Showing posts with label মিসরের শহীদ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি. Show all posts
Showing posts with label মিসরের শহীদ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি. Show all posts

Monday, July 8, 2019

প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির হত্যাকাণ্ড ও একটি বিভ্রান্তি



ড. মো. নূরুল আমিন : ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতি বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলন ও দল মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান, মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি তার জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের জবাব দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে খাঁচার মধ্যে পড়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ২০ মিনিট পর্যন্ত তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। আদালত তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনও ডাক্তারও ডাকেনি। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তার এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, তার এই মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহান নেতার অকাল মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শাহাদাতের মৃত্যু। জেলখানায় সরকারি নির্যাতন উপেক্ষা ও অবহেলায় ছয় বছরে তিনি এতই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, জালেমের কারাগারে জালেম নির্মিত কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, ঠাণ্ডা মাথায় খুন। এই খুনের সাথে মিশরের সামরিক শাসক জেনারেল সিসিও তার সহযোগী কর্মকর্তাবৃন্দ, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতালিপ্সু শাসকরা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলামী বিদ্বেষী ইহুদিবান্ধব শক্তি ও রাষ্ট্রসমূহ যৌথভাবে জড়িত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর বেশির ভাগ মিশরের গণতান্ত্রিক ও ইসলামী পুনরুত্থানে শংকিত ছিল। তারা মুরসি হত্যাকাণ্ড ও ইখওয়ান ধ্বংসে সিসিকে সহায়তা করেছে বলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। ড. মুরসি বহু প্রতিভার অধিকারী একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। মিশরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রথিতযশা প্রকৌশলী, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী উঁচুমানের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কুরআনে হাফেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান। রাজনীতির কথা বাদ দিলেও তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, ইসলামী ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত মননশীল একজন ব্যক্তি। কারাগারে তার প্রতি আচরণ ছিল নিকৃষ্ট ও অমানবিক। তাকে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কুরআন ছিল তার প্রাণ। কুরআনী বিধান বাস্তবায়ন ছিল তার জীবনের লক্ষ্যমাত্রা। কারাগারে তিনি জালেমদের কাছে এক জিলদ কুরআন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি তাদের কাছে কারাগারে একটা কুরআন চেয়েছিলাম, তারা দেয়নি। কিন্তু ওরা জানেনা ৪০ বছর আগে আমি কুরআন মুখস্ত করেছি। কুরআনকে ছু’তে চেয়েছিলাম,” একজন মুমিনের জীবনে এই ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক।

ড. মুরসি ডায়াবেটিস এবং লিভার ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এই উভয় রোগের চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং সময়ে সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া তার মৌলিক অধিকারের অপরিহার্য অংশ ছিল। জেলখানায় তাকে চিকিৎসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার রক্তের সুগার লেবেল কমে যাওয়ায় তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হলে তিনি হয়তো এভাবে মারা যেতেন না। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের নেতা হিসেবে মিশরের অবৈধ সরকার ড. মুরসির প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো তো দূরের কথা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও সামান্যতম সম্মান প্রদর্শন করেননি। অবশ্য মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লংঘন এবং গণহত্যায় পটু জেনারেল সিসির সরকারের কাছে এই দয়া, মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ আশা করাও বৃথা। মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর যেতে না যেতেই দেশটির সামরিক প্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালে রক্তাক্ত মিলিটারী ক্যুর মাধ্যমে ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ক্যুতে তার গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে প্রমাণিত হয় এবং তিনি গণহত্যার জন্য এক নির্মম কসাইয়ের খেতাব পান। তার নির্দেশে মিশরীয় সৈন্যরা ২০১৩ সালের ১৪ই আগস্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে একই দিন ১৫০০ লোককে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে যারা বেঁচেছিলেন তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানে তাদের সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। এখানেই শেষ নয়, ইখওয়ানুল মুসলেমিনকে বেআইনি ঘোষণা করে তাদের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেফতাকৃতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তার সৃষ্ট ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের জেল জরিমানা এবং ফাঁসির শাস্তি দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যের সরকারগুলো এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তারা নব্য এই ফেরাউনের এই নির্মম অমানবিকতার কোনও প্রতিবাদ করেনি বরং ইসরাইলের ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ইসলাম নির্মূলের হাতিয়ার হিসাবে সিসিকে ব্যবহার করেছে। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের গদীকে হুমকিমুক্ত করার জন্য মিশরের গণতান্ত্রিক উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য সিসিকে সহযোগিতা করেছে। এমনও শোনা গেছে যে, পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের একজন বাদশাহ স্বয়ং কায়রো বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত বিমানে কোটি কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বিমান থেকে নামেননি, আল সিসি বিমানে উঠে তাকে সালাম জানিয়ে এই তোহফা গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ইসলাম বিদ্বেষী শাসক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ইসরাইলকে নিয়ে মিশরের এই অবৈধ স্বৈরশাসককে শুধু উৎসাহিত করেনি বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকেও নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তারা ড. মুরসি ও তার দলের উপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে সিসিকে বাহবা দিচ্ছিলেন। ড. মুরসি কারাগারে কিভাবে আছেন তা দেখা ও জানার কারুরই সুযোগ ছিল না। তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দল কাউকেই তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে ড. মুরসির পরিবারের অনুরোধে বৃটিশ হাউজ অব কমন্স এর ফরেন এফেয়ার্স সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির একজন সাবেক সভাপতি ও এমপি জনাব ত্রিসপিন ব্লান্ট মিশর সফর এবং জেলখানায় ড. মুরসির অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে রাজি হন। জনাব ব্লান্ট মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে এই সফর করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির অবস্থা অবহিত হয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী সিসি প্রশাসন ড. মুরসির প্রতি এতই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিলেন যে, প্রায় ছয় বছরে মাত্র তিনবার তারা ড. মুরসির পরিবারকে তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল।
ব্লান্ট রিপোর্টে কয়েকটি মর্মান্তিক বিষয় উঠে আসে। ড. মুরসি ডায়াবেটিস ও লিভার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ মিশরীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি এই সেবা পাওয়ার যোগ্য। সেখানে তার চলাফেরা বা হাঁটা, ব্যায়ামেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। জেলকোড অনুযায়ী তিনি ভিআইপি মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তাকে সাধারণ কয়েদি হিসাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার ২৩ ঘণ্টাই তিনি অন্ধকারে থাকতেন, মাত্র এক ঘণ্টা আলোর মুখ দেখতেন। তাকে প্রদত্ত খাবারের মান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি খেতে পারতেন না। তিনি নিয়মিত অজু, গোসলের পানি পেতেন না। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা ও ওষুধ পথ্যের অভাবে তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছিল এবং তিনি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলেন। জনাব ব্লান্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে ড. মুরসি শীঘ্রই মৃত্যুবরণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। এটা মৃত্যু নয়, ঠাণ্ডা মাথায় খুন, নরহত্যা। বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা এই রিপোর্টের উপর তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি, কেন নেননি তা সবাই জানেন। তার মৃত্যু শহীদি মৃত্যু, আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করুন, তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন। আমরা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত কামনা করি।
ড. মুরসির শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামিক বিশ্ব একজন মহান নেতাকে হারালো। তার জীবন ও সংগ্রাম এবং ইসলামের জন্য ত্যাগ যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফ্যাসিষ্ট ও মিলিটারী ডিক্টেটার আল সিসির অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল ও ড. মুরসির ইসলামী সরকারের পতনকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের পতন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করছেন যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্তব্য ও বিশ্বাসটি সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র সফল হয়েছে। জনগণ নানা প্ররোচনার মুখেও বিপুল ভোটে ড. মুরসিকে জয়ী করে ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সা, ফ্যাসিবাদ, ইহুদী, খৃস্টান শক্তির ইসলাম বৈরিতা এবং প্রতিবেশী অগণতান্ত্রিক শক্তির মিথস্ক্রিয়ায় ড. মুরসিকে সরে যেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতার মোকাবিলা করতে হবে। দাওয়াত ও তরবিয়ত ব্যক্তি ও দলীয় চরিত্রকে পবিত্র ও সংহত করার জন্য তো থাকবেই। এখানে বিভ্রান্তির অথবা হতাশার কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-১



ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : গণমানুষের গণজোয়ার দেশ-বিদেশে অনেক দেখেছি । কিন্তু মিশরের শহিদ মুরসির মত এমন গণজোয়ার মনে হয় আর কোথাও দেখিনি । সেটা ছিল দীর্ঘ ৩০ বছরের কুখ্যাত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিশরের গণমানুষের অগ্রণী মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম ড. মোহাম্মদ মুরসির সফল সংগ্রামী মিছিলের গণজোয়ার । বিশ্ব কাঁপানো সেই মিছিল ছিল মিশরের চরম বিরক্তিকর স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে সাধারণ গণমানুষের ন্যায্য অধিকারের মিছিল । সেই মিছিল ছিল শোষণ, নিপীড়ন, জুলুম, অত্যাচার আর বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে । সেই মিছিল ছিল ঐতিহ্যবাহী মিশরের মুসলমানদের প্রাণের আদর্শ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মিছিল । সেই মিছিল ছিল আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর আইন কায়েমের বলিষ্ঠ স্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবারের’ মিছিল । তাই সেদিন ২০১২ সালে মিশরের লক্ষ-কোটি গণমানুষের প্রাণের নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন । কুখ্যাত স্বৈরশাসক হোসনী মুবারকের পতন হয়েছিল । মিশরের গণমানুষের সেদিনের মুক্তি ছিল স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসীর স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন । স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের বিজয় ছিল শান্তিকামী বিশ্ববাসীর অনিবার্য দাবী । তাই ড. মোহাম্মদ মুরসি সেদিনই বিশ্বজাহানের হৃদয়ের সেরা নেতা হয়ে গেলেন । সারা বিশ্বে ড. মোহাম্মদ মুরসির অগ্রযাত্রা কামনা করছিল ।

উল্লেখ্য যে,বিশ্বব্যাপী মহা আতংক এই মিশরের মানবতাবিরোধী কুখ্যাত স্বৈরশাসন । যুগ যুগ ধরে যারাই অত্যাচারী এই জালিমশাহীর বিরোধিতা করতে গিয়েছে তাদেরকেই স্বৈরাচারীর যাতাকলে নিস্পিষ্ট হতে হয়েছে । বিভিন্নভাবে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের অত্যাচার করা হয়েছে । অগণিত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের জেল জুলুম বা ফাঁসী দিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার সব অ¯্র ব্যবহার করা হয়েছে । কারাগারই নয় শুধু, পুরা মিশরই ব্রাদারহুডের নেতা কর্মী তথা গণ মানুষের কারাগারে পরিণত করা হয়েছে । হাসানুল বান্না,সাইয়েদ কুতুবদের মত অসংখ্য আল্লাহর শ্রেষ্ট মুজাহিদদেরকে সেখানে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয় । মিশরের সবুজ শান্ত ভ’মিতে লাল রক্তের জোয়ার বহানো হয় । ড. মোহাম্মদ মুরসির এ বিজয় হল ঐ সব ফাঁসি, জেল, জুলুম আর অত্যাচারের ফসল । বিজয়ী মিশর গণতান্ত্রিক বিশ্বে রূপ নিল বিজয় উল্লাস, ইসলামপ্রিয় বিশ্ববাসীর জন্য হয়ে উঠল মাইলফলক ,অন্য সবার জন্য হল প্রেরণার উৎস ।

 কিন্তু যারা মানবতা আর গণতন্ত্রের শত্রু আধিপত্যবাদী সেই সব পশ্চিমা দুষমণেরা মুরসির এ মহা বিজয়কে সামনে বাড়তে দিল না । অভিশপ্ত ইসরাইল চরম ক্ষিপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয়কে নির্মূলে টার্গেট নিল । ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে নিক্ষেপ করে মিশরের সেনাবাহিনী । নেতৃত্ব দিল প্রেসিডেন্ট মুরসির নিয়োগপ্রাপ্ত তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি । পশ্চিমাবিশ্বের মোড়লদের সহায়তায় প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড, মুরসিকে । মিথ্যা এক মামলা চাপিয়ে দিয়ে সেখানে বলা হয় মিশরের মধ্যে বিদেশের সন্ত্রাসীদের দিয়ে আক্রমণের ষড়যন্ত্রের গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান নায়ক প্রেসিডেন্ট মুরসি । তাই আসামী করা হয় মুরসি এবং তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের । সেই প্রহসনমূলক বিচারে অন্যায় স্বিদ্ধান্ত নেয়া হয় । বিচারে দেশোদ্রেীহিতার আসামী ঘোষণা দিয়ে মুরসিকে এক পর্যায়ে মৃত্যদন্ড দেয়া হয় । পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ বাতিল করে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় । বিশ্বনেতা ড. মোহাম্মদ মুরসিকে সেই থেকে কারাভ্যন্তরে সীমাহীন অবহেলা, অত্যাচার, হুমকী, মানসিক যাতনা ইত্যাদিতে আতংকিত করে ফেলে । তার ছেলে মেয়ে এবং পরিবারের অন্যান্যদের উপরও চালানো হয় সীমাহীন অত্যাচার । দলের নেতা কর্মীদের উপর কারাগারের ভিতর ও বাহিরে চলতে থাকে জেল জুলুমসহ অকথ্য রকমের নির্যাতন । এতোসব যন্ত্রণার ভারেই গত ১৭ই জুন ২০১৯ইং সাল মিশরের একটি আদালতে বক্তব্য দিবার সময় মহান এই নেতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়,‘আদালতের এজলাসে হঠাৎ পড়ে গিয়ে’ তার মৃত্যু হয় । গত ৭ ই মে মুরসি বলেছিলেন,তার জীবন হুমকীর মুখে।
সামরিক অভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত মিশরের ইতিহাসের প্রথম নির্বচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির লাশ কঠোর গোপনীয়তায় ১৮ ই জুন ভোরে কায়রোতে সরকারের লোক দিয়ে কড়া নিরাপত্তার সাথে দাফন করা হয় । এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে সারকিয়া প্রদেশের নিজ শহরে তার দাফনের অনুরোধ জানালে সরকার তা দেয় নি । তবে কায়রোর নসর এলাকায় গোপণীয় ওই দাফনে মুরসির পরিবারের সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হয় ।
মুরসির এ মৃত্যু বিশ্ববাসী মেনে নিতে পারছে না । সারা বিশ্ব মুরসির এমন নির্মম মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও শোকবার্তা জানাচ্ছে । তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন ,জালিমের কারাগারে শহিদ হয়েছেন মুরসি । কারাগারে নিক্ষেপ করে যারা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই জালিমদের ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না । আমাদের চোখে মুরসি একজন শহিদ । তিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছেন । ইতিহাস একনায়ক সেই জেনারেল সিসিকে ক্ষমা করবে না ,যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার যাবতীয় চক্রান্ত করা হয়েছিল । আদালতে নিজের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন তিনি । মিশরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা স্মরণ রাখবে । আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের শহিদ ভাইদের জন্য রহমত কামনা করছি । মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন । কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি । জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছে । তার দেয়া মৃত্যু দন্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা সব সময়ই নিরব থেকেছে ।
মিশরের জালিম শাসক হয়তো গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের অত্যাচার করে সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে । কিন্তু তাদের ত্যাগ - ইতিহাস মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না।
মিশরের ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এক বিবৃতিতে বলে,মুরসিকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে । চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি । দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে দেয়া হয়েছে । মৌলিক মানবাধিকারের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । আর এতে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে । হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মুরসির মৃত্যুতে বলেছে, তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । তার মৃত্যু ও আটকাদেশ নিয়ে একটি পূর্ণাংগ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ রিপোর্ট তৈরী করতে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আহবান জানিয়েছে । [চলবে]

গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-২



ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : [দুই]

কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার নিজের ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে শোক জানিয়ে বলেন,‘মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির হঠাৎ মৃত্যুর খবর পেয়ে মর্মাহত হয়েছি। তার পরিবার ও মিশরবাসীর জন্য সমবেদনা জানাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মকবুল আহমাদ ও সেক্রেটারি ড: শফিকুর রহমান গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন,মিশরের ইতিহাসে প্রথমবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিশরের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি দেশের একটি আদালতের এজলাসে রহস্যজনকভাবে ইন্তিকাল করার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তার রহস্যজনকভাবে ইন্তিকালে আমরা একজন স্বজন হারানোর গভীর বেদনা অনুভব করছি। ড. মুরসির রহস্যজনকভাবে ইন্তিকালে গোটা মুসলিম উম্মাহ গভীরভাবে শোকাভিভুত ও মর্মাহত। মিশরের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ড: মুরসিকে ২০১৩ সালে জে: আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি অবৈধভাবে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে প্রায় ৬ টি বছর অবৈধভাবে কারাগারে আটক রেখে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। সেই থেকেই মিশরের জনগণ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের উপর চলছে হত্যা,জুলুম, নির্যাতন । এছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছে । জে: সিসি মিশর থেকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও ন্যায় বিচার নির্বাসনে পাঠিয়ে গোটা দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে । সেখানে কারোর জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই । জে: সিসি সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ড: মুরসি আদালতের এজলাসে রহস্যজনকভাবে ইন্তিকাল করেছেন । এ ঘটনা মিশর সরকারের জুলুম নির্যাতনের জ্বলন্ত উদাহরণ । তারা বলেন, ইসলামী আদর্শ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তার এ আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও সকল মুক্তিকামী জনতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে । তারা আরো বলেন,আল্লাহ তায়ালা ড: মুরসির জীবনের সকল নেক আমল কবুল করে তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান করুন । আমরা তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজন,দলীয় সহকর্মী ও মিশরের শোক সন্তপ্ত জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে দোয়া করছি । আল্লাহ তাদের এ শোক সহ্য করার তৌফিক দান করুন ।
ড: মোহাম্মদ মুরসির ইন্তিকালে ছাত্রশিবিরের শোক: মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসির ইন্তিকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ও তাঁর শাহাদাতের কবুলিয়াতের জন্য সবাইকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির । যৌথ শোক বার্তায় ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন ও সেক্রেটারী জেনারেল মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন,সারা বিশ্বের ইসলামপ্রিয় কোটি জনতার প্রিয় নেতা মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি স্বৈরাচার জালিম শাসক আব্দুল ফাত্তাহ সিসির আদালতে থাকাবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন ) । ইসলামবিরোধী বর্বর শাসকের সাজানো মামলায় আটক থাকাবস্থায় জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি পরিবারের সান্নিধ্য, উন্নত চিকিৎসা - বঞ্চিত অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন । তাঁর এই বেদনাদায়ক ইন্তিকালে ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল,কর্মী ও বাংলাদেশের জনগণসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব গভীরভাবে শোকাহত ।
বিশ্ব বরেণ্য এই ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে শোকবাণী জ্ঞাপণ করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন,জনসেবা আন্দোলন,ফিলিস্তিনের হামাস, ব্রিটিশ সরকার প্রধান এবং বিশ্বের আরো অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ।
ড. মুরসির সোনালী জীবনমালা : মোহাম্মদ মুরসি ১৯৫১সালের ৮ই আগস্ট মিশরের আল শারক্বিয়্যাহর আল আদওয়াহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে। তার আব্বা ছিলেন একজন কৃষক । আম্মা ছিলেন সাধারণ গৃহিণী। মুরসিরা তিন ভাই ও দুই বোন । মেধাবী মুরসির প্রাথমিক ও সেকেন্ডারী স্কুলের লেখাপড়া সাফল্যের সাথে শেষ হয়েছে নিজ গ্রামে এর পর কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন । এর পর ১৯৭৫ - ৭৬ এ তিনি মিশর সেনাবাহিনীতে কাজ করেন । ১৯৭৮ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ১৯৮২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে অধ্যাপনা শুরু করেন । পরে আমেরিকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত । নাসার মত প্রতিষ্ঠানেও তিনি খুব সুনামের সাথে স্পেস শ্যাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে অনেক বড় ভ’মিকা রেখেছেন । এর পরে তিনি নিজ প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১০ সাল পর্যন্ত এভাবে সেখানে শিক্ষকতা করেন ।
তিনি ১৯৯২ সালে তিনি ইখওয়ানের সদস্য হন কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি ইসলামী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন । ১৯৯৫ ও ২০০০ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণ করেন এবং এমপি হিসেবে ইখওয়ানের পার্লামেন্টারিয়ান দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত এমপি হন অথচ তার পরিবর্তে তার বিরোধীকে জয়ী ঘোষণা দেয়া হয় । মিশরীয় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই নামকরা । ২০১১ সালের আরব বসন্তের ধাক্কায় মিশর যখন ভেংগে পড়ে, তিনি তখন বড় ভূমিকা পালন করেন । তিনিই সেই নেতা যিনি একদিকে ইখওয়ানের শুরা সদস্য আবার সমমনাদের নিয়ে গঠিত ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’গঠন করে উহাকে বিজয়ের মুখ দেখান । ২০১২ সালের নির্বাচনের আগে ইখওয়ান তাদের নেতা খায়রাত আশশাতেরকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থিতা ঘোষণা করে। পরে সাংগঠনিকভাবে মুরসিকেও প্রার্থী হৗয়ার জন্য নির্দেশ দেয় যেন খায়রাতকে বাতিল করা হলে তাকে ইখওয়ান সমর্থন দিতে পারে। তাই হল । খায়রাতকে বাতিল করা হল। পরে ইখওয়ান মুরসিকে সমর্থন জানায়। ২০১২ সালে ৫১.৭% ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী ঘোষিত হন। ২৪ শে জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষিত হন। শপথ নেন ৩ শে জুন ২০১২ তে। নতুনভাবে মিশরকে গড়ার সংগ্রাম শুরু করেন কেবল। কিন্তু পশ্চিমাদের চক্রান্তে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দলের সহকর্মীদেরসহ কারারুদ্ধ হন । [সমাপ্ত]

Sunday, July 7, 2019

মিসরের শহীদ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি প্রসঙ্গে



আশিকুল হামিদ : প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। নানাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতেও থাকবে। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে আন্দোলিত করে। বিশ্ববাসীর মনে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। গত ১৭ জুন মিসরের রাজধানী কায়রোর একটি আদালতে মৃত দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি ছিলেন তেমন একজন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে এ যুগের একজন মহামানব। অভিযোগ উঠেছে, মিসরে এ পর্যন্ত জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে আসলে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েফ এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু দেশ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। এর কারণ, তার মৃত্যু সাধারণ অসুস্থতার কারণে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ঘটেনি। তিনি মারা গেছেন আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে। জনাব মুরসি অজ্ঞান হয়ে মাটিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দীর্ঘ ২০ মিনিট পর্যন্ত সরকার কোনো চিকিৎসককে আনার ব্যবস্থা করেনি। অনেক পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সরকারিভাবেও প্রচার করে জানানো হয়, মোহাম্মদ মুরসি ইন্তিকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। পরদিন, ১৮ জুন তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে একই সময়ে জনাব মুরসির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতাই গায়েবানা জানাজায় শরিক হয়ে জনাব মুরসির মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছেন। তার নিজের দেশ মিসরে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটেছে। সেখানে প্রকাশ্যে কারো পক্ষে গায়েবানা জানাজা পড়া সম্ভব হয়নি। যারা পড়েছেন তারা গোপনীয়তা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, মিসরে এখন অবৈধ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির স্বৈরশাসন চলছে। দেশের সংবিধান সংশোধন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই এই জেনারেল আল-সিসিই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিথ্যা মামলায় কারাগারে ঢুকিয়েছিলেন। প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে জেনারেল সিসির সরকার জানিয়েছিল, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও কর্মকান্ডের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় জনাব মুরসিকে বন্দী করা হয়েছে। সে সময় থেকেই জনাব মুরসিকে করাগারে রেখেছে আল-সিসির সরকার।
অন্যদিকে ২০১৩ সাল থেকে বন্দী সাবেক প্রেসিডেন্ট বহুবার আদালতে অভিযোগ করেছেন, তার ওপর প্রচ- নির্যাতন চালানো হয় এবং তাকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে বাস করতেও বাধ্য করা হয়। তিনি দুর্গন্ধযুক্ত পচা ও বাসী খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তাকে কোনো ওষুধ ও চিকিৎসার সুযোগও দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে অন্য একটি তথ্যও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। বন্দী অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে জনাব মুরসি একবারের জন্য পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নামে মুসলিম হলেও আল-সিসির সরকার তাকে কোরআন শরীফও দেয়নি। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে জনাব মুরসি বলে গেছেন, তারা হয়তো জানেই না যে তিনি অর্থাৎ মোহাম্মদ মুরসি ৪০ বছর আগেই পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি শুধু কোরআন শরীফকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগটুকুও তাকে দেয়নি মুসলিম নামের আল-সিসির সরকার। এভাবে সব মিলিয়ে তাকে এত বেশি নির্যাতিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে, সাবেক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি তার জীবন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতিদের তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সবশেষে গত ১৭ জুন জনাব মোহাম্মদ মুরসির সে আশংকাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাকে আসলেও হত্যা করেছে আল-সিসির সরকার। না হলে একজন জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ২০ মিনিট পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মাটিতে ফেলে রাখা হতো না। একই কারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন। বিশ্বের মুসলিমরাও তাকে ‘শহীদ’ এর মর্যাদা দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে মোহাম্মদ মুরসির এবং সেই সাথে মিসরের ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, প্রায় ৮৪ বছর ধরে নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসিকে মেয়াদের এক বছরও পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। এর আগে প্রায় তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি। প্রচন্ড গণআন্দোলনের মুখে তার পতন ঘটে ১০ ফেব্রুয়ারি। হোসনি মোবারক ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার আট দিন পর। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা হিসেবে মোবারক চারবার প্রেসিডেন্ট পদে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। সেগুলো এমন নির্বাচন ছিল যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পাত্তাই পেতেন না। শেষবার ২০০৫ সালে নির্বাচনে মোবারক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেননি।
এভাবে সময়ে সময়ে লোক দেখানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মিসর আসলে ছিল অঘোষিত সামরিক শাসনের অধীনে। এরও শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে রাজা ফারুককে উৎখাত করার পর থেকে। প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা ফারুক বিরোধী অভ্যুত্থানের নেতা কর্নেল গামাল আবদেল নাসের। নাসেরের আমলে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলের সঙ্গে মিসরের যুদ্ধ হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংঘটিত সে যুদ্ধে গোটা বিশ্ব দাঁড়িয়েছিল মিসরের পক্ষে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নাসের সে সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোসেফ টিটোর সঙ্গে নাসের ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
অমন ভূমিকা ও অবস্থান সম্মানজনক হলেও মিসরকে প্রেসিডেন্ট নাসের গণতন্ত্রের পথে এগোতে দেননি, তিনি বরং সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার কৌশল হিসেবে তিনি এমনকি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণের অভিনয়ও করতেন। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসেছিলেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আরেক জেনারেল আনোয়ার সাদাত। ইসরাইলের সঙ্গে ক’টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে আনোয়ার সাদাত জনসমর্থন খুইয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর এক সদস্য তাকে প্রকাশ্য এক সামরিক অনুষ্ঠানে গুলী করে হত্যা করেছিলেন। আনোয়ার সাদাত মারা যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। এভাবেই মিসরে বছরের পর বছর ধরে চলেছে সামরিক শাসন। মুখে গণতন্ত্রের আড়াল নেয়া হলেও হোসনি মোবারকের ৩০ বছরই মিসর ছিল জরুরি অবস্থার অধীনে। মিসরে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হোসনি মোবারকের পতনের পর, ২০১২ সালের ৩০ জুন। প্রথম সে নির্বাচনে ৫১.২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ মুরসি। তিনি ছিলেন আল-ইখওয়ান আল-মুসলিমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী। ১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাববিদ ও রাজনীতিক হাসান আল বান্না। ১৯৪৮ সালে তাকে হত্যা করা হয়। একযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নেমে আসে সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতন। ১৯৫৪ সালে নাসেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতা-কর্মি ও সমর্থকদের ওপর চলতে থাকে প্রচন্ড নির্যাতন। সুদীর্ঘ এ সময়কালে মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন নেতাকে এমনকি ফাঁসিতেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। কিন্তু এত প্রতিক’লতার পরও মুসলিম ব্রাদারহুড শুধু টিকেই থাকেনি, গোপন তৎপরতার মাধ্যমে মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানেও পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্যই মোহাম্মদ মুরসি ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
কিন্তু নির্বাচিত হলেও এবং দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও গণভোটের মাধ্যমে সে সংবিধানকে পাস করিয়ে নিলেও রাষ্ট্রীয় কোনো একটি ক্ষেত্রেই মোহাম্মদ মুরসিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বা পদক্ষেপ নিতে দেয়া হয়নি। ড. মুরসি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। বাজেট ও ব্যয়সহ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে ২০১২ সালের আগস্টে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহিনীর কোনো সহযোগিতা পাননি। পাশাপাশি ছিল স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সাজিয়ে যাওয়া বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসন। অর্থাৎ সবদিক থেকেই প্রেসিডেন্ট মুরসি প্রচন্ড প্রতিক’ল এক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যার কারণে সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে জনকল্যাণমূলক কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল বারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। উল্লেখ্য, এই এল বারাদেই-ই প্রধান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক পরিদর্শক হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে ব্যাপক মানববিধ্বংসী সমরাস্ত্র রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সে মিথ্যাচারকে অবলম্বন করেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় মিসরেও এল বারাদেইকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তার কাছে এল বারাদেই চুপসে গিয়েছিলেন। তিনি এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা যে নীরবে বসে থাকেনি তারই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল আল-সিসির নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে। ২০১৩ সালের ৪ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থানে প্রমাণিত হয়েছে, মুরসি তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়ে মিসরে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে জানাজানি হতেও সময় লাগেনি। প্রমাণিত হয়েছে, এল বারাদেই এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা এতদিন নীরবে বসে থাকেনি। তারাই ঘটিয়েছিল মুরসি বিরোধী অভ্যুত্থান।
তারও আগে মূলত সেনাবাহিনীর অসহযোগিতাজনিত অক্ষমতাকে মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অযোগ্যতা হিসেবে প্রচার করেছে ক্ষমতালোভী চক্র। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল রারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। তারা সম্মিলিতভাবে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুরসি বিরোধী বিক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর রাতারাতি কোনো সুফল ভোগ করতে না পারায় তরুণরাও নতুন করে রাজপথে নেমে এসেছে। তারা লক্ষ্যই করেনি যে, প্রেসিডেন্ট মুরসির কথিত ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার পেছনে দায়ী আসলে ছিল সেনাবাহিনী। বিরামহীন উস্কানিতে বিক্ষুব্ধ তরুণদের পাশাপাশি মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজপথে আন্দোলন করেছে। সে অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী প্রসিডেন্ট মুরসিকে হঠাৎ ২০১৩ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং সংবিধান সংশোধন করাসহ বেশ কিছু শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছিল সেনাবাহিনী। ওদিকে মুরসির পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে শুরু হয়েছিল গণসমাবেশ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি সেনাবাহিনীর দাবি ও আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে মুরসি ঘোষণা করেছিলেন, জীবন দিতে হলেও অবৈধ কোনো শক্তির অশুভ ইচ্ছার কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না। তিনি বরং জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাংক্ষা এবং দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখবেন। প্রেসিডেন্ট মুরসির এই অস্বীকৃতি ও বলিষ্ঠ অবস্থান সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ইসলামবিরোধী পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক হিসেবে চিহ্নিত সাবেক ক’টনীতিক মোহাম্মদ এল বারাদেইসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দলের সমর্থন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই। সেদিন থেকেই কায়রোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন মুরসির সমর্থক লাখ লাখ নারী-পুরুষ। এসব স্থানে দিনের পর দিন অবস্থান করেছেন তারা। বন্দি প্রেসিডেন্ট মুরসির মুক্তি ও পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। তাদের ওপরই দিনের পর দিন ধরে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। তুরস্ক একে গণহত্যা বলেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি অস্ত্রের মুখে সমাবেশ পন্ড করতে এবং মুরসি সমর্থকদের রাজধানী কায়রো থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেও সেনাবাহিনীর পক্ষে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। কারণ, মোহাম্মদ মুরসি শুধু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টই ছিলেন না, ছিলেন এমন একদল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিওÑ যে দলটি নিষেধাজ্ঞা এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের মধ্যেও দীর্ঘ ৮৪ বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। জনপ্রিয়তারও শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল দলটি। অমন একটি দলকে কেবলই বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রাখা কিংবা নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে না। এরই মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়াও বইতে শুরু করেছিল বলেই মোহাম্মদ মুরসিকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, ৬৭ বছরের বেশি সময় ধরে সেনা শাসনে অতীষ্ঠ ও পিছিয়ে পড়া মিসরের সাধারণ মানুষও নতুন করে সেনাবাহিনীর অধীনস্থ হতে সহজে সম্মত হবে না। প্রেসিডেন্ট পদে মোহাম্মদ মুরসির পুনর্বহাল আর সম্ভব নয় সত্য, কিন্তু সংবিধান, গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে মিসরের জনগণ। সে ইঙ্গিত এর মধ্যে পাওয়াও যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আল-সিসির সেনাবাহিনী নতুন করে এক গভীর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ হবে না। সেনাবাহিনীকে বরং জনগণের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হবে।
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন হারাতে হলেও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রয়েছে এমন এক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড, ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতন পর্যন্ত নিষিদ্ধ অবস্থায় কাটানোর পরও যে দলটির প্রার্থী হিসেবেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। সুবিধাবাদী ও পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকদের সহযোগিতা নিয়ে সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করলেও তার দলই আবারও ক্ষমতায় আসতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। সব মিলিয়ে বলা যায়, মিসর আসলে নতুন করে এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মিসরকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। আবারও সুযোগ দিতে হবে গণতন্ত্রকে, যার সূচনা করতে হলে আয়োজন করতে হবে নতুন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। গণতন্ত্রসম্মত এই পথে যাওয়ার পরিবর্তে জেনারেল আল-সিসি যদি সামরিক শাসনের ভিত্তিকেই দৃঢ়মূল করার চেষ্টা চালান তাহলে সভ্য ও ঐতিহ্যের মুসলিম দেশটি এমনকি গৃহযুদ্ধেরও শিকার হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বলা দরকার, যা কিছুই ঘটুক না কেন মিসরের ভবিষ্যৎ সকল পরিবর্তনের পেছনে থাকবেন ‘শহীদ’ মোহাম্মদ মুরসি।

মুরসি সাহেবকে শহিদ বলা যাবে কি? দলিল সহ প্রমান দেখুন, কথা বললেন #মুফতি_আবুল_কালাম_আজাদ।

Popular Posts