Friday, November 30, 2018

পরামর্শভিত্তিক জীবন ও আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা মানবতার মুক্তির চাবিকাঠি । ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম


ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে দিন দিন জনসমর্থন বাড়ছে । হারুন ইবনে শাহাদাত

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর দমন পীড়নের চিত্র দেখে রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও আসল মিশন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। অনুগত বিরোধী দল রেখে বিশ্বের মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে বুঝাতে চায়- ‘তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় আন্তরিক’। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের নামে তারা যা চায় তা আসলে একদলীয় শাসন। কিন্তু ইতিহাস বলে এমন দুঃস্বপ্ন এদেশের জনগণ মেনে নেয় না। অতীতে যারাই জনগণের সাথে এমন চালাকি করছেন, তাদের পরিণতি ভালো হয়নি। এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানিদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করার দৃঢ়প্রত্যয়ে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তারা এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। অথচ স্বৈরাচারী শক্তি চেয়েছিল তাদেরকে ধ্বংস করতে কিন্তু পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক স্বৈরাচারের পতন হয়েছে গণআন্দোলনের মুখে। বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একই কায়দায় দেশে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল অভিযান শুরু করেছে। হামলা, মামলা, ফাঁসি, খুন, গুম, অপহরণ, জেল, জুলুম রিমান্ড থেকে শুরু করে দেশছাড়া পর্যন্ত করার হীন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে অব্যাহতভাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর ফলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, অপর দিকে বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক দলগুলোর পক্ষে দিন দিন জনসমর্থন বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট আজাদে প্রকাশিত মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জনগণেরও মৃত্যু নাই, গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নাই। তবু মাঝে মাঝে গণতন্ত্রের দম আটকাইয়া যায় আমাদের চোখের সামনেই। তার কারণ ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্টরা ওর গলা টিপিয়া ধরে।’ উল্লেখ্য প্রবন্ধটি পরে ‘শেরে-বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে।

নেতাতন্ত্র ইসলামে নেই
উপরে উল্লিখিত মরহুম আবুল মনসুর আহমদের উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে- ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের গণতন্ত্র কি ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্টদের কবলে পড়েছে? কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নয়, তারও আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের রক্তভেজা পল্টন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপদ ডেকে এনেছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরাই। তাদের ‘ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী পলিটিক্যাল অ্যাডভ্যাঞ্চারিস্ট’ নগ্ন আচরণের কারণে রাজনৈতিক ২০০৭ সালের ১/১১, অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি থেকেই গণতন্ত্র দম আটকানো অবস্থায় আছে। এর আগেও এদেশে গণতন্ত্রের দম অনেকবার আটকেছে। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফেরার পূর্ব পর্যন্ত এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকাল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মরহুম আমির অধ্যাপক গোলাম আযম প্রবর্তিত কেয়ারটেকার সরকার বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র একটু দম নেয়ার সুযোগ পায়। অবশ্য রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে অনেক সংকীর্ণমনা জ্ঞানপাপী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযমের এই চিরস্মরণীয় অবদান স্বীকার করতে চান না। অথচ যে সমাজতন্ত্রীরা বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস মনে করেন, তাদের গণতন্ত্রের মিত্র বলে গলা ফাটালেও তারা ইসলামকে গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করান। তারা অপপ্রচার চালান ইসলাম নেতাতন্ত্রে পরিচালিত। তাদের এই চিন্তা যে ভুল, তা আবুল মনসুর আহমদ অনেক আগেই বলে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, যে সামাজিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক গণতন্ত্রের বুনিয়াদ, সেটা মুসলমান সমাজে যত বেশি আছে আর কোনো সমাজে ততটা নেই। মানুষে-মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও সমান অধিকার, সকলের নজরে সকলের সমান মানবিক মর্যাদা মুসলমানের ধর্মীয় ঈমানের অঙ্গ। কাজেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতে, মুসলমান সমাজই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সবচেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র।’ নেতাতন্ত্রের জায়গা যে ইসলামে নেই উল্লিখিত প্রবন্ধে তাও পরিষ্কার করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। বলেছেন, ‘নেতাকে নির্ভুল ও বিচার-সমালোচনার ঊর্ধ্বে জ্ঞান করা নেতাতন্ত্রের মূল কথা। কিন্তু মুসলমানরা কোনোকালেই নেতাকে বিচার-সমালোচনার অতীত মনে করে নাই। তাদের পয়গাম্বর হজরত মুহাম্মদ জীবন-মৃত্যুর সাধারণ মানুষ, এটা তাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের শিক্ষা।’ জনগণকে বোকা বানিয়ে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে রাজনীতির মাঠ থেকে ইসলামপন্থীদের তাড়াতেই অপপ্রচার, জেল-জুলুম, মামলা-হামলা, ষড়যন্ত্র, খুন-গুম, হত্যা-নির্যাতনের বাক্স খুলেছে আধিপত্যবাদী শাসক ও তাদের দোসররা।
উন্নয়নের বুলিতে গণতন্ত্রবিমুখ হবে না জনগণ
১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট দৈনিক আজাদে মরহুম আবুল মনসুর আহমদের ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ নিবন্ধটি যখন প্রকাশিত হয়, সেই সময় ‘উন্নয়ন’ শব্দটি ছিল বহুল প্রচলিত। আইয়ুব খানের জাদুর স্পর্শে উন্নয়ন শব্দটি তখন অভিধান থেকে বের হয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। গণতন্ত্রের বিপরীতে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির অবস্থান তখন উচ্চমার্গে। ‘উন্নয়ন’র ঠেলায় মানুষের বাকস্বাধীনতাসহ সকল স্বাধীনতাই উর্দিওয়ালাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত। সেই সময় বিবেকের তাড়নায় বাধ্য হয়েই আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের হায়াত ফুরাইয়াছে কি?’ এই নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি জাতির বিবেক জাগাতে চেয়েছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রী সরকার সুস্পষ্ট কারণেই একটু মন্থরগতি। গণতন্ত্রী দেশে আইন আছে, আইন পরিষদ আছে, ডিবেট আছে, খবরের কাগজের সমালোচনা আছে, জনমতের বাদ-প্রতিবাদ আছে। সে দেশে বাজেট করিয়া খরচ করিতে হয়, খরচ করিয়া হিসাব দিতে হয়; অপরপক্ষে ডিক্টেটরের দেশে এসব হাঙ্গামা নাই। আইন নাই, আইনসভা নাই, খবরের কাগজের সমালোচনা নাই, সভার প্রতিবাদ নাই। বাজেটও নাই, খরচের হিসাব-নিকাশও নাই। গৌরী সেনের টাকা খরচ করেন এক ব্যক্তি তার মর্জি-মোতাবেক।’

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এখন আমাদের মাঝে নেই। তাঁর উত্তরসূরি সুযোগ্য সন্তান ডেইলি স্টারের সম্পাদক জনাব মাহফুজ আনাম আছেন। তার অনেক ভক্ত অনুরক্তও আছেন। তারাও নিশ্চয়ই আবুল মনসুর আহমদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বীকার করবেন, ‘গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।’
আবুল মনসুর আহমদ তার সময়ের স্বৈরশাসকের যে চিত্র তুলে ধরেছেন একুশ শতকে তার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন স্বৈরতন্ত্রের সংজ্ঞাও দেশে দেশে বদল হয়েছে। স্বৈরশাসকরা নির্বাচন নির্বাচন নাটক মঞ্চস্থ করেন। তাদের জাতীয় সংসদ আছে। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো আইন তৈরি করেন। সংবিধান পরিবর্তন করেন। বাজেট ঘোষণা ও পাস করেন। শত শত সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেন। কিন্তু ডিবেট নেই, খবরের কাগজের সমালোচনা নেই, আছে শুধু ‘স্তব’ আর ‘স্তুতি’। সমালোচনার বদলে চালু হয়েছে ‘ভালোচনা’ তথা ‘স্তব’। আসলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই শাসকরা পাল্টে ফেলেন। তারা নিজের শাসনকাল ছাড়া আরো শাসনকালকে গণতান্ত্রিক বলে মনে করেন না। নিজের দল ছাড়া অন্য কোনো দলকেও গণতান্ত্রিক বলে মনে করতে চান না। বিপত্তির সূচনা হয় এখান থেকেই। এই মানসিকতার কারণেই গণতন্ত্রের জন্য জানপ্রাণ, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন রাজনৈতিক দলও ক্ষমতার লড়াইয়ে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ বেমালুম ভুলে যায়। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রশ্নে প্রতিদিন নেতারা কথা বলছেন। তাতে জনগণের লাভটা কী? ওসব তো ক্ষমতায় যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়। বর্তমান অবস্থায় পাতানো নির্বাচন নয়, একটি অতি সুষ্ঠু নির্বাচনও বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াও সমস্যার সমাধান হবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে আরেকটি নির্বাচিত সরকার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারবে না। তা যদি পারত, তাহলে ১৯৯১ সালের পর ’৯৬-এর নির্বাচনেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডে পরিণত হতো। তা না হওয়ার কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজটি নেতারা করেননি গত ৪১ বছরে। গণতন্ত্র বলতে তারা বুঝেছেন ভোটাভুটি করে কোনো রকমে ক্ষমতায় যাওয়া। গণতন্ত্র অন্য জিনিস। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর সংগ্রাম ক্ষমতায় যাওয়ার সংগ্রাম ছিল না। একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। সে জন্যই তিনি শ্রদ্ধেয়। শুধু তাঁর নিজের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী। ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তিনি এখনো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাকতেন। ২৭ বছর জেল খাটার জন্য তিনি শ্রদ্ধেয় নন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো : ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪)


ইসলামপন্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে

শত অত্যাচার নির্যাতনের পরও দেশে ইসলামপন্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বিগত দুই বছরে জনসমর্থন দ্বিগুণ বেড়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিগত পর্যবেক্ষণ এবং ২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপটি পরিচালনা করেছে নিয়েলসন-বাংলাদেশ। গত ২০১৫ সালে মে ও জুন মাসে আড়াই হাজার প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের ওপর চালানো এই মতামত জরিপের একটি প্রশ্ন ছিল আপনি কি জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন, এই প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ২৫ জন ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন। অথচ মোট প্রাপ্ত ভোটের হিসাব বিবেচনা করে গত ২০১৩ পর্যন্ত রাজনীতি বিশ্লেষকদের প্রতিটি প্রতিবেদনেই তারা বলেছেন, জামায়াতের জনসমর্থন শতকরা ১২-১৩। এই হিসেবে দলটির জনসমর্থন দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সাল থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় এই ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর অকথ্য নির্মম নির্যাতন অব্যাহত আছে। বিরামহীন অপপ্রচার, ভিত্তিহীন অভিযোগ, হয়রানি, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্যাতন, ফাঁসি, গুম, খুনসহ হেন কৌশল অপকৌশল নেই যা জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে না। তারপরও দলটির এগিয়ে যাওয়া এর বিরোধী শক্তির মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে দলটির প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ছে। অত্যাচার নির্যাতন করে সরকার ভুল করছে এতে সমর্থন আরো বাড়বে- এমন ইঙ্গিত ২০১৩ সালেই দিয়েছিলেন ইরানের এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক পীর মুহাম্মদ মোল্লাযেহি। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রেডিও তেহরান সূত্রে প্রকাশ, পীর মুহাম্মদ মোল্লাযেহি বলেন, ‘বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে দেশটির সরকার।
এ লড়াইয়ের শেষ বিজয়ে
গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনকারীদের জীবন সুখের হয় না। উপরে উল্লিখিত দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর জেলখানায় কাটাতে হয়েছে। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জেলখানায় কেটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতে যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন এবং বর্তমানেও যারা করছেন, কারো পথ ফুলবিছানো নয়। তবে বর্তমানের মুখোশপরা স্বৈরাচারদের সাথে আন্দোলন সংগ্রাম আগের চেয়ে অনেক কঠিন, এতে সন্দেহ নেই। কারণ কারো অজানা নয়। মুখোশের আড়ালে লুকানো মুখ যে বেশি ভয়ঙ্কর, তা-ও সবার জানা। কিন্তু তারপরও থেমে নেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের সাহসী সৈনিকরা। খুন, গুম, মামলা-হামলাসহ নানান অপপ্রচারের জাল ছিন্ন করে তারা জীবনবাজির শপথ নিয়ে এগিয়ে চলছে। ইতিহাস সাক্ষী এই পথচলার শেষ মঞ্জিল বিজয়ের স্বর্ণদুয়ার।

আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, ‘গণতন্ত্র ধ্বংসের এদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইবে। এরা নিজেরাই ধ্বংস হইবে। গণতন্ত্র ধ্বংস হইবে না। গণতন্ত্রের হায়াত ফুরায় নাই।… গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন মুল্লুক যে মুদ্দতে চাঁদে মানুষ নামাইতে পারিল, ডিক্টেটরের দেশ রাশিয়া সে মুদ্দতে তা পারে নাই।’ উন্নয়নের যুক্তিতেই হিটলার, মুসোলিনি, আইয়ুব; জার্মান, ইতালি আর পাকিস্তানে ‘নেতাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের পরিণতি কারো অজানা নয়। রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সেই ভুল পথে হাঁটবে না। গণতন্ত্রহীনতার দেশ থেকে মুক্তি দিতে আগামী নির্বাচনকে অবশ্যই বড় চান্স হিসেবে নিবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে একটি রাজনৈতিক দলের কোনো কিছু হারানোর ভয় থাকার কথা নয়। একটি গণতান্ত্রিক দলের সবচেয়ে বড় শক্তি গণভিত্তি। স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে সেই ভিত্তির মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম বলেন, ‘সরকার জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে গোটা দেশটাকেই এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সরকার দেশকে রাজনীতিশূন্য করে একদলীয় শাসন কায়েম করার ষড়যন্ত্র করছে।’ এ টি এম মাসুম মনে করেন, সরকার ষড়যন্ত্রের পথ ছেড়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে। তা না হলে জনগণই তাদের ফিরতে বাধ্য করবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যা হয়েছেÑ এমন কোনো নির্বাচন আর হবে না। আওয়ামী লীগ যদি ভাবে, বিএনপি নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে বন্দী রেখে তারা অতি আনন্দে আরেকটি ৫ জানুয়ারি বাস্তবায়ন করবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে মানুষ।’
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, ‘এ সরকার একদিকে গুম, খুন, হত্যা, মামলা দিয়ে জুলুমের রাজত্ব কায়েম করেছে; অন্যদিকে অবাস্তব, কাল্পনিক বাজেট দিয়ে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো লুট করে এখন জনগণের টাকায় ভর্তুকি দিচ্ছে। দেশে লাখ লাখ যুবক বেকার, কর্মসংস্থান নেই। অথচ মেগা প্রজেক্টের বাজেট দিয়ে মেগা দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচন চাই। তবে তা হতে হবে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে। আমাদের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, সব দলের জন্য সমান সুযোগ রাখতে হবে।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে একমত, অত্যাচার-নির্যাতন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা আখেরে সুফল বয়ে আনে না। ইতিহাস সাক্ষী নীরব নিরীহ জনগণ ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠলে তাকে সামাল দেয়ার ক্ষমতা কোনো স্বৈরশাসকের থাকে না। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন হত্যাকাণ্ডের পর দেশে আরো অনেক খুন, গুম, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এখনো ঘটছে কাঙ্ক্ষিত না হলেও হয়তো আরো ঘটবে। তার মানে এই নয়, জনগণের মৃত্যু ঘটবে, গণতন্ত্রের দাফন-কাফন হবে। চূড়ান্ত সত্য হলো জনগণকে হত্যা করে নিঃশেষ করা যায় না। গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নেই। অবশেষে জনগণেরই বিজয় হয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সিনিয়র সাংবাদিক

Thursday, November 22, 2018

জাতীয় সংসদে প্রবেশে মাথা ঝুকানো আইন বাতিলের ভূমিকায় - আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী

জামায়াতনেতা কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালে ১৭ বছর বয়সে সুপারম্যান ছিলেন!!!!!!!!!


আমার দেখা মীর কাসেম আলী -ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক


আমার দেখা মীর কাসেম আলী

-ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক

১. ১৪৩৭ হিজরির জ্বিলহজ্জ মাসে (৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬) মীর কাশেম আলী ফাঁসীর কাষ্টে আরহোন করেন। জ্বিলহজ্জ মাস একটি পবিত্র মাস। সূরা ফজরের দ্বিতিয় আয়াতে এই মাসের ১ম দশ দিনের কসম খেয়েছেন। রাসূল সা: এর আগমনের পূর্বে অসভ্য আরব বেদুইনরাও এই মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত।

২. ২০১২ সালের ১৭ই জুনের বিকাল। চেম্বারে বসে কাজ করছি। হঠাৎ করে মীর কাশেম আলীর ফোন এল। পুলিশ তার দিগন্ত টেলিভিশনের অফিস ঘেরাও করে ফেলেছে। যেকোন মুহুর্তে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। কন্ঠ স্বাভাবিক। এই অনিশ্চয়তা ও উৎকন্ঠার মাঝেও তিনি দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম সেরে নিয়েছেন। তিনি যে কত প্রশান্ত হৃদয়ের ( সূরা আল ফজর, ৮৯:২৭) এবং শক্তিশালী মনের মানুষ ছিলেন, এটা তার প্রমান।

৩. বিভিন্ন পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের সাথে তার বেশ যোগাযোগ ছিল। দুই একজন মন্ত্রীর সাথেও তার সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে আশ্বস্ত করেছিল তার কোন সমস্যা হবেনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হল।

৪. তিনি খুব আশাবাদী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে তার যখন বিচার চলছিল, তখন আমাকে একাধিকবার বলেছেন: রাজনীতিবিদদের জন্য জেল জুলুম তো অপরিহার্য। খালাস পেয়ে বেরিয়ে আসবেন এমন একটা দৃঢ় বিশ্বাস তার ছিল।

৫. তিনি যথেষ্ট কর্মক্ষম ব্যাক্তি ছিলেন। তার কর্ম দক্ষতার সাক্ষর তিনি রেখে গেছেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, রাবেতা-ই-আলম আল-ইসলামী সহ অন্যন্ন সংস্থার সাথে তার সম্পৃক্ততা এবং সর্বপরি দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

৬. খুব সম্ভবত ৯০ এর দশকের শেষের দিকে একবার তার কর্মকান্ড নিয়ে আলাপের জন্য সময় চাইলাম। তিনি হোটেল সোনারগায়ে লান্চের দাওয়াত দিলেন। আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে তার সাথে বিস্তারিত আলাপ হল। মহিলাদের কাজের একটি ফাইন টিউনিং হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করলেন। রোকনিয়াতের জন্য নেকাব বাধ্যতামুলক হওয়া বান্চনিয় নয়। অন্যান্ন শর্ত পূরন কারী হিজাবী মহিলাদেরকেও রোকন করা উচিৎ। ঐদিনের আলোচনায় তার একটি কথা আমার মনে খুবই দাগ কেটে ছিল: “ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাথে আমার একটি চুক্তি হয়েছে; তিনি আমাকে আমার কোন প্রজেক্টে অকৃতকার্য করবেননা।” এই উক্তি তার সীমাহীন আত্ববিশ্বাসের পরিচয় বহন করে। দৈনিক নয়াদিগন্ত এবং দিগন্ত টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠা তার উত্তম স্বাক্ষর।

৭. তার কর্মক্ষমতায় আমি খুব মুগ্ধ ছিলাম। তিনি সংগঠনের অনেকটা প্রান্তসীমায় (periphery) কাজ করছিলেন। তাই তাকে যাতে সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল করা হয় এজন্য আমি তৎকালীন আমীরে জামায়াত এবং সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে ব্যাক্তিগত আলোচনায় জোর দাবী জানিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কোন কারনে তা হয়নি। ২০০৩ সালে আমাকেই প্রথমবারের মত সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল করা হয়। যদিও জামায়াতের মত এতবড় সংগঠনের এ দায়িত্বপালনের যোগ্য আমি ছিলাম না।

৮. পারিবারিক পর্যায়ে তার সাথে আমার খুব একটা উঠাবসা ছিলনা। একবার ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য তিনি সস্ত্রীক আমার বাসায় এসেছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে ভাবী খন্দকার আয়েশা খাতুনের সাথে আমার কোন কথা হয়নি। তার সাথে আমার প্রথম কথা হল আমাদের সকলের প্রিয় আরমান অপহ্রত হওয়ার পর। এরপর তারসাথে বেশ কয়েকবার আমার টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। সব সময় আমি তাকে সাহসী, ধৈয্যশীলা এবং আল্লাহর রহমতের উপর ভরসাকারীনী হিসাবেই পেয়েছি। আল্লাহ তার থেকে অনেক কঠিন পরিক্ষা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত জামায়াত নেতৃবৃন্দ যারাই ফাঁসীর কাষ্ঠে জীবন দিয়েছেন তাদের কারও পরিবারকে এরূপ অগ্নিপরিক্ষার সম্মুখিন হতে হয়নি। মীর কাশেম আলীর শাহাদাতের ৩ সপ্তাহ পূর্বে তার ২য় ছেলে আরমান অপহৃত হয় । নিরাপত্তাজনীত কারনে তার বড়ছেলে তখন দেশের বাইরে। দুই ছেলের অবর্তমানে স্বামীর শাহাদাত যে কী বিষম যাতনার ব্যাপার খন্দকার আয়েশার মত মায়েরাই শুধু তা অনুভব করতে পারেন।

৯. আরমানের মত সহজ সরল সজ্জন সদালাপী যুবক আজকের সমাজে পাওয়া খুবই দুস্কর। সে শুরু থেকেই আমার জুনিয়র ছিল। ব্যারিষ্টার হয়ে আসার পর থেকেই আমার চেম্বারে তার শিক্ষানবীশের কাজ শুরু হয়। তারপর হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট। কিন্তু আইনপেশার চাইতে তার কূটনৈতিক কাজের প্রতি ঝোক ছিল বেশী। ঢাকায় ডিপ্লম্যাটিক ফাংশন গুলোতে আমি প্রায়ই তাকে সাথে নিয়ে যেতাম। আমেরিকান দুতাবাস, বৃটিশ হাইকমিশন, কানাডিয়ান হাইকমিশন, চীনা দুতাবাস, রাশিয়ান দুতাবাসসহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক দুতাবাসের প্রোগ্রামেই সে আমার সাথে থাকত। খুব মনোযোগ সহকারে প্রত্যেকটি মিটিংয়ে নোট নিত এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারও সে বেশ রপ্ত করতে পেরেছিল। আমি ঢাকা ত্যাগ করার পর থেকে বেশ কয়েকটি দুতাবাস তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল।

১০. ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে সাথে নিয়ে বৃটেন এবং আমেরিকা সফর করি। বৃটিশ ফরেন এবং কমনওয়েলথ অফিস, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সিনেট, হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস এবং সুশীল সমাজের সাথে আমাদের অনেক বৈঠক হয়। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের অফিস হচ্ছে হোয়াইট হাউসের ভিতরে। নিরাপত্তাজনীত কারনে ইতিপূর্বে আমার সাথে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের সব বৈঠক হোয়াইট হাউজের আশেপাশে কোন একটি রেস্তোরাতেই হয়েছে। এইবার ব্যাতিক্রম হল। হোয়াইট হাউসের ভিতরেই আমাদের মিটিং হল কারন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার বাহিরে সফররত ছিলেন। তাই নিরাপত্তার কোন ঝামেলা ছিল না। তাছাড়া ন্যাশনাল সিকিউরিটির যে ভদ্রলোক সাউথ এশিয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। আরমান এইসব বৈঠকগুলো খুবই উপভোগ করেছে।

১১. সে ছিল খুব ভাল একজন সফর সঙ্গী। ঐ বছর আমেরিকায় দীর্ঘ সফরে যাওয়ার আগে তাকে নিয়ে দুদিনের জন্য ইংলিশ চ্যানেলের পাশে অবস্থিত ছোট্ট শহর ব্রাইটনে বেড়াতে গেলাম। ইসলামী আন্দোলনের এক নিবেদিত প্রান কর্মী আমরা ব্রাইটন যাব শুনে নিজে বড়শী দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল থেকে মাছ ধরে সে মাছের তরকারী আমাদেরকে পরিবেশন করেছে। আরমান আমাকে বলেছিল, “ স্যার দেখেন এরা কতটা ডেডিকেটেড”।

১২. ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার নির্বাসিত জীবন শুরু হলেও আরমানের সাথে টেলিফোন এবং স্কাইপের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ২০১৪ সালেও আমেরিকায় কুটনৈতিক সফরে সে আমার সাথী ছিল। ২০১৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক ডিপ্লমেটিক ট্রেনিংয়ে তার যাওয়ার ব্যাবস্থা হয়। ফেরার পথে সে কয়েকদিন লন্ডনে যাত্রা বিরতি করে। এ হচ্ছে আরমানের সাথে আমার শেষ দেখা।

১৩. ২০১৬ সালের জুন মাসে আমার আমেরিকা সফরের সময় তাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলাম। তখন মীর কাশেম আলীর বিচারের শেষ পর্যায়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। ইতিপূর্বে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয় ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে। শুধু বাকি ছিল সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ। প্রথমে মীর কাশেম আলী তাকে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য দেশের বাইরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু পরে কি যেন এক স্বপ্ন দেখে মত পরিবর্তন করলেন। আরমানের আর বাহিরে আসা হলনা। ঐ সফরে আমি তার অভাব খুবই অনুভব করেছি। এটা আমার দূর্ভাগ্য যে, মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের শুনানী ছাড়া ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্টে তাকে ডিফেন্ড করার সুযোগ থেকে আমি বন্চিত হয়েছি।

১৪. ৯ ই আগষ্ট ২০১৬ সালে গুম হওয়ার দুই একদিন পূর্বে আমার সাথে আরমানের দীর্ঘ আলাপ হয়। একদিকে পিতার মামলা, অন্যদিকে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সে ছিল খুবই উদবীগ্ন। আমাকে জিগ্গাসা করল বাসায় থাকবে কিনা? আমি তার বাসায় থাকার পক্ষে মত দিলাম। কারন এই সহজ সরল নিরপরাধ ছেলেটিকে কেও গুম করে নিবে তা চিন্তাও করতে পারিনি। আরমানের কোন দোষ ছিলনা। তার কোন অপরাধ ছিল না। সে কোন অভিযুক্ত ব্যাক্তি ছিল না। তবে তার ‘অপরাধ” ছিল একটাই, সে মীর কাশেম আলীর ছেলে। দেশে বিদেশে তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তাকে নিয়ে অনেক ক্যাম্পেইন হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তার নামে সম্পাদকীয় লিখেছে। ইংলিশ বার সহ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন বার এসোসিয়েশন তার মুক্তির দাবী তুলেছে। জাতি সংঘের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে তার গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুক্তি দাবী করা হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ক্রিমিনাল বার কোয়াটার্লির এবছরের আগষ্ট সংখ্যায় কেভিন ডেন্ট নামিয়ো এক ব্যারিষ্টার আরমানের মুক্তি দাবী করেছেন। কিন্তু প্রতিশোধের দেশ বাংলাদেশের কানে এসব আবেদন নিবেদন, অভিযোগ অনুযোগ কিছুই যে পৌছায় না। আরমানকে কে বা কার গুম করেছে তা আমরা জানিনা। গুমকারীদের প্রতি তার স্ত্রী, দুই অবুঝ সন্তান, পরিবার-পরিজন আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং আমাদের সকলের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে ধৈয্য ধারন করতে বলেছেন। “তাদের বলে দাও: আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তাছাড়া আর কোন ক্ষতিই আমাদের স্পর্শ করবেনা, আর আল্লাই আমাদের অভিভাবক”। (সূরা তাওবা, ৯:৫১)। “ আর আমরা আল্লাহরই উপর ভরসা করবনা কেন, যখন তিনি আমাদেরকে জীবনের পথে পথ দেখিয়েছেন? তোমরা আমাদের কে যে যন্ত্রনা দিচ্ছ তার উপর আমরা সবর করব, এবং ভরসাকারীদের ভরসা শুধুমাত্র আল্লাহর উপরই হওয়া উচিত।” (সূরা ইবরাহীম, ১৪:১২)।

১৫. গত ইদুল ফিতরের ছুটিতে উত্তর আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিলাম কিছু জিনিস সচক্ষে দেখার জন্য। বেলফাস্ট এবং লন্ডন ডেইরীর মত শহরের মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট উচু দেয়াল দেয়া হয়েছিল যা এখনও বিদ্যমান আছে। ক্যাথলিক এবং প্রোটেষ্টান্ট এ দুই গ্রুপের মাঝে সংঘাত এড়ানোর জন্য। অনেকটা যেন অধুনালুপ্ত বার্লিন ওয়ালের মত। ক্যাথলিকরা উত্তর আয়ারল্যান্ডকে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সাথে সংযুক্তির পক্ষে, আর প্রটেষ্ট্যান্টরা বৃটেনের অংশ হিসাবেই থাকতে চায়। কিন্তু সেখানেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আই আর এ) রাজপরিবারের অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য এবং অবিভক্ত ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটন কে হত্যা করেছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠার পর সেই আই আর এ নেতা মার্টিন মেগেনেসের সাথে (যিনি কিছুদিন পূর্বে মারা গেছেন) রানী এলিজাবেথ হাত মিলাতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। বাংলাদেশে ক্যাথলিক এবং প্রোটেষ্ট্যান্টদের মত কোন ধর্মীয় বিভক্তি নেই। কোন জাতিগত ভেদাভেদও নেই। সবাই একই বাংলার সন্তান। তারপরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক এই বিভাজন আর কতদিন চলবে? কবে অবসান হবে এই হানাহানি এই হত্যা এই প্রতিশোধ এবং এই গুমের রাজনীতি!

১৬. মীর কাশেম আলী আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। আজকের এই দিনে রাব্বুল আলামিনের দরবারে তার মাগফেরাত কামনা করছি, তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দেবার জন্য মোনাজাত করছি। আর পথপানে চেয়ে আছি কখন আমাদের প্রিয় আরমান আমাদের কাছে আবার ফিরে আসবে। ফিরে সে আসবেই, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে নেই, (সূরা যুমার, ৩৯:৫৩)। হযরত ইউসূফ আ: এর নিখোজ হওয়া এবং তার ছোট ভাই বিনইয়ামিনকে মিশরের বাদশার দরবারে আটক হওয়ার পর, হযরত ইয়াকুব আ: তার ছেলেদেরকে দুই জনের ব্যাপার অনুসন্ধান করতে বলে এই হেদায়াত করেছিলেন যে, “শুধুমাত্র কাফেররা ছাড়া আর কেও আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয় না” (সূরা ইউসূফ, ১২:৮৭)। আল্লাহ তায়ালা প্রায় ৪০ বছর পর হযরত ইউসূফকে তার পিতা হযরত ইয়াকুবের কাছে ফিরিয়ে এনেছিলেন।

Wednesday, November 7, 2018

যে ৩টি দল বর্তমানে ইসলামকে ধ্বংস করছে না জানলে জেনে নিন। Sayed Anwer Hossain Taher Zabiry



চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের খতিব কি সত্যিই আওলাদে রাসুল ???

Popular Posts