Friday, March 23, 2018

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদ গানের নতুন জগৎ -ড. নঈম আহমেদ


শিল্পী গায়ক নয়তো মোদের আসল পরিচয়
আল কুরআনের কর্মী মোরা বিপ্লবী নির্ভয়
শিল্পী থেকে কর্মী বড়
সুর ছড়িয়ে যাই ॥

বাংলা গানের জগতে মতিউর রহমান মল্লিক একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতসাধক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন সে-সময় গণমাধ্যমে ইসলামী গান অবহেলিত ছিলো। বিশেষভাবে খালি কণ্ঠে বাজনা ছাড়া গান কল্পনাই করা হতো না। সময়ের দাবি অনুযায়ী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী গানের নতুন দিগন্ত তিনি সৃষ্টি করেন। [দ্র. আহমদ বাসির সম্পাদিত মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, ঢাকা: মর্নিং ব্রিজ, ২০১৭, পৃ. ১৯] স্বকণ্ঠে স্বরচিত ও নিজের সুরারোপিত গানের অ্যালবাম প্রতীতি: এক (১৯৯৩) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রতীতি: দুই (১৯৯৪) এই পরিচয়কে আরো বেশি প্রতিষ্ঠা দান করে। গীতিকার হিসেবেও তিনি সফলতার পরিচয় দেন। ঝংকার (১৯৭৮), যত গান গেয়েছি (১৯৮৭), প্রাণের ভেতরে প্রাণ (২০১০) এবং অপ্রকাশিত গীতিকাব্য চিরকালের গান তাঁর গানের সঙ্কলন একজন গীতিকার ও সঙ্গীত সাধকরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন একাধিক গানের সঙ্কলন।
মতিউর রহমান মল্লিক কিভাবে ইসলামী সাংস্কৃতিক জগতে আসেন এবং গানের প্রতি অনুরাগী হলেন সে বিষয়ে নিজের মন্তব্য : ‘আমি একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের পরিবারে আগে থেকেই একটি জারির দল ছিলো। আমার আব্বা ঐ জারি দলের জন্য বিশাল বিশাল জারি গান লিখে দিতেন। আর এই গান আমার ছোট চাচা আমাদের এলাকায় গেয়ে বেড়াতেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা আমাদের আত্মীয়স্বজন ছিলো। আমার আব্বা কবিতা লিখতেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে আমার আব্বা ২-৩ মাইল দূরে গিয়ে পত্রিকা পড়ে আসতেন। রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করতেন, সেই আসরে আমার বড় ভাই কবিতা পড়েছেন। যে কবিতা ফররুখ আহমদ নিজে অনুমোদন করেছেন। ছোটবেলা থেকে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এবং অনেক গান লিখেও ফেলেছিলাম। যার সবগুলোই ছিলো প্রেমের গান। আমি যখন ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম, তখন আমার গান লেখার মোড় ঘুরে যায়। দেশ, মুসলমান, ইসলামী আন্দোলনের জয়গান লেখা শুরু করলাম। প্রেমের গানের লেখার পর্ব ছুটে গেল।’ [আবিদ আজমের নেয়া মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, রহমান তাওহীদ সম্পাদিত রিদম, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৭]
মতিউর রহমান মল্লিকের জীবনকালেই ‘কবি’ অভিধা তার নামের সাথে অবিভাজ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রধানত কবি, যদিও এ যাবৎ প্রকাশিত তার কবিতার সংখ্যা তার রচিত গানের তুলনায় কম। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, কবি না হলে কেউ গান লিখতে পারে না। পৃথিবীর সকল গীতিকারই মূলত কবি। অনেক খ্যাতনামা কবির প্রখ্যাত অনেক কবিতাও গান আকারে গীত হয়ে থাকে। কবিতার মধ্যে যেমন মিল, ছন্দ, ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি রয়েছে, গানের মধ্যেও তার উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে গানের মধ্যে গীতলতার দিকটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, গান একটি নির্দিষ্ট সুর, তাল-লয় ও আকারে সীমাবদ্ধ থাকে, কবিতার ক্ষেত্রে অতটা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই গান রচনার সময় কবিকে অধিকতর সচেতনতা ও শিল্পবোধের পরিচয় দিতে হয়। সেজন্য গীতিকার যখন শব্দ নিয়ে খেলা করেন, তখন তাকে সুর-তাল-লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে সজাগ-সতর্ক থাকতে হয়। গানের সফলতা অনেকটা এর ওপর নির্ভরশীল। মতিউর রহমান মল্লিকের কবি-স্বভাবের মধ্যে গীতিধর্মিতার প্রাবল্য তাকে একজন সার্থক এবং বহুলপ্রজ গীতিকার হিসেবে সাফল্য ও খ্যাতি এনে দিয়েছে। মল্লিক নিজে একজন সুগায়ক ছিলেন। গান রচনার সাথে সাথে তিনি তাতে সুরারোপ করতেন ও গাইতেন। [মুহম্মদ মতিউর রহমান, মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্যকর্ম, পৃ. ১৬১] সার্থক গীতিকার হওয়ার জন্য এটা এক অপরিহার্য গুণ। যিনি গায়ক তিনি গানের সুর, তাল, লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। সার্থক গান রচনার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। তাঁর মধ্যে সে গুণের কমতি ছিল না। তাই তার রচিত গান সার্থক বলা যায়। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার মধ্যে গীতিকার হিসেবে তার সাফল্য তুলনামূলকভাবে অধিক।
তারুণ্য-যৌবনের কবি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের সুরেলা পাখি। মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বাণী ও সুরের মৌলিকতা ও বৈচিত্র্য বিশেষত্বপূর্ণ। উত্তরাধিকারের পথে নতুন বাঁক-বদল। তাঁর গানের কথার বিষয় নানা মাত্রিক, নানা সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি। ইসলামী আন্দোলনের পথপরিক্রমায় জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে তিনি গানের সম্ভার রচনা করেন। তাঁর গানের বিষয়বৈচিত্র্যকে নি¤েœাক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা: ক. হামদ, খ. নাতে রাসূল সা., গ. ইসলামী আন্দোলন, ঘ. দেশপ্রেম, ঙ. প্রকৃতি, চ. আধুনিক জীবনমুখী, ছ. আধ্যাত্মিক/ মৃত্যুচেতনা, জ. ইসলামী সংস্কৃতি, ঝ. বিবিধ।
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর।
আল্লাহর প্রশংসামূলক বা তাঁর গুণের কথামালাসম্পন্ন সুরারোপিত গানকে হামদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে মানুষ প্রেরিত হয়েছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। আর প্রতিনিধির কাজ হলো আল্লাহর ইবাদত করা। সেই দিক বিবেচনায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করা। সৃষ্টিশীল মানুষ যারা হেদায়াত প্রাপ্ত তারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বিশেষভাবে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর গুণ, কার্যাবলি ও মহিমা নিয়ে সৃজনশীল কাজ করে থাকেন। রাসূল সা:-এর সময়ে যে সমস্ত সাহাবী কবিতা লিখতেন তারা প্রধানত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই লিখতেন। হাসসান ইবনে সাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ সাহাবী আল্লাহর প্রশংসা, গুণাবলি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, ফেরদৌসী প্রমুখ সাহিত্যিক হামদ রচনায় বিশ^সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই ধারা পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিককালেও কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর মহিমা কীর্তনে সৃষ্টিশীল। আল্লামা ইকবাল এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় স্মরণীয়, বরণীয় ও প্রভাবশালী। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগে অসংখ্য কবি আল্লাহর প্রশংসামূলক কবিতা লিখেছেন। আধুনিককালে কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসন, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদ বিপুল পরিমাণে হামদ রচনা করেছেন।
এই ধারায় মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা গানের ভুবনে হামদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর একজন কৃতজ্ঞ বান্দা, কবি-সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি বাংলা গানে নতুন সুর, ছন্দ, কথা, আবহ ও বাঁক এনেছেন। গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতো একই মতাদর্শের পথিক হয়েও একক গানের জগৎ নির্মাণ করেন। ‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীত পর্বের কিছু দৃষ্টান্ত :
দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো দীপ্ত সৃষ্টির জন্য
দেখবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কত না অনন্য ॥

বিহঙ্গ তার পক্ষ দোলায়
দূর বিমানে শূন্য কোলায়
কে রাখে ভাসিয়ে তারে ভাবনা সামান্য॥

সমতল আর পর্বতমালা
এই কোলাহল ঐ নিরালা
কার মহিমা জড়িয়ে রাখে গহনও অরণ্য॥
[প্রতীতি]

মাঠ ভরা ওই সবুজ দেখে
নীল আকাশে স্বপ্ন এঁকে
যার কথা মনে পড়ে
সে যে আমার পালনেওয়ালা॥
[প্রতীতি]

এসো গাই আল্লাহ নামের গান
এসো গাই গানের সেরা গান
তনুমনে তুলবো তুমুল
তূর্য তাল ও তান॥
[প্রতীতি]

বিশ্বজগতের বিশাল ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি যে কোন মানুষকে বিস্মিত ও ভাবুক করে তোলে। সৃষ্টিশীল কবি মতিউর রহমান মল্লিক গানের খাতায় এই পৃথিবীর রূপে-রসে-রঙে-রেখায় মনোযোগ দিয়ে আবেগে আপ্লুত এই ভেবে যে, আল্লাহ কিভাবে কী অসীম নির্মাণশৈলীতে এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের রহস্য, চারপাশের পরিবেশ, চাঁদ-সূর্য-তারা-আলোকমালা, নদী-সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য-জলাশয় এবং এই সবের মাঝে সুন্দরের সন্ধানে কবি আল্লাহর মহত্ত্ব ও অসীম কুদরত অনুভব করেছেন ও দেখেছেন। সৃষ্টির মাঝেই ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যে অনন্য সে অনুভব করার জন্যও শ্রোতাকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ যে পালনকর্তা ও রিজিকদাতা সে কথাও গভীরভাবে গানে ব্যক্ত করেন।
‘প্রতীতি’ প্রথম গানের সংকলনে এই হামদগুলো স্থান পায়। সৃষ্টির মাঝে ¯্রষ্টার ছায়া ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন গীতিকার। কিছু কিছু গানে সুফি মতের প্রভাব লক্ষণীয়। সুফি মতের কেন্দ্রে আছে আল্লাহর ধারণা। বিভিন্ন সুফি মতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার: আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকিক বলখি, ইব্রাহীম আদম, রাবিয়া বসরী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (Semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহ্ প্রেম ও পাপভীতিই এই মতের সুফিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্রেমকামীরূপে কল্পনা করেছেন যাঁরা তাঁদের মতে, আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সুফিরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর Manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হলো প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্রেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সুফিরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্রেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্রেমানলেÑ হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহ। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্বÑ যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহম’ বোধে। এই মতের সুফিদের মধ্যে বায়জিদ বোস্তামি, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। [আহমদ শরীফ, বাংলার সুফি সাহিত্য, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৩, পৃ. ২৪] অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। সৃষ্টি মাত্রই ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্রহ্মেতে লীন। সুফি মতে, আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্ভূ জ্যোতি’। Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতো প্রকাশ। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সুফিব্রত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ‘ইনসানুল কামেল’। প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের। মতিউর রহমান মল্লিক উভয় ক্ষেত্রেই মনোযোগী।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ
নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া
পাখির গানে গানে
হাওয়ার তানে তানে
ঐ নামেরই পাই মহিমা
হলে আপনহারা ॥
আল্লাহ নামের গান গেয়ে দেখ
কেমন লাগে নামের সুর
ঐ নামে যে যাদু রাখা
ঐ নামে যে শহদ মাখা
পান করে দেখো কী মধুর ॥
[ঝংকার]

আজকে আমার প্রাণ-সাগরে
আল্লাহ নামের নুর
উথাল পাথাল ঢেউ তুলেছে
যেনো পাহাড় তুর ॥
[ঝংকার]

হাত পেতেছে এই গোনাহগার
তোমারি দরগায় খোদা তোমারি দরগায়
শূন্য হাতে ওগো তুমি
ফিরাইও না হায়, মোরে ফিরাইও না হায় ॥
আমার কণ্ঠে এমন সুধা
দাও ঢেলে দাও হে পরোয়ার
যদি পিয়ে এই ঘুমন্ত জাত
ভাঙে যেনো রুদ্ধ দ্বার।
[ঝংকার]
‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীতের পর ‘ঝংকার’ গীতিকাব্যে মতিউর রহমান মল্লিক হামদে আরো বৈচিত্র্য আনেন। আল্লাহ নামের উচ্চারণে, রূপে ও মহিমায় কবি দিশেহারা। তাঁর নামের গুণের মুগ্ধতায় কবি নূরের উজ্জ্বলতায় পাখিদের গানে, ঝরনার সুরে, সবুজে ও রোদে আল্লাহ নামের মহিমা অনুভব করেছেন। প্রাকৃতিক সবকিছুতেই তিনি ¯্রষ্টার সৃজনশৈলী লক্ষ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ গানের কথায় শিল্পসম্মত রূপে প্রকাশ করেন।
তুমি দয়ার অথৈ পারাবার
দুঃখের সাগর তুমি কর পার
পাপী তাপি সব গোনাহগার
চাহি তোমার করুণা।-
[যত গান গেয়েছি]

আমাকে দাও সে ঈমান
আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে
অসংকোচে
গায় জীবনের গান।
[যত গান গেয়েছি]

কথায় কাজে মিল দাও আমার
রাব্বুল আলামিন
আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লায়
রাখো বিরামহীন।
[যত গান গেয়েছি]

ঈমানের দাবি যদি কোরবানি হয়
সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার
প্রভু দয়াময়।
[যত গান গেয়েছি]

আমি পাখির কাছে বললাম
নদীর কাছে শুধালাম
তোমাদের গান তোমাদের সুর
কেন এমন মনোহর
কেন এমন সুন্দর
ওরা বললো শুধু বললো:
আমাদের কণ্ঠে ¯্রষ্টার নাম
অঙ্গে অঙ্গে তার সৃষ্টি দাম
আমাদের গান আমাদের সুর
তাই তো এমন মনোহর
তাই তো এমন সুন্দর।
[যত গান গেয়েছি]

যখন পথের দিশা দিয়েছো খোদা
তখন বিপথে তুমি নিও না
যেই পথ কোরানের
যেই পথ রসূলের
সেই পথ ছেড়ে যেতে দিও না।
[যত গান গেয়েছি]
‘যত গান গেয়েছি’ পর্বের হামদে মতিউর রহমান মল্লিক বাস্তব জীবন সংগ্রাম-আন্দোলনের দুর্গম পথে এবং ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন, করুণা ও সাহায্য চেয়েছেন এবং তাকেই সহায়-সম্বল ভেবেছেন। নিজেকে গোনাহগার-পাপী হিসেবে উপস্থাপন করে পরকালের অথৈ সাগর পারাপারের জন্য আকুল আবেদন করেছেন। সেই সাথে সেই ঈমানের জন্য দরখাস্ত করেছেন যে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে স্বেচ্ছায় ফাঁসির মঞ্চে নির্ভীকভাবে দাঁড়াতে পারেন; আল্লাহর রাজ কায়েমের জন্য জিহাদে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের ময়দানে লড়াকু হতে ঈমানের জোর চাই, ঈমানের দাবি যে কোরবানি সেই কোরবানির জন্য সেই শক্তি কামনা করেছেন কবি আল্লাহর কাছে। যে পথ কোরআনের ও রাসূলের সেই পথের ঠিকানা যেহেতু একবার আল্লাহ দয়া করে দিয়েছেন সেই পথে যেন চলতে শক্তি দেন, সেই দোয়া করেছেন। আল্লাহর মহিমা ও গুণের কথা কবি ফুল-পাখি-নদীসহ প্রকৃতির কাছে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছেন এক আল্লাহর অসীম অনন্ত মহিমা। পরবর্তী গীতিকাব্য ‘প্রাণের ভেতরে প্রাণ’-এ হামদ নেই। অন্যান্য বিষয়ে গান আছে।
মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায় এভাবে-
ক. আল্লাহর গুণাগুণ, রূপ-অরূপ, শক্তি-মহিমা-শ্রেষ্ঠত্ব, সর্বাত্মক সত্তার প্রশংসা তাঁর হামদে প্রকাশিত;
খ. জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেছেন ও করুণা চেয়েছেন;
গ. বিশেষভাবে জীবন সংগ্রামে, ত্যাগে, লড়াইয়ে, কঠিন বিপদে ও দুঃখে জয়ী হতে আল্লাহর কাছে সাহায্য-সহযোগিতা ও শক্তি প্রার্থনা করেছেন;
ঘ. মহান রবের প্রতি গভীর বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা-প্রেমের পরিচয় হামদের মাঝে প্রতিফলিত;
ঙ. আল্লাহর মহত্ত্বের সাথে সাথে পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব কায়েমের কথাও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন;
চ. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উজ্জীবনে এই হামদগুলো অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী;
ছ. সুর সংযেজনের দিক থেকে মৌলিকত্ব ও নতুনত্ব লক্ষণীয়।

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের সুর কবি নিজেই করেছেন নিজ সঙ্গীত প্রতিভায়। একদম নতুন সুর সংযোজন ঘটিয়েছেন এইসব হামদে যা বাংলা গানে অভিনব। নজরুলের গানের বা হামদের দূরগত প্রভাব থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব নেই এতে। শেষের দিকে কিছু গানে অন্যরাও সুর দিয়েছেন।
লেখক : কবি ও গবেষক

Wednesday, March 21, 2018

ছাত্রশিবিরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং অবদান

উপমহাদেশের রাজনীতির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির শক্ত অবস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনসমূহের রয়েছে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির মাঝে পার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতায় এখানে যেমন রয়েছে ভিন্ন আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ তেমনি রয়েছে অনেক দলের অঙ্গীভূত ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশের বুকে রয়েছে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা ছাত্র সংগঠনসমূহ। তারই পাশাপাশি কাজ করছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কতিপয় সংগঠন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠা, দলীয় লেজুড়বৃত্তিমুক্ত এক আলোকিত ছাত্রসংগঠনের নাম, একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে পথচলা শুরু করে একে একে ৪১টি বছর পেছনে ফেলে এ সংগঠন রচনা করেছে এক গৌরবময় ইতিহাস। একটি গঠনমূলক গতিশীল গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে, একটি একক ও অনন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে, মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জনতার মনে, লক্ষ তরুণের হৃদয়ে করে নিয়েছে তার স্থায়ী আসন।
শিবিরের বিগত ৪১ বছরের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের অনেক রকম মূল্যায়ন হতে পারে, পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবেও হতে পারে অপর বিবেচনা। একটি অনন্য সংগঠনের প্রায় তিনযুগের ইতিহাস সত্যি সত্যিই সচেতন, নিরপেক্ষ ও যথার্থ বিবেচনার দাবি রাখে।
একটি নিরন্তর সংগ্রামরত ছাত্রসংগঠন হিসেবে ৪১ বছর ধরে অব্যাহত ধারায় কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির রচনা করেছে গৌরবময় ইতিহাস। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অনেক ঐতিহ্য। দেশ-জনতার সুবিবেচনার জন্য সে বিষয়গুলো তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
শিবিরের আত্মপ্রকাশ সময়ের অনিবার্য বাস্তবতা কোন প্রেক্ষাপট ছাড়া যেমন কোন ঐতিহাসিক ঘটনা জন্ম নেয় না, তেমনি কোন প্রয়োজন ছাড়া সংগঠনেরও জন্ম হয় না। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা ছিল তৎকালীন সময়ের এক অনিবার্য দাবি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এ ধরনের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশকে অনিবার্য করে তোলে।
ক. স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ী হয় মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটি স্বাধীন দেশ, একটি ভৌগোলিক মানচিত্র, একটি লাল-সবুজ পতাকা লাভ করলেও দেশের মানুষের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানকারী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত সহসাই আমাদের সাথে ‘দাদাগিরি’ শুরু করে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চলে যেতে থাকে আমাদের দামী দামী সম্পদরাজি। প্রতিবাদ করার অপরাধে দেশের প্রথম রাজনৈতিক বন্দী হন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ. জলিল। অল্প সময়ের মাঝেই দেখা দিলো দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক দেওলিয়াত্ব। সামগ্রিক অরাজকতা অতি অল্প সময়ের মাঝে দেশটির স্বাধীনতাকে এক ধরনের পরাধীনতায় রূপান্তরিত করলো। যাকে প্রখ্যাত গবেষক আবুল মনছুর আহমদ বললেন ‘বেশি দামে কেনা, কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’।
৭১ থেকে ৭৫ এর সাড়ে তিন বছর সময়কাল। এ সময়ের মাঝেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো একদলীয় স্বৈর সরকার ‘বাকশাল’। সকল দলের, সকল মতের টুঁটি চেপে ধরা হলো। ইসলামের নামে যে কোন দল বা সংগঠন করা নিষিদ্ধ হলো। সরকার নিয়ন্ত্রিত ৪টি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হলো। কালা-কানুনের যাঁতাকলে পিষ্ট হলো মানুষ। হারালো বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। ৩০ হাজার তরুণ প্রাণ দিলো প্রতিবাদ করতে গিয়ে। দেশ চলে গেলো “এক নেতা এক দেশ” শ্লোগানধারী একদল উচ্ছৃঙ্খল ও জিঘাংসু বাহিনীর কবলে। হাতে বালাশৃঙ্খল পরিহিত এই সব উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা প্রশাসন নামক কুশাসনের ছত্রছায়ায় সর্বত্র জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললো। সামগ্রিক এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের কান্নার অধিকারও যেনো হারিয়ে গেলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে জীবন দিলো, কাপড়ের অভাবে বাসন্তীরা ছেঁড়া জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে বাধ্য হলো, মানুষে-কুকুরে কাড়াকাড়ি করলো ডাস্টবিনের উচ্ছ্বিষ্ট খাবার নিয়ে। ক্ষমতাশীনদের সন্তান-সন্ততিরা উঠে গেলো আইনের ঊর্ধ্বে। নিরীহ মানুষেরা শিকার হতে লাগলো কালো আইনের কঠোর থাবার।
খ. সোনার বাংলার স্বপ্ন : সোনার মানুষের অভাব বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এক স্বপ্নের দেশ। এক সময় এ দেশে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো। এখানে ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর গৃহ ভরা স্নেহপ্রীতি। তাই এই বাংলাকে বলা হতো ‘সোনার বাংলা’। বারবার ঔপনিবেশিক শাসন, বর্গীদের হানা এই বাংলার জনপদের সুখ-সমৃদ্ধি ও স্থিতি ছিনিয়ে নেয়ার অপপ্রয়াস পেয়েছে। সেজন্য যারাই মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছে তারাই বলেছে আমরা সোনার বাংলা কায়েম করবো। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামেও এ কথা বলেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মনে আশার আলো জাগানো হয়েছিলো, মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলো কারা? সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই বললেন- “মানুষ পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে সর্বত্র চোর। সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল এসেছে- আমার কম্বল কই?” একটি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা যতো সহজ তা বাস্তবায়ন তত সহজ নয়। এজন্য চাই একদল সোনার মানুষ। সৎ, সত্যনিষ্ঠ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক একদল মানুষ -যাদের মূল্য হবে স্বর্ণের চেয়ে বেশি। এমন একদল মানুষ ছাড়া কিভাবে সম্ভব এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন? মূলত মানুষ তৈরী হয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। আম খেতে হলে যেমন আমগাছের চারা লাগাতে হয়। তেমনি একদল সোনার মানুষ তৈরীর জন্য উপযুক্ত একটি শিা ব্যবস্থার প্রয়োজন। বিগত প্রায় সোয়া দুইশত বছর পর্যন্ত আমরা ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মেনে চলছি।
একজন খোদাভীতি সম্পন্ন, সত্যনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক যোগ্য লোক তৈরি করা -অন্তত এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। এই ছিল যখন বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র তার সাথে যুক্ত হলো ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তন। এ সময় সপরিবারে নিহত হলেন দেশের স্বাধীনতার নায়ক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান- যিনি আবার ছিলেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতবড় একটি বিয়োগান্তক ঘটনায় সাধারণ মানুষকে কাঁদতে দেখা যায়নি। উল্টো তারই সতীর্থ সহযোগীগণ মতায় বসলেন। অল্প সময়ের মাঝে ঘটে গেল অনেক ঘটনা। সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিভিন্ন ধাপ গড়িয়ে দেশটি এক অদ্ভূত অবস্থানে চলে এলো। হতাশাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারছিলেন না কী হবে এই দেশের ভবিষ্যত? এমনি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কতিপয় চিন্তাশীল ও সাহসী তরুণ মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তরুণ ছাত্রসমাজকে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ে একটি আদর্শবাদী ছাত্রসংগঠনের জন্ম দেয়ার জন্য। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে তাদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হলো শান্তিকামী ছাত্র-তরুণদের প্রিয় কাফেলা “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” এর। শুরু হল একটি সুমধুর সঙ্গীতের শপথদীপ্ত অনুরণন –
“পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি
শপথের সঙ্গীন হাতে নিয়ে সকলে নবীজীর রাস্তা ধরেছি”
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসাবে ঠিক করলো ‘‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন”।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দ্বীন কায়েমের লক্ষে শিবির ঠিক করলো পাঁচ দফা কর্মসূচি। নবী-রাসুলদের আন্দোলনের ইতিহাসকে সামনে রেখে শিবির তিনদফা স্থায়ী কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করলো দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিণের কর্মসূচি। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গ্রহণ করলো শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা আন্দোলন এবং সামগ্রিক ইসলামী জীবনাদর্শের কর্মসূচী। এভাবেই শিবির স্থির করলো তার ৫ দফা বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা ঘোষণা এ যেন ছিলো ঘনঘোর অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। হতাশা ও নিরাশার মাঝে এক শুভ্র আলোর হাতছানি। এ সংগঠন সবার প্রাণে ছড়িয়ে দিলো আশা ও সম্ভাবনার নতুন দীপ্তি। অতি অল্প সময়ের মাঝেই দেশের ইসলামপ্রিয় ছাত্র তরুণদের একক কাফেলায় পরিণত হয় ছাত্রশিবির। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-কর্ণফুলীসহ নাম না জানা অসংখ্য নদীর বাঁকে বাঁকে, শহরে, বন্দরে, নগরে, গ্রামে-গঞ্জের প্রতিটি জনপদে ছড়িয়ে পড়লো একটি হিল্লোল, একটি নাম- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
শিবিরের অনুপম কর্মসূচি, আল্লাহর পথে সাধারণ ছাত্রসমাজকে উদারভাবে আহবান, সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনময় সংগঠন গড়ে তোলা, সংগঠিত ছাত্রদের জ্ঞান-চরিত্র ও মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ সুন্দর মানুষে পরিণত করা, ছাত্রদের অধিকার রক্ষা ও ক্যারিয়ার গঠনে সহযোগিতা প্রদান আর যাবতীয় শোষণ, নিপীড়ন ও গোলামী থেকে তাদের মুক্তির প্রয়াস ছাত্রশিবিরকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর রাহে কোরবানির মানসিকতা সম্পন্ন একদল জিন্দাদিল তরুণ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। এসব তরুণদের কোন পিছুটানই ধরে রাখতে পারে না, পারে না লোভ-লালসা, দুনিয়াবী আকর্ষণ এদের কান্ত করতে। ঘরের টান বড় নয়, বড় এদের কাছে খোদার পথে নিরন্তর সংগ্রামের আহবান। এদেরই গান “আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর, আমি বলি খোদার পথে হোক এ জীবন পার।”
ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের এই নিরলস নিরাপোষ চেষ্টাই সংগঠনকে ৪১ বছরের মাঝে দিয়েছে এক অনন্য সাধারণ মজবুত ভিত্তি।
ছাত্রশিবির এক বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একজন ছাত্রকে দুনিয়ায় চলার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কলা-কৌশল শিক্ষা দেয়। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর মানুষ এবং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ছাত্র তীব্র প্রতিযোগিতার মানসিকতা সম্পন্ন একজন দয়ামায়াহীন, দায়িত্ববোধহীন ভোগবাদী মানবে রূপ নেয়। তার ভেতর মানবতা, কল্যাণব্রত, খোদাভীতি ও জবাবদিহিতা জন্ম নেয় না।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিগত ৪১ বছরের শ্রমনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে আজ অবধি পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন না হলেও বাংলাদেশ প্রতি বছর সমৃদ্ধ হচ্ছে একদল আলোকিত মানুষের মাধ্যমে। লাভ করছে একদল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ। শিবির তার কর্মীদেরকে একটি সুন্দর সমন্বিত সিলেবাসের মাধ্যমে গড়ে তোলে। প্রতিটি কর্মীকে নিয়মিত রিপোর্ট রাখতে হয়। প্রতিদিন তাকে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ আল কুরআনের কিছু অংশ অধ্যয়ন করতে হয়। অধ্যয়ন করতে হয় এক বা একাধিক হাদীস, ইসলামী সাহিত্যের কমপক্ষে ১০টি পৃষ্ঠা, তাকে পত্র-পত্রিকা পড়তে হয়। প্রতিদিনই তাকে দিনশেষে নিজের কৃতকর্ম নিয়ে আত্ম-সমালোচনা করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা এসব অধ্যয়নকে বাস্তবে রূপায়ন করতে হয়। তাকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে আদায় করতে হয়। এভাবে শিবির প্রতিটি তরুণকে জ্ঞানে ও চরিত্রে একজন সমন্বিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
শুধু তাই নয়, শিবিরের প্রতিটি কর্মীকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘন্টা পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের জন্য তাগিদ দেয়া হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে পড়ালেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে দেখা হয় শিবির প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষার জন্য গাইড ও কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করছে। শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলো ও ভর্তি গাইডসমূহ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে সর্বাধিক বিশ্বস্ত এবং কার্যকর। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সেরা শিক্ষক ও ছাত্রগণ এসব কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয় বরং ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি উপযোগী করে গড়ে তোলার জনকল্যাণমূলক মনোভাব নিয়ে এসব কোচিং পরিচালিত হয়। মেধাবী, অসচ্ছল ও দরিদ্র শিার্থীদেরকে স্বল্প ফি, এমনকি প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিনা ফিতেও কোচিং করানো হয়।
শিবির মেধাবী ও কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত সংবর্ধনা প্রদান করে উৎসাহিত করে থাকে। গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য শিবিরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। মেধার সুষ্ঠু ও সঠিক বিকাশ ঘটাতে তার স্বীকৃতি অপরিহার্য। বিষয়টিকে যথাযথ বিবেচনায় রেখেই শিবির মেধাবী ও কৃতি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত সংবর্ধিত ও উৎসাহিত করছে। স্থানীয়ভাবে শাখাসমূহ আয়োজন করে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীর বৃত্তিপ্রাপ্তদের সংবর্ধনা। জাতীয় ও স্থানীয় বিশিষ্ট মেহমানদের উপস্থিতিতে এস.এস.সি/দাখিল, এইচ.এস.সি/ আলিম পরীক্ষায় অ+ প্রাপ্তদের নিয়ে আয়োজন হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে পরিচালিত ফ্রি কোচিং এবং বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ কর্মসূচির সহায়তায় আজ বহু কৃতি ছাত্র ভাল ফলাফল করতে সম হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে যাচ্ছে ধূমপান, মাদকতা ও পরীক্ষায় নকলমুক্ত এক অনাবিল সুন্দর জীবনের পরশ। শিবিরের কর্মীগণ নিজেরা যেমন এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তেমনি তারা অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে এ ধরনের পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও অনুসরণীয় জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ধূমপান বিরোধী যে আইন পাশ করেছে শিবির তা বাস্তবায়ন করে আসছে বিগত ৪০ বছর ধরে। যাত্রার শুরু থেকেই শিবির তার প্রতিটি কর্মীকে অভ্যস্ত করেছে নকলমুক্ত পরীক্ষায়।
শিবির তার কর্মীদের মাঝে আল্লাহ-প্রেম ও খোদাভীতি সৃষ্টির জন্য তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলে শব্বেদারী বা নৈশ ইবাদাতে যা তাদেরকে তাহাজ্জুদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করে।
প্রতিভার লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিবির বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির কেবল প্রতিভা বিকাশ ও লালনের কাজই করে না বরং শিবির হচ্ছে প্রতিভা সন্ধানী একটি অনন্য সংগঠন। ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভা সন্ধানের জন্য শিবির প্রতি বছর তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আয়োজন করে বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতা, মেধা যাচাই, ক্যারিয়ার গাইডলাইন কনফারেন্স, কম্পিউটার মেলা, বিজ্ঞান মেলা, সাধারণ জ্ঞানের আসর, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়া শিবির আয়োজন করে থাকে আন্তঃস্কুল, আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজন যেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে মেধাবী তরুণদের, তেমনিভাবে বের করে আনে প্রতিভাসমূহকে, যারা গড়ে তুলবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের একমাত্র ছাত্রসংগঠন যার রয়েছে নিয়মিত প্রকাশনা। সকল পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে শিবিরের কেন্দ্রীয় মাসিক ছাত্র সংবাদ। শিশু কিশোরদের জন্যও রয়েছে অনেক বাংলা ও ইংরেজি মাসিক সাময়িকী। এসব মাসিক পত্রিকায় লিখে যাদের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল তাদের অনেকেই আজ দেশের খ্যাতনামা কবি,সাহিত্যিক। এছাড়া শিবিরের বড় বড় শাখাগুলোর প্রায় প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব নিয়মিত প্রকাশনা। বড় শাখাগুলো মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করছে।
অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন অথচ কোন কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ তখন ‘‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” গ্রহণ করেছে কার্যকর কর্মসূচি। আজ ৪১ বছর শেষে শিবির অনেক সমৃদ্ধ। কারণ তার রয়েছে সারাদেশে সর্বজনস্বীকৃত ২০০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠী নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কসপ ও প্রযোজনার মধ্য দিয়ে একঝাঁক তরুণ শিল্পী তৈরী করে যাচ্ছে প্রতি বছর। মঞ্চ অনুষ্ঠান ছাড়াও এসব গোষ্ঠীর রয়েছে নিয়মিত অডিও ভিডিও প্রকাশনার বিপুল সম্ভার। আর এসব ধারণ করে আছে- ইসলামী গান, দেশাত্মবোধক গান, জারী, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গান। রয়েছে আবৃত্তি, নাটক, কৌতুকের সমাহার যা একজন দর্শক শ্রোতাকে নির্মল আনন্দ ও ইসলামী মূল্যবোধের যৌথ আস্বাদ দান করে থাকে।
১৯৯৪ থেকে শিবির গড়ে তুলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি সংগঠনসমূহের ফোরাম। এই ফোরাম আয়োজন করে প্রশিণের, উৎসবের। আর প্রকাশ করে যাচ্ছে অসংখ্য অডিও-ভিডিও ক্যাসেট ও সিডি। একটি নতুন ধারার নাট্য ও চলচ্চিত্র আন্দোলনও দিন দিন এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের মাঝে ইসলামী আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে শিবিরের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। সবার মাঝে সালামের প্রচলন এসবের একটি। বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করা শিবিরের কালচার। এছাড়া শিবির ঈদকার্ড ও শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের প্রচলন করেছে। শিবির সববয়সীদের জন্য প্রকাশ করছে চমৎকার সব পোস্টার, স্টিকার, ভিউকার্ড, পোস্টকার্ড, কাস রুটিন, রমজানের সময়সূচি, নববর্ষের ডায়েরী, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। এছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করার জন্য সায়েন্স সিরিজ সহ অন্যান্য প্রকাশনা। ২০০০ সাল থেকে শিবির প্রকাশ করছে তিন পাতার বিষয়ভিত্তিক বড় ক্যালেন্ডার।
জাতীয় ইস্যুসমূহে শিবিরের ইতিবাচক ভূমিকা একটি ছাত্রসংগঠন হিসেবে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যু ও ক্রান্তিলগ্নে এ সংগঠন রেখে এসেছে ইতিবাচক ভূমিকা। ১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ১৯৮২ সালে বন্দুকের নলের মুখে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও বলিষ্ঠ। নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টি.এস.সি, শাহবাগ ও দোয়েল চত্বর কেন্দ্রিক যে বিশাল ছাত্রজমায়েত ও আন্দোলন গড়ে উঠে তার অন্যতম সংগঠক ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের বহু নেতা-কর্মী স্বৈরশাসকের হাতে নিহত ও বন্দী হলেও শিবির মুহূর্তের জন্যও ঘাবড়ে যায়নি। শিবিরের বিশাল সমাবেশ ও মিছিল ছাত্র জনতার প্রাণে নতুন আশা ও প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের প্রধান নিয়ামক শক্তি ছিল ছাত্রদের গড়ে তোলা আন্দোলন, আর সে আন্দোলনের অন্যতম শরিক ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৯২ সালে শিবিরকে রাখতে হয়েছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা -যা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গণআদালতী ঘাদানিকদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে শিবির ছিল ময়দানের লড়াকু শক্তি।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির এক মহাক্রান্তিকাল। ১৯৯৬-এর নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় আসা দলটি পর্যায়ক্রমে একদলীয় স্বৈরাচারে রূপ নিলে দেশের অন্যসব ছাত্র সংগঠনসহ শিবির গড়ে তোলে “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য” -যার নিরলস প্রয়াসে দেশ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে শিবিরের ভূমিকা ছিল প্রচণ্ড প্রত্যয়দীপ্ত, পরিশ্রমী ও আত্মত্যাগী। বিষয়টি সর্বজনবিদিত ও প্রশংসিত।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যতো রকম সন্ত্রাস, রাহাজানি ও দেশদ্রোহী কাজ রয়েছে, শিবির বার বার তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। শিবির নিজে যেমন দলের মাঝে সন্ত্রাসীদের কোন স্থান রাখেনি তেমনি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকেই শিবির প্রশ্রয় দেয় না। বারবার বোমা, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, তখন প্রতিপরে কেউ কেউ শিবিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও শিবির যে এসব অপরাধ থেকে বহু বহু দূরে তা প্রমাণ করতে পেরেছে।
১৯৯৯ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে শিবির তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত শান্তিচুক্তির নামে মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করার অবিমৃষ্যকারীতার বিরুদ্ধে গণচেতনা সৃষ্টি, আত্মঘাতী ট্রানজিট ইস্যুতে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন, বিতর্কিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের নামে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সরকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয় ইস্যুতে শিবিরের ভূমিকা ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ।
২০০৫-এ শিবির সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে গড়ে ওঠা অস্থিতিশীল ও দোদুল্যমান পরিস্থিতি এবং ৬৩ জেলায় চেইন বোমা হামলার ঘটনার পর দেশের সচেতন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের নিয়ে আয়োজন করেছে গোলটেবিল বৈঠকের। এ আয়োজন ও আলোচনা দেশ ও জাতিকে নতুন আশায় উজ্জ্বীবিত করেছিলো।
শিবির সন্ত্রাসকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করে সারাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী জনমত গঠন, সন্ত্রাস দমন ও সন্ত্রাস নির্মূলের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্রে শিবির সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, র‍্যালী আয়োজন ছাড়াও সকল উদ্যোগে সর্বোত্তম সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটদল ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১ দিনের ম্যাচে জয়ী হলে শিবির নেতৃবৃন্দ বিজয়ী দল, কোচ ও তার কর্মকর্তাদের অভিনন্দিত করে বিবৃতি প্রদান করেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও সেনা প্রত্যাহার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে ভারত সহজেই চট্টগ্রাম বন্দর পেয়ে যাবে। এই লোভে শান্তিবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাকে ভারত অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষন দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে। সরকার পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে অন্যদিকে স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিলেন সন্তু লারমা (নয়া দিগন্ত ১০.০৮.০৯)।
ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে এ দেশের সরকার ও জনগণকে সচেতন করতে কর্মসূচি নিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সন্তু লারমার স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সন্ত্রাসে মদদদান অন্যতম বিতর্কিত একটি বিষয়। ভারতের অভিযোগ হলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দাবি করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে এই রকম ৩৯টি ঘাঁটি রয়েছে ভারতে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর ৪৫টি সশস্ত্র ক্যাম্প খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের সন্নিকটস্থ বর্ডারিং এরিয়ায় ভারতে অবস্থিত। একইভাবে বঙ্গভূমি আন্দোলনেও বঙ্গসেনাদের ভারত সরাসরি মদদ দানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ছাত্রশিবির দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সন্ত্রাসের এই মরণখেলা থেকে উত্তরণ চায় এবং অব্যাহতভাবে এর বিরোধিতা করে আসছে।
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ভারত বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এই কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের অবন্ধুত্বসুলভ নির্মম আচরণ প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় না, চায় বাংলাদেশকে আবদ্ধ করে রাখতে। ভারতের এই আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী কাজের জন্য ছাত্রশিবির দেশবাসীকে সাথে নিয়ে প্রথম থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ভারত ১৩৫৭ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। তা ছাড়াও ভারতের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪২৯.৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় মতার উদ্ধত রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। আর এর জের ধরে মিয়ানমারও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজে মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের সাথে নতুন করে এখন মিয়ানমার যোগ হলো। ফলে একসাথে দু’টো দেশকে এখন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি। ছাত্রশিবির চায় অনতিবিলম্বে উভয় দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে এহেন কাজ হতে বিরত রাখুক বাংলাদেশ সরকার।
২৮ অক্টোবর ২০০৬, রক্তের হোলি খেলা ও লগি বৈঠার তাণ্ডব ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে যখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোট সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ ও সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে এম হাসানের পরিবর্তে বিচারপতি মাহমুদুল আমিনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার দাবিতে আন্দোলনের শুরু করে। ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ চারদলীয় জোট যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তর করার কথা, তার পূর্বমুহূর্তে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে তাদের সর্বশেষ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে শেখ হাসিনার নির্দেশে লগি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা। ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো হত্যা ও আহত করে জামায়াত ও শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে। ঐ দিন ঐ সমাবেশের ঘটনা বাংলাদেশের সুষ্ঠু রাজনীতির পরিক্রমায় এক শক্ত আঘাত। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সেদিন জানবাজি রেখে দেশের সার্বভোমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল।
কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ২০০৮ সালের আপোষের নির্বাচনে মঈন সরকার কৃত অপরাধের দায়মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং এতে সরাসরি মধ্যস্থতা করে ভারত। যা কিছুদিন আগে প্রকাশিত প্রনব মুখার্জির বইতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে ভারতের প্রেসক্রিপশনে এদেশের ইসলামপন্থীদের হত্যা করার উদ্যোগ নেয় ১৯৭১ সালের কাল্পনিক সব অভিযোগে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শিবির। এর ফলে ২০১৩ সালে শহীদ হয় বহু ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী। অগণিত মানুষ গুলিবিদ্ধ ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আওয়ামীলীগ সরকার একের পর এক হত্যা করে ৬ জন ইসলামপন্থী নেতাকে।
পাঁচ জানুয়ারীর নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ সরকার। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে একাই নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ। দেশের সচেতন মানুষদের সাথে নিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে সোচ্চার ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে। ১৫৪ টি আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীতাই হয়নি।
শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন শিক্ষা ব্যবস্থা একটি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৪৭ বছর পরও বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে দেশে কোন শিক্ষা-নীতি প্রণীত হয়নি। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শিবির বরাবরই এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমত শিবিরের জনশক্তি ও সাধারণ জনগণকে সচেতন করে জনমত সংগ্রহের জন্য জাতীয় শিক্ষা সেমিনারের আয়োজন, স্থানীয় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক, বুকলেট প্রকাশ, পুস্তিকা প্রকাশ, শিক্ষা স্মরণিকা প্রকাশ ও Workshop, গ্রুপ মিটিং ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া প্রতিবছর ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিতে ১৫ আগস্টকে “ইসলামী শিক্ষা দিবস” হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর দেশব্যাপী শিক্ষা সপ্তাহ পালন করা হয়। এ উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞান মেলা, জাতীয় সেমিনার, বিজ্ঞান মেলা, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, শিক্ষা সামগ্রী প্রদর্শন, Understanding Science Series প্রদর্শনী এবং “আমাদের শিক্ষা সংকট : উত্তরণের উপায়” শীর্ষক বুকলেট প্রকাশসহ বহুবিধ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়।
শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। শিক্ষাখাতে যে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া উচিত অনেক সময়েই তা দেয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে ব্রাহ্মণ্যবাদের আসর, দেরীতে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ দলীয়করণ, ইতিহাস বিকৃতি ও জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি, বিপক্ষ শক্তি হিসাবে বিভক্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিবির সব সময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন ছিল ছাত্রশিবিরের বড় সফলতা। মিছিল, মিটিং, ছাত্রধর্মঘট, সমাবেশ বিক্ষোভ, ঘেরাও, লিফলেট, প্রচারপত্র বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে ভূমিকা পালন করেছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বৈষম্যের প্রতিবাদ বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা বরাবরই অবহেলিত। এবতেদায়ীর জন্য আওয়ামী সরকারের কোন বাজেট ছিল না। তাদের ফ্রি-বই বিতরণ ও বৃত্তির ব্যবস্থাও ছিল না। একটি মাত্র মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। একটি মাত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য ভাল ব্যবস্থা নেই। মাদ্রাসা ছাত্ররা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। বিপুলসংখ্যক ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাকে সমন্বয় করার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সাধারণ প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মধ্যে বিরাট ব্যবধান করে রাখা হয়েছে। শিবির তার জন্মলগ্ন থেকেই মাদ্রাসার এ বৈষম্য দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসলামী শিক্ষা দিবস উদযাপন শিবির এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ তুলে ধরে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন থেকে ১৫ই আগস্টকে ইসলামী শিক্ষা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। ১৯৬৯ সালের এ দিনে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে শহীদ আব্দুল মালেককে। প্রতি বছর এ দিনকে সামনে রেখে সারা দেশে শিক্ষা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা ইসলামী শিক্ষার পক্ষে স্বাক্ষর অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। একটি ছাত্র সংগঠনের এটি একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ।
সৃজনশীল প্রকাশনায় শিবির ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা বিভাগ রয়েছে। আধুনিক রুচিসম্মত এবং সামাজিক চাহিদা নির্ভর বিভিন্ন প্রকাশনা সামগ্রী এই বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয়। তথ্যবহুল দাওয়াতী কার্যক্রম, উপহার আদান প্রদান এবং সুস্থ বিনোদন চর্চায় শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী অনন্য। এই প্রকাশনা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে নববর্ষের ৬ প্রকার ক্যালেন্ডার, ৪ প্রকার ডায়েরী, অসংখ্য ক্যাসেট, গান ও নাটকের সিডি এবং বহু রকমের কার্ড, ভিউকার্ড, স্টিকার, মানোগ্রাম, কোটপিন, চাবির রিং, চিঠির প্যাড ইত্যাদি প্রকাশনীর মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের মাঝে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি অপরিহার্য সৌন্দর্য্যরে প্রতিক। তথ্যবহুল, গবেষণালব্ধ, বহু রং ও ডিজাইনের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি দেশ ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। মনোরম সমসাময়িক প্রচ্ছদ নিয়ে মাসিক ছাত্রসংবাদ, বাংলা ও ইংরেজি কিশোর পত্রিকা, মাসিক ইংরেজি ম্যাগাজিন, ত্রৈমাসিক-At a Glance বের হয়, যা ইতিমেধ্যই পাঠকদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ছাত্রশিবিরের বিজ্ঞান সামগ্রী প্রকাশনাও সমৃদ্ধ। দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার পশ্চাদপদতা দূর করার জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ করেছে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিদ্যার উপর রেফারেন্স বই ও চার্ট পেপার। এ বইগুলো এস.এস.সি/দাখিল, এইচ.এস.সি/আলিম ও ডিগ্রীর প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনন্য ও অপরিহার্য শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বহুরঙ্গা ও দ্বিমাত্রিক চিত্রসহ সম্পূর্ণ ডি.টি.পি তে ও ইলাস্ট্রেটেড ডিজাইনে ছাপানো এ উচ্চমানের বইগুলো বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ প্রয়োজন এবং একাডেমিক শিক্ষার যথার্থ তথ্য উপকরণ দিয়েই এই Understanding Science Series প্রকাশিত হয়েছে।
সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন একটি দেশের রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এ দেশের ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে শিবিরের রয়েছে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভান্ডার। জ্ঞান অর্জন ও মেধা বিকাশের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে মানসিক বিকাশের জন্য এবং তার মধ্যে সহজভাবে ইসলামের জীবন পদ্ধতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অপসংস্কৃতির সয়লাব থেকে ছাত্র ও যুবসমাজকে রক্ষা করে তাদেরকে ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে হলেও প্রয়োজন পরিশীলিত সংস্কৃতির আয়োজন। সাহিত্য সংস্কৃতি মানেই অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, পাশ্চত্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ অনুকরণ এই ধারণার পরিবর্তন করতে শিবির বদ্ধপরিকর। ইসলামী ছাত্রশিবির সে জন্যই ইসলামী সাংস্কৃতির এক বিরাট জগতকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সাইমুম, প্রত্যয়, বিকল্প, উচ্চারণ, পাঞ্জেরী ও টাইফুন ইত্যাদি শিল্পীগোষ্ঠীর সমগ্র দেশেই সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। প্রতিবছর এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত সাংস্কৃতিক কর্মী তৈরী হচ্ছে।
ছাত্রকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ছাত্রদের কল্যাণমূখী কর্মকান্ড পরিচালনায় শিবির তৎপর। বাড়ি থেকে দূরে অবস্থানকারী ছাত্রদেরকে লজিং-এর ব্যবস্থা করে দেয়া, বেতন দানে অক্ষম ছাত্রদেরকে বেতন প্রদান, বই ক্রয়ে সহযোগিতাসহ, মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, ফ্রী কোচিং, বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র বিলি এবং কর্জে হাসানা প্রদান করে থাকে। প্রতিবছর ছাত্রশিবির থেকে বৃত্তি পায় অন্তত ৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রী। ছাত্রশিবির তার কর্মীদেরকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই তার বই শিবির পরিরচালিত লেন্ডিং লাইব্রেরিতে বিনামূল্যে বই প্রদান করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিবির বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্লাসের বই লেন্ডিং লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করে থাকে। ফেরত দেয়ার শর্তে বই গরীব ও উপযুক্ত ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বাজারে প্রথম শ্রেণীর গাইড ও কোচিং বলতে যা বুঝায় সেগুলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের। বুয়েট, কৃষি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ইসলামী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিকসহ দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিবিরের গাইড এবং কোচিং রয়েছে। এছাড়াও ক্লাস কোচিং, বৃত্তি কোচিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোচিং রয়েছে। বাজারের অন্য্যন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত কোচিং এর মতো নয়। ছাত্রদেরকে ভর্তি উপযোগী করার জন্য ছাত্রকল্যাণমূলক মনোভাব নিয়ে এ কোচিং পরিচালিত হয়।
ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রদেরকে নকল প্রবণতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করে। শিবিরের সাথী ও সদস্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছাত্ররা নকল করতে পারে না। কেউ নকল করলে তার সাথী বা সদস্য পদ বাতিল করা হয়। কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা না নিলেও শিবির তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অন্য কোন ছাত্রসংগঠনে তা কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশে নকল বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রশিবির নামটা বেশ উজ্জ্বল।
অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা ও বৃত্তি প্রদান শারীরিক অক্ষমতা, দারিদ্রের কষাঘাত ও বিভিন্ন প্রকার সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে যারা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বে স্বাক্ষর রাখে এমন অদম্য মেধাবীদের ছাত্রশিবির সংবর্ধনা দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। শুধু তাই নয়, এসব অদম্য মেধাবীরা যেন বাকী পড়াশুনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে ছাত্রশিবির তাদের শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থাও করে থাকে। কোন অপূর্ণতাই যেন তাদেরকে শিক্ষাজীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে না পারে তা নিশ্চিত করতে দিয়ে থাকে ক্যারিয়ার গাইডলাইন, কোচিং সুবিধা ও আনুসঙ্গিক সহযোগিতা। ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবির সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। সংকট ও দুর্যোগ মুহুর্তে ত্রাণ বিতরণ, উদ্ধারকাজ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, রক্ত দান ও ব্লাড গ্রুপিং সহ নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিবির সাধারণ ছাত্রজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিবছর দশলক্ষ গাছের চারা রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে। যেকোন দূর্যোগে জনগণের পাশে সবার আগে যে সংগঠনটি দাঁড়ায় তার নাম ছাত্রশিবির। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে সমাজ সচেতন করে গড়ে তোলা, সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিবির সে কাজটি প্রতিনিয়তই করে থাকে। বাংলাদেশের অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের উদ্যোগ খুবই গৌণ।
বন্যার্তদের সহযোগিতায় ছাত্রশিবির ভাটির দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এদেশের জনগণকে। উজানের নদীতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শত শত বাঁধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় প্রতি বছরই দেশের কোন না কোন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ। বাড়ি ঘর হারিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু বাঁধ হয় তাদের শেষ আশ্রয়। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা আর পানীয় জলের অভাবে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। বন্যা কবলিত এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দূর্ভোগ লাঘবে তরুণ সমাজকে সাথে নিয়ে ত্রাণ তৎপরতার মাধ্যমে খাদ্য, বস্ত্র ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করে আসছে ছাত্রশিবির। ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের মাধ্যমে দূর্গত এলাকার ভাগ্যাহত মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবারও ব্যবস্থা করে থাকে।
১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যায় দূর্গত মানুষের সেবায় ছাত্রশিবিরের ভূমিকা ছিল অভাবনীয়। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি বন্যায় ছাত্রশিবির দূর্গত মানুষের পাশে থেকেছে বরাবরের মতই। ২০০৭ সালের বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ও ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানার পর ছাত্রশিবির দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দূর্গত ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সেবা ও উদ্ধার তৎপরতায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ২০০৯ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় এ অঞ্চলের হাজার হাজার বসত-ভিটা, আবাদিজমি। সরকারি হিসেবেই এতে প্রাণ যায় ৩৩২ জনের। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ভূমিকা সারা দেশে প্রশংসিত হয়। ছাত্রশিবিরের আহ্বানে সারাদেশ থেকেই তরুনসমাজ ত্রাণ তৎপরতা ও দূর্গতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ভারতের গজলডোবা ও ফারাক্কা বাঁধের শত শত গেইট খুলে দেয়ায় দেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেইসাথে প্রবল বর্ষণে বেড়ে যায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। স্বৈরাচারী সরকারের চলমান জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে ছাত্রশিবির এগিয়ে যায় বন্যাদূর্গত মানুষের দোরগোড়ায়। যা মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে ভারতের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। তদুপরি ভারতীয় ইউরেনিয়াম খনির দূষণে হাজার হাজার টন মাছ, হাজার হাজার হাঁস মারা যায়। সর্বশান্ত হয়ে পড়ে হাওড় পারের মানুষ। ছাত্রশিবির এই দূর্যোগে তাদের পাশে দাঁড়ায়। এছাড়াও বন্যা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া মানুষদের কাছে জরুরী ত্রাণ পৌঁছে, বাড়িঘড় নির্মাণ করে দেয়া ছাত্রশিবিরের নিয়মিত কাজ।
বহির্বিশ্বে দুর্যোগে দূর্গতদের পাশে ছাত্রশিবির ২০১৫ সালের ২৫ শে এপ্রিল নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় নেপালের জনগণ। ছাত্রশিবির সে দুর্যোগে ছাত্রসংগঠন হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। বিধ্বস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সহায়তা করে ছাত্রশিবির।
শীতার্ত মানুষের পাশে ছাত্রশিবির বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ৪৭.১% লোক দারিদ্র্যসীমা এবং ২৪.৬% লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য শীত ঋতুতে জীবন ধারণ অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ অচল করে দেয় তাদের জীবনযাত্রা। ছাত্রশিবির প্রতিবছরই শীতার্ত এই জনগোষ্ঠির কষ্ট লাঘবে শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচী পালন করে থাকে। সংগঠনের প্রত্যেক জনশক্তিকে অন্তত একজন শীতার্ত ব্যক্তিকে শীতবস্ত্র প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলসহ প্রতিটি শহর ও পল্লীর ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষের জন্য ছাত্রশিবিরের এ কাজ সর্বমহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়ে আসছে। এর পাশাপাশি দেশের তরুন সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে ইদানিংকালে তরুণদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও এসব কাজে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের।
ঈদ সামগ্রী বিতরণ বছরে মুসলমানদের জন্য দু’টি ঈদ নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ আর অনাবিল আনন্দ। কিন্তু দারিদ্রপীড়িত একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠি বঞ্চিত হয় এই উৎসবের আমেজ থেকে। হাজার হাজার ছিন্নমূল পথশিশু আর দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের কাছে তাই ঈদের দিনটি কখনো কখনো বিষাদের দিনে পরিণত হয়। দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এসব দারিদ্রপীড়িত মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। হাসি ফোটাতে চেষ্টা করে ছিন্নমূল পথশিশুর মুখেও। নতুন পোষাক আর সেমাই-চিনি নিয়ে উপস্থিত হয় তাদের দরজায়। ভাগাভাগি করে নেয় ঈদের আনন্দ।
ঈদুল আযহায় ‘কুরবানী প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে পশু কোরবানী করে দুস্থ ও অসহায়ের কাছে পৌঁছে দেয় কোরবানীর গোশত। অসহায় বঞ্চিতের মুখে হাসি ফোটাতে নিরন্তর ছুটে চলে তারুণ্যদীপ্ত ছাত্রশিবিরের হাজার হাজার জনশক্তি।
পথশিশু ইয়াতমদের মাঝে খাবার বিতরণ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে ছাত্রশিবির ইয়াতিম ও পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী হিসেবে গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।
দূর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন বড় দূর্ঘটনায় দূর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ছাত্রশিবির। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ‘রানাপ্লাজা ট্রাজেডী’ ছিল দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শিল্পদূর্ঘটনা। যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্পদূর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ দূর্ঘটনায় সরকারি হিসেবেই নিহত হয় ১১৬৭ জন গার্মেন্টস কর্মী। আহত হয় কয়েক হাজার শ্রমিক। দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এ দূর্ঘটনার উদ্ধারকাজে সরাসরি অংশগ্রহন করে। অনলাইনে সার্বক্ষণিক আপডেট জানিয়ে আরও বেশি মানুষকে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় সামগ্রী চেয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে টানা প্রচারণা চালায়।
মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচী দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণে ছাত্রশিবির বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে ‘ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প’ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। পালন করে থাকে ‘রক্তদান কর্মসূচী’। এছাড়া দেশের প্রতিটি আঞ্চলিক শাখার জনশক্তিরা মূমূর্ষু রোগীদের বিনামূল্যে রক্তদান করে থাকেন। দেশের সর্ববৃহৎ ধূমপানমূক্ত ছাত্রসংগঠন হিসেবে রক্তদানের মাধ্যমে ছাত্রশিবির সারাদেশে জনগণের মাঝে ব্যাপক আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
মানবাধিকার সচেতনতায় ছাত্রশিবির দেশে কিংবা সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেখানেই শোষিতের চিৎকার সেখানেই মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার কন্ঠে আওয়াজ তুলেছে ছাত্রশিবির। নিপীড়িত মানুষ ও মানবতা রক্ষার জন্য কথা বলেছে সাহসিকতার সাথে। বসনিয়া, চেচনিয়া, আজারবাইজান, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, গুজরাট, মায়ানমার যেখানেই মুসলমান নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে সেখানেই নির্যাতন বন্ধের জন্য বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ছাত্রশিবির। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শ্লোগানে মুখরিত করেছে রাজপথ। ভারতে বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে দেশের তৌহীদি জনতাকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছে গণআন্দোলন। সভা, সমাবেশ, সেমিনার, বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে সকল অমানবিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ছাত্রশিবিরের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। দেশের স্বার্থান্বেষী কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী কর্তৃক চালানো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রশিবির। দেশের রাজনৈতিক চরম প্রতিকূল পরিবেশ চলাকালীন সময়ে ঝুকিপূর্ণ এলাকায় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থাপনা ও বাড়ি-ঘর পাহারা দিয়েছে ছাত্রশিবির। অন্যকোন দেশের মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন কেউ এদেশের কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রোশ প্রকাশ না করে তা নিশ্চিত করতে সবসময় সচেতনভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রশিবির।
বিগত কয়েক বছরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক অপহরণ, গুম, ও নিখোঁজের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পর অপহরণ ও গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গুমবিরোধী প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি অপহৃত ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্রশিবির। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিমাসে মানবাধিকার প্রতিবেদন পেশ করে থাকে ছাত্রশিবির। যে প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তরে গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের মত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন সকল বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
সচেতন ছাত্রসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন এবং এই পরিস্থিতির উন্নয়নে ছাত্রশিবির ভূমিকা রাখে। প্রতিমাসে ছাত্রশিবির বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিবেদন পেশ করে। এখানে আমরা হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নারীর প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক সহিংসতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, শিশুর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্রম, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষেদের কথা এসব রিপোর্টে উঠে আসে। প্রতি মাসের রিপোর্টে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ছাত্রশিবির কিছু মৌলিক পরামর্শ এবং প্রস্তাবনা সংযুক্তি করে। ছাত্রশিবির নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সাধ্যনুসারে চেষ্টা করে।
ইসলাম প্রচারে দাওয়াহ কার্যক্রম ছাত্রশিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল (সা) এর নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী মানবজীবনের সার্বিক পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ থাকায় এদেশে স্কুল কলেজ এমনকি মাদরাসাতেও ইসলামের সঠিক বক্তব্যের প্রসার নেই। যার দরুণ গোটা জাতি ইসলামের সঠিক শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না। এই বিশাল সমস্যার জন্য আজ আমরা দূর্ণিতিপরায়ন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ছাত্রদের মাঝে আমরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য বিতরণ করে থাকি। কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি জ্ঞান আহরণের জন্য আমরা ছাত্রদের এবং আমাদের জনশক্তিদের তাগিদ দিয়ে থাকি। এছাড়াও কুরআন ক্লাস, আলোচনা চক্র, পাঠচক্র, হাদীস পাঠ, দারসুল কুরআন, তাফসীরুল কুরআন মাহফিল, সীরাতুন্নবী মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে দাওয়াহ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছাত্রশিবির ইসলাম প্রচারে এবং ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারে ম্যান টু ম্যান দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছে।
পাঠাগার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মনে করে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরীর জন্য জনশক্তিদের বই পড়ানোর বিকল্প নেই। তাই ছাত্রশিবির সারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকহাজার লাইব্রেরী। এছাড়াও শিবির প্রতিষ্ঠা করেছে ‘শিবির অনলাইন লাইব্রেরী’। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম অনলাইন লাইব্রেরীগুলোর অন্যতম।
অন্যান্য কার্যক্রম ছাত্রশিবির সৎ দক্ষ জাতি গঠনে প্রয়োজনীয় সব কর্মকান্ডের এবং ইভেন্টের আয়োজন করে। এরকমই একটা বিভাগ হচ্ছে বিতর্ক। সারাদেশে সবগুলো শাখায় এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনশক্তিদের বাগ্মীতা বাড়ানো, মুখের জড়তা দূর করা, সঠিক যুক্তির প্রয়োগ, কূটনৈতিক জ্ঞানের শিক্ষা ইত্যাদি যোগ্যতা অর্জনের জন্য বিতর্ক সভার আয়োজন করে থাকে। শিবিরের প্রতিটি শাখায় বিতর্ক ক্লাব রয়েছে। প্রতিবছর বিতর্ক প্রতিযোগীতা এবং কর্মশালার মাধ্যমে হাজার হাজার বিতার্কিক তৈরী হচ্ছে।
খেলাধূলায়ও পিছিয়ে নেই ছাত্রশিবির। খেলাধূলার মাধ্যমে শরীর গঠন, সুস্থ জাতি গঠনে ছাত্রশিবির ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিটি শাখা নানান খেলাধূলার আয়োজন করে। প্রতিটি শাখায় একজন ক্রিয়া সম্পাদকের অধীনে ফুটবল টীম, ক্রিকেট টীম গঠিত হয়ে নিয়মিত অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে দেশী খেলাগুলোর মধ্যে হাডুডু, ঘুড়ি ওড়ানো, দৌড় প্রতিযোগীতা, নৌকাবাইচ ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে।

রাছুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-র ভবিষ্যদ্বাণী


Thursday, March 15, 2018

ইসলামী আন্দোলনের সামাজিক প্রভাব -এইচ এম জোবায়ের


ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী বিপ্লব প্রচেষ্টার নাম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াত, কুফুর, শিরক এবং ইসলামবিরোধী অপশক্তিকে সবদিক থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন সামনে এগিয়ে চলে। জাহেলিয়াতের ফুলশয্যায় আয়েশরত কুফরি শক্তি নড়ে চড়ে বসে। তাদের সাথে হাত মেলায় সমাজের ধনিক-বণিক ও এলিট শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদীরা। এসব প্রভাবশালী মহলের নিমক খাওয়া আমজনতা মেষপালের ন্যায় দল নেতার অনুসরণ করে চলে মাত্র। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বুঝে না বুঝে ইসলামী আন্দোলন এবং এর অনুসারীদের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। রাষ্ট্রশক্তি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতায় সদা সম্মুখ সেনানীর ভূমিকা পালন করে। আপাতদৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন তিরস্কার, উপহাস এবং হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হয়। প্রভাবশালী লোকদের বিরোধিতা ও কতিপয় দুর্বল লোকদের সমর্থনপুষ্ট ইসলামী আন্দোলন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে এবং এর অনুসারীগণ অনেকটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হন। এহেন পরিস্থিতিতে এ আন্দোলনকে প্রভাবহীন মনে হলেও কার্যত ও দীর্ঘ মেয়াদে এ আন্দোলনের প্রভাব সমাজের প্রতিটি দিক ও বিভাগে মেঘলুপ্ত সূর্যের ন্যায় বিরাজমান থাকে। সময়ের ব্যবধানে মেঘ কেটে গিয়ে ইসলামী আন্দোলন নামক সূর্য উঁকি দেয় স্বমহিমায়, অতঃপর সমাজের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে বিপ্লবের বীজ বপনের উপযোগী করতে ক্রমাগত প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। আন্দোলনের উর্বর জমিন ফসল ফলানোর উপযোগী হওয়ামাত্র আষাঢ়ের বর্ষণের ন্যায় বিপ্লব এসে যায় এবং সেই বিপ্লবের সু-ঘ্রাণ বসন্ত বাতাসের মত শীতের সকল জরা-জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলন সক্রিয় থাকা একটি বড় নেয়ামত। এর প্রভাব বৃক্ষরূপী সমাজের পাতা থেকে শেকড় পর্যন্ত প্রোথিত। ইসলামী আন্দোলনের সামাজিক প্রভাব নিয়েই আজকের আলোচনা।

বর্তমান সমাজ ও ইসলামী আন্দোলন
অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্ট মতে, বর্তমানে বংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫.৮৯ কোটি। শিক্ষার হার ৬২.৭% এবং সাক্ষরতার হার ৭+ বছর ৬৩.৬%। বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুপাতে এই শিক্ষার হার মোটামুটি চলনসই বলা যেতে পারে। দিন দিন বাড়ছে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা। সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্নীতির মাত্রা। বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫তম। বিশ্লেষকগণ একে ভাল বলেননি। দুর্নীতি সূচকে ভাল থেকে খারাপ, এই তালিকায় এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫। অথচ এর আগের বছর অবস্থান ছিল ১৩৯। অর্থাৎ ছয় ধাপ অবনতি হয়েছে। খাত ভিত্তিক হিসেবে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা, এনজিও উল্লেখযোগ্য। এসব খাতে সেবা নিতে গিয়ে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ অবৈধ লেনদের এবং হয়রানির শিকার হন। পক্ষান্তরে আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাবো এই সেক্টরগুলোর কর্ণধার, কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, বিসিএস ক্যাডার, নন ক্যাডার এবং মেধাবী ব্যক্তি। তাদের দেশী-বিদেশী সনদ দেশের সুনাম, উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন এবং দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি রোধে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে বিপরীত ভূমিকা পালন করে চলেছে। চারদিকে নৈরাজ্য, অরাজকতা, মারামারি, খুনাখুনি ও অমানবিকতার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে একাকী পথ চলছে ইসলামী আন্দোলন। কাদায় বসবাস করেও যার অনুসারীদের গায়ে কোন কাদা লাগে না। কুরআন-হাদিসের শিক্ষা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় না থাকায় সেখান থেকে পাস করা লোকেরা পুঁজিবাদী বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বের হন এবং তাদের দিন-রাতের সকল কাজ-কর্মে দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, লুটপাট, হিং¯্রতা, অমানবিকতা ও বিবেকহীনতারই পরিচয় পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কুরআন-হাদিসের নিখাদ ও পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন-অনুশীলন ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীদের মধ্যে থাকায় তারা বিবেক, মূল্যবোধ ও উদারতার এক সুউচ্চ মানদন্ডে অবস্থান করেন। ফলশ্রুতিতে তাদের চরিত্রে সততা, দক্ষতা, মানবিকতা এবং স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠতা ও জবাবদিহিতার এক অপূর্ব বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।

অফিস-আদালতে এই সৎ ও আন্তরিক লোকদের প্রমোশন কম হলেও সহকর্মীগণ আড়ালে তাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হন। বসগণ তাদের কঠিন ও জটিল কাজগুলো এই ব্যক্তিদের দ্বারাই করিয়ে নিয়ে থাকেন। উন্নত চারিত্রিক মাধুর্য নিয়ে সমাজে বাস করা এ ধরনের লোকদের প্রভাব সমাজেও দেখতে পাওয়া যায়। তাদের নৈতিক প্রভাব পুঁজিবাদীদের আর্থিক প্রভাবকে ম্লান করে দেয়।
ধর্ম-দীন ও ইসলামী আন্দোলন
ধর্ম ও দীনের মধ্যে পার্থক্য- আকাশ ও জমিন। কুরআন নাজিলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং রাসূল (সা) প্রেরণের মহান উদ্দেশ্যের দিকে তাকালে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়- ইসলাম কতিপয় আনুষ্ঠানিক বন্দেগিসর্বস্ব কোন ধর্মের নাম নয়। বরং আল ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। মানবজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পথনির্দেশনার একমাত্র আলোকবর্তিকা হচ্ছে দীন ইসলাম। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে হতাশার এক করুণ চিত্র সামনে আসে। দীন ইসলামকে নিয়ে মনগড়া আলোচনা এবং অনুসরণের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। আলেমসমাজের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা, মূর্খদের কল্পিত ও পূর্ব পুরুষদের দোহাইমূলক অনুসরণ, রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও লোকদেখানো ইসলাম মানা এবং এক শ্রেণির জ্ঞানপাপী ও অর্ধ শিক্ষিত মানুষের আংশিক ইসলামের দাওয়াত, প্রচার ও অনুসরণ আমাদের জাতিকে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ও তৎপরতা নিয়ে কাজ করছে ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীগণ ইসলামকে লোকদেখানো অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধার্মিকতার নিষ্প্রাণ খোলস থেকে বের করে এনেছেন। তারা ইসলাম ও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন, গুরুত্বহীন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করেন না এবং ফরজকে ফরজ ও নফলকে নফলের স্থানে রাখেন। ফলশ্রুতিতে তারা গোঁড়ামি, সঙ্কীর্ণতা, একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত হয়ে উদারতার নীতি গ্রহণ করেন। নীতি হিসেবে উদারতা বরাবরই ময়দানে জয়ী হয়ে থাকে। তাই ইসলামকে যারা ‘কমপ্লিট কোড অফ লাইফ’ হিসেবে মানার চেষ্টা করেন তারা সমাজে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন। তাদের ব্যক্তিত্ব ও সহনশীলতার কাছে সমালোচকরাও হার মানে। নগদ লাভ ও ক্ষমতাসীনদের সাময়িক প্রভাবের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের দাওয়াত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে না মানলেও মনে মনে ঐ লোকগুলো ইসলামী আন্দোলন ও এর অনুসারীদের সমর্থকে পরিণত হন। তাই বলা যায়, একমাত্র ইসলামী আন্দোলনই পতনোন্মুখ এই সভ্যতার পতন ঠেকাতে পারে।
জেল-জুলুম-নির্যাতন
এক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তি সবসময় ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকেন। নমরূদ, ফেরাউন, আবু জাহেলদের অনুসারীর সংখ্যা প্রতি যুগেই বেশি ছিল, এখনো তাই। প্রতিষ্ঠিত কায়েমি স্বার্থবাদ কখনোই কুরআনের রাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বরদাশত করেনি। তারা নানান বাহানায় আন্দোলনের কর্মীদের ওপর হামলা, মামলা, জুলুম-নির্যাতন ও প্রাণ হরণ করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- ইসলামী আন্দোলকে নিস্তেজ করা এবং বিপ্লবীদের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী তাদের এই প্রচেষ্টা সৃষ্টির শুরু থেকেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে আসছে। বিপরীতে দুর্বল লোকদের ওপর প্রতিষ্ঠিত শক্তির জুলুম নির্যাতন সাধারণ মানুষের কৌতূহলের কারণ হয়েছে এবং এ আন্দোলনকে জানার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আল্লাহর রাসূলের প্রিয় সাহাবী খুবাইব ইবনে আদি (রা) কে শূলিতে চড়ানোর দৃশ্য যেমন হযরত সা’ঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী (রা) কে পরবর্তীতে বারবার মর্মপীড়া দিয়েছে তেমনি হযরত বেলাল (রা) এবং হজরত খাব্বাব (রা) দের ওপর চালানো সীমাহীন নিপীড়ন আরবের মানুষকে অনুসন্ধিৎসু করেছে ইসলামকে জানার ও মানার ব্যাপারে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী আন্দোলনের ওপর নিকট অতীতে চালানো জুলুম-অত্যাচারের প্রভাব সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সাধারণ মানুষের অন্তরে কী পরিমাণ পড়েছে তা চিন্তাশীল মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। বরং বলা যায় বিরোধীদের সকল অপতৎপরতা বুমেরাং হয়েছে। নির্যাতিতের পরিবারের উপর এর প্রথম প্রভাব পড়েছে। পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যারা ইসলামী আন্দোলনকে অপছন্দ করতেন তারা এই সময়ে এসে অনুধাবন করেন যে, সত্যিই, আন্দোলনই সঠিক। তারা দেখেন তাদের নিকটজনকে বিনা কারণে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে, জেলে দিনের পর দিন আটকে রাখা হচ্ছে। নিকটজনের পাশাপাশি পাশের বাড়ির এবং গ্রামের সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন- এই নিরীহ, গরিব, মেধাবী ছেলেটির তো কোন দোষ নাই, তাহলে কেন তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? এই ধরনের হাজারো প্রশ্ন নিজেকে নিজেই করে তারা উত্তর পান- সত্যিই এরা সঠিক পথে আছে। এভাবে বিরোধী মহলের অপপ্রচার, হত্যা, নির্যাতন ও জুলুম ইসলামী আন্দোলনের জন্য যুগ যুগ ধরে প্রচারের ভূমিকা পালন করে আসছে। আন্দোলনকে কোটি টাকা খরচ করে যে প্রচারণা চালানো লাগতো বিরোধী বন্ধুগণ বিনা পয়সায় তা করে দিচ্ছেন।
ছাত্র ও তরুণ সমাজ
সুপিরিয়র টেকনোলজির যুগে অভিভাবকদের চিন্তার শেষ নেই। সন্তান স্কুল-কলেজে গিয়ে কী করছে? আদৌ যাচ্ছে কি-না? পড়ালেখা ঠিকঠাক চলছে তো? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন অভিভাবকদের চিন্তায় ঘুরপাক খায় সারাদিন। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন, প্রত্যাখ্যাত হয়ে বান্ধবীকে নির্যাতন-হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি পত্র-পত্রিকার নিয়মিত খবরের অংশ বিশেষ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের হাতে থাকায় তাদের মাঝে এমন কিছু অসৎ চিন্তা ও কর্ম পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণ বিবেকবান মানুষের চিন্তার বাইরে। স্মার্ট ফোন বা আই ফোন এবং হাই স্পিডি ইন্টারনেট এমন কোমলমতীদের হাতে পড়ছে যারা এর ব্যবহারের সীমা-পরিসীমা বোঝার জ্ঞান রাখে না। প্রযুক্তির অপব্যবহার তরুণ-যুবকদের চরিত্রকে উগ্রতা, হিং¯্রতা, অনমনিয়তা, কুটিলতা এবং অনৈতিকতার অতল গহবরে পৌঁছে দিচ্ছে। ইন্টরনেটের নিষিদ্ধ সাইটগুলোয় বিশেষত ছাত্রদের অবাধ বিচরণ অবক্ষয়ের শেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফায়িং অথরিটিজ (সিসিএ) এর এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অষ্টম হতে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীদের ৬৯ শতাংশই ইন্টারনেটে আসক্ত। এদের মধ্যে আবার ৮৩ শতাংশ ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এই যখন দেশের তরুণ যুবকদের অবস্থা তখন ইসলামী আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু শিক্ষার্থী উপর্যুক্ত অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে তাদের স্যালুট। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী যখন মদ-গাঁজা-ইয়াবা সেবন থেকে বিরত থাকেন, বান্ধবীদের সাথে অহেতুক আড্ডাবাজিতে লিপ্ত না হন, মুখ থেকে দুই অক্ষরেরও কোন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করেন তখন এই নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বন্ধু মহলে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। সচেতন-বিবেকবান অনেকেই তাদের পথ অনুসরণে এগিয়ে আসেন। জওহর দোদায়েভ: এসএসসি পরীক্ষা চলাবস্থায় পরীক্ষার হলে বাহির থেকে সমাধান হাতে পায়। বন্ধুরা সবাই মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে যায়। কিন্তু জওহর দোদায়েভ সমাধান হাতে পাওয়ার সাথে সাথে তা স্যারের সামনেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তার এই সততা পরীক্ষার হলের সবাই অত্যাশ্চর্যের মত উপভোগ করে। এই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের সংস্পর্শে থাকা একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর নির্মল চরিত্র।

পেশাজীবী মহল
জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ কত পেশাই না বেছে নেন। ইসলামের মূলনীতি মেনে যে কোন পেশাই গ্রহণ করা যায়। তবে কিছু পেশা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য অতীব জরুরি যেমন- ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, বিচার, সাংবাদিকতা ইত্যাদি। একজন ডাক্তার তার বিদ্যা ও আন্তরিকতা দিয়ে একজন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারেন। একজন শিক্ষক তার মেধা ও অভিজ্ঞতা থেকে পাঠদানের মাধ্যমে দেশের জন্য ভবিষ্যৎ সৎ, দক্ষ ও আদর্শবান নাগরিক উপহার দিতে পারেন। একজন সাংবাদিক তার লেখনীশক্তির মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতা, মাদক, দুর্নীতি দূর এবং দেশে আইন ও ইনসাফের শাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন আইনজীবীর কাছে অধিকারহারা মানুষ আইনগত সহায়তার মাধ্যমে অধিকার ফিরে পেতে পারেন। কিন্তু উক্ত পেশার কেউ যদি নীতি ও দীনহীন হন তবে তার কাছে সেবার পরিবর্তে দুর্ভোগ, অকল্যাণই উপহার পাওয়া যেতে পারে। যেমন- একজন অপেশাদার ও বদমেজাজি ডাক্তার চোখের অপারেশন করতে গিয়ে রোগীকে বেশি যন্ত্রণা দিতে পারেন এবং তার অপূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় রোগীর চোখের আলো চিরদিনের জন্য নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। একজন হলুদ সাংবাদিকের কলম কখনো সমাজের মানুষের বিপথগামিতার কারণ হতে পারে। একজন অসৎ বিচারকের রায় নিরপরাধ মানুষের জীবন হরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে সর্বত্র এই চিত্রই বিরাজমান। হাতেগোনা ব্যতিক্রমীদের সবাই চেনেন, জানেন। তাদের সেবা মানুষের হৃদয়-মন কেড়ে নেয়। তাদের সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং অমায়িক ব্যবহার সেবাগ্রহীতার মনে গেঁথে যায়। ইসলামী আন্দোলনই এ ধরনের অগণিত মানুষ তৈরি করেছে। এদের চরিত্র ও কর্মের উপমা প্রতিটি পেশায় অল্প হলেও দেখতে পাওয়া যায়।

পরিশেষে সূরা আল বাকারার ৩০ নম্বর আয়াত দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই। সেখানে আল্লাহপাক পৃথিবীতে মানুষ নামক খলিফা পাঠানোর কথা বলেছেন। খলিফা অর্থ- প্রতিনিধি। তিনি আসল মালিক নন বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। মালিক তাকে যে কাজ যেভাবে করার জন্য আদেশ দিয়েছেন তাকে সে কাজ ঠিক সেভাবেই আঞ্জাম দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি বলেই বিবেচিত হবে। প্রতিনিধির কোন স্বাধীন ক্ষমতা নেই, মালিকের দেয়া কিছু এখতিয়ারই তাই এখতিয়ার। প্রতিনিধির কোনো স্বতন্ত্র ইচ্ছাশক্তি নেই, মালিকের ইচ্ছার বিলকুল বাস্তবায়নই হবে তার একমাত্র পেরেশানির কারণ। ইসলামী আন্দোলন এই চেতনাকে শাণিত করে। এই শাণিত চেতনার লোক সমাজে যত বেশি হবে বিপ্লব তত ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Popular Posts