেতে থাকে। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে মু’মিন আসলে পুরোপুরি সবরের জীবন যাপন করে। কারণ সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এবং আখেরাতের স্থায়ী পরিণাম ফলের প্রতি দৃষ্টি রেখে এ দুনিয়ার আত্মসংযম করতে থাকে এবং সবরের সাথে মনের প্রতিটি পাপ প্রবণতার মোকাবেলা করে। নামাজ কায়েম করে। সমাজে পুরোপুরি নামায যাতে চালু হয়ে যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করে। আর আল্লাহর দেয়া রিজিক হতে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে। ফরজ খরচ তথা যাকাত এবং অন্যান্য সাদাকা এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করে।
তারা মন্দের মোকাবেলায় একই মন্দ বা অন্য কোন মন্দ কাজ দিয়ে করে না বরং মন্দের মোকাবেলায় ভালো কোন কাজের মাধ্যমে করে। অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য অন্যায়ের সাহায্য গ্রহণ না করে ন্যায়ের সাহায্য গ্রহণ করে। কেউ তাদের প্রতি যতই জুলুম করুক না কেন তার জবাবে তারা পাল্টা জুলুম করে না বরং ইনসাফ করে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে যতই মিথ্যাচার করুক না কেন জবাবে তারা পাল্টা সত্যই বলে। কেউ তাদের সাথে যতই বিশ্বাস ভঙ্গ করুক না কেন জবাবে তারা বিশ্বস্ত আচরণই করে থাকে। রাসূলুল্লাহর সা: নিম্নোক্ত হাদিসটি এ অর্থই প্রকাশ করে: “তোমরা নিজেদের কার্যধারাকে অন্যের কর্মধারার অনুসারী করো না। এ কথা বলা ঠিক নয় যে লোকেরা ভালো করলে আমরা ভালো করবো এবং লোকেরা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করবো। তোমরা নিজেদেরকে একটি নিয়মের অধীন করো। যদি লোকেরা সদাচরণ করে তোমরাও সদাচরণ করো। আর যদি লোকেরা তোমাদের প্রতি অসৎ আচরণ করে তাহলে তোমরা জুলুম করো না।” রাসূলের সা: আরেকটি হাদিস একই অর্থ প্রকাশ করে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ আমাকে নয়টি কাজের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি এ চারটি কথা বলেছেন : কারো প্রতি সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট যাই থাকি না কেন সর্বাবস্থায় আমি যেন ইনসাফের কথা বলি। যে আমার অধিকার হরণ করে আমি যেন তার অধিকার আদায় করি। যে আমাকে বঞ্চিত করবে আমি যেন তাকে দান করি। আর যে আমার প্রতি জুলুম করবে আমি যেন তাকে মাফ করি। একই অর্থ প্রকাশ করে নিম্নের হাদিসটিও। “যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।” হযরত উমরের রা: উক্তিটিও এ অর্থ প্রকাশ করে : “যে ব্যক্তি তোমার প্রতি আচরণ করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে না তুমি আল্লাহকে ভয় করে তার প্রতি আচরণ করো।”
এ ভাগ্যবান কারা
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।” (সূরা হা-মিম আস সেজদা : ৩৫) অসৎ কর্ম বা দুষ্কর্মকে সৎকর্ম দ্বারা মোকাবেলা করা কোন ছেলেখেলা নয়। এ জন্য দরকার সাহসী লোকের। এ জন্য দরকার দৃঢ়সঙ্কল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। কেবল সেই ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে যে বুঝে শুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকি ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামি তাকে তার উচ্চাসন থেকে নামিয়ে আনতে সফল হতে পারে না। অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার মানুষই কেবল এসব গুণাবলির অধিকারী হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি এসব গুণাবলির অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনযিলে মকসুদে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নিচু প্রকৃতির মানুষ তাদের হীন চক্রান্ত জঘন্য কৌশল এবং কুৎসিৎ আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
পুুরস্কার
এ ব্যক্তিদের সাথে আখেরাতে কি ধরনের আচরণ করা হবে নিম্নোক্ত আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : “আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই। তারা নিজেরা এতে প্রবেশ করবে এবং তাদের সাথে বাপ-দাদারা ও স্ত্রী-সন্তানদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে তারাও তাদের সাথে সেখানে থাকবে। ফেরেশতারা সবদিক থেকে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আসবে এবং বলবে : “তোমাদের প্রতি শান্তি। তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে তোমরা এর অধিকারী হয়েছো।” -কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের গৃহ!” (সূরা আর রাদ : ২২-২৪) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, “যারা আত্মসংযমী তাদেরকে বিনা হিসেবেই প্রতিদান দেয়া হবে।” ওমর রা: বলেন, “যখন আমরা আত্মসংযমী ছিলাম, তখনকার জীবনই সুন্দর ছিল।” (বুখারি কিতাবুর রিকাক)
লেখক : ইসলামী গবেষক

Thursday, December 27, 2018

রাসূলুল্লাহ সা.-এর লোক গঠন পদ্ধতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন । মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ


নবী মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ সালে নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়ে মক্কা বাসীর নিকট আহবান জানালেন যে, হে আমার কওম! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। 
তিনি মক্কার কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বলেছিলেন, তোমরা আমার একটা কথা মেনে নাও তাহলে তোমরা আরবের বাদশাহ্ হবে এবং অনারবরা তোমাদের অধীনে চলে আসবে। তিনি ২৩ বছর নবুয়তি জীবনে আল্লাহ পাকের সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াত) প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে যে সকল লোক পেয়েছিলেন তাদেরকে তিনি দেশ জাতি ও সমাজ পরিচালনার যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন এবং গোটা আরবের ইসলামবিরোধী শক্তির সঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।
রাসূল (সা.) লোক গঠনপদ্ধতি নিম্নরূপ
লোকগঠনের গুরুত্ব সম্পর্কে সূরা নূরের ৫৫ আয়াতে আল কুরআনের বক্তব্য আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে (মুমিনিন, সালিহিন) তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয় ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দিবেন। তারা শুধু আমার বন্দেগি করুক এবং আমার সাথে কাউকে শরিক না করে।
মু’মিনিন ও সালেহিনের পরিচয়
সূরা বাকারা, আয়াত : ১৭৭ অর্থ : তোমাদের মুখ পূর্ব দিক বা পশ্চিম দিকে ফিরাবার মধ্যে কোন পুণ্য নেই। বরং সৎ কাজ হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ, কিয়ামতের দিন, ফেরেশতা, আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও নবীদেরকে মনে প্রাণে মেনে দিবে এবং আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণ প্রিয় ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থী ও কৃতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে। আর নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করবে এবং বিপদে অনটনে ও হক-বাতিলের সংগ্রামে সবর করবে তারাই সৎ ও সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকি। 
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১৩-১১৪ অর্থ : যারা রাতে আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করে এবং সিজদারত থাকে তারা ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং তারা ভাল কাজের আদেশ করে মন্দ কাজ থেকে বারণ করে এবং মানব কল্যাণে তৎপর থাকে এরা সালেহিন লোকদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪-১৩৫ অর্থ : যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষত্রুটি মাফ করে দেয়। এই ধরনের সৎ লোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালবাসেন। আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গুনাহের কাজ করে নিজেদের উপরে জুলুম করে বসলে আবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গুনাহ খাতার জন্য মাফ চায়- কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গুনাহ মাফ করতে পারেন- এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না।
রাসূল (সা.)-এর মু’মিনিন ও সালেহিন তৈরিতে দুই দফা কর্মসূচি
প্রথম দফা কর্মসূচি : ইসলামের জ্ঞান অর্জন ও চরিত্রগঠন: 
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪ অর্থ : ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান (হিকমা) শিক্ষা দেয়া। অথচ এর আগে এই লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত ছিল। 
উপরোক্ত আয়াতে চার দফা কর্মসূচি পেশ করা হয়েছে: 
এক. আয়াতের তেলাওয়াত অর্থাৎ আয়াতের অধ্যয়ন, অনুধাবন ও অনুসরণ। 
দুই. কিতাবের জ্ঞান অর্থাৎ কিতাবের আইন কানুন, বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান। 
তিন. হিকমত শিক্ষা দেয়া অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি, ইজতিহাদ করার শক্তি, দ্বীনের গভীর তত্ত্বজ্ঞান, জীবন সমস্যার ক্ষেত্রে সঠিক মত প্রকাশের যোগ্যতা। 
চার. তাজকিয়া অর্থাৎ জীবন পরিশুদ্ধ করা- কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচারণ অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা।
দ্বিতীয় দফা কর্মসূচি : বিপদ আপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করা: 
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪০-১৪২ অর্থ : এ সময় এ অবস্থা তোমাদের এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মু’মিন কে আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আর জালিমদের আল্লাহ পছন্দ করেন না এবং আল্লাহ যাতে নির্মাণ করতে পারেন মুমিনদের আর নিপাত করতে পারেন কাফেরদের। তোমরা কি মনে করে রেখেছো, এমনিতেই জান্নাতের প্রবেশ করবে? অথচ এখনও আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ সংগ্রাম করতে প্রস্তুত এবং কে তার জন্য সবরকারী। 
সূরা হাদিদ, আয়াত : ২২ অর্থ : পৃথিবীতে এবং তাদের নিজেদের উপর যে সব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে, তাকে আমি সৃষ্টি করার পূর্বেই একটি গ্রন্থে লিখে রাখিনি। 
ব্যাখ্যা : আল্লাহ তায়ালা যে বিরাট কাজ আঞ্জাম দিতে চান উক্ত মুসিবতের মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি, এ প্রশিক্ষণ ছাড়াই যদি সফলতার স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হয় তাহলে মুমিনদের চরিত্রে এমন সব দুর্বলতা থেকে যাবে যার কারণে মু’মিনরা না পারবে মর্যাদা ও ক্ষমতার গুরুপাক খাদ্য হজম করতে না পারবে বাতিলের প্রলয়ঙ্করী তুফানের চরম আঘাত সহ্য করতে। 
বিপদ মুসিবত, সমস্যা ও সংকটের পথ অতিক্রম করে মুমিনদেরকে অর্জন করতে হবে সবর, সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্মোৎসর্গিতা, ঈমানী দৃঢ়তা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা। এসব গুণাবলি কেবলমাত্র কঠিন বিপদ সংকুল গিরিপবর্তেই লালিত হতে পারে। (তাফহীমূল কুরআন)

নবী মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ সালে নবুয়ত লাভের মাধ্যমে লোক তৈরির যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সে সকল তৈরি লোকদের দ্বারাই ৬৩৬ সালে কাদেসিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ও ৬৩৭ সালে জেরুজালেম যুদ্ধের মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের পতন সংঘটিত হয়। মাত্র ২৭-২৮ বছরের তৈরি নেতৃত্বের মাধ্যমে মুসলমানগণ যে ইসলামী সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল সে সভ্যতা দীর্ঘকাল পর্যন্ত বিশ্বের মানুষদেরকে শোষণমুক্ত ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল।


বিপদে-আপদে মনোক্ষুন্ন না হওয়ার আহবান
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪৬ অর্থ : এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছেন, যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যে সব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৪ অর্থ : তাদেরকে বলো! তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও অবস্থান করতে তাহলেও যাদের মৃত্যু অবধারিত ছিল তারা নিজেরাই নিজের বদ্ধভূমির দিকে এগিয়ে আসতো।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৩ অর্থ : যা কিছু তোমাদের হাত থেকে বের হয়ে যায় অথবা যে বিপদই তোমাদের ওপর নাযিল হয় সে ব্যাপারে মনোক্ষুন্ন হবে না, আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে জানেন। 
সূরা হাদিদ, আয়াত : ২২-২৩ অর্থ : পৃথিবীতে এবং তোমাদের ওপর যে সব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে তাদের আমি সৃষ্টি করার পূর্বে একটি গ্রন্থে লিখে রাখিনি। এমনটি করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ কাজ। (এ সবই এ জন্য) যাতে যে ক্ষতিই তোমাদের হয়ে থাকুক তাতে তোমরা মনোক্ষুন্ন না হও।
বিরোধীদের ব্যাপারে আল্লাহ পাকের বক্তব্য
সূরা আহযাব, আয়াত : ৪৮ অর্থ : কখন দমিত হয়ো না কাফের, মুনাফিকদের কাছে, পরোয়া করোনা তাদের পীড়নকে এবং ভরসা করো আল্লাহর প্রতি।
সূরা মুহাম্মদ, আয়াত : ৩৫ অর্থ : তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির জন্য আহবান করো না, তোমরাই বিজয়ী থাকবে, আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।
সূরা আল কলম, আয়াত : ৪৪-৪৫ অর্থ : তাই হে নবী এই বাণী অস্বীকারকারীদের ব্যাপারটি আমার ওপরে ছেড়ে দাও। আমি ধীরে ধীরে এমনভাবে তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবো যে তারা বুঝতেই পারবে না। আমি তাদের রশি ঢিলে করে দিচ্ছি আমার কৌশল অত্যন্ত মজবুত।
সূরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ১১ অর্থ : এ মিথ্যা আরোপকারী সম্পদশালী লোকদের সাথে বুঝা পড়ার ব্যাপারটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, আর কিছু কালের জন্য এদেরকে এই অবস্থায় থাকতে দাও।
সফলতার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের বক্তব্য
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬০ অর্থ : আল্লাহ যদি তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে কোন শক্তিই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। আর তিনিই যদি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তাহলে এর পরে কে আছে তোমাদের সাহায্য করার মতো! কাজেই সাচ্চা মু’মিনদের আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ২০০ অর্থ : হে ঈমানদারগণ, তোমরা ব্যক্তিগত বিপদ-আপদে সবর করো। (ইসলামের) প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় সবর করো। (ইসলামের) প্রতিপক্ষের মোকাবেলার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পারো।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯ অর্থ : মন মরা হয়ো না, দুঃখ করো না তোমারই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।
সূরা তুর, আয়াত : ৪৮ অর্থ : হে নবী! তোমার রবের ফায়সালা আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করো। তুমি আমার চোখে চোখে আছে। তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করো।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
১-৩ নবুয়তি বছর গোপনভাবে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমে ৪৬ জন ইসলাম গ্রহণ করেন। 
৪র্থ নবুয়তি বছর প্রকাশ্য ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমে শুরু হয়। 
৫ম নবুয়তি বছরের শুরুতে কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করে প্রথমে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলাসহ মোট ৮৩ জন পুরুষ ১১ জন মহিলা ও ৭ জন অ-কুরাইশি। এ সময় নবী করীম (সা.) এর সাথে মাত্র ৪০ জন সাহাবী থেকে গিয়েছিল। (তাফহীম সূরা মারিয়ামের ভূমিকা।) 
৬ষ্ঠ নবুয়তি বছরের শেষের দিকে হযরত হামজা (রা.) ও হজরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণ করেন। 
৭ম থেকে ৯ম নবুয়তি বছর অর্থাৎ তিন বছর শিয়াবে আবু তালিবে অন্তরীণ হয়ে থাকতে হয়।
১০ম নবুয়তি বছরে আবু তালিব ও হজরত খাদিজার মৃত্যুর পরে কুরাইশদের অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছালে তিনি মক্কা ছেড়ে তায়েফে দাওয়াতি কাজে যান। 
১১তম নবুয়তি বছরে হজের সময় মদিনার ৬ জন ইসলাম গ্রহণ করেন। 
১২তম নবুয়তি বছরে হজের সময় মদিনা থেকে ১২ জন এসে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ঐ বছর মেরাজ অনুষ্ঠিত হয়। 
১৩তম নবুয়তি বছরে হজের সময় মদিনার ৭৩ জন নর-নারী ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরত অনুষ্ঠিত হয়। 
** ১ম হিজরি সনে মদিনায় গিয়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। উক্ত ইসলামী রাষ্ট্রকে উৎখাত করার জন্য কুরাইশদের নেতৃত্বে আরবের সকল কুফরি শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে। কুফরি শক্তির মোকাবেলায় মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য নবী মুহাম্মদ (সা.) কে বিভিন্ন যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়। 
১ম হিজরি সনে রমজান মাসে সারিয়া সিফ্ফুল বাহার ও জিলকদ মাসে সারিয়া খাররার অনুষ্ঠিত হয়। 
২য় হিজরি সনে বদরের যুদ্ধ ও বনু কায়নুকার সাথে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। বদর যুদ্ধে ৮৬ জন মুহাজির, ৬১ জন আউস গোত্র ও ১৭০ জন খাজরাজ গোত্রের লোক ছিল।
৩য় হিজরি সনে ওহুদ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। 
৪র্থ হিজরি সনে রবিউল আউওয়ালে বনু নাজিরের সাথে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। 
৫ম হিজরি সনে খন্দকের যুদ্ধ ও বুন কুরায়জার সাথে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। 
৬ষ্ঠ হিজরি সনের বনু মুস্তালিক যুদ্ধ ও হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুষ্ঠিত হয়। 
৭ম হিজরি সনে খায়বার যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। 
৮ম হিজরি সনে মূতার যুদ্ধ ও মক্কা বিজয় হয়। 
৯ম হিজরি সনে তাবুকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। 
১০ম হিজরি সনে বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। 
লক্ষ করার বিষয় ১০টি বছর ধরে একটু নিরাপদ স্থানে যাদের (হিজরতের পূর্বে মুসলমানদের) দাঁড়াবার যায়গা ছিল না পরবর্তী ১০ বৎসরে ১০ লক্ষ সাতাশ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃৃত, বাংলাদেশের ১৯গুন বড় বিশাল ভূখণ্ডের তাঁরাই হলেন শাসক দল যাঁরা শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করলেন।
নবী মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ সালে নবুয়ত লাভের মাধ্যমে লোক তৈরির যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সে সকল তৈরি লোকদের দ্বারাই ৬৩৬ সালে কাদেসিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ও ৬৩৭ সালে জেরুজালেম যুদ্ধের মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের পতন সংঘটিত হয়। মাত্র ২৭-২৮ বছরের তৈরি নেতৃত্বের মাধ্যমে মুসলমানগণ যে ইসলামী সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল সে সভ্যতা দীর্ঘকাল পর্যন্ত বিশ্বের মানুষদেরকে শোষণমুক্ত ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে ইসলামী আদর্শের আলোকে পরিপূর্ণভাবে না হলেও মুসলমানগণ ১৭৫৭ সালে বাংলায় মুসলমানদের শাসন পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ শত বৎসরেরও অধিক সময় বিশ্ব সভ্যতার নেতৃত্ব প্রদান করে ছিল।

Monday, December 3, 2018

যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না । জালাল উদ্দিন ওমর


বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরীর পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশুন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। নিংসন্দেহে এটা একটি বিরাট অর্জন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরীর ইন্ডাষ্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র গত ৫ই নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে আবারো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরানের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস জ্বালানী তেলের রফতানি শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনার মাধ্যমে ইরানের অর্থনীতি দুর্বল করা এবং এর মাধ্যমে ইরানের সরকার পরিবর্তনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এই অর্থনৈতিক অবরোধকে ইসরাইল বরাবরের মতই সমর্থন জানিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি অত্যন্ত দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে -তারা কিছুতেই এই অবরোধ মানবেনা এবং এই অবরোধকে তারা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাবে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীন বরাবরের মতই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের নিন্দা জানিয়েছে এবং তারা ইরানের পাশে দাড়িয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এই অবরোধের বিরোধিতা করেছে। এভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে বিশ্ব বরাবরের মতই বিভক্ত হয়েছে এবং অনেক শক্তিশালী দেশ ইরানের পাশে দাড়িয়েছে। আর এটা ইরানের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। সুতরাং ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না বরং সময়ের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী হবে।
ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসুচি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি। ইরান যদি ও বারবার বলেছে- তার পরমাণু কর্মসুচী শান্তিপূর্ন এবং এটা তার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য, তবু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশংকা ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরীর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এজন্যই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দীর্ঘ বৈরিতা এবং দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ করার জন্য ২০১০ সালের ৯ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ইরানের বিরুদ্ধে এর আগেও তিন বার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিগত ২০১৫ সালের ১৪ ই জুলাই অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইরানের পরমাণুু কর্মসুচি নিয়ে ইরানের সাথে বিশে^র ছয় পরাশক্তির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির একপক্ষ হচ্ছে ইরান আর অপর পক্ষ হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ -যুক্তরাষ্ট্র ,রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। তবে ইসরাইল বরাবরই এই চুক্তির বিরোধীতা করেছে। চুক্তিটি ওই বছরের ২০ শে জুলাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। চুক্তিটির সার সংক্ষেপ হচ্ছে – ইরান একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত তার পরমাণু কর্মসুচী চালাবে, তবে পরমাণু বোমা বানাবে না। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অথনৈতিক অবরোধ উঠে যায়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসুচী নিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা এবং বাকযুদ্ধ ছিল তা থেকে বিশ্ববাসী আপাতত মুক্তি পায়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই ইরানের সাথে সম্পাদিত এই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলতে থাকেন এবং অবশেষে ২০১৮ সালের ৮ ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আবারো অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। তবে ইরানের সাথে সম্পাদিত চুক্তির অবশিষ্ট পাঁচটি দেশ – রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি এই চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন। 
ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ এবং ইরানকে দুর্বল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের যে অবিরাম প্রচেষ্টা তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী ধ্বংস হবে না এবং ইরান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও হবে না। তবে সাময়িক সমস্যায় পড়বে মাত্র, যা কাটিয়ে উঠা ইরানের পক্ষে কঠিন হবে না। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তো বরাবরই আরোপিত ছিল। এবারের অবরোধ ও অতীতের অবরোধের মতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সেই ১৯৭৯ সালে খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের সাথে ইরানের বৈরিতা চলছে। এই বৈরীতা চলে আসছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে। এসব মোকাবেলা করেই কিন্তু ইরান টিকে আছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ হয়ে যাবে এবং ইরান দুর্বল হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। মনে রাখতে হবে ইরান সবদিক দিয়ে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। আয়তন, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সবদিক দিয়েই ইরান অনেক শক্তিশালী। তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইরানের রয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। অধিকন্তু ইরানে ক্ষমতায় রয়েছে একটি বিপ্লবী সরকার, যাদের পিছনে রয়েছে শক্তিশালী ও স্বতঃস্ফূত জনসর্মথন, যারা কট্টর ইসলামপন্থী, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বিরোধী। সুতরাং ইরানের মত একটি দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সফলতা অর্জন করা কারো পক্ষে অতটা সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বিরোধ থাকলেও বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথেই তার রয়েছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের রয়েছে দীর্ঘদিনের গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক। দেশ দুটির সাথে ইরানের দীর্ঘদিনের এবং গভীর প্রযুক্তি এবং সামরিক সম্পর্ক ও রয়েছে। অপরদিকে কিউবা, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিলসহ অধিকাংশ ল্যাটিন আমেরিকার দেশের সাথেই ইরানের ভাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। একইভাবে উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের সাথে ও রয়েছে ইরানের সখ্যতা। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, ইরাক এবং সুদানের সাথে ইরানের রয়েছে নিবিড় একটি সম্পর্ক। একইভাবে ইসরাইলের চরম শত্রু ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে ইরানের রয়েছে অন্যরকম সেতুবন্ধন। এতগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে যার বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক অবরোধে তাকে দুর্বল করাটা সম্ভব নয়। আর ইরানের ব্যবসা বানিজ্য কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরাবরই কম। তাছাড়া এবারের অবরোধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আরোপিত । তার সাথে ইসরাইল ছাড়া কেউই নাই। পরমাণু সমঝোতা চুক্তি করে আবার সেই সমঝোতা চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়াটা আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি কর্তৃক চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে ।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি ইরান কিন্তু প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতে ও যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। ইরান এখন তৈরী করছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ী এবং মেশিনারী। ইরান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে কামান, ট্যাংক, রকেট এবং ভুমি থেকে ভুমিতে নিক্ষেপযোগ্য দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র। বিমানবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপ যোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র। একইভাবে নৌবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যন্ত দ্রুত গতির টর্পেডো আর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সফলতা অনস্বীকার্য। এদিকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরীর পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশুন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। নিংসন্দেহে এটা একটি বিরাট অর্জন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরীর ইন্ডাষ্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে। ইরান ঘোষণা করেছে সে উচ্চ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম এবং পরমাণু জ্বালানী সে বিদেশে রপ্তানী করবে। স্বাভাবিকভাবেই একথা নিশ্চিতে বলা যায় ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় একটি অবস্থান তৈরী করেছে, যার উপর ভিত্তি করে ইরানের অগ্রগতি শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি এখন ইরানীদের আয়ত্তে আর এটাকে এখন কেবল বিকশিত করার পালা। এ অবস্থায় ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানের জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং ইরানের বিজ্ঞানীদেরকে নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায় উদ্ধুদ্ধ করবে। আর এ নেশা ইরানীদেরকে এনে দেবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের সফলতা। যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এতটা সফলতা অর্জন করেছে সেই জাতি নিশ্চয়ই অবরোধের কাছে হার মানবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না বরং স্বনির্ভরতা অর্জন করবে।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক

Friday, November 30, 2018

পরামর্শভিত্তিক জীবন ও আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা মানবতার মুক্তির চাবিকাঠি । ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম


ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে দিন দিন জনসমর্থন বাড়ছে । হারুন ইবনে শাহাদাত

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর দমন পীড়নের চিত্র দেখে রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও আসল মিশন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। অনুগত বিরোধী দল রেখে বিশ্বের মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে বুঝাতে চায়- ‘তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় আন্তরিক’। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের নামে তারা যা চায় তা আসলে একদলীয় শাসন। কিন্তু ইতিহাস বলে এমন দুঃস্বপ্ন এদেশের জনগণ মেনে নেয় না। অতীতে যারাই জনগণের সাথে এমন চালাকি করছেন, তাদের পরিণতি ভালো হয়নি। এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানিদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করার দৃঢ়প্রত্যয়ে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তারা এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। অথচ স্বৈরাচারী শক্তি চেয়েছিল তাদেরকে ধ্বংস করতে কিন্তু পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক স্বৈরাচারের পতন হয়েছে গণআন্দোলনের মুখে। বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একই কায়দায় দেশে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল অভিযান শুরু করেছে। হামলা, মামলা, ফাঁসি, খুন, গুম, অপহরণ, জেল, জুলুম রিমান্ড থেকে শুরু করে দেশছাড়া পর্যন্ত করার হীন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে অব্যাহতভাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর ফলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, অপর দিকে বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক দলগুলোর পক্ষে দিন দিন জনসমর্থন বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট আজাদে প্রকাশিত মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জনগণেরও মৃত্যু নাই, গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নাই। তবু মাঝে মাঝে গণতন্ত্রের দম আটকাইয়া যায় আমাদের চোখের সামনেই। তার কারণ ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্টরা ওর গলা টিপিয়া ধরে।’ উল্লেখ্য প্রবন্ধটি পরে ‘শেরে-বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে।

নেতাতন্ত্র ইসলামে নেই
উপরে উল্লিখিত মরহুম আবুল মনসুর আহমদের উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে- ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের গণতন্ত্র কি ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্টদের কবলে পড়েছে? কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নয়, তারও আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের রক্তভেজা পল্টন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপদ ডেকে এনেছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরাই। তাদের ‘ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্ট’ নগ্ন আচরণের কারণে রাজনৈতিক ২০০৭ সালের ১/১১, অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি থেকেই গণতন্ত্র দম আটকানো অবস্থায় আছে। এর আগেও এদেশে গণতন্ত্রের দম অনেকবার আটকেছে। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফেরার পূর্ব পর্যন্ত এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকাল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মরহুম আমির অধ্যাপক গোলাম আযম প্রবর্তিত কেয়ারটেকার সরকার বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র একটু দম নেয়ার সুযোগ পায়। অবশ্য রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে অনেক সংকীর্ণমনা জ্ঞানপাপী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযমের এই চিরস্মরণীয় অবদান স্বীকার করতে চান না। অথচ যে সমাজতন্ত্রীরা বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস মনে করেন, তাদের গণতন্ত্রের মিত্র বলে গলা ফাটালেও তারা ইসলামকে গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করান। তারা অপপ্রচার চালান ইসলাম নেতাতন্ত্রে পরিচালিত। তাদের এই চিন্তা যে ভুল, তা আবুল মনসুর আহমদ অনেক আগেই বলে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, যে সামাজিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক গণতন্ত্রের বুনিয়াদ, সেটা মুসলমান সমাজে যত বেশি আছে আর কোনো সমাজে ততটা নেই। মানুষে-মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও সমান অধিকার, সকলের নজরে সকলের সমান মানবিক মর্যাদা মুসলমানের ধর্মীয় ঈমানের অঙ্গ। কাজেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতে, মুসলমান সমাজই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সবচেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র।’ নেতাতন্ত্রের জায়গা যে ইসলামে নেই উল্লিখিত প্রবন্ধে তাও পরিষ্কার করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। বলেছেন, ‘নেতাকে নির্ভুল ও বিচার-সমালোচনার ঊর্ধ্বে জ্ঞান করা নেতাতন্ত্রের মূল কথা। কিন্তু মুসলমানরা কোনোকালেই নেতাকে বিচার-সমালোচনার অতীত মনে করে নাই। তাদের পয়গাম্বর হজরত মুহাম্মদ জীবন-মৃত্যুর সাধারণ মানুষ, এটা তাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের শিক্ষা।’ জনগণকে বোকা বানিয়ে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে রাজনীতির মাঠ থেকে ইসলামপন্থীদের তাড়াতেই অপপ্রচার, জেল-জুলুম, মামলা-হামলা, ষড়যন্ত্র, খুন-গুম, হত্যা-নির্যাতনের বাক্স খুলেছে আধিপত্যবাদী শাসক ও তাদের দোসররা।
উন্নয়নের বুলিতে গণতন্ত্রবিমুখ হবে না জনগণ
১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট দৈনিক আজাদে মরহুম আবুল মনসুর আহমদের ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ নিবন্ধটি যখন প্রকাশিত হয়, সেই সময় ‘উন্নয়ন’ শব্দটি ছিল বহুল প্রচলিত। আইয়ুব খানের জাদুর স্পর্শে উন্নয়ন শব্দটি তখন অভিধান থেকে বের হয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। গণতন্ত্রের বিপরীতে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির অবস্থান তখন উচ্চমার্গে। ‘উন্নয়ন’র ঠেলায় মানুষের বাকস্বাধীনতাসহ সকল স্বাধীনতাই উর্দিওয়ালাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত। সেই সময় বিবেকের তাড়নায় বাধ্য হয়েই আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ এই নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি জাতির বিবেক জাগাতে চেয়েছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রী সরকার সুস্পষ্ট কারণেই একটু মন্থরগতি। গণতন্ত্রী দেশে আইন আছে, আইন পরিষদ আছে, ডিবেট আছে, খবরের কাগজের সমালোচনা আছে, জনমতের বাদ-প্রতিবাদ আছে। সে দেশে বাজেট করিয়া খরচ করিতে হয়, খরচ করিয়া হিসাব দিতে হয়; অপরপক্ষে ডিক্টেটরের দেশে এসব হাঙ্গামা নাই। আইন নাই, আইনসভা নাই, খবরের কাগজের সমালোচনা নাই, সভার প্রতিবাদ নাই। বাজেটও নাই, খরচের হিসাব-নিকাশও নাই। গৌরী সেনের টাকা খরচ করেন এক ব্যক্তি তার মর্জি-মোতাবেক।’

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এখন আমাদের মাঝে নেই। তাঁর উত্তরসূরি সুযোগ্য সন্তান ডেইলি স্টারের সম্পাদক জনাব মাহফুজ আনাম আছেন। তার অনেক ভক্ত অনুরক্তও আছেন। তারাও নিশ্চয়ই আবুল মনসুর আহমদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বীকার করবেন, ‘গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।’
আবুল মনসুর আহমদ তার সময়ের স্বৈরশাসকের যে চিত্র তুলে ধরেছেন একুশ শতকে তার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন স্বৈরতন্ত্রের সংজ্ঞাও দেশে দেশে বদল হয়েছে। স্বৈরশাসকরা নির্বাচন নির্বাচন নাটক মঞ্চস্থ করেন। তাদের জাতীয় সংসদ আছে। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো আইন তৈরি করেন। সংবিধান পরিবর্তন করেন। বাজেট ঘোষণা ও পাস করেন। শত শত সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেন। কিন্তু ডিবেট নেই, খবরের কাগজের সমালোচনা নেই, আছে শুধু ‘স্তব’ আর ‘স্তুতি’। সমালোচনার বদলে চালু হয়েছে ‘ভালোচনা’ তথা ‘স্তব’। আসলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই শাসকরা পাল্টে ফেলেন। তারা নিজের শাসনকাল ছাড়া আরো শাসনকালকে গণতান্ত্রিক বলে মনে করেন না। নিজের দল ছাড়া অন্য কোনো দলকেও গণতান্ত্রিক বলে মনে করতে চান না। বিপত্তির সূচনা হয় এখান থেকেই। এই মানসিকতার কারণেই গণতন্ত্রের জন্য জানপ্রাণ, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন রাজনৈতিক দলও ক্ষমতার লড়াইয়ে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ বেমালুম ভুলে যায়। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রশ্নে প্রতিদিন নেতারা কথা বলছেন। তাতে জনগণের লাভটা কী? ওসব তো ক্ষমতায় যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়। বর্তমান অবস্থায় পাতানো নির্বাচন নয়, একটি অতি সুষ্ঠু নির্বাচনও বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াও সমস্যার সমাধান হবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে আরেকটি নির্বাচিত সরকার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারবে না। তা যদি পারত, তাহলে ১৯৯১ সালের পর ’৯৬-এর নির্বাচনেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডে পরিণত হতো। তা না হওয়ার কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজটি নেতারা করেননি গত ৪১ বছরে। গণতন্ত্র বলতে তারা বুঝেছেন ভোটাভুটি করে কোনো রকমে ক্ষমতায় যাওয়া। গণতন্ত্র অন্য জিনিস। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর সংগ্রাম ক্ষমতায় যাওয়ার সংগ্রাম ছিল না। একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। সে জন্যই তিনি শ্রদ্ধেয়। শুধু তাঁর নিজের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী। ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তিনি এখনো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাকতেন। ২৭ বছর জেল খাটার জন্য তিনি শ্রদ্ধেয় নন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো : ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪)


ইসলামপন্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে

শত অত্যাচার নির্যাতনের পরও দেশে ইসলামপন্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বিগত দুই বছরে জনসমর্থন দ্বিগুণ বেড়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিগত পর্যবেক্ষণ এবং ২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপটি পরিচালনা করেছে নিয়েলসন-বাংলাদেশ। গত ২০১৫ সালে মে ও জুন মাসে আড়াই হাজার প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের ওপর চালানো এই মতামত জরিপের একটি প্রশ্ন ছিল আপনি কি জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন, এই প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ২৫ জন ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন। অথচ মোট প্রাপ্ত ভোটের হিসাব বিবেচনা করে গত ২০১৩ পর্যন্ত রাজনীতি বিশ্লেষকদের প্রতিটি প্রতিবেদনেই তারা বলেছেন, জামায়াতের জনসমর্থন শতকরা ১২-১৩। এই হিসেবে দলটির জনসমর্থন দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সাল থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় এই ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর অকথ্য নির্মম নির্যাতন অব্যাহত আছে। বিরামহীন অপপ্রচার, ভিত্তিহীন অভিযোগ, হয়রানি, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্যাতন, ফাঁসি, গুম, খুনসহ হেন কৌশল অপকৌশল নেই যা জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে না। তারপরও দলটির এগিয়ে যাওয়া এর বিরোধী শক্তির মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে দলটির প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ছে। অত্যাচার নির্যাতন করে সরকার ভুল করছে এতে সমর্থন আরো বাড়বে- এমন ইঙ্গিত ২০১৩ সালেই দিয়েছিলেন ইরানের এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক পীর মুহাম্মদ মোল্লাযেহি। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রেডিও তেহরান সূত্রে প্রকাশ, পীর মুহাম্মদ মোল্লাযেহি বলেন, ‘বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে দেশটির সরকার।
এ লড়াইয়ের শেষ বিজয়ে
গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনকারীদের জীবন সুখের হয় না। উপরে উল্লিখিত দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর জেলখানায় কাটাতে হয়েছে। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জেলখানায় কেটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতে যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন এবং বর্তমানেও যারা করছেন, কারো পথ ফুলবিছানো নয়। তবে বর্তমানের মুখোশপরা স্বৈরাচারদের সাথে আন্দোলন সংগ্রাম আগের চেয়ে অনেক কঠিন, এতে সন্দেহ নেই। কারণ কারো অজানা নয়। মুখোশের আড়ালে লুকানো মুখ যে বেশি ভয়ঙ্কর, তা-ও সবার জানা। কিন্তু তারপরও থেমে নেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের সাহসী সৈনিকরা। খুন, গুম, মামলা-হামলাসহ নানান অপপ্রচারের জাল ছিন্ন করে তারা জীবনবাজির শপথ নিয়ে এগিয়ে চলছে। ইতিহাস সাক্ষী এই পথচলার শেষ মঞ্জিল বিজয়ের স্বর্ণদুয়ার।

আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, ‘গণতন্ত্র ধ্বংসের এদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইবে। এরা নিজেরাই ধ্বংস হইবে। গণতন্ত্র ধ্বংস হইবে না। গণতন্ত্রের হায়াত ফুরায় নাই।… গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন মুল্লুক যে মুদ্দতে চাঁদে মানুষ নামাইতে পারিল, ডিক্টেটরের দেশ রাশিয়া সে মুদ্দতে তা পারে নাই।’ উন্নয়নের যুক্তিতেই হিটলার, মুসোলিনি, আইয়ুব; জার্মান, ইতালি আর পাকিস্তানে ‘নেতাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের পরিণতি কারো অজানা নয়। রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সেই ভুল পথে হাঁটবে না। গণতন্ত্রহীনতার দেশ থেকে মুক্তি দিতে আগামী নির্বাচনকে অবশ্যই বড় চান্স হিসেবে নিবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে একটি রাজনৈতিক দলের কোনো কিছু হারানোর ভয় থাকার কথা নয়। একটি গণতান্ত্রিক দলের সবচেয়ে বড় শক্তি গণভিত্তি। স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে সেই ভিত্তির মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম বলেন, ‘সরকার জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে গোটা দেশটাকেই এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সরকার দেশকে রাজনীতিশূন্য করে একদলীয় শাসন কায়েম করার ষড়যন্ত্র করছে।’ এ টি এম মাসুম মনে করেন, সরকার ষড়যন্ত্রের পথ ছেড়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে। তা না হলে জনগণই তাদের ফিরতে বাধ্য করবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যা হয়েছেÑ এমন কোনো নির্বাচন আর হবে না। আওয়ামী লীগ যদি ভাবে, বিএনপি নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে বন্দী রেখে তারা অতি আনন্দে আরেকটি ৫ জানুয়ারি বাস্তবায়ন করবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে মানুষ।’
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, ‘এ সরকার একদিকে গুম, খুন, হত্যা, মামলা দিয়ে জুলুমের রাজত্ব কায়েম করেছে; অন্যদিকে অবাস্তব, কাল্পনিক বাজেট দিয়ে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো লুট করে এখন জনগণের টাকায় ভর্তুকি দিচ্ছে। দেশে লাখ লাখ যুবক বেকার, কর্মসংস্থান নেই। অথচ মেগা প্রজেক্টের বাজেট দিয়ে মেগা দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচন চাই। তবে তা হতে হবে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে। আমাদের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, সব দলের জন্য সমান সুযোগ রাখতে হবে।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে একমত, অত্যাচার-নির্যাতন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা আখেরে সুফল বয়ে আনে না। ইতিহাস সাক্ষী নীরব নিরীহ জনগণ ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠলে তাকে সামাল দেয়ার ক্ষমতা কোনো স্বৈরশাসকের থাকে না। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন হত্যাকাণ্ডের পর দেশে আরো অনেক খুন, গুম, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এখনো ঘটছে কাঙ্ক্ষিত না হলেও হয়তো আরো ঘটবে। তার মানে এই নয়, জনগণের মৃত্যু ঘটবে, গণতন্ত্রের দাফন-কাফন হবে। চূড়ান্ত সত্য হলো জনগণকে হত্যা করে নিঃশেষ করা যায় না। গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নেই। অবশেষে জনগণেরই বিজয় হয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সিনিয়র সাংবাদিক

Wednesday, October 17, 2018

তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ড. রাশিদ ঘানুসি (২য় পর্ব) ।

[গত সংখ্যার পর]
২০১৩ সালের জুলাই মাসে বিরোধী দলের আরেকজন নেতা মুহাম্মদ ব্রাহিমি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে আবার অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় দেশটির শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন ইউজিটিটি সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগ নেয়। তাদের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিরোধী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মত হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে আননাহদা সরকার পদত্যাগ করে এবং তারপর মেহেদি জুমআর নেতৃত্বে টেকনোক্র্যাট সরকার গঠিত হয়।
আননাহদা কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়। এর ফলে দেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে। FRANCIS GHILÈS আননাহদার ভূমিকার প্রশংসা করে মন্তব্য করেন :
The resignation fosters a promising culture of peaceful transfer of power – a first in the Arab world. Before stepping down, however, Ennahda’s leaders – working with leaders from two secular-leaning political parties, al-Mu’tamar and al-Takattul -managed to reduce the level of violence in the country, stabilize the economy, draft a new constitution, and set the course for a transition to a permanent government though the ballot, not the bullet.
আননাহদা সরকার পরিচালনায় অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তাদের উদার মনোভাব পোষণ এবং সকল রাজনৈতিক দলের সাথে ডায়ালগ এর উদ্যোগ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। এককভাবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরিবর্তে সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান রচনা করে। এই সম্পর্কে Tunisia’s Higher Political Reform Commission প্রেসিডেন্ট Professor Yadh Ben Achour চমৎকার পর্যালোচনা করেন :
The constitution reflects the compromise that was found through discussion, between principles that include the respect of a nation’s religious identity as well as the implementation of modern democratic rules. It also reflects the sometimes substantial concessions made by both camps, which would not have been possible in a situation of extreme crisis.The Islamists in Tunisia conceded, significantly, the freedom of conscience or religious freedom, which no other Muslim-majority country has yet accepted. They agreed, for example, that Takfir – the accusation of apostasy, which could be interpreted as an invitation to murder – is a crime punishable by law. They also conceded that sovereignty lies with the people, and that politics must be governed by democratic norms.On the other hand, their opponents conceded that there is a sacred realm, which deserves to be protected and respected, which is part of the national identity, and which should not be exposed to hostile assaults.In Tunisia, there was recognition that at decisive moments such as during the design of a new constitution, the principle of majority rule could be divisive, and not allow a real rallying of all political perspectives.For this reason, the idea of building a consensus through dialogue, or ‘Tawafuq’, was seen as a pathway to better outcomes.
সংবিধান রচনায় আননাহদার দূরদর্শী পলিসির কারণে বিরোধী দল এই ইস্যুতে কোন আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ পায়নি। ফলে সামরিক হস্তক্ষেপ বা বৈদেশিক হস্তক্ষেপের কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আননাহদা শান্তিপূর্ণভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। আরব বসন্তের পর মিশরে ইখওয়ান ক্ষমতায় এলেও সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং হাজারো নেতাকর্মী শহীদ হয়। আরব বসন্তের পর লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। যার ফলে লিবিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর আলজেরিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ অস্থিতিশীল। আফ্রিকার ছোট একটি দেশ তিউনিশিয়াতে এই ধরনের কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হউক আননাহদা চায়নি। সাংবাদিক Neil Clarkযথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, Tunisia: Where the Arab Spring has not yet turned to winter ড. রাশিদ ঘানুসির ভাষায় ‘‘আরব বসন্তের পর তিউনিশিয়া একমাত্র দেশ যা এখনো বিপ্লবের আলোক শিখা জ্বালিয়ে রেখেছে।”
এই দিক থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে আননাহদা তাদের লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত কৌশলে এখন পর্যন্ত সফল। তিউনিশিয়া ভৌগোলিক অবস্থান মিশরের মত গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ তুলনামূলকভাবে কম। আর তিউনিশিয়াতে সিভিল সোসাইটির ভূমিকা বেশ কার্যকর হওয়ায় রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বরাবরই কার্যকর ভূমিকা রাখে (Tunisians have succeeded in keeping outside influence to a minimum. They trusted civil society institutions with mediating political dissent)।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদার পরাজয়
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ৩৭.৪৭% ভোট পেয়ে ৮৯ আসন নিয়ে সরকার গঠন করলেও ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ২৭.৭৯% ভোট পেয়ে ৬৯ আসন পায়। ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিস দল ২১৭ আসনের মধ্যে ৮৬ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। Popular Front ১৬ আসন , Free Patriotic Union ১৬ আসন ও Prospects for Tunisia ৮ আসন পায়। আননাহদা পরাজয়কে স্বীকার করে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায় (We have accepted this result and congratulate the winner)। মূলত দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই নির্বাচনে আননাহদার পরাজয় বরণ করে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মতপ্রকাশ করেন। নর্থ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞ Michael Willis বলেন, ‘the decline in Ennahda’s electoral popularity reflected public discontent with their handling of the economy. On the doorsteps, the economy was the main issue.”
দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার কারণে বেকার যুবকদের প্রত্যাশা পূরণ করা কঠিন ছিল। FRANCIS GHILÈS ২১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ সালে Tunisia: the Arab exception’s test শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধে তা এইভাবে তুলে ধরেন :
During the two years they governed Tunisia in 2012-13, the Islamists demonstrated their lack of interest, or inability, in addressing the economic and social problems of a modernising society. The Islamists favour free-wheeling – nay, crony – capitalism as do all authoritarian Arab regimes. Even more damming was their failure to control the hardline Salafi Islamists who not only resorted to violence in Tunisia but sent an estimated 3,000 of their number to Syria to join the war there. Such insecurity does little to attract domestic or foreign investment.
ANOUAR JAMAOUI Zuvi The decline of political Islam in Tunisia শীর্ষক প্রবন্ধে আননাহদার পরাজয়ের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আননাহদা নেতৃবৃন্দের সরকার পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তিউনিশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারই ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়। ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে দেশ পরিচালনা কত কঠিন সে অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। তাই তারা ট্রেড ইউনিয়ন, টেরোরিস্ট হামলা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক নানামুখী সমস্যা সমাধানে হিমশিম খায়। দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনা এক কথা নয়। আদর্শিক বক্তব্য দেয়া আর ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এক কথা নয়। বেকারত্ব দূর, কালোবাজারি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় জনগণের মধ্যে হতাশা জাগে। মিডিয়ায় অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালায় এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থা নিয়ে নানা ধরনের কল্পকাহিনী প্রচার করে। এই ক্ষেত্রে আননাহদার সমর্থনে উল্লেখযোগ্য কোন মিডিয়া ছিল না; তারাও বিকল্প মিডিয়া করতে ব্যর্থ হয়। আননাহদার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সফলতার সাথে প্রচারণা চালায় যে, ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। তাই তারা সকলে আননাহদার পরাজয়ের জন্য সকলে ঐক্যবদ্ধ ছিল। দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তারা আননাহদার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না এবং তারা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বেকার যুবকরা আননাহদার মাঝে তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আশা দেখতে পায়নি।

আননাহদা নেতৃত্ব আশাবাদী ছিল যে জনগণ সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের আমলের রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু এটা ছিল তাদের অলীক বাসনা। শরিয়াহ আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করায় ইসলামপন্থী একটি অংশ আননাহদার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। বিশেষভাবে সালাফি ইসলামপন্থীদের কট্টর ভূমিকাও আননাহদার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। আননাহদা স্বৈারাচারী বেনআলি সরকারে সংশ্লিষ্টদের বিচারের পরিবর্তে রাজনৈতিক ঐক্যকে গুরুত্ব দেয়। এর ফলে বিপ্লবের চেতনার সাথে তারা আপস করেছে বলে অনেকই অভিযোগ করে।
আননাহদার নেতৃবৃন্দের সাথে লেখকের আলোচনার সময় তাঁরা বলেন, সাবেক স্বৈরশাসকের সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তাই কোন দেশের অর্থনীতি চরম খারাপ অবস্থায় থাকলে ট্রানজিশনাল সময়ে ইসলামপন্থীরা প্রথম পর্যায়ে সরাসরি ক্ষমতায় না গিয়ে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করা ভালো। একটি বিষয় সকলেই স্বীকার করেন যে, আননাহদা ক্ষমতায় থাকাকালীন বিরোধীদের ওপর কোনো ধরনের দমন পীড়ন চালায়নি। অথচ তারা দীর্ঘদিন দমন পীড়নের শিকার হয়েই ক্ষমতাসীন হয়। তারা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সংলাপ এর আয়োজন করে। একটি বৈরী পরিবেশে সকলকে সাথে নিয়ে দেশের সংবিধান রচনা করায় তারা কৃতিত্বের দাবিদার। নারী-পুরুষের অধিকার সংরক্ষণ, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা আরব বসন্তের হাওয়া কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। এর ফলেই তিউনিশিয়াতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। FRANCIS GHILÈS আননহাদার ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা করে মন্তব্য করেন : It did not control citizens via hellish surveillance machinery, and did not disrupt the political activities of its political rivals. Ennahda indeed encouraged national dialogue between political contenders. It is also true that Ennahda contributed actively to the adoption of the first democratic and consensual Arabconstitution that guarantees equality between men and women, freedom of expression, freedom of conscience, freedom of thought, the right of association, and the right to difference and political pluralism. As an Islamist political party, Ennahda was able to provide an example of a peaceful handover of power।
সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আননাহদার ভূমিকার কারণেই Tunisian National Dialogue Quarter শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। নোবেল পুরস্কার কমিটি পোপ ফ্রান্সেস ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের পরিবর্তে তিউনিশিয়ার ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টারকে কী কারণে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করে তা এইভাবে উল্লেখ করে : The Nobel Peace Prize Committee confounded expectations Friday — bypassing figures such as Pope Francis and German Chancellor Angela Merkel — and handed the award to the Tunisian National Dialogue Quartet for its decisive contribution to the building of a pluralistic democracy in the country in the wake of the Jasmine Revolution of 2011.
তিউনিশিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়াটার ২০১৩ সালে মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন, সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় গুপ্ত হত্যার পর যখন সামাজিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় এবং গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ডায়ালগ কোয়াটার শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নোবেল কমিটি তাদের স্টেটমেন্টে উল্লেখ করে- It established an alternative, peaceful political process at a time when the country was on the brink of civil war. It was thus instrumental in enabling Tunisia, in the space of a few years, to establish a constitutional system of government guaranteeing fundamental rights for the entire population, irrespective of gender, political conviction or religious belief.”
ক্ষমতাসীন দলে ভাঙন এবং কোয়ালিশন সরকারে আননাহদার যোগদান
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মন্ত্রিপরিষদ নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে বিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের কতিপয় সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেন। সরকারি দলের সংসদ সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৫৮। আর আননাহদার সংসদ সদস্য সংখ্যা ৬৯ এবং সর্ববৃহৎ দল হিসাবে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তারা ইচ্ছা করলে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু আননাহদা দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের সাথে সমঝোতায় যায় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিয়ে কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়। এই প্রসঙ্গে লেখকের সাথে উস্তাদ ঘানুসির ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তিউনিশিয়ায় তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎকারের সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘‘আপনারা কেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ না নিয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদ নিয়ে ক্ষমতাসীনদেরকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন?” তিনি জবাবে বলেন, ‘‘আননাহদা এককভাবে ক্ষমতায় থাকাকালে নৌকা ডুবানোর জন্য সবাই চেষ্টা করে। বর্তমানে আবারও ক্ষমতাসীন হলে সকলে মিলে চক্রান্ত করবে নৌকাটি ডুবিয়ে দিতে। অপর দিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় এবং আননাহদার বর্তমান সাপোর্ট হচ্ছে জনসংখ্যার প্রায় ৪০%। আননাহদার টার্গেট হচ্ছে এই সমর্থন ৬০% উন্নীত করা এবং তারপর স্থিতিশীল সরকার গঠন করা।” তিনি আরও জানান, ‘‘আননাহদা বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা নেই বরং কম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিয়ে কোয়ালিশন সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল তিউনিশিয়া গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।” অভ্যন্তরীণ সার্ভ অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে আননাহদা সকল আসনে প্রার্থী দিলে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বর্তমান ক্ষমতাসীন ‘‘নিদায়ে তিউনিশিয়া” বৈদিশিক সাহায্য পাওয়ার যত প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তা পাওয়া যাবে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে ; তাই আননাহদা আগামী নির্বাচনে সকল আসনে প্রার্থী না দেয়ার চিন্তা করছে। তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে আরও কিছুদিন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বদ্ধপরিকর। ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমেই তারা আরও কিছু সংস্কারকার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে চায়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আননাহদা সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। যার কারণে নিদা তিউনিস কর্তৃক মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ৮৭ বছর বয়সী Beji Caid Essebisi বিজয়ী হন। তিনি হাবিব বর্গুইবা ও বেনআলি সরকারের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য Essebsi বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে তার পুর্বসূরি প্রেসিডেন্ট মারযুকীর দুর্বলতাও বড় ফ্যাক্টর ছিল। এ ছাড়া মহিলারা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ তাকে বেশি ভোট দেয়।
অপর দিকে ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট ড. ঘানুসির সাথে ফ্রান্সে ঐকমত্যের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আননাহদা সরকার কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে Essebsi গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেন। আননাহদা তা ইতিবাচক দৃষ্টিতে স্মরণে রাখে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বৃদ্ধিতেও প্রয়াস চালায়। ড. রাশিদ ঘানুসি ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিসের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যান ; একইভাবে তিউনিশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট Essebsi আননাহদার কনফারেন্সে অতিথি হিসেবে যোগদান করে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশগড়ার আহবান জানান। তাঁরা মনে করেন, The sharing power is the safest way for Tunisia to really be sucuessful in this transition.
তাঁরা বিশ্বাস করেন, ডিক্টেটরশিপ থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশ শাসনের পরিবর্তে সকল রাজনৈতিক দলের মাঝে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। স্বৈরাচারী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে যে পচন ধরে দেশকে এই গভীর ক্ষত থেকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসলামপন্থী আননাহদা ও সেক্যুলারিস্ট নিদা তিউনিসের মধ্যে কোয়ালিশন হওয়ার কারণে তিউনিশিয়ায় একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পথ বন্ধ হয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হয়। দেশের বুদ্বিজীবী মহল ও মিডিয়া আননাহদার এই উদারতার প্রশংসা করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, Ennahda’s support of the current Tunisian government in the parliamentary vote of confidence made it appear in the eyes of its supporters and citizens as a responsible political party, which gives priority to national unity over narrow political interests and considerations.The Islamist movement persuaded its partisans of the validity of its strategic political choices, particularly its use of diplomatic flexibility in political negotiations in the transitional phase, and its support for the coalition government.Through its symbolic presence in the government, Ennahda plans to maintain a foothold within the newly formed Council of Ministers, as one of the key centres of decision-making in the new Tunisian state. It is believed that its participation in the current government will inevitably allow it to have first-hand knowledge of political developments, and will preserve its power to influence political projects by acclamation or revocation.Through this presence, Ennahda seeks to avoid the scenario of a monopoly of political authority by leftists and constitutionalists. Such a scenario could lead to the isolation of Ennahda, its exclusion from the political scene, and the prosecution of its adherents and leaders—as happened in the nineties, at the time when the Democratic Constitutional Rally and Ben Ali’s oligarchic regime tolerated no political pluralism.আননাহদা ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিশের সাথে সংঘাত এড়ানোর কৌশল গ্রহণ করার ফলে জনগণের মধ্যে দলের ইমেজ বৃদ্ধি পায়। কারণ মানুষ সংঘাতের রাজনীতি চায় না। তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায়। আননাহদা প্রমাণ করেছে যে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সংঘাত নয় বরং ডায়ালগে বিশ্বাসী। কোয়ালিশন সরকারে যোগদানের ফলে তারা রাজনীতির মূলধারার ভেতরই থাকে। অপরদিকে আননাহদার সাথে সমঝোতা না করলে সরকার স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারতো না। যেকোনো সময় ছোট দলগুলো আননাহদার সাথে যোগ দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারতো। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দল স্বৈরাচারী বেনআলির সহযোগী হিসেবে যে দুর্নাম ছিল তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। আননাহদার সাথে কোয়ালিশন এর কারণে নিদায়ে তিউনিশ লাভবান হয়।
আননাহদা ও নিদায়ে তিউনিশ দুই দলের ঐক্য নিয়ে উভয় দলের ভেতরে কারো কারো বিপরীত মত থাকলেও উভয় দলের মূল নেতৃত্বের প্রতি দলের অধিকাংশেরই সমর্থন আছে। এই ইস্যুতে আননাহদাতে বাহ্যত তেমন কোন বিভাজন দেখা যায়নি। কিন্তু নিদায়ে তিউনিশের সংসদ সদস্যদের একটি অংশ ইসলামপন্থীদের সাথে ঐকমত্যের সরকার গঠন প্রশ্নে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে। ড. ঘানুসির আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্বের কারণে তাই আননাহদার কারো কারো মাঝে দ্বিমত থাকলেও দলীয় বিভাজন হয়নি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হামিদ জাবালিসহ কেউ কেউ চুপচাপ হয়ে পড়লেও প্রকাশ্যে দ্বিমত করেনি। কিন্তু নিদায়ে তিউনিশ এর দলীয় প্রধান ঊংংবনংর’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দল থেকে পদত্যাগ করার পর দলে তাঁর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবে তাদের মধ্যকার বিরোধ প্রকাশিত হয়। দলের যারা মন্ত্রিপরিষদে বা প্রেসিডেন্ট এর উপদেষ্টা হিসাবে সরকার পরিচালনায় সম্পৃক্ত তাদের সাথে অন্যদের বড় ধরনের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্য গড়ার ইস্যুতে ধর্মনিরপেক্ষ নিদায়ে তিউনিশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এটা ইসলামপন্থী আননাহদার এক ধরনের সফলতা। কারণ নিদায়ে তিউনিশের ভিতর যারা আননাহদা বিরোধী ছিল তারা সরকার পরিচালনা থেকে ছিটকে পড়ে।
ঘানুসির উদারনীতি ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বেনআলির সময়কার মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে দুর্নীতির দায়ে কারারুদ্ধ করার দাবি জানায়। এই ইস্যু নিয়ে সংসদের তুমুল হট্টগোল হয়। ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ তাদের সাথে সুর মিলায়। আন-নাহদার কিছু সংসদ সদস্যও উক্ত দাবির সাথে একমত হয়। এমতাবস্থায় উস্তাদ রাশিদ ঘানুসি মনে করেন অতীত নিয়ে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে না দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশকে সমৃদ্ধির পথে নেয়া জরুরি। তাই তিনি সংসদ ভবনের দিকে ছুটে যান সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়টি বুঝানোর জন্য। তিনি সংসদ ভবনে যাওয়ার পর উক্ত ইস্যুতে সংসদে আর ভোটাভোটি হয়নি।
আমাকে আরেকটি বিষয় বিমোহিত করে যে, কিছুদিন আগে উস্তাদ ঘানুসির সাথে স্বৈরশাসক বেনআলির মেয়ে দেখা করতে তাঁর বাসায় গিয়ে জানায়, ‘‘সরকার তাদের সম্পদ ও বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” সে তাঁর সহযোগিতা চায়। তা শোনার পর উস্তাদ ঘানুসি বেনআলির মেয়েকে বলেন, ‘‘সরকার যদি তোমাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে এবং তা বাজেয়াপ্ত করে তাহলে তোমার ঠিকানা হচ্ছে আমার বাড়ি।” যেই বেনআলির কারণে তিনি ২২ বছর নির্বাসনে ছিলেন তার মেয়েকে এইভাবে আশস্ত করে উস্তাদ ঘানুসি অতীতমুখী রাজনীতির পরিবর্তে সমৃদ্ধ তিউনিশিয়া গড়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৬ সালে আননাহদার দশম কনফারেন্স এবং নয়া কৌশল
আননাহদার প্রথম কনফারেন্স ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় এবং দশম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ২১-২৫ শে মে ২০১৬। এই সম্মেলনে আননাহদা মৌলিক কিছু পলিসির পরিবর্তন সাধন করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে উস্তাদ রাশিদ ঘানুসি এক ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁর উক্ত বক্তব্যের নির্যাস হচ্ছে :
আরব বসন্তের পর তিউনিশিয়া একমাত্র দেশ যা এখনো বিপ্লবের আলোক শিখা জ্বালিয়ে রেখেছে। আননাহদাহ ওঝওঝ ও তাকফিরিদের বিরুদ্ধে সমর্থন পূর্নব্যক্ত করেছে। সন্ত্রাসবাদ এবং ঘৃণা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে জনগণ জয়ী হবে। চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলাম এক ইতিবাচক শক্তি; এই জন্য আমাদের এমন আলেম দরকার যারা ইসলামের নামে চরম পন্থাকে প্রত্যাখ্যান করবেন। দেশকে বিভক্ত কার চেয়ে ঐক্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। রাষ্ট্রের কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এক নয়। আমরা এমন একটা সার্বজনীন জাতীয় ঐক্য, সহযোগিতা ও সংহতি গড়ে তুলতে চাই যেখানে বিপ্লব ও শহীদ বিপ্লবীদের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হবে ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। ইসলামপন্থী, সংবিধানপন্থী, বামপন্থীসহ বিপ্লবকে মূল্যায়ন করে এমন সব বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সকলে মিলে ঘৃণা ও বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। এটা কোন গোপন সমঝোতা নয় বরং রাষ্ট্র বনাম নাগরিক, সুবিধাপ্রাপ্ত বনাম সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল এবং অতীত বনাম বর্তমানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জাতীয় আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ।
বিপ্লবের আগের এবং পরের ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিতে আননাহদা আন্তরিক। ভুল-ত্রুটি স্বীকার করার ব্যাপারে আমরা ভীত নই। সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত নিজেদের বিকাশের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়নি। একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ইসলামী মূল্যবোধ, দেশের শাসনতন্ত্র এবং যুগের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ধর্মকে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে মসজিদগুলোকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকার আহবান জানাই। আমরা চাই না মসজিদগুলো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হউক। মসজিদগুলো দলীয় বিভাজনের পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য গঠনে অধিকতর ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। জনজীবনে ইসলামী মূল্যবাধের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে নেতৃবৃন্দ ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। বর্তমানে ত্যাগ স্বীকার, সত্যবাদিতা, সততায় উৎসাহ প্রদান এবং উন্নয়নের সহায়ক হিসাবে ইসলামী মূল্যবোধকে কাজে লাগানো যায়। দমননীতি, অপবাদ এবং ভয়ের মাধ্যমে আননাহদার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য স্বৈরাচারী সরকার চেষ্টা করেছে। আল্লাহর রহমত রাষ্ট্র ও আননাহদার মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা সৃষ্টি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আননাহদা সরকার জাতীয় ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ক্ষমতালিপ্সু, কর্তৃত্বপরায়ণ কিংবা ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হতে ইচ্ছুক নই।
সুষম রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমই আমাদের লক্ষ্য। কোন ধরনের বৈষম্য ব্যতিরেকে সর্বস্তরের নারী-পুরুষকে ধারণ করবে। আইন পরিষদ, আদালত, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার পর্যবেক্ষণের মধ্য থেকে আইনের প্রয়োগ ও সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। আননাহদা দুর্নীতি, ঘুষ, কর ফাঁকি এবং জনগণের সম্পদ অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বাধীনতা মানে নৈরাজ্য নয় এবং অপরদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা মানে দমন পীড়ন ও কণ্ঠরোধ করা নয়। জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের মর্যাদা রাষ্ট্রের মর্যাদারই অংশ। কোনো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পুনর্জাগরণ সত্যিকার প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া হতে পারে না। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনকে পরিপূর্ণ ডিজিটাল প্রশাসনে রূপান্তরিত করা। জীবনযাত্রার ব্যয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। বড় বড় শ্লোগান এবং রাজনৈতিক বিরোধ দিয়ে কোনো আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। সবার জন্য নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও সেসবের বাস্তধায়নের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আদর্শনির্ভর তাত্ত্বিক বিতর্ক থেকে সরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আননাহদার বর্তমান প্রাইমারি লক্ষ্য। নারীদের অধিকার ও উন্নতিতে আমরা গর্বিত। তাদের সম্ভাবনার বিকাশ এবং আরো বেশি স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। একই সাথে ঐক্য ও সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে পরিবার প্রথার সংরক্ষণকে আমরা সমর্থন করি।
জ্ঞান ও নৈতিকতার ভারসাম্য রক্ষা এবং কর্মসংস্থান উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বেকারত্বের রাস্তা নয় বরং শিক্ষা হতে হবে কর্মসংস্থানের প্রবেশদ্বার। মাদকতাসহ তরুণদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সংখ্যাধিক্যকে প্রাধান্য দেয়ার চেয়ে গুণগতমানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের সর্বত্র ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে একটি সুইমিংপুল, একটি ক্রীড়াকেন্দ্র এবং একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেখতে চাই। বেকারত্ব দূরীকরণে ভোকেশনাল টেনিং সিস্টেমকে শক্তিশালীকরণ, একে প্রমোট করা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আঞ্চলিক উন্নয়নে ভারসাম্যতা অর্জন, কর্মোদ্যোগ এবং ব্যক্তি উদ্যোগের প্রতি উৎসাহ প্রদানের মত বিনিয়োগ নির্ভর অর্থনীতি বেকারত্ব দূর করতে পারে। দেশের বঞ্চিত অঞ্চলের উন্নয়নে দেশের অঞ্চলগুলোর স্ব স্ব প্রাকৃতিক সম্পদের অনুপাত অনুসারে আঞ্চলিক উন্নয়নের নীতিমালাকে সমর্থন। আগামী পাঁচ বছরে প্রত্যেক জেলার নিজস্ব অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি করে অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি। সমাজকল্যাণ কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়া বিশেষ করে কৃষি শ্রমিকদের জন্য। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেয়া জরুরি। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধানের পথ হলো ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করা। দুর্নীতি, ঘুষ, স্বৈরতন্ত্র, বিশৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্তির সমাধান যে গণতন্ত্র আমরা তা দেখাতে পেরেছি। পশ্চাৎপদ একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করার চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা ভালো এবং ফলপ্রসূ।
অসংখ্য ত্যাগ, অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে আননাহদার সদস্যরা শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আমাদেরকে নিজেদের ভুলগুলো স্বীকার এবং আত্মম্ভরিতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পলিসির পুনর্মূল্যায়ন করার সাহস অর্জন করতে শিখিয়েছে। বর্তমান যুগে এগিয়ে যাবার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো আত্মসমালোচনা। ঐক্যবদ্ধ নয়া আননাহদা তিউনিশিয়ার সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করতে সক্ষম। এই দল জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার দল। এই দলটি জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার মূল্যায়ন এবং গঠনমূলক সমালোচনা করতে সক্ষম যা দেশে বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। দলটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ স্বচ্ছতার নীতি দ্বারা পরিচালিত এবং এর সকল সামর্থ্য সম্ভাবনা সকলের জন্য উন্মুক্ত। মেজরিটি বা মাইনরিটির ভিত্তিতে নয় বরং ঐকমত্য ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই আসন্ন বছরগুলোতে তিউনিশিয়া শাসন করতে হবে।
নতুন আগামী তৈরির স্বপ্ন
ড. ঘানুসি দীর্ঘদিন তিউনিশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘পৃথিবীর যে কোন দেশে আমি তিউনিশিয়ার কোন বিমান দেখতে পেতাম আমি দেশে ফিরার স্বপ্নে বিভোর হতাম। এমন স্বপ্ন যা ছিল বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। আমি কি কোন দিন বাড়ি ফিরতে পারবো? আমি কি আরেকটাবার আমাদের পুত্র-কন্যাদেরকে দেখতে পারবো যারা অসংখ্য কারাগার ও নির্বাসনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? আমার দেশের রাস্তায় চলাফেরা কি আমার আর কোন দিন হবে? ঈদ-উৎসবে পরিবার, সহকর্মী সহযোগীদের শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ কি আর কোন দিন হবে? আল্লাহর রহমতে সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সেই স্বপ্ন এখন দিক পরিবর্তন করে তিউনিশিয়ার জন্য একটি নতুন আগামী তৈরির স্বপ্নের দিকে বাঁক নিয়েছে। স্বপ্নটা আমার ভেতরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একটি সুন্দর ও ঐক্যবদ্ধ তিউনিশিয়া গড়ার স্বপ্ন। একটি গণতান্ত্রিক, উন্নত ও সমন্বিত তিউনিশিয়া গড়ার স্বপ্ন। আমাদের অবশ্য দেশবাসীর সাথে এই স্বপ্ন ভাগ করে নিতে হবে। সেই সাথে অতীতকে পেছনে ফেলে ভবিষ্যতের ওপর ভরসা করে আশাবাদী ও সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে। এটাই হচ্ছে তিউনিশিয়ার স্বপ্ন। বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এই স্বপ্ন আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে অনুপ্রাণিত করে।
সম্মেলনে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য
সম্মেলনে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং দেশ-বিদেশের অনেক অতিথি উপস্থিত হন। তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট Beji Caid Essebisi সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, তিউনিশিয়াতে ২০৪টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সকলের কনফারেন্সে যাওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। কিন্তু তিনি আননাহদার কনফারেন্সে এসেছেন তিউনিশিয়ার জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও অগ্রগতি সাধনে আননাহদার গঠনমূলক ভূমিকার কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তিনি ড. ঘানুসি ও আননাহদাকে জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনায় ঐকমত্য পোষণ ও সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক তিউনিশিয়া গঠনে কার্যকর ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান। বিশেষভাবে আননাহদা তাদের অতীত কার্যক্রমের বস্তুনিষ্ঠ যে পর্যালোচনা করেছে তা শুধু দলের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আননাহদার ভূমিকায় প্রমাণিত হয়েছে যে, Islam does not contradict democracy, as is said by Ennahdha in its international forums; that the Islamic movement in Tunisia does not represent a danger to democracy.পরিশেষে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আননাহদা সামাজিক ও জাতীয় বাস্তবতার নিরিখে তাদের পলিসি নির্ধারণ করবে এবং তিউনিশিয়ার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে। তাঁর ভাষায়:
I also hope that your work emphasizes the peculiarity of the Ennahdha movement derived from the nature of the society it grew up in, Imposing considering the social and political context, not others, when deciding its policies. Finally, I look forward to the political project of Ennahdha after the adoption of the revisions publicized in this Conference, consistent with the overall national context and responsive to the expectations of the Tunisian people.
আননাহদার পরিবর্তিত কৌশল
তিউনিশিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের পর এই বাস্তবতা প্রতীয়মান হয় যে, দেশগঠনে সকল দল ও পথের জনগণের মাঝে চিন্তা ও পলিসিগত গুণগত পরিবর্তন সময়ের দাবি। বিপ্লব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বাস্তবতা অনুধাবন করে আননাহদা তাদের ভিশন, কর্মনীতি ও কর্মসূচি নতুন আঙ্গিকে সাজিয়েছে। বেনআলির রাজত্বকালে চরম যুলুম নির্যাতনের সময় সংগঠন যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার আলোকে বিপ্লব-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আননাহদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আননাহদা মনে করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে পলিসি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিচালনা, জনসাধারণের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে সংগঠন আরও যোগ্যতার সাথে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এই জন্য দেশের ভেতর ও বাইরে গঠনমূলক পর্যালোচনা করা হয়। উক্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে কতিপয় চিত্র ফুটে উঠেছে।
জনাব আব্দুর রউফ আন নাযযারকে প্রধান করে আননাহদা সম্মেলন কমিটি গঠন করে এবং সম্মেলন উপলক্ষে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। উক্ত প্রস্তাবনার আলোকেই কৌশলগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিম্নে পরিবর্তিত কৌশলের মৌলিক কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো :
ধর্ম ও রাজনীতি পৃথকীকরণ : রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় পৃথকীকরণে আননাহদার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নানা জনে নানা মত পোষণ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক Rory McCarthy, এর মতে, It was easier for the party to advance an Islamist message when it was an underground opposition movement, but “now they have to make compromises and reassess what it means to be a political movement”. He sees a potential split in the future between the political wing and others who criticize the concessions and compromises made by the party since 201. ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান- এই কনসেপ্টের সাথে পরিবর্তিত কৌশল কি সাংঘর্ষিক? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ধর্ম ও রাজনীতি পৃথকীকরণের সাথে তাহলে পার্থক্য কোথায়? এই ধরনের প্রশ্নের জবাবে ড. রাশিদ ঘানুসি বলেন, ‘‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। রাসূলে কারীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুকাম্মাল নেয়ামে হায়াতের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে গিয়েছেন। রাসূলে কারীম (সা) রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন; রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। একই সাথে প্রধান বিচারপতি ও প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের পর খিলাফাতে রাশেদার সময় থেকে আস্তে আস্তে পৃথক বিচার বিভাগ গড়ে ওঠে। খলিফা কর্তৃক প্রধান সেনাপতি নিয়োগ দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর সৃষ্টি করা হয়। অতএব, রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করার অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মত ধর্মহীনতা নয়। এই বিভাজন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখার বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক ফিল্ডে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের স্ব স্ব ফিল্ডে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কাজ করতে দেয়া (distinction based on specific field, knowledge and expertise)। যারা রাজনীতিতে দক্ষ তারা রাজনৈতিক ফিল্ডে কাজ করবে। আর যারা শরিয়াহর ওপর দক্ষ তারা শরিয়াহর বিষয়ে আরও একনিষ্ঠতার সাথে কাজ করবে। প্রত্যেক ফিল্ডের সকলেই একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবেন। যারা ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ কিন্তু রাজনৈতিক ফিল্ডে অভিজ্ঞ নন। তাঁরা রাজনীতির পরিবর্তে ইসলামের সার্বজনীন সুমহান বাণী সকলের মাঝেই প্রচার করবেন। আরও যারা দাওয়াত ও নাসিহার কাজ করেন তাদের সাথে উদারভাবে উক্ত কাজে শরিক হবেন। আর রাজনীতি যারা করবেন তারাও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা করবেন।
ইসলামের মৌলিক নীতিমালায় কারো কোন বিরোধ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক পলিসির ব্যাপারে যে কারো দ্বিমত থাকতে পারে। তাই ইসলামের মূল্যবোধ সকলের মাঝে রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে প্রচার করা প্রয়োজন। বর্তমানে আননাহদা পরিচয় দিচ্ছে ‘‘মুসলিম ডেমোক্রেট” হিসাবে। ড. রাশিদ ঘানুসি সম্প্রতি একটি কনফারেন্সে স্পষ্ট করেন যে যারা পলিটিক্যাল ইসলাম পরিভাষা ব্যবহার করেন এই শব্দটির ওপর আমার নিজের ঘোর আপত্তি রয়েছে। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান তাই সঙ্গত কারণেই এতে মানবজীবনের প্রতিটি মৌলিক দিকের সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। রাজনীতি সে রকমই একটি অধ্যায়। আমরা ইসলামের অর্থনীতির ব্যাপারে ‘‘ইকোনমিক্যাল ইসলাম” না বলে ‘‘ইকোনোমিকস ইন ইসলাম” বলি। সংস্কৃতির ব্যাপারে কালচারাল ইসলাম না বলে কালচার ইন ইসলাম বা ইসলামিক কালচার বলি। তেমনি রাজনীতির ব্যাপারে ‘‘পলিটিক্যাল ইসলাম” না হয়ে শব্দটি যদি ইসলামি পলিটিক্স বা পলিটিক্স ইন ইসলাম বলি তাহলে যথার্থ হতো। ইসলামকে আমরা যদি পূর্ণ ও সুস্থ মানব শরীরের সাথে তুলনা করি তাহলে মানব শরীরের প্রতিটি সেকশনের গুরুত্ব ও পূর্ণতার সাথে ইসলামের প্রতিটি শাখার গুরুত্ব ও পূর্ণতার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবো। মানব শরীরের একটি শাখা যদি ফরংধনষব হয়ে যায় তাহলে তার প্রভাব যেভাবে গোটা শরীরে disorder সৃষ্টি হয়, তেমনি ইসলামের যে কোন একটি শাখা যদি disable হয়ে যায় বা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয় তাহলে দ্বীন ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্যতা বা কার্যকারিতা হারায়। যেমন শিক্ষানীতির ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব মূলনীতির কথা বলা আছে মুসলমানদের কোনো সমাজে যখন সেই নীতি সমূহকে উপেক্ষা করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় তখন এটি ঐ সমাজের সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল মৌলিক শাখাকেই প্রভাবিত করবে। সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি মৌলিক শাখাসমূহে যতই ইসলাম থাকুক যদি শিক্ষানীতির মতো একটি মৌলিক শাখাতে ইসলাম না থাকে তাহলে সেটি বাদবাকিগুলোকেও প্রভাবিত করবে। এভাবে একটি আরেকটির পূর্ণতার জন্য ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে কেউ কেউ বলেন, ‘‘পরিবর্তিত কৌশলের কারণে আননাহদাকে মুসলিম লীগের মত ভাগ্যবরণ করতে হবে । তাদের মতে ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলা হলেও মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ইসলামকে পরিপূর্ণ জানার, বুঝার ও অনুশীলনের কর্মসূচি না থাকলে আননাহদার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সময়ের ব্যবধানের দাঁড়িয়ে যাবে। অবশ্য ড: ঘানুসি এটাকে কৌশল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সূরা কাহাফের ১৯-২০ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আসহাবে কাহাফ গুহার ভেতর জেগে ওঠার পর তাদের একজনকে রূপার মুদ্রাসহ বাজারে পাঠায় তখন নির্দেশিকা দেয়া হয় যেন সব চেয়ে ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায় তা আনে এবং সে যেন সতর্ক থাকে যেন কেউ তাদের এখানে থাকার বিষযটি টের না পায়। আরও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘‘যদি তোমাদের কথা তাদের কাছে প্রকাশ পায় তাহলে অবশ্যই তারা তোমাদেরকে পাথর মেরে শেষ করবে, অথবা তাদের দীনে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবে। যদি তা-ই হয় তা হলে তোমরা কখনো সফল হতে পারবে না।” এই দুইটি আয়াতে টার্গেট হাসিলে কৌশলী হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। আর কৌশল গোপন রাখার বিষয়েও দীক্ষা আছে।
◊ আননাহদা নিম্নবর্ণিত নীতি ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে:
◊ স্বাধীনতা : জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা করা হবে।
◊ মর্যাদা : সকল মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা সকল বনি আদমকে সম্মানিত করেছেন। প্রত্যেক নর-নারী, শাসক-শাসিত, ধনী-গরিব, জীবিত-মৃত, ধর্মপরায়ণ-ধর্মহীন, সকল ভাষাভাষী ও বর্ণের মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় আননাহদা বদ্ধপরিকর। কারো প্রতি অন্যায় ও কারো মৌলিক অধিকার হরণ করা হবে না।
◊ কর্মসংস্থান : সকলের জন্য কর্মসৃষ্টি ও সকল ধরনের পেশাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা।
◊ আদল : সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা। যুলুম নয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
◊ শূরা : পরামর্শভিত্তিক কাজ করা। গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের মতামত নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
◊ বিরোধ নয় ঐক্য: দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোটখাটো বিষয়ে বিরোধিতার পরিবর্তে একতার মনোভাব সৃষ্টি করা।
◊ পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও অপরকে অগ্রাধিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূলভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে পরস্পরের সাহায্য ও সহযোগিতার।
◊ মধ্যমপন্থা : আত্মিক ও বস্তুগত, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থার নীতি অবলম্বন করা। কোন ক্ষেত্রে উগ্রতা প্রদর্শন না করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা হচ্ছে ব্যক্তির মালিকানার স্বীকৃতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা।
◊ ইসলাহ : চিন্তার পরিশুদ্ধি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা।
◊ আমানত : জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি।
◊ ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষের আত্মিক উন্নয়ন, সততা, নিষ্ঠার ভাবধারা জাগ্রত করা। কপটতা, প্রদর্শনেচ্ছামুক্ত হয়ে আত্মশুদ্ধির অনুভূতি জাগ্রত করা।
◊ আননাহদা একটি মুসলিম গণতান্ত্রিক দল হিসাবে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক সরকার কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখাকে গুরুত্ব দেবে। স্বাধীনতা, শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নতি ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ভূমিকা পালন করবে। ন্যায় ও ইনসাফের মূলনীতির ভিত্তিতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তিউনিশিয়াকে প্রতিষ্ঠা করা। শান্তি, পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার মূলনীতির ভিত্তিতে সকল বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করবে।
আননাহদার দৃষ্টিতে কতিপয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় ও আরব বসন্তের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনা। দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীদের মাঝে ঐক্য। অর্থনৈতিক সংস্কার। দেশের উন্নয়নে উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্প প্রতিষ্ঠায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি এবং উগ্রবাদ দমন করা। দ্বীন এর নামে কেউ যেন সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের মত উগ্রপন্থা অবলম্বন করতে না পারে। হতাশার কারণে কোন যুবক যেন বিপথগামী না হয়। সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে কেউ যেন সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের পথ বেছে না নেয়। আন্তর্জাতিক কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা যেন কেউ প্রভাবিত হতে না পারে। সৌদি আরব ও ইরানসহ আন্তর্জাতিক ইস্যুসমূহে কূটনৈতিক কৌশলী ভূমিকা পালন করা। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে একদিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে অপর দিকে রাজতান্ত্রিক বা ডিক্টেটরশিপ চালু রয়েছে। যেভাবে অস্ত্র দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধানো হচ্ছে, আননাহদা তা সমর্থন করে না। বরং ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতির মাধ্যমে সন্ধি, সমঝোতা ও শান্তি স্থাপন করতে চায়। বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতির সাথে দেশের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে আননাহদা সর্বাবস্থাই দেশের সাংবিধানিক সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। উগ্রবাদ যেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে সংস্কার সাধন করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহে চিন্তার ঐক্য স্থাপন করতে হবে। আননাহদা জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জন করাও একটি চ্যালেঞ্জ। আননাহদার ক্ষমতার অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে; পরাজয় বরণের অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আবার জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জন করতে হবে। এই জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। জনগণের সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা সুচিন্তিত ভাবে পেশ করতে হবে। জনগণের সমস্যা সমাধানে জাতীয় সংলাপ এর আয়োজন করতে হবে। যুবসমাজ ও নারীদের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণা আছে তা দূর করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবিলা করে আননাহদা যে শান্তিময়, স্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক তিউনিশিয়া গঠনে সক্ষম সেই বিশ্বাস জনমনে বদ্ধমূল করতে হবে।
আননাহদার অগ্রাধিকার হচ্ছে: অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী প্রজেক্ট বাস্তবায়ন। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উগ্রবাদ দমন করা। প্রশাসনিক সংস্কার সাধন ও যুবকদের সমস্যা সমাধান অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার সাধন। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা। ক্ষমতাভোগের জন্য কোয়ালিশন সরকারে যোগদান নয় বরং দেশ ও জনগণের স্বার্থেই কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ করা। রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য স্থাপন এবং দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা। ইসলামী মূল্যবোধ ও ভারসাম্যমূলক সাংবিধানিক নীতিমালার ভিত্তিতে কাজ করা।

সাংগঠনিক কাঠামো পর্যালোচনা

সাংগঠনিক মজবুতি যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু সংগঠন কতিপয় ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যদি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্কার সাধনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় তখন তার ফল অনেক বেশি পাওয়া যায়। অতএব, সাংগঠনিক কাঠামো অপপড়সসড়ফধঃরাব হওয়া দরকার। সংগঠনের অতীত ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করা। সংগঠন কতটুকু ভূমিকা রাখার যোগ্যতা ছিল আর কতটুকু রেখেছে? সম্ভাবনা কতটুকু কাজে লাগানো সক্ষম হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে কি ধরনের দুর্বলতা ছিল তা চিহ্নিত করা। সংগঠনের উপায় উপকরণের যথাযথ সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না? নেতৃত্ব ও জনশক্তির মাঝে যোগাযোগ ও সম্পর্কের মূল্যায়ন হওয়া। সংগঠন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। নারী-পুরুষ, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সংগঠনে সকলে যোগদান করতে পারবে।

নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা
আননাহদা নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সশস্ত্র বিপ্লব বা গোপন গেরিলা আন্দোলনে বিশ্বাসী নয়। যার কারণে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে আননাহদা অংশগ্রহণ করে। আরব বসন্তের পর আননাহদা ক্ষমতায় থাকাকালীন উক্ত মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে। নির্বাচনে পরাজয় বরণ করার পর বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়। ক্ষমতাসীন দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সরকারের ভিত্তি নড়বড়ে হলে কোয়ালিশন সরকারে যোগদান করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা পালন করে। আননাহদা প্রধান ড. রাশিদ ঘানুসি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সমর্থক। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, সেক্যুলারিস্ট এবং রেডিকালিস্টরাই আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। ইসলামিস্টরা যেহেতু পাশ্চাত্যের বিরোধী তাই তারা এ ব্যাপারে এত সোচ্চার নয়। যারা সমালোচনা করে বলেন, Islam and democracy did not work তার জবাবে অুুধস Tamimi Zuvi Rachid Ghannouchi A Democrat Within Islamism গ্রন্থের ভূমিকায় মন্তব্য করেন যে, Rachid Ghannouchi leads a school in modern Islamic political thought that advocates democracy and pluralism. He believes democracy to be a set of mechanisms for guaranteeing the sovereignty of the people and for supplying safety valves against corruption and the hegemonic monopoly of power. While insisting on the compatibility of democracy with Islam, he believes that because of their secular foundations, contemporary forms of liberal democracy may not suit Muslim societies W: Nvbywm Zuvi Al-Hurriyyat al-‘Ammah Fid-Dawlah al-Islamiyyah বইতে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ও ইসলামের মাঝে কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা সুন্দরভাবে আলোচনা করেন।
আননাহদার পর্যালোচনার প্রস্তাবনা
ইসলামী আন্দোলনগুলোর মধ্যে তিউনিশিয়ার আননাহদা একটা নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে। নিজেদের অতীতের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার মাধ্যমে নতুন পথ নির্মাণে আননাহদা যে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে তা বাদ বাকি মুসলিম বিশ্বের ইসলামী দল ও আন্দোলনগুলোর জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় কনফারেন্সে আননাহদা ৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী এক দীর্ঘ পর্যালোচনার প্রস্তাবনা পেশ করে। নিচে তার সারসংক্ষেপ পেশ করা হলো। সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ৮১৪ জন এই পর্যালোচনা অনুমোদনের পক্ষে, ৩৮ জন বিপক্ষে ভোট দেন এবং ১০০ জন ভোটদানে বিরত থাকেন।
‘‘নিজেদের অর্জন ও অতীতের পর্যালোচনার ব্যাপারে যারা অঙ্গীকারবদ্ধ একমাত্র তারাই সফল দল ও আন্দোলন। আননাহদা এই পর্যালোচনা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক দলিল প্রণয়ন বা তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য করছে না। এই সবের জন্য ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞরাই যথেষ্ট। বরং নিজেদেরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে একটা সম্ভাবনাময় নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ এবং ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করাই এই পর্যালোচনার লক্ষ্য। আমাদের আন্দোলন স্বেচ্ছায়, সচেতনভাবে একসাথে মিলে যে আত্মসমালোচনা করেছে এই পর্যালোচনা তারই ফলশ্রুতি। এর জন্য একটা সাহসী ও ব্যাপক অভ্যন্তরীণ আলোচনা পরিচালনা করা হয়েছে। এই কাজের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ছিল অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া। যাতে করে একটা নির্মোহ পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহর মেহেরবানিতে যেসব অর্জন হয়েছে তাকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়া এবং যেসব ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি এবং অবহেলা হয়েছে তা থেকে সবক গ্রহণ করে ভবিষ্যতের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা গ্রহণ করা যায়।
একাধিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই পর্যালোচনা পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলো হচ্ছে : আমাদের কাজ ও প্রধান প্রধান সিদ্ধান্তসমূহ যেসব মৌলিক নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল ছিলো তার পরিপূর্ণ পর্যালোচনা করা। সিদ্ধান্ত ও পলিসি প্রণয়নে এই সব নীতিমালা কতটা অনুসরণ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা। প্রতিটি পলিসি ও কর্মসূচি প্রণয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বডিগুলো কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ছিল তা পর্যালোচনা করে দেখা। সংগঠনের কার্যকরী বডিগুলো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কতটা প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করেছে তা পরীক্ষা করে দেখা। প্রশ্ন করে দেখা যে, এক সিদ্ধান্ত থেকে অন্য সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে প্রথমটির যাবতীয় শর্তাবলি পরিপূর্ণ করা হয়েছিলো কিনা? পরিশেষে প্রত্যেক পর্যায়ের সফলতা নির্ণয়ে ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট কতটা প্রভাবিত করেছে তা পর্যালোচনা করে দেখা। নেহায়েত সাংগঠনিক অর্থে মূল্যায়ন বা অনুসন্ধানই নয়; দায়িত্ব নির্ণয় শুধুমাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের ওপরই প্রভাব ফেলে না বা এর কাজের ক্ষতি করে না বরং দলের জাতীয় ও নাগরিক দায়িত্ব পালনের তাগিদেই এই পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার চাইতেও সংস্কারের প্রয়োজনেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র

Azzam S. Tamimi (2001) Rachid Ghannouchi A Democrat Within Islamism, OXFORD UNIVERSITY PRESS
ড. মোস্তফা মোহাম্মদ তাহান (২০১০) আল হারাকাতুল ইসলামিয়্যা ফি শিমালি আফরিকা, সালমিয়্যা কুয়েত আবদুর রউফ নাজ্জার (২০১৬) লাওয়ায়েহ মুতামার আল আশির, আল হারাকাহ আননাহদাহ

(সমাপ্ত)

Popular Posts