Friday, September 28, 2018

কাব্য-সাহিত্য চর্চায় রাসূলের (সা) কালজয়ী দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা -মোশাররফ হোসেন খান

রাসূল (সা)। তিনি ছিলেন তুলনারহিত এক অসাধারণ মহামানব। ছিলেন মানুষ ও মানবতার শিক্ষক। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রয়াসে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ এক নতুন আলোকিত মাত্রা পেয়েছিল। তিনি শুধু সমাজ-সংস্কারই করেননি, বরং সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। আমরা বিস্মিত হই, যখন দেখি রাসূল (সা) একই সাথে শাসক, সমরবিদ, সেনাপতি, সমাজ-সংস্কারকসহ সকল দিকে তাঁর ঐতিহাসিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এমনই একজন মহামানব তিনি, যিনি শিল্প-সাহিত্য ও আসহাবে রাসূলের (সা) কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন অতুলনীয় ভূমিকা। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় সাহাবী-কবিগণ তাঁদের কাব্যচর্চার ধারা বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের রচিত সেসব কাব্যসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত বলেই আজও সেসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা হয়।

রাসূলের (সা) সাহায্য, সহযোগিতা, প্রেরণা ও উৎসাহে যেসকল সাহাবী-কবির উত্থান ঘটেছিল এবং যাঁরা কাব্যসাহিত্যে অমরতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) অন্যতম। তাঁর কাব্যসাহিত্য নিয়েই আজকের এই যৎকিঞ্চিৎ পর্যালোচনা।
রাহমাতুল্লিল আলামিন সাইয়িদুল মুরসালিন খাতামুন নাবিয়্যিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী-হযরত আলী (রা) ইবনে আবু তালিব। সুবিচারের জন্য তিনি ‘শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক’ মর্যাদায় ভূষিত ছিলেন। সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সশস্ত্র জিহাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র রচনা, নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে চুক্তিপত্র রচনা, কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলনে হযরত আলীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। কৃষক-শ্রমিক তথা সকল শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ছিলেন তিনি। অনন্য মগ্নতায় তিনি নামাজ সম্পন্ন করতেন এবং আল্লাহর প্রেমে কখনো কখনো সংজ্ঞা হারাতেন। তিনি নাজিলকৃত আয়াত লিখে রাখতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আলোচনা করতেন। আল কুরআনের ভাষ্যে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। অনন্য জ্ঞান প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিশেষ নৈকট্যে থেকে সূরা নাজিলের প্রেক্ষিতসহ আয়াতসমূহের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ লাভ করেন তিনি।
মহান সাহাবী ও খলিফা হযরত আলী (রা) আরবি সাহিত্যেও সুপণ্ডিত ছিলেন। সশস্ত্র জিহাদসমূহে তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয়ী হন তিনি। বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভ করেন সোমবারে এবং হযরত আলী (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন পরদিন মঙ্গলবার। ইসলাম গ্রহণের পর সত্য অবলম্বন করে থাকা ও প্রচারের কাজে তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হন। হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিনিধিরূপে আমানতকারীদের কাছে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে তাঁর নিজের বিছানায় তাঁকে রেখে যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সেখানে থেকে মারাত্মক বিরূপ পরিস্থিতি মুকাবিলা করে আমানতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দিয়ে সপরিবারে মদিনায় হিজরত করেন।
ইসলামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ জিহাদ-বদরে তিনি বিপুল সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। উহুদের যুদ্ধে মহানবীর জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। বিধর্মীরা তাঁকে ঘিরে ফেললো। তিনি নিজ অবস্থান থেকে ছুটে এসে তাদের ব্যূহ ভেদ করে নবীজীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। খন্দকের সশস্ত্র জিহাদে আমির ইবন আবদে উদ দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালে তিনি এগিয়ে যান ও সবাইকে অবাক করে তাঁর জুলফিকারে ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন।
খায়বারের জিহাদে কঠিন ভাগ্য পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর কোনো সেনাপতি জয়ী হতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেবো, যিনি আল্লাহ ও রাসূলকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিজয় লাভ করাবেন। তিনি কিছুতেই পশ্চাৎপদ হবেন না।’ হযরত আলীর চোখের রোগ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় মুহূর্তে নিরাময় হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে পতাকা প্রদান করে বললেন, ‘হে আলী! পতাকা গ্রহণ করো এবং তা নিয়ে অগ্রসর হও যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন।’ যুদ্ধে ঢাল হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি দুর্গের কপাট খুলে ঢালরূপে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধ শেষে তা দূরে নিক্ষেপ করেন। একমাত্র তাবুক অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে মদিনা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
তিনি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখেন ও প্রথম তিন খলিফার শাসনকালের পঁচিশ বছর সহযোগিতা দান করেন। তিনি হযরত উমর (রা)-কে হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ দান করেন। হযরত উমর (রা) বলেন, ‘আলী না হলে উমর ধ্বংস হতো।’ হিজরির শেষ দিক থেকে ৪০ হিজরির ১৭ রমজান পর্যন্ত খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পরিচালনা করেন তিনি। ২১ রমজান রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি শাহাদাত লাভ করেন। রবিবার রাতে তাঁকে কুফায় দাফন করা হয়।
হযরত আলীর (রা) অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভা ছিল। অধ্যাপক পি.কে হিট্টি হযরত আলীকে (রা) ‘মুসলিম সাহিত্য ও শৌর্যবীর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মূল্যায়ন করেন।’ ঐতিহাসিক গিবন বলেন, ‘জন্ম, আত্মীয়তার বন্ধন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলীকে (রা) এত বেশি মহিমান্বিত করেছিল যে, আরবের শূন্য সিংহাসনের দাবি করা তাঁর জন্য অযৌক্তিক ছিল না। একজন কবি, একজন দরবেশ ও একজন সৈনিকের সমন্বিত গুণাবলি তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাঁর বাগ্মিতা ও সাহসিকতার কাছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো। মহানবী (সা) তাঁর কর্তব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বন্ধুর কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁকে তিনি নিজের ভাই, প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয় মূসার বিশ্বস্ত হারুন হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।’
অনন্য বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন হযরত আলী (রা)। জনগণের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন, তার সংকলন গ্রন্থ বিখ্যাত ‘নাহযুল বালাগা।’ এতে তাঁর ধর্মীয় বিচার-বুদ্ধি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জীবনবোধ ও আল্লাহর কাছে আত্ম-নিবেদনের আকুতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সেই ভাষণাবলি প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন ও ভাষার লালিত্যে এক অতুলনীয় সাহিত্য-কর্মে রূপ গ্রহণ করেছে। আরবি ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসেবে এ গ্রন্থ স্বীকৃত ও সম্মানিত। আরবি গদ্য ধারায় মাকামা সাহিত্যের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। শাশ্বত সর্বজনীন বাণীর ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন, কালোত্তীর্ণ ভাব ও অলঙ্করণ, গদ্য ধারায় ছান্দিক কুশলতা ও শিল্প-শোভনতা নাহযুল বালাগার মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে।
হযরত আলী (রা)-কে আরবি ব্যাকরণের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে আবুল আসওয়াদ দুয়েলি প্রথম আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন। হযরত আলী (রা) লিখেছেন অনেক কবিতা। পবিত্র হাদিস ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলিতে তাঁর অনেক কবিতা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলনও হয়েছে। দিওয়ান-ই-আলী (রা) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন। মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও এ গ্রন্থের সমাদর ব্যাপক-বিশাল। সর্বজনীন কালোত্তীর্ণ বাণী ও শিল্প সৌন্দর্যে এ গ্রন্থ কালজয়ীর ভূমিকা পালন করছে। দিওয়ান শব্দের অর্থ কাব্যগ্রন্থ, কবিতা সংকলন। বিচারালয়ও এর অর্থ হয়। এককভাবে কোনো কবির কাব্য-সমষ্টিকে বা একই গোত্রের কয়েকজনের কাব্যসংগ্রহকে দিওয়ান বলা হয়। দিওয়ান-ই-আলী (রা) মানে আলী (রা)-এর কাব্য সংকলন। আল্লামা শিবলী নুমানী এ গ্রন্থের মর্যাদা ও খ্যাতির ওপর মূল্যবান এক অভিমতে বলেন, ‘আরবি কাব্যসাহিত্যে মুআল্লাকা, লামিয়াত ও আধুনিক আরবীয় গদ্য ও কাব্যসাহিত্যের সুবিশাল জগতের মধ্যে দিওয়ান-ই-আলীর তুলনামূলক মূল্যায়নে এটা স্বচ্ছ হয় যে, ইসলামের অনুপম সত্য ও সুন্দরের উপস্থাপনায়, মানবীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সৃজনশীলতায়, নশ্বর পার্থিবতার মোহের বলয় ভেঙে চিরন্তন জীবনের আহ্বান কুশলতায়, সর্বোপরি মাবুদ ও বান্দার সম্পর্ক ও নৈকট্যের জন্য অনুপম আকুতি-সমৃদ্ধ দিওয়ান-ই আলী (রা) একই সাথে তত্ত্বসন্ধানী ও শিল্পান্বেষী মানুষের জন্য এক মূল্যবান উপহার এবং এর গতিময়তা কাল থেকে কালান্তরে, শতকের পর শতক পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। দুর্ভাগ্যশত দৃষ্টিকোণগত সংকীর্ণতার যূপকাষ্ঠে দিওয়ান-ই-আলী (রা)-এর মত সর্বজনীন মানবতাবাদী বিশ্বসাহিত্যে যথাযোগ্য মূল্যায়ন ঘটেনি। খিলাফতের প্রতি বৈরী আঘাত থেকে এ সাহিতকর্মও রেহাই পায়নি। কারণ, এর কবি হযরত আলী (রা), খুলাফায়ে রাশেদীনের শেষ খলিফা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে, মজলুম মানুষের মুক্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য-কর্ম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এর আহ্বান উপস্থাপিত হয়নি। মানবিক মহিমার সর্বোচ্চ ঘোষণায় দিওয়ান-ই-আলী (রা) শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ছিল সেদিন, রয়েছে আজো এবং এর আবেদন আগামীর আবহমান মানুষের মিছিলেও শামিল থাকবে।’
হযরত আলী (রা)-এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সুধীমহল কম-বেশি অবহিত আছেন। আরবি কাব্যক্ষেত্রে হযরত আলী (রা)-এর অমর অবদানের মধ্যে রয়েছে আনওয়ার আল-উকূল মিন আশআরী ওয়াসিইয়ী আর-রাসূল (রাসূল প্রতিনিধির কবিতাবলি জ্ঞানপ্রদীপ)। হি. ৮৯৭,/খ্রি. ১৪৯২ সনে সাদী ইবন তাজি সঙ্কলিত এ গ্রন্থ ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৮/৫৭৭; আয়া সুফিয়া ৪২/৩৯৩৭; পাটনা ১: ৭৪৯, ১৯৫; লিডন ৫৮০; প্যারিস (প্রথম) ৩/৩০৮২; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ২/১২২৪; মিউনিখ (প্রথম) ২/৪৪১; ভ্যাটিক্যান (তৃতীয়) ৩৬৫; আলীগড় ৭,১৩৪ ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। হি. ৮৯০/খ্রি. ১৭৮৫ সনে হুসাইন ইবন মুঈন আল-দীন-আল-মাইবুযী কর্তৃক ফারসি ভাষায়কৃত এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিডন ৫৭৯; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৫৭৯/১৬৬৫; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ১: ১৯,২০; তেহরান ২: ৪/৪১৩ ইত্যাদি স্থানে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তিত্বকৃত এর ফারসি অনুবাদ হামবুর্গ (১,১৯১)-সংরক্ষিত রয়েছে।
মূলত হযরত আলীর (রা) কাব্য ও সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

দুই.
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবুও আবারো স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, হযরত আলী (রা) ছিলেন একজন সুবক্তা ও বিখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেক কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেক কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবি কাব্যজগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন এতে পণ্ডিতগণের কোন সংশয় নেই। ‘নাহজুলবালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

হযরত আলীর (রা) কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রধর্মী। বংশ অহমিকা, মূর্খের সাহচর্য, যুগের বিশ্বাস ঘাতকতা, যুগ-যন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, দুনিয়া থেকে আত্মরক্ষা, সহিষ্ণুতার মর্যাদা, বিপদে ধৈর্য ধারণ, দুঃখের পর সুখ, অল্পে তুষ্টি, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য ইত্যাদি বিষয় যেমন তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনিভাবে সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধের বর্ণনা, প্রিয় নবীর (সা) সাহচর্য, তাকদির, আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, খোদাভীতিসহ নানা বিষয় তাতে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, যৌবনের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের রীতিনীতি, ভ্রমণের উপকারিতা, জ্ঞানের মহত্ত্ব ও অজ্ঞতার নীচতা, মানুষের অভ্যন্তরের পশুত্ব ইত্যাদি বিষয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে প্রিয় নবীর (সা) ও প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতিমার (রা) মৃত্যুতে শোকগাথাও রচনা করেছেন।
বংশ অহমিকা যে অসার ও ভিত্তিহীন সে কথা হযরত আলী (রা) বলেছেন এভাবে :
‘আকার-আকৃতির দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান।
তাদের পিতা আদম এবং মা হাওয়া।
মায়েরা ধারণের পাত্রস্বরূপ, আর পিতারা বংশের জন্য।
সুতরাং মানুষের গর্ব ও অহঙ্কারের যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো কাদা ও পানি।’
পুত্র হুসায়নকে (রা) তিনি উপদেশ দান করেছেন এভাবে :
‘হে হুসায়ন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,
তোমাকে আদব শিখাচ্ছি; মন দিয়ে শোন।
কারণ, বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়।
তোমার স্নেহশীল পিতার উপদেশ স্মরণ রাখবে,
যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
যাতে তোমার পদস্খলন না হয়।
আমার প্রিয় ছেলে!
জেনে রাখ, তোমার রুজি-রিজিক নির্ধারিত আছে।
সুতরাং উপার্জন যাই কর, সৎভাবে করবে।
অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না।
বরং আল্লাহ-ভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।’
বুদ্ধি, জ্ঞানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি বলেছেন এভাবে :
‘মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ হলো তার বোধ ও বুদ্ধি।
তার সমতুল্য অন্য কোন ভালো জিনিস আর নেই।
দয়াময় আল্লাহ যদি মানুষের বুদ্ধি পূর্ণ করে দেন
তাহলে তার নীতি-নৈতিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
একজন যুবক মানুষের মাঝে বুদ্ধির দ্বারাই বেঁচে থাকে।
আর বুদ্ধির ওপরই তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সুস্থ-সঠিক বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে সৌন্দর্যময় করে-
যদিও তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
আর স্বল্প বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে গানিময় করে-
যদিও বংশ মর্যাদায় সে হয় অভিজাত।’
তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা ও নিত্যতাকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করে বলেছেন :
‘নিশ্চয় দুনিয়া নশ্বর।
এর কোনো স্থায়িত্ব নেই।
এ দুনিয়ার উপমা হলো মাকড়সার তৈরি করা ঘর।
হে দুনিয়ার অন্বেষণকারী!
দিনের খোরাকই তোমার জন্য যথেষ্ট।
আর আমার জীবনের শপথ!
খুব শিগগির এ দুনিয়ার বুকে যারা আছে,
সবাই মারা যাবে।’
তিনি দুনিয়াকে সাপের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে :
‘দুনিয়া হলো সেই সাপের মত যে বিষ ছড়ায়-
যদিও তার দেহ নরম ও কৃশকায়।’
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখে ধৈর্যহারা না হবার কথা বলেছেন এভাবে :
‘যুগ বা কাল যদি আমাকে দুঃখ দেয়
তা হলে আমি সংকল্প করেছি ধৈর্য ধরার।
আর যে বিপদ চিরস্থায়ী নয় তা খুবই সহজ ব্যাপার।
আর যুগ যদি আনন্দ দেয় তাহলে উল্লাসে আমি মাতি না।
আর যে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী তা একান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।’
খায়বার যুদ্ধের দিন মারহাব ইহুদি তরবারি কোষমুক্ত করে নিম্নের এই শ্লোকটি আওড়াতে আওড়াতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায় :
‘খায়বার ময়দান জানে যে, আমি মারহাব।
আমি অস্ত্রধাণকারী,
অভিজ্ঞ বীর-যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠে।’
এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই শ্লোকটি আবৃত্তি করতে করতে অসীম সাহসিকতার সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন :
‘আমি সেই ব্যক্তি যার মা তাকে ‘হায়দার’ নাম রেখেছে।
আমি জঙ্গলের বীভৎস দৃশ্যরূপী সিংহ।
আমি শত্র“ বাহিনীকে সানদারাড় পরিমাপে পরিমাপ করি।
অর্থাৎ তাদেরকে পূর্ণরূপে হত্যা করি।’
উহুদ যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমার (রা) কাছে এসে বললেন, ফাতিমা! তরবারিটি রাখ। আজ এটি দিয়ে খুব যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি এই দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলেন:
‘হে ফাতিমা!
এই তরবারিটি রাখ যা কখনো কলঙ্কিত হয়নি।
আর আমিও ভীরু কাপুরুষ নই এবং নই নীচ।
আমার জীবনের কসম!
নবী আহমাদের সাহায্যার্থে এবং বান্দার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত
প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে আমি এটাকে ব্যবহার করে
পুরনো করে ফেলেছি।’
কবিতা সম্পর্কে হযরত আলীর (রা) মনোভাব তাঁর একটি মূল্যবান উক্তিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন :
‘কবিতা হলো একটি জাতির দাঁড়িপাল্লা (অথবা তিনি বলেছেন) কথার দাঁড়িপাল্লা।’
অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেমন জিনিসপত্রের পরিমাপ করা হয় তেমনি কোনো জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৈতিকতা ও আদর্শের পরিমাপ করা যায় তাদের কবিতা দ্বারা।
তিনি শুধু নিজে একজন উঁচু মানের কবি ছিলেন শুধু তাই নয়, বরং অন্য কবিদেরকেও তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাদের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নও করতেন।
যেমন, একবার এক বেদুঈন তাঁর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে একটি চাদর দান করলেন। লোকটি যাওয়ার সময় তার নিজের একটি কবিতা শোনালো। এবার হযরত আলী (রা) তাকে আরো পঞ্চাশটি দিনার দিয়ে বললেন, শোন, চাদর হলো তোমার চাওয়ার জন্য, আর দিনারগুলো হলো তোমার কবিতার জন্য। আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে, তোমরা প্রত্যেক লোককে তার যোগ্য আসনে সমাসীন করবে।’

তিন.
রাসূল (সা) কবি ও কবিতাকে ভালোবাসতেন। কবিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সহযোগিতা করতেন। অনুপ্রেরণা দান করতেন। রাসূলের (সা) এই কর্মধারায় সাহাবীগণও অভিষিক্ত ছিলেন। হযরত আলীও (রা) কবি ও কবিতাকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতাও করতেন। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত ছিলেন তাঁরা। যে কারণে সমরে কিংবা শান্তিতে, শাসকের দায়িত্ব পালন কালে, নেতৃত্ব প্রদান কালেÑ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় তাঁরা কবি ও কবিতাকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে গেছেন। যা আজ এবং আগামীর জন্য এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্তস্বরূপ।

সুতরাং কবি ও কবিতার যথাযোগ্য মূল্য ও মর্যাদা দেয়া সুন্নতেরই একটি বড় অধ্যায়।
বেদনার বিষয় বটে, আজকে যারা নেতৃত্বের আসীনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের কাছে কবি ও কবিতার বিশেষ কোনো মূল্য বা মর্যাদা আছে বলে মনে হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিরাই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত। এটা কোনো ক্রমেই শুভ লক্ষণ নয়। কাম্যতো নয়-ই।
স্মরণ রাখা উচিত যে, বিশ্বাসী কবিদের কবিতা ইসলামী সমাজগঠনে, আদর্শিক সংস্কৃৃতি বিকাশে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং যাদের এতটা অবদান সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে, সেই সব কবি-সাহিত্যিকের প্রতিও ইসলামের নেতৃবৃন্দসহ সকলের সুদৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন কবি ও কবিতার যথাযথ মর্যাদা ও মূল্য দেয়ার। তাঁদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করার। তাহলেই বিশ্বাসী কবিতার ধারা আরও বেগবান হয়ে উঠবে। আর তাতে করে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সবুজ চত্বর আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে।
একটি সবুজ-সুন্দর পৃথিবী ও সমাজ বিনির্মাণের জন্য কবি ও কবিতার ভূমিকা অনিঃশেষ। বিষয়টির প্রতি সবার সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও সম্পাদক

Wednesday, September 26, 2018

স্টিফেন হকিংসকে বিজ্ঞানী বলা যাবে না



আবু মহি মুসা : শুরুতেই একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, আমাদের এ সভ্যতার দর্শনের শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতক থেকে। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছে গ্রিক। যে কারণে গ্রিককে বলা হয় ‘মাদার অব ফিলোসফি।’ খ্রীস্টপূর্ব ৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়-কাল হচ্ছে ছাব্বিশ শত বছর। যেখনে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শত ভাগের কাছাকাছি, সেখানে এই ছাব্বিশ শত বছরে দর্শনের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। এই সময়ে মধ্যে আমরা  দার্শনিক কোনো বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাইনি। যেমন প্রেম, দেশপ্রেম,  মানবিক মূল্যবোধ, সততা, দর্শন, দর্শনের উৎপত্তি ইত্যাদি, কোন্ বিষয়ে আমরা ধারণা পেয়েছি?   
উল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত একটি বিষয় রয়েছে।  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বহু আলোচিত এবং আলোড়িত যে মতবাদ, তা হচ্ছে স্টিফেন হকিংসের ‘বিগ ব্যাং থিওরী।’ বিগ ব্যাং থিওরী সম্পর্কে আমি বলবো, it is bogus and absolutely bogus. Not only that Stepehen Halkings neither philosopher, nor Scientiest. অর্থাৎ স্টিফেন হকিংস বিজ্ঞানীও ছিলেন না, দার্শনিকও ছিলেন না।  এ বক্তব্যটি শুনে অনেকের বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। সমগ্র বিশ্ব  টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যেভাবে তাকে সপ্তম আস্মানে নিয়ে গেছে, সেখানে উল্লেখিত বক্তব্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য করে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। তিনি যে বিজ্ঞানী নন, এখানে তিনটি যুক্তি রয়েছে।
প্রথম যুক্তি : লক্ষ্য করা গেছে,  অনেক সময় অনেকেই নিজেকে দার্শনিক হিসেবে দাবি করে থাকেন। কে দার্শনিক এটা  কেউ নিজে দাবি করলেও হবে না, বা অন্য কেউ বললেও হবে না। কে দার্শনিক এটা বলবে দর্শনের সংজ্ঞা। আমরা কি  দর্শনের সেই সংজ্ঞা পেয়েছি? আমি ‘দেশপ্রেমিক’, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বলবে আমি দেশপ্রেমিক কিনা? ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বলবে কে বিজ্ঞানী। আমরা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সঠিক কোনো সংজ্ঞা পাইনি। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,  বিজ্ঞান হচ্ছে, ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমি দর্শনকেও বিশেষ জ্ঞান  বলতে পারি । এ দিয়ে কি বুঝা যাবে বিজ্ঞান কি অথবা কে বিজ্ঞানী? বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা বইর মধ্যে পাওয়া যায় তা হচ্ছে, ‘কোনো বিষয়ের সুসংঘবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান।’ বিজ্ঞানের এ সংজ্ঞাকে গ্রহণযোগ্য বলে  মনে করা হয় না।
আমরা জানি যে,  বিশ্বজগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগৎ, অন্যটি ভাবজগৎ। বস্তুজগতের কোনো কিছুর সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। যেমন, তাল গাছ, নারকেল গাছ। আমরা নামেই তাকে চিনতে পারি। কিন্তু ভাবের ক্ষেত্রে সংজ্ঞার প্রয়োজন হয়। কারণ, শুধু নাম দিয়ে কিছুই বুঝা যায় না। যেমন, প্রেম, মানবিক মূল্যবোধ সততা, ন্যায়পরয়ণতা ইত্যাদি । এ জন্য এর সংজ্ঞার প্রয়োজন। সংজ্ঞারও  একটি সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞার সংজ্ঞা হচ্ছে ‘brief description’ অর্থাৎ যে বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হবে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এরপর উদঘাটন করতে  হবে ঐ বিষয়ের সাথে আর কি কি বিষয় জড়িত। যেমন, ভালোবাসা, একটি শব্দ। এই একটি শব্দ দিয়ে কিন্তু বুঝা যায় না ভালোবাসা কি। ৭টি বিষয়ের সমষ্টি হচ্ছে  ভালোবাসা (প্রেম-ভালোবাসা অধ্যায় : সৃষ্টি থেকে ধ্বংস)। যেমন, মানসিক আকর্ষণ, কল্যাণ কামনা, স্বার্থ, জ্ঞান, আবেগ, ইচ্ছা এবং অনুভুতি। জ্ঞানটা এর মধ্যে কেন রয়েছে। যেমন, দশটি মেয়ে একই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যায়। এর মধ্যে একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগলো, যে মেয়েটি দেখতে কুৎসিৎ। এই কুৎসিৎ মেয়েটিকে ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, এ মেয়েটির এমন একটি গুণ আছে, যা আর কারো মধ্যে নেই। এখানে জ্ঞান এনালাইসিস করবে, মেয়ের রূপ সৌন্দর্য ভালো লাগবে না গুণ ভালো লাগবে। উল্লেখিত বিষয়ের  প্রত্যেকটির ভূমিকা রয়েছে। ঠিক তেমনি কি কি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান এটা জানতে হবে। বিজ্ঞান বলতে দুটো বিষয়। একটি জ্ঞান, অন্যটি বস্তু। জ্ঞান ছাড়া বিজ্ঞান হবে না, বস্তু ছাড়াও বিজ্ঞান হবে না। (যদিও অতিন্দ্রি বিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বস্তুর উপস্থিতি নেই, এটা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ)। রাইট ব্রাদার্স বিমান সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন গ্লাইডিংয়ের মাধ্যমে। এর জ্ঞান তাঁরা কোথায় পেয়েছেন? আকাশে পাখি উড়তে দেখে। পরবর্তীকালে যান্ত্রিক বিমান আবিস্কৃত হয়েছে। এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। এর জ্ঞান তারা পেয়েছে আকাশে পাখি উড়তে দেখে। এরা যদি কোনো কালেই আকাশে পাখি উড়তে না দেখতেন, তাহলে তাদের পক্ষে বিমান আবিস্কার করা সম্ভব ছিল না। এটাই হচ্ছে ভাব বা জ্ঞান। পাখি দেখে বিমানের নক্সা করলেন। এই নক্সা নিয়ে গেলেন বস্তুর কাছে। বস্তু দিয়ে বিমানের বডি তৈরী করলেন, ডানা দিলেন, লেজ দিলেন। এরপর ইঞ্জিন ফিট করলেন। আকাশে উড়লেন। এবার বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হবে এভাবে, ‘ যে জ্ঞান বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা বস্তু মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এটা হচ্ছে বিজ্ঞান। প্রশ্ন হচ্ছে, স্টিফেন হকিংসের কোনো জ্ঞান সরাসরি বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত? এটাই যথেষ্ট যে তিনি বিজ্ঞানী নন।  
দ্বিতীয় যুক্তি : দর্শনের উৎপত্তির পর দর্শন দুই ভাগে বিভক্ত। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। তৃতীয় স্তরে দর্শন চারভাগে বিভক্ত । যেমন, ভাববাদী ক্ষেত্র, বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ধর্মীয় ক্ষেত্র এবং দার্শনিক সাধারণ ক্ষেত্র।  কিন্তু, মতবাদ দেয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে তিনটি। বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ভাববাদী ক্ষেত্র এবং মিশ্রক্ষেত্র। বস্তুবাদী ক্ষেত্র বলতে যেমন, একজন ডাক্তার-বিজ্ঞানী একটি রোগের ঔষধ অবিস্কার করেছেন, এটা হচ্ছে বস্তুবাদী ক্ষেত্র। এখানে তার সাথে কোনো দার্শনিকের দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। তাদের দুজনের পথ এবং মত ভিন্ন। কিন্তু মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেবেন প্রমাণ, দার্শনিকরা দেবেন যুক্তি। প্রমাণ এবং যুক্তি এক হতে হবে।  মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ৯৯ ভাগ প্রমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ। অনেক প্রমাণ দেখানো হয়েছে। শেষে বলা হয়েছে মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল প্রাইমেট। শিক্ষিত সমাজের অনেকে এখনও মনে করেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল বানর। এটা সম্পূর্ণ একটি বোগাস মতবাদ। কতগুলো যুক্তি চান মানুষ মানুষ আকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে? বানর যদি মাটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে, মানুষর সৃষ্টি মাটি হতে বাধা কোথায়? কাজেই এই মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা যতগুলো বিষয়ে মতবাদ দিয়েছেন, যেমন, বিগ ব্যাং, ব্লাক হোল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, বিশ্ব্সৃষ্টি, আকাশ অসীম না সসীম, পৃথিবী ধ্বংস, সবগুলো বোগাস। এর মধ্যে বস্তুগত প্রমাণ, দার্শনিক যুক্তি, বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা নেই। এর পর টাইম ট্রাভেলের কথা বলা হয়েছে। এলিয়েন নামক প্রাণীরা পৃথিবীতে আসে। অনেকে দেখেছেও। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
তৃতীয় যুক্তি : স্টিফেন হকিংস বলেছেন, জমাটবদ্ধ বস্তুতে মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি । প্রশ্ন হচ্ছে, জমাটবদ্ধ বস্তু কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এর ভর কত? তরল না সলিড? মহাবিস্ফোরণের ফলে যে বস্তুপুঞ্জ ছুটে এসে সূর্যের সৃষ্টি করেছে, বিস্ফোরণ স্থল থেকে এর দূরত্ব কত? এর মাঝে অনেক গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ রয়েছে। সে সব সৌরজগৎ অতিক্রম করে সূর্যের সৃষ্টি করা কি সম্ভব? বস্তুপুঞ্জ ছুটে আসার শক্তি কোথায় পেয়েছে, নাকি জেট ইঞ্জিল ফিট করা ছিল? ভারতের দুজন বিজ্ঞানী বলেছেন, মহাবিশ্ব এত সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি,  বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি  সম্ভব নয়। কাজেই তার এ মতবাদ সম্পূর্ণ মনগড়া কল্পকাহিনী।
প্রশ্ন হতে পারে যে, মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? জার্মান দার্শনিক ইমনুয়েল কান্ট বলেছেন, ‘বিশ্ব কখনো সৃষ্টি হয়নি, কখনো ধ্বংস হবে না। ছিল, আছে, থাকবে। বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মের সাথে এর তুলনা করা যাবে না। ধর্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য । অন্য দিকে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার। জ্ঞানীদের জন্য  সূরা ইমরানের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই গ্রন্থের কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন, অন্যগুলো রূপক। অর্থৎ কাল্পনিক। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, যারা নাস্তিক, তারা এসব নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি করে।’ কাজেই এমন কিছু বলা যাবে না যা বললে ধর্মের ভিত দুর্বল হতে পারে।  যেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মের সাথে একটি সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, এবং বহু আলোচিত। আমরা কখনো ধর্মীয় বিষয়ের সাথে দার্শনিক বিষয়ের তুলনা করবো না। এ ক্ষেত্রে আমরা বলবো, ইমানুয়েল কান্টের এ বক্তব্য যথার্থ। তিনি এতটুকুই বলে থেমে গেছেন। আমরা এখান থেকে আরও সামনের দিকে নিয়ে গেছি। আমরা বলেছি, বিশ্বের অনেক গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে, অনেক গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গ্রহ ধ্বংস হয়েছে? এবার আমরা ফর্মুলায় যাবো। বলা হয়েছে, যে গ্রহের সৃষ্টি আছে, কেবল সেই গ্রহের ধ্বংস আছে। যে গ্রহের সৃষ্টি এবং ধ্বংস আছে, সে গ্রহের সময় আছে। যে গ্রহের সময় আছে সে গ্রহটাই ধ্বংস হবে। যেমন, পৃথিবী একটি ধ্বংস হবে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে সকাল, বিকাল, রাত্রি আছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শো কোটি বছর। সময় সম্পর্কেই তো তাদের কোনো ধারণা  নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রা- রাসেল প্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেম হলো সিগারেটের মতো, যার শুরু অগ্নি দিয়ে, শেষ ছাইয়ে।’ মানুষের জীবনে মানবিক মুল্যবোধের পর যে বিষয়টি মূল্যবান সেটি হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা। মানুষের মধ্যে যেদিন ভালোবাসা থাকবে না, সেদিন সভ্যতাও থাকবে না। আদি রাষ্ট্রের উৎপত্তির একটি কারণ হচ্ছে প্রেম। অথচ বার্ট্রা- রাসেল কি বললেন। ওই সব বিজ্ঞানীরা সময় সম্পর্কে ঠিক তেমনি যুক্তিহীন ভিত্তিহীন কথা বলেছে। সময়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। সময় হচ্ছে পৃথিবীর ব্যাপার। দুটো কারণে সময়ের উৎপত্তি।  সূর্য আলো দিচ্ছে, পৃথিবী ঘুরছে, ফলে আমরা একটি দিন এবং একটি রাত পাচ্ছি। এই দিন রাত্রিকে যান্ত্রিক উপায়ে ২৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় এক দিন। এটাকে মিনিট, সেকেন্ডে ভাগ করা হয়েছে। কাজেই পৃথিবীর সময় দিয়ে কি বিশ্বের বয়স নির্ণয় করা যাবে?
স্টিফিন হকিংসের বিগ ব্যাং থিওরী যে একটি বোগাস মতবাদ, এর পর আর কোনো যুক্তির প্রয়োজন আছে। তার মতবাদ যদি বোগাস বলা হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি বিজ্ঞানী নন। তার এই মতবাদ ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো একদিন কোল্ডস্টোরেজে চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : দার্শনিক।

Tuesday, September 25, 2018

মানুষ গুজবে কান দেয় কেন? -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত



বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত শব্দটি হচ্ছে ‘গুজব’। সোস্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিনে ‘গুজব’ শব্দটি যতবার ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হয়েছে, তা আর কোনো শব্দের ক্ষেত্রে হয়েছে কি না সন্দেহ। বহুল প্রচারিত ‘গুজব’ শব্দটির ব্যবহার বাড়ে ৪ আগস্টের পর থেকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর জিগাতলা-সায়েন্সল্যাবে অবস্থানরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং তৎপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেদিন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সপ্তম দিনের মতো রাজপথে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেদিন দলীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা একযোগে হামলে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শিক্ষার্থীরা ফেসবুক লাইভে এসে তাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার বিবরণের পাশাপাশি এটিও বলে যে, তাদের চারজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং চারজন ছাত্রীকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আরো বহু ছাত্রকে আটকে রেখেছে তারা। ঘটনাস্থলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের অসংখ্য লাইভ ভিডিওতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের সহপাঠী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রচ- বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটিকে ‘গুজব’ বলে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। আর এর পরপরই সোস্যাল মিডিয়ায় ‘গুজব’ শব্দটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক শব্দে পরিণত হয়।

ইদানীং ছাত্রসমাজ ‘গুজব’ শব্দটিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে। সোস্যাল মিডিয়ায় একযোগে প্রচারণার ধরন এমনই যে, শিক্ষার্থীদের কেউ আহত ও রক্তাক্ত কিংবা চোখে ব্যান্ডেজ, গুলিবিদ্ধ অথবা সাংবাদিকদের ওপর হেলমেটধারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি হামলা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের ছবি অথবা একেকটি প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র পোস্ট করে তার ক্যাপশনে লিখেছেন- ‘গুজবে কান দেবেন না। তবে চোখ দিয়ে দেখুন।’
একজন ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা, চারজনকে হত্যা করা, চারজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা এবং আরো ছাত্রীকে আটকে রাখার যে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের ডেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের ভেতরের দৃশ্য দেখানো হয়। এ রকম দু’জন ছাত্রলীগ সমর্থক ছাত্রকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়- শিক্ষার্র্থীদের পক্ষ হতে যা বলা হচ্ছে তার সবই গুজব! সেদিনই রাতে এক প্রেসনোটে ডিএমপি থেকে জানানো হয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রচারিত ঘটনার কোনোটা ঘটেনি। এগুলো সবই গুজব। গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়। সেদিনই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে একটি মেসেজ দিয়ে সরকার জানায় এটি গুজব মাত্র। আমার মোবাইলেও সে রকম একটি মেসেজ পেয়েছি। এড়াঃ. রহভড় থেকে পাঠানো মেসেজে লেখা ছিল- ‘রাজধানীর জিগাতলায় ছাত্রহত্যা ও ছাত্রীধর্ষণের ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। এতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। পুলিশকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
যদিও আজ পর্যন্ত আসলে সত্যিকারার্থে সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক কী ঘটেছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি।
তথ্য জানার অধিকার একজন নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল এবং কোন ঘটনা থেকে গুজবের সূত্রপাত হয়েছে, কতজন আহত কিংবা কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী হসপিটালে ভর্তি, কোন পক্ষ কোন পক্ষকে আঘাত করেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছিলো। আর এই ঘটনার জন্য কোন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কিনা তা আজ পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাগরিকদের গুজবে কান না দেয়ার আহবান জানিয়ে মেসেজ দেয়া হয় সে ঘটনার প্রকৃত সত্য যদি জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় তাহলে নাগরিকরা গুজবে প্রভাবিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মূলধারার গণমাধ্যমকে যখন গলাটিপে ধরা হয় তখন গণমাধ্যমের বদলে সোস্যাল মিডিয়াকেই জনগণ খবর জানার মূল মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। তখন যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোন খবর প্রচার করে তখন তা সত্য না মিথ্যা, কে তার প্রমাণ দেবে? ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমের ওপর সরকার খড়গহস্ত হয়েছে তখনই সেখানে সোস্যাল মিডিয়া শক্তিশালী অবস্থানে চলে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন সকল টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ প্রচার করেছিল কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনোটে সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয় সকল টিভি চ্যানেলকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে বলে। সরকার সমর্থক চ্যানেল একাত্তর ও যমুনা টিভিকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়। ফলে সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলায় সেদিন কোনো চ্যানেলই তেমন লাইভ প্রচার করেনি। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তার ফলে বেসরকারি সকল টিভি চ্যানেল কেন যেন বিটিভির মতো আচরণ করতে শুরু করে। সেদিন একটি পোস্ট দেখে খুব হাসি পেয়েছিল। কোন একজন স্কুলছাত্র বিটিভির খবর পড়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিল- ‘দিনাজপুরে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে।’ এটি দিয়ে পোস্টকারী বুঝাতে চেয়েছেন হাজার হাজার স্কুলশিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এলেও বিটিভিতে সেই খবর স্থান পায়নি। এটি বিটিভির প্রতি জনগণের এক ধরনের অনাস্থা। যদিও সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বাংলাদেশে ৮০% মানুষ বিটিভি দেখে। সেদিন ধানমন্ডি জিগাতলায় যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ থাকতো সকল মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে খবর প্রচারের স্বাধীনতা দেয়া হতো, টিভি চ্যানেলগুলো যদি আগের মতো লাইভ টেলিকাস্ট করার সুযোগ পেত, তাহলে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব তা নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যেতো। মূলধারার গণমাধ্যমকে প্রেসনোট জারি করে এবং বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারই তো গুজব সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে।
গুজব মানুষের এক ধরনের বিশ্বাসের প্রতিফলন। মানুষ যা প্রতিনিয়ত দেখে এবং মানুষের অন্তরে যে বিষয় স্থির হয়ে গেছে, সে ধরনের ঘটনার খবর সামনে এলে- সেটা গুজব হোক বা সত্যি হোক, মানুষ তার বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সেটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, গুলিবর্ষণ ও ধর্ষণের খবর কেইবা বিশ্বাস করবে না- বলুন দেখি। দেশের নাগরিকদের সামনে তো এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছেই! ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং সেই লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য, বিশ্বজিৎকে দিন-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা, কুষ্টিয়ায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্লজ্জ হামলা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা- এসবতো সাধারণ নাগরিকদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নেতাদের ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য গুলির ভিডিও এখনো সোস্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে আছে। এরপরও ছাত্রলীগের হামলার খবর জনগণ কিসের ভিত্তিতে গুজব বলে মনে করবে? আর ধর্ষণের ঘটনা- সেটা তো আরো স্পর্শকাতর। কিন্তু যে ছাত্রসংগঠনের নেতা কাজী নাসির উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের রেকর্ড আছে, যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধর্ষণের খবর প্রতিদিন কোনো না কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- সেই সংগঠনের লোকজন কাউকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে- এমন গুজবে কান দেয়ার যৌক্তিক উপকরণতো ছাত্রলীগই তৈরি করে রেখেছে!
বাংলাদেশের মানুষ গুজবে কেন বিশ্বাস করছে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর যে কেউ একবাক্যে বলে দিতে পারবে- সেটা হলো, এদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশের মানুষ খবর পাওয়ার জন্য এখন আর টিভি চ্যানেল অন করে না। আর সে কারণেই মানুষ ঘটনা জানার জন্য সবার আগে সোস্যাল-মিডিয়ায় প্রবেশ করে এবং সত্যটা জানার চেষ্টা করে। একটা প্রেসনোট জারি করে কিংবা নাগরিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে গুজবে কান দেয়া থেকে জনগণকে বিরত রাখা আদৌ সম্ভব কি না- বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করুন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করুন- দেখবেন, কোনটা ‘গুজব’ আর কোনটা ধ্রুব সত্য। তা যদি না হয় তাহলে এইসব চাতুর্যপূর্ণ প্রেসনোটই বরং হয়ে উঠবে অতীব নির্মম একেকটি গুজব।
লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, September 21, 2018

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা


ভিডিওটি দেখুন, প্রচার করুন। টার্কিশ ভাষাকে মনে হবে বাংলা শুনছেন!
এরদোগান নিজামী শাহাদাতের সময় প্রোগ্রামে শহীদ নিজামীর কথা বলছেন। আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে যেমন বলেছেন তেমনি বলেছেন একদম নিজেদের ঘরোয়া সমাবেশে। এটি তাদের একান্তই নিজেদের একটি সমাবেশ। সেখানে তিনি বলেন-
"বাংলাদেশের ঘটনা শুনেছেন..? মতিউর রহমান নিজামী, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ওখানে আমাদের ঈঐচ (ধর্মনিরপে- প্রধান বিরোধী দল) এর মত এক রাজনৈতিক দল আছে। যার প্রধান এক মহিলা মতিউর রহমান নিজামীর ফাসিঁ দিয়েছে।
যার বয়স ৭৩, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে ফাসিঁ দেওয়া হয়েছে। যিনি একজন বিজ্ঞ মানুষ, আলেম ও সাবেক মন্ত্রী....
কী বলতে চাই জানেন..? বেশী কিছু বলতে চাইনা..! শুধু এতটুকুই বলব, জালিমদের জায়গা জাহান্নাম।
কিন্তু এই অন্যায়ের কেউ কী প্রতিবাদ করেছে..? না, করেনী..। গণতন্ত্রকামীরা কী আওয়াজ করেছে..? না, করেনী..। কিন্তু অন্য ধর্মের হলে পশ্চিমাতে এটা নিয়ে কেয়ামত ঘটে যেত। উনি শুধু মুসলমান ও মুসলিম নেতা হওয়ার কারনেই সবাই চুপ.... "
সর্বশেষ বলেছেন.... সকল জুলুমেরই একটা শেষ আছে, সকল খারাপের পরই একটা বসন্ত আসে.... এবং সেই দিন আসবেই ইনশাআল্লাহ....
উনি সর্বশেষ তুরস্কের কিছু কথা বলে একটি হাদীস উল্লেখ করেন, "মান সাবারা..... জাফারা" যে ধৈর্য্য ধরে সে বিজয়ী হয়।

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা,
প্রেসিডেন্ট এরদোগান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান

Thursday, September 20, 2018

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে স্বরণীয় একটি বিকেল! - শিবির নেতা হাফিজুর রহমান


এরদোয়ান : দ্যা চেঞ্জ মেকার লিখতে গিয়ে বেশ কয়েকবারই একে পার্টির হেড কোযার্টারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে কিংবা প্রয়োজন হয়েছে। নয় তলা বিশিষ্ট এই কার্যালয়ের নবম তলায় দলীয় চেয়ারম্যানের অফিস। নিচ থেকে উপরে উঠতে চারটি লিফট রয়েছে, যেগুলো আটতলা পর্যন্ত যায়। স্বভাবতই নয় তলায় উঠতে আলাদা সিড়ি/লিফট ব্যবহার করতে হয় এবং দরকার হয় স্পেশাল এপয়েন্টমেন্টের। বই লিখতে গিয়ে আটতলা পর্যন্তই উঠেছি। আটতলায় দলের সাংগঠনিক সভাপতি এবং সেক্রেটারী জেনারেলের অফিস। সাংগঠনিক সভাপতির সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম গত বইতে। সবমিলে নয়তলা নিয়ে রহস্যের কোন শেষ ছিলনা!!
সেদিন ছিল প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রধান উপদেষ্টার সাথে এপয়েন্টমেন্ট, উনাকে বই উপহার দেওয়ার জন্য। প্রধান উপদেষ্টার অফিসটি দলীয় চেয়ারম্যানের রুমের পাশেই। উনি আবার একজন একাডেমিশিয়ান এবং ইসলামী আন্দোলনগুলো উনার গবেষণার অন্যতম বিষয়। তাই উনার সাথে একাডেমিক কিছু আলোচনাও জমে ছিল। আমরা উনার সাথে দেখা করে বই তুলে দেওয়ার পর গল্প করছি এবং তুর্কি চায়ে চুমুক দিচ্ছি।
হঠাৎ প্রেসিডেন্ট উনাকে ডাকলেন। উনি দেখা করে ফিরে আসার পর আবারো আড্ডা শুরু হলো। বিদায় নিতে যাবো এমন সময় আবারো প্রেসিডেন্ট উনাকে ডাকলেন। এবার আমরা একটু সুযোগ নিতে চাইলাম। যদিও প্রথমে বলতে কিছুটা ইত:স্তত বোধ করছিলাম তারপরও বলেই ফেললাম, আমরা কি একটু সালাম দেওয়ার সুযোগ পাবো?
বলার পর নিজের কাছে আরো লজ্জিত হলাম। কারণ কোন প্রস্তুতি এমনকি চিন্তাও ছিলনা। ড্রেসআপও অফিসিয়াল না। উনি বললেন: "দেখি, উনাকে বলবো তোমাদের কথা। যদিও সিডিউল খুব ব্যস্ত।"
উনি গিয়ে আর ফিরছেন না। আমাদের আরেকটি এপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাই উনার পিএসকে (প্রধান উপদেষ্টার) বলে বের হয়ে গেলাম। ষষ্ট তলায় আসার পর পিএস ফোন দিলো, আপনাদের ডাকছে। দৌড়িয়ে গেলাম, প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্টের দরজায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
উনি আমাদের নিয়ে উনার রুমে নিয়ে গেলেন। প্রেসিডেন্ট দরজার কাছে এসে আমাদের স্বাগতম জানালেন। তুরস্কের সংস্কৃতিতে স্বাগতম জানানো ও বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত আসার এই বিষয়টি আমাকে খুব অবাক করে। আপনি যেই হোন না কেন, আপনার পজিশন যাই হোক না কেন... তাদের মেহমান হিসেবে গেলে তারা আপনাকে দরজায় এসে স্বাগতম জানাবে এবং বিদায় দিবে।
আমরা সালাম দিলাম, প্রেসিডেন্টের হাতে চুমু খেতে গেলাম। উল্লেখ্য, তুরস্কে বয়োজেষ্ট ও সম্মানিত ব্যক্তিদের হাতে চুমু খাওয়া হয়। উনি হাত সরিয়ে নিলেন এবং আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেলেন।
আমি পরিচয় দিলাম; হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশী, গাজী ইউনির্ভিসিটিতে পিএইচডি করছি আর আপনার জীবনী গ্রন্থের লেখক।
উনি হেসে বললেন: Yes, I Know (আমার মনে পড়েছে/ আমি জানি)।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাধারণত ইংরেজী খুবই কমই বলেন। উনার মুখ থেকে ইংরেজী শুনে বেশ অবাকই হলাম।
এরপর আমাদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। পরিবারে কে কে আছে, কোথায় থাকি, ওয়াইফ কি করে, বাচ্চা কয়জন, কতবড় হইছে, একাডেমিক কি অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাচ্চা একটা শুনেই বললেন; "নো নো, হবে না। কমপক্ষে পাঁচটা নিতে হতে হবে।" আমি হেসে ইনশাআল্লাহ বললাম। উনি খুব সিরিয়াসভাবে বললেন: "শুধু ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বললেই হবে না। পদক্ষেপ নিতে হবে"। এভাবে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন। উল্লেখ্য, আমাদের সাথে আরো কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক ছাত্ররা ছিল। অবশেষে কিছুক্ষণ খোসগল্প করে বিদায় নেওয়ার পালা। উনি সবাইকে আবারো বুকে জড়িয়ে আদর করে বিদায় দিলেন।
সত্যিই স্বরণীয় মুহুর্তু। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!! মাশাআল্লাহ। উনার মুখ থেকে বইয়ের ব্যাপারে "Yes I know" বাক্যটি আমার চিরকাল মনে থাকবে এবং আজীবন লেখালেখীর উৎসাহ হবে।
শেষ করছি লেখালেখি নিয়ে দুটি ঘোষণার মাধ্যমে;
১. আলহামদুলিল্লাহ, আমার দ্বিতীয় বই "আমার দেখা তুরস্ক (বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন শক্তি তুর্কি জাতির ভেতর-বাহির)" বইমেলাতে আসছে ইনশাআল্লাহ। (পরবর্তী পোস্টে বইয়ের আলোচ্যসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবো)।
২. এরদোয়ান : দ্যা চেঞ্জ মেকার বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ বই মেলায় আসবে। লেখার পর প্রথমবারের মতো বর্ধিতরুপে আসছে এই সংস্করণটি। যাতে ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ সমসাময়িক তুরস্কের আলোচিত কয়েকটি ঘটনা যোগ হবে।

Thursday, September 13, 2018

ইসলামী আন্দোলনে কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা এবং তার পরিণতি

- মুহা: আল আমিন ওমর
ইসলামী আন্দোলন
সাধারনত আন্দোলন বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে নড়া-চড়া করা, দোল খাওয়া বা অবস্থান পরিবর্তন করা ইত্যাদি। এ শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে আল-হারকাত এবং ইংরেজিতে এর প্রতিশব্দ হচ্ছে গড়াবসবহঃ। আল কুরআনের নিজস্ব পরিভাষায় এ শব্দটি হচ্ছে আল-জিহাদু ফি সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর জমিনে তার দীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইসলাম বিরোধী সকল প্রকার প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে নিজের জান, মাল, বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং শক্তি সামর্থ্য উৎসর্গ করে সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত সংগ্রাম করার নামই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলন।

ইসলামী আন্দোলন ঈমানের অপরিহার্য দাবি
মহান আল্লাহ আল কুরআনের সূরা আস-সফের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে ঈমানদারদের লক্ষ্য করে বলেন, “হে ঈমানদারগ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসার কথা বলব না, যা তোমাদেরকে (আখিরাতের) ভয়াবহ শাস্তি থেকে রেহাই দিতে পারে? আর তা হচ্ছে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের জান-মাল কুরবান করে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে পার।”
সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন, “তোমরা কি মনে করেছো যে, এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে? অথচ আল্লাহ কি দেখে নিবেন না কে আল্লাহর দীন বিজয়ের জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করেছে?”
রাসূলে কারীম (সা) ইসলামী আন্দোলনের কাজকে সর্বোত্তম কাজ হিসেবে অবিহিত করেছেন। হযরত আবু যার গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, কোন্ কাজটি সবচেয়ে উত্তম? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর পথে জিহাদ করা। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম]
হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হল, সর্বোত্তম আমল কোন্টি? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনা। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা), তারপর কোন্টি সর্বোত্তম আমল? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা), তারপর কোন্টি সর্বোত্তম (কাজ) আমল? তিনি বললেন, মকবুল হজ বা গৃহীত হজ। [সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড]

ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার
পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম মানব হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান সিপাহসালার। আর এ সমস্ত নবী-রাসূলদের পাশাপাশি যাঁরা তাঁদের তাওহীদের সুমহান দাওয়াত কবুল করেছিলেন তাঁরাও এ আন্দোলনের অন্যতম শরিকদার। তাওরাত, যাবুর, ইনজিল এবং সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কুরআনে যার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা আল কুরআনের সূরা আন-নাহলের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলেন, “প্রত্যেক জাতির কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি। যিনি এই বলে তাদের আহব্বান জানিয়েছিলেন- তোমরা আল্লাহর বন্দেগী কর এবং তাগুতের আনুগত্য পরিহার কর। এরপর তাদের মধ্য হতে কাউকে হেদায়াত দান করা হয়েছে আর কারোর ওপর গোমরাহী চেপে বসেছে। সুতরাং তোমরা জমিনে পরিভ্রমণ কর আর দেখ মিথ্যাবাদীদের পরিণাম কী হয়েছিল।”
সূরা মায়িদার ৫৭ নম্ব আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন, “হে রাসূল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা (মানুষের কাছে) পৌঁছে দিন। আর যদি তা না করেন, তবে তো আপনি তাঁর পয়গামের কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের সৎপথে পরিচালিত করেন না।”
যেহেতু, সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী মুহাম্মদ (সা)-এর ওফাতের পর কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না, সেহেতু যারা প্রকৃত মুমিন তারাই কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অদ্যাবধি লড়াই করে আসছেন এবং এ লড়াই কিয়ামত সংঘঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলতেই থাকবে ইনশাআল্লাহ।

ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয়তার ফলাফল
ইসলামী আন্দোলনে সর্বসময়ে সক্রিয় থাকা আন্দোলনের কর্মীদের একটি প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্য। বিপদ মুসিবত যত বড়ই হোক না কেন তাদের থাকতে হবে দৃঢ় ঈমান, অনঢ় ও অটল মনোবল।
এক্ষেত্রে রাসূল (সা) ও সাহাবায়ে কেরামগণসহ যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহৎ ব্যক্তিরাই হচ্ছেন আমাদের প্রধান মাইল ফলক। ইসলামবিরোধী শক্তির নির্যাতন নিপীড়নে তারা ছিলেন সীসাঢালা প্রচীরের ন্যায় অবিচল। নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা যতই বেড়েছে তাদের ঈমান ততোই বৃদ্ধি পেয়েছে। নিস্ক্রিয়তার লেশ মাত্র তাদের আঁচ করতে পারেনি। প্রয়োজনে তারা দেশান্তরিত হয়েছেন কিন্তু তাগুতি শক্তির কাছে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। বিপদ-মুসিবতে সর্বসময়ে যারা ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন বলে কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
আল কুরআনে সূরা আস-সফের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “আল্লাহ তা’য়ালা ঐ সমস্ত লোকদের ভালোবাসেন যারা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে।”
সূরা বাকারার ২১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা কি মনে করে নিয়েছ যে, তোমরা অতি সহজেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখন পর্যন্ত তোমাদের ওপর তোমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় বিপদ-আপদ অবতীর্ণ হয়নি। তাঁদের ওপর বহু কষ্ট ও কঠোরতা এবং কঠিন বিপদ মুসিবত অবতীর্ণ হয়েছিল। এমনকি তাঁদেরকে অত্যাচার নির্যাতনে জর্জরিত করে দেয়া হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত তদানীন্তন রাসূল এবং তাঁর সঙ্গীগণ আর্তনাদ করে বলেছিলেন, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? তখন তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছিল, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।”
রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল করীম (সা) বলেছেন, আল্লাহর পথে একটা সকাল ও একটা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া ও এর সমস্ত সম্পদ থেকে উত্তম।” [সহীহ বুখারী]
হযরত মু’য়াজ ইবনে জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন, যে মুসলিম ব্যক্তি উটের দুধ দোহনের সম-পরিমাণ সময় আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়। (তিরমিযী)

ইসলামী আন্দোলনে যারা নিস্ক্রিয়
সুযোগবাদী স্বার্থান্বেষী ও মুনাফিকরাই ইসলামী আন্দোলনে এসে নিস্ক্রিয় থাকে। সুযোগ বুঝে এ আন্দোলন থেকে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে এবং অনেক সময়ে এ আন্দোলনের ক্ষতি করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। বিশ্বনবী (সা)-এর সময়ে আব্দুল্লাহ বিন উবাইসহ কিছু সুযোগবাদী, স্বার্থান্বেষী মুনাফিক ছিল, লোক দেখানো এবং স্বার্থ হাসিল করার জন্যই তারা মূলত এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।
এইসব মুনাফিকদের সম্পর্কে সূরা নিসার ১৪২-১৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোকাবাজি করেছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাদেরকে ধোকার প্রতিফলন প্রদান করবেন। তারা যখন নামাজের জন্য দাঁড়ায় তখন অনিচ্ছা ও শৈথিল্য সহকারে শুধু লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে। তারা কুফরি ও ঈমানের মাঝখানে দোদুল্যমান হয়ে রয়েছে, না পূর্ণভাবে এদিকে না পূর্ণভাবে ওদিকে। বস্তুত আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার মুক্তির জন্য আপনি কোনো পথ পাবেন না।”

ইসলামী আন্দোলনে নিস্ক্রয়তার পরিণতি
যেহেতু নামাজ-রোজার মত ইসলামী আন্দোলনও ফরজ, সেহেতু মুমিন জীবনে ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অসীম। এ আন্দোলনে যারা নিস্ক্রিয় থাকে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা সূরা বাকারার ২১৭-২১৮ নম্বর আয়াতে বলেন, “তোমদের মধ্যে যারা নিজেদের দীন থেকে এড়িয়ে চলবে এবং অস্বীকারকারী (কাফির) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। এ সমস্ত লোকেরাই হবে জাহান্নামী, এতে তারা চিরকাল থাকবে। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে ও আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে, তারাই তো মহান রবের রহমতের প্রত্যাশী, যিনি ক্ষমাকারী ও পরম করুণাময়।”
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১৩৭-১৩৮ নম্বর আয়াতে আরো বলেন, “যারা একবার পরিপূর্ণ মুসলমান হয়ে পুনরায় কুফরির পথ অবলম্বন করে এবং দিন দিন এ কুফরিতেই তারা উন্নতি লাভ করে আল্লাহ এ সমস্ত লোকদেরকে ক্ষমা করবেন না এবং পথও দেখাবেন না। আর যারা প্রতারনা করে তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দিন যে তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ বেদনাদায়ক আজাব এবং যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারীদের পরিত্যাগ করে যারা কুফরি করে তাদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয়। আর তাদের কাছেই সম্মান প্রত্যাশা করে অথচ যাবতীয় সম্মান তো শুধু আল্লাহরই জন্য।”
আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ৩৮-৩৯ নম্বর আয়াত আরো বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো? যখন তোমাদেরকে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে বলা হয়, তখন তোমরা বিভিন্ন ধরনের বাহানাবাজি তালাশ করার মাধ্যমে (আমাদের দ্বারা সম্ভব নয় বলে) জমিনকে আকড়ে ধরো। তাহলে তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনেই সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের বিভিন্ন উপকরণ তো খুবই নগন্য। যদি তোমরা (আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজে) বের না হও তাহলে তিনি তোমাদেরকে বেদনাদায়ক কঠিন আজাব দিবেন। আর তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।”
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, হযরত হারেসুল আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিচ্ছি যেগুলো আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেনÑ ১. সংঘবদ্ধ হবে; ২. নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে; ৩. তার আদেশ মেনে চলবে; ৪. হিজরত করবে অথবা আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে; ৫. আর আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাবে।
আর যে ব্যক্তি (আল্লাহর দ্বীন কায়েমের) সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘৎ পরিমাণ দূরে সরে গেল সে যেন ইসলামের রশি তার গলা থেকে খুলে ফেলল, যতক্ষণ না সে (আল্লাহর দীন কায়েমের) সংগঠনে ফিরে আসে।
আর যে ব্যক্তি লোকদেরকে জাহেলিয়াতের দিকে আহ্Ÿান করে নিশ্চয়ই সে জাহান্নামী, যদিও সে রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে। (তিরমিযী)

নিস্ক্রিয় থাকা মুমিনের কাম্য নয়
যেহেতু (১) দাওয়াত ইলাল্লাহ, (২) শাহাদাতে আ’লান্নাস, (৩) কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ, (৪) ইক্বামতে দীন, (৫) আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আ’নিল মুনকার- এই পাঁচটি কাজের  সমন্বয়ের নামই ইসলামী আন্দোলন। সেহেতু আল্লাহ তা’য়ালার প্রকৃত কোনো মুমিন এই পাঁচটি কাজের কোনো একটি কাজ থেকে নিজেকে গাফিল রাখতে চায় না।
সূরা হজের ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর (প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাও) যেমন জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে নিজের কাজের জন্যই বাছাই করে রেখেছেন। আর দীনের ব্যাপারে কোনো সঙ্কীর্ণতা চাপিয়ে দেননি। আর তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।”
সূরা নিসার ৭৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করবে না, অথচ অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এ জনপদের জালিম অধিবাসীদের নিকট হতে বের করে নাও। আর আমাদের জন্য তোমার নিকট হতে একজন পৃষ্ঠপোষক অধিপতি নিয়োগ কর এবং তোমার নিকট হতে একজন সাহায্যকারী পাঠাও।”

তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ড. রাশিদ ঘানুসি (প্রথম পর্ব )-ইউনুছ আব্দুদ্দাইয়ান


তিউনিশিয়া উত্তর আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত ছোট একটি দেশ। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে জনসংখ্যা মাত্র ১১,৩৮৪,৯০৬। এর মধ্যে প্রায় ৯৮% আরব বংশোদ্ভূত মুসলিম এবং বাকি ২% খ্রিস্টান, ইয়াহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি এবং রাজধানী তিউনিশ। দেশটির আয়তন হচ্ছে ১৬৪ হাজার বর্গ-কিলোমিটার। আলজেরিয়া ও লিবিয়া ভৌগোলিকভাবে নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আর সমুদ্রের উপকূলজুড়ে অপর দিকসমূহে রয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, তুরস্ক, সিরিয়া ও মিশর। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে (২৭ হিজরিতে) ওকবা বিন নাফে উত্তর আফ্রিকা বিজয় করেন। তিনি ইতিহাসে আফ্রিকা বিজেতা হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। উমাইয়া শাসনামলে বাইজান্টাইন সাম্রজ্যের সাথে যুদ্ধে মুসলমানেরা বিজয়ী হয়। সেই সময় তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিশের গ্রিক নাম ছিলো কার্থেজ। ১৫৩৪ সালে উসমানীয় খিলাফতের অধীনে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর স্পেনের অধীনে চলে যায় এবং ১৫৭৪ সালে স্পেন থেকে আবার উসমানীয় খিলাফতের অধীনে আসে। ১৮৮১ সালের ১২ মে ফ্রান্সের কলোনিভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রায় তিনশত বছরের উসমানি খিলাফতের অবসান ঘটে ।

১৯৩৮ সাল থেকে তিউনিশিয়াতে ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে চলে। ফ্রান্স সরকার উক্ত আন্দোলন দমন করার জন্য অনেককে গ্রেফতার করে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪০ সালে শেষ নাগাদ জার্মানির কাছে ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করলে তিউনিশিয়ার জনগণ খুশি হয়। জনগণের চাপে তিউনিশিয়ার সরকার জার্মানিকে তারা নতুন বন্ধু হিসেবে বরণ করে এবং জার্মান নিয়ন্ত্রিত ফ্রান্স সরকার তিউনিশিয়ান বন্দী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেন। কিন্তু ফ্রান্স আবার জার্মানি থেকে মুক্ত হলে তিউনিশিয়ার নেতৃত্বকে তার খেসারত দিতে হয়। জার্মানির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য অনেককে সামরিক আদালতে বিচার করে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলন থেমে যায়নি বরং দিন দিন জোরালো হয়। এক পর্যায়ে গেরিলা আন্দোলন শুরু হয় এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। এমতাবস্থায় দুই বছর ফ্রান্সের সাথে তিউনিশিয়ার ‘নিউ কনস্টিটিউশন পার্টির’ আলাপ আলোচনার পর ১৯৫৬ সালের ২০ মার্চ তিউনিশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে হাবিব বর্গুইবা ক্ষমতাসীন হন। ইতঃপূর্বে তিনি প্রায় বিশ বছর ফ্রান্সের কারাগারে বন্দী ছিলেন। প্রথম পর্যায়ে তার দল স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। তিনি সুদীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপরিচালনায় অযোগ্য হিসাবে মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। কোন কোন পর্যবেক্ষকের মতে এটা ছিল মেডিক্যাল ক্যু (the medical coup detal)। তারপর জেনারেল জয়নাল আবদিন বেনআলি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনে কথিত ৯০% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।

বেনআলি শুরুতে কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের প্রয়াস চালান। ১৯৮৬ সালে বুর্গুবিয়ার সময় ১২০১ ইউএস ডলার বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল আর তা ২০০৮ সালে বেনআলির সময় ৩৭৮৬ ইউএস ডলারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশে দুর্নীতি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায় । বেকারত্ব অনেক বেড়ে যায়। মানবাধিকার চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও তার বিদেশনীতি ছিলো পাশ্চাত্যের ঘেঁষা। আরব বসন্ত (Arab Spring) এর সূচনা হয় ২০১০ সালের শেষ দিকে; তিউনিশিয়ায় তদানীন্তন স্বৈরশাসক জয়নাল আবদিন বেনআলির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি সরকার সংসদ ভেঙে দিয়ে ছয় মাসের ভেতর নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয় এবং স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট বেনআলি দেশত্যাগ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যায়। আরব বসন্তের পর ২৩ অক্টোবর ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ৩৭.৪৭% ভোট পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং জাতীয় সংসদের ২১৭ আসনের মধ্যে ৮৯ আসন পায়। কিন্তু ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ২৭.৭৯% ভোট পেয়ে ৬৯ আসন পায়। ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিস দল ২১৭ আসনের মধ্যে ৮৬ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। Popular Front১৬ আসন, Free Patriotic Union ১৬ আসন ও Prospects for Tunisia ৮ আসন পায়। আননাহদা পরাজয়কে স্বীকার করে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু পরবর্তীতে নিদা তিউনিসে দলে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের আসনসংখ্যা ৫৮। আননাহদা ৬৯ আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নিদায়ে তিউনিসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিবর্তে মাইনর পার্টনার হিসাবে কোয়ালিশন সরকারে রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার রক্ষার জন্যই তারা এই কৌশল নিয়েছে।

তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেঁনেসা আন্দোলন
তিউনিশিয়াতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। শাইখ সালেম বুহাযেব, ওযির খাইরুদ্দিন পাশা, ঐতিহাসিক আহমদ বিন আবু দিয়াফ, মুহাম্মদ বৈরাম আল খামেস, মুহাম্ সানৌসি, সালেহ শরীফ, শাইখ আবদুল আযিয সালাবি প্রমুখ উক্ত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। উক্ত সংস্কার আন্দোলন কখনও শক্তিশালী ছিল আর কখনও দুর্বল ছিল। তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া ও লিবিয়াতে ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলনে সানৌসি আন্দোলনের বিরাট ভূমিকা ছিল। শাইখ মুহাম্মদ আল সানৌসির (১৭৮৭-১৮৫৯) ইন্তেকালের পর তার ছেলে সাইয়েদ মুহাম্মদ আলমাহদি আসসানৌসি (১৮৫৯-১৯০২) উক্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্বের সময় থেকে আলহাজ সাঈদ বিন আবদুল লতিফের নেতৃত্বে তিউনিশিয়াতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯১৯ প্যারিসে সন্ধি চুক্তি হয়। আবদুল আযিয সালাবি ১৯২০ সালে তিউনিশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে সভা-সমাবেশ শুরু করেন এবং হিযব আলদসতুরি নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মতে আরব ও মুসলিম দেশসমূহের সংবিধানের মূল উৎস হওয়া উচিত ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। তিনি ধর্ম ও রাজনীতি পৃথক করে দেখতেন না। তাঁর দৃষ্টিতে দ্বীন এসেছে মানুষের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদির সংস্কার সাধন ও দ্বীনের আলোকে মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা হলেও আল্লামা রশিদ রেদার চিন্তাধারায় প্রভাবান্বিত সমাজ সংস্কারক ছিলেন। যার কারণে তাঁকে ফ্রান্স সরকার আরও কয়েকজন সাংবাদিক ও চিন্তাবিদসহ কারারুদ্ধ করে। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৪৭ সালে হজ পালন করেন এবং তারপর মিশর যান। মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আম ইমাম হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাৎ করেন। হাসানুল বান্না তিউনিশিয়াসহ আরব বিশ্বের সমস্যা সমাধানে তাঁর চিন্তাধারা ব্যক্ত করেন।

১৯৫৪ সালে তিউনিশিয়া স্বায়ত্তশাসন এবং ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই সময় তিউনিশিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাঈয়েদ বাহের বিন আম্মার। স্বাধীনতা লাভের পর হাবিব বর্গুইবা রাষ্ট্রপতি হন। ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভের পর অতীতের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার জন্য তিউনিশিয়ার তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান। বর্গুইবা স্বাধীন তিউনিশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হলেও চিন্তা-ভাবনায় ছিলেন সেক্যুলার ও পাশ্চাত্যের আস্থাভাজন। দেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করা হলেও বুর্গুবিয়া শরিয়াহ আইন ও ইসলামী শিক্ষা বিলুপ্ত করেন। এই প্রসঙ্গে ড. আযযাম তামিমি তাঁর গ্রন্থে বলেন :

Although the constitution stated clearly that Islam was the religion of the state, Bourguiba launched his era with a series of reforms that were aimed at eliminating Islamic symbols, restricting religious practice, and replacing what had remained of Islamic laws. The first measure was the standardization of the court system, which meant the effective abrogation of Shari’ah courts. This was achieved by means of a presidential decree issued on 25 September 1956. The abolition of the traditional court system was followed on 1 January 1957 by the publication of Majallat alAhuial ash-Shakhsiyah (personal status code), which effectively and immediately did away with all Shari’ah-based family laws, including legislation pertaining to marriage, divorce, and inheritance. In 1961, the president issued a decree removing religious education from the curricula of az-Zaytouna.
তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা হয় তিউনিশিয়ার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। বর্গুইবা ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারীদের প্রতি রোজা না রাখার নির্দেশ দেয় এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করে ‘রোযা উৎপাদন কমায়’। তালাক ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৭ বছর নির্ধারণ করে মুসলিম-অমুসলিম বিবাহ বৈধ ঘোষণা করা হয়। হজ ও কুরবানির কারণে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয় বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেয়া হয়। যেসব আলেম প্রেসিডেন্ট এর কথা অন্ধভাবে মেনে নেন তাদেরকে সরকারি চাকরি দেয়া হতো। সমাজ থেকে ধর্মের নাম নিশানা মুছে ফেলার জন্য তিনি সকল ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যাতুন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে আরবি ভাষার পরিবর্তে ফ্রেন্স ভাষা চর্চা চালু করেন। পরিবার ও পারিবারিক জীবন নিয়ে কুরআনের শিক্ষা পরিবর্তন করে ফ্রান্সের অনুসরণ করা শুরু করেন। ইসলাম নিয়ে প্রকাশ্যে কটাক্ষ করা সরকারের মন্ত্রীদের অভ্যাসে পরিণত হয়। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৯৬১ সালে শাইখ আবদুর রহমান খালিফের নেতৃত্বে প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকার তাঁকেসহ অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করে। তারপর থেকে তিউনিশিয়ায় ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন অব্যাহত থাকে।


তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ
ড: রাশিদ ঘানুসি বর্তমান বিশ্বের সুপরিচিত একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও নেতা। তিনি শহীদ হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব ও সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত হলেও মডারেট ইসলামিস্ট বলে পরিচিত। ২০১২ সালে টাইমের সার্ভে অনুসারে তিনি বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন। তিউনিশিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালনের জন্য Chatham House Prize২০১২ লাভ করেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সমর্থক এবং ডায়ালগ উইথ দা ওয়েস্ট এর প্রবক্তা। তাঁর লেখার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে Islam and modernity, democracy and secularism, relations between East nd West, Human rights and Civil Society.

ঘানুসি দক্ষিণ তিউনিশিয়ার ক্বাবীস প্রদেশে ১৯৪১ সালের ২২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মুহাম্মদ হাফেজে কুরআন ছিলেন। তিনি দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। ঘানুসির মা ছিলেন তাঁর পিতার চতুর্থ স্ত্রী। তাঁর পিতার প্রথম স্ত্রী ঘানুসিকে খুব মায়া করতো। আর অপর দুই স্ত্রীর একজন তাঁর জন্মের আগেই মারা যান এবং আরেকজনকে তাঁর পিতা আগেই তালাক দেন।

ঘানুসির পিতা গ্রামের হাতেগোনা অল্প কয়েকজন শিক্ষিতদের অন্যতম ছিলেন। তিনি খুব বেশি ধনী ছিলেন না আবার একেবারে দরিদ্রও ছিলেন না। ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। গ্রামে ফকিরদের নামে পশু যবেহ করা, মিলাদ পড়াসহ যেসব বিদআতের প্রচলন ছিলো তিনি তা পালন করতেন না। প্রত্যেক রমযান মাসে গ্রামের লোকজন তাঁদের বাড়িতেই তারাবিহর নামায আদায় করতেন। তিনি প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন কিন্তু লোকসান দিয়ে ব্যবসা পরিত্যাগ করে কৃষিকাজ শুরু করেন। তাঁর অন্য ভাইয়েরাও তাঁর সাথে কৃষিকাজ করতো। তাঁরা সকলে খুব ভোরবেলা বের হয়ে পড়তেন আর বিকেলে বাড়িতে ফিরতেন। শীতকালে মধ্যরাত পর্যন্ত চায়ের বাগানে সকলেই কাজ করতেন।
ঘানুসির চাচা বাশির মিশরের জামাল আবদুন নাসেরের ভক্ত হিসাবে আরব জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা এক সাথে রেডিওতে নাসেরের বক্তব্য শুনতেন; তাঁর চাচা রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরতেন। তিনি বুর্গুবিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্টের সদস্য হিসাবে তিউনিশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনেও ভূমিকা রাখেন। উক্ত আন্দোলনে বাশির গ্রেফতার হলে ঘানুসির মা চোখের পানি ফেলে কান্না করেন; পাঁচ বছর বয়সী ঘানুসি তা প্রত্যক্ষ করেন। বাশিরের মুক্তির পর গ্রামবাসী তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়। ঘানুসিও তার চাচার প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিউনিশিয়ার স্বাধীনতার আগে বুর্গুবিয়া হামমা গ্রামে সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য আসেন এবং তার চাচা তাঁদের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে ঘানুসি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেন। কিছুদিন পর স্বাধীনতাকামী গেরিলাদের সাথে ফ্রান্স আর্মির এক যুদ্ধ হয়। ফ্রান্স আর্মি চারজনকে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে রাখে এবং পাহারা দিয়ে রাখে যাতে কেউ তাদেরকে দাফন করতে না পারে। কিশোর ঘানুসি স্কুল থেকে ফেরার পথে তা প্রত্যক্ষ করেন। সেই সময় ঘানুসি ১৯৪৮ সালে ইয়াহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক নারী, শিশুসহ ২৫০ জন ফিলিস্তিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করার বিবরণ সংবলিত একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
তেরো বছর বয়সে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করার পর ঘানুসি তাঁর পিতার সাথে মাঠে কাজ করতেন। কিন্তু ঘানুসির মাতা সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্য মরিয়া ছিলেন। ঘানুসির বয়স যখন ১৬ বছর তখন তাঁর পিতা অন্য আত্মীয়দের ওপর কৃষি জমির দেখশুনার দায়িত্ব দিয়ে পরিবারসহ ক্বাবীস শহরে চলে যান এবং সেখানে ঘানুসিকে যাইতুন স্কুলে ভর্তি করান। এতদিন ঘানুসি ট্র্যাডিশনাল গ্রামীণ পরিবেশে বড় হন; ক্বাবীস আসার পর নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হন। এই সময় তিনি Leo Tolstoy (1828- 1910), author of War and Peace, Maxim Gorky (1868-1936), author of Mother, and Fyodor Dostoyevsky (1821-1881), author of Crime and Punishment প্রমুখের নোবেল ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। এছাড়াও তিনি Irish writer Bernard Shaw (1856-1950), French author Victor Hugo (1802- 1885), Ges American novelist Ernest Hemingway (1899-1961) বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। আরব উপন্যাসিক Najib Mahfuz, Yusuf as-Sibaei, Muhammad Abdelhalim Abdullah, and Colin Suhail সাহিত্য দ্বারাও প্রভাবিত হন।
গ্রাম থেকে শহরে আসার পর ঘানুসির ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার অভ্যাস কমতে থাকে। নামায আদায় করা কষ্টকর মনে হতে থাকে। হাইস্কুলে পড়াশুনা শেষ হতেই কুরআনের হিফজ অনেকাংশ ভুলে যান এবং নামায বলতে গেলে ছেড়ে দেন। সে সময় তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক ভাবতে শুরু করেন। মূলত এসব কিছুই ছিল শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব। নামাযের সময় ৩-৪ জন ছাত্র ছাড়া প্রায় সকল শিক্ষার্থী ধূমপান করতো বা গল্প করতো। পাশ্চাত্যের ধারার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তামিমি বলেন :
French-medium teaching curricula in modern schools were designed to produce Western-minded individuals whose conception of the world, of civilization, and of history emanated from Western culture and not from their own. At the same time, azZaytouna curriculum failed, in spite of its supposedly Islamic foundation, to provide students with knowledge in a genuine, albeit modern, Islamic framework. Consequently, an az-Zaytouna graduate would be torn between an extremely backward culture on the one hand and a modern, but alien, culture on the other. He would be torn between a Westernized life he had no option but to be part of and an inadequate Arabic-teaching medium that had very little relevance to what went on outside the school walls
১৯৫৯ সালে তিনি রাজধানীর আযযাইতুনিয়ায় ভর্তি হন। ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ হিসাবে বাদশাহ হাসান বিন নোমান এটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে মসজিদ এর পাশাপাশি স্কুল হিসাবে একই সাথে পাঠদান চলে। আর তেরোশত শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। আঠারশত শতাব্দীতে শুধুমাত্র ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদি পড়ানো হতো। কিন্তু তিউনিশিয়া ফ্রান্সের কলোনি রাজ্যে (১৮৮১-১৯৫৬) পরিণত হলে যাইতুনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় অত্র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ধরে রাখার প্রতি অবজ্ঞা করা হয় এবং শিক্ষানীতি সেক্যুলারাইজ করা হয়। শাইখ মুহাম্মদ আব্দুহ (১৮৫৯-১৯০৫) মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকীকরণের প্রয়াস চালান। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দুই বার তিউনিশিয়া ভ্রমণকালে যাইতুনিয়ায় স্কলারদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন এবং অত্র প্রতিষ্ঠানকে আধুনিকীকরণের প্রস্তাব তুলে ধরেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ‘আততাহরীর ওয়া আততানবীর’ নামক তাফসির গ্রন্থের লেখক শেখ মুহাম্মদ তাহির বিন আশুরের (১৮৭৯-১৯৭০) নেতৃত্বে একটি সুপাভাইজরি কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু তিউনিশিয়া স্বাধীন হলেও শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষীকরণের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট এর অধ্যাদেশ বলে যাইতুনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ধমীয় শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বুর্গুবিয়া বিশ্বাস করতেন ধর্মীয় শিক্ষা বিলুপ্ত করে পাশ্চাত্যের অনুকরণে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে না সাজালে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ঘানুসি পুরাতন ক্যারিকুলামে তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৬২ সালে যাইতুনিয়া থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে শিক্ষাজীবনে ঘানুসি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসেরের (১৯৫২-১৯৭০) আরব ঐক্যের তত্ত্ব দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, pan-Arabism এই কনসেপ্ট Arab Socialist Union এর হলেও নাসের প্রথম দিকে হাসানুল বান্নার চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হন। পরবর্তীতে তার শাসনামলেই মুসলিম ব্রাদারহুড সীমাহনীন যুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়। সেই সময় মিশরের রেডিওতে সব সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদের চেতনা তুলে ধরা হতো। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগানে আরব বিশ্বের যুবসমাজের মত ঘানুসিও আকৃষ্ট হন। অন্যান্যদের সাথে ‘নাহনু আরব, নাহনু আরব‘ এই শ্লোগান দিতে গর্ববোধ করতেন।
ঘানুসি যাইতুনিয়া থেকে পাস করার পর ১৯৬৪ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য কায়রো যান এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিভাগে ভর্তি হন। কায়রোতে আসার পর তিনি জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনায় আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হন। প্রায় চল্লিশজনের মত বন্ধুসহ তিনি আরব জাতীয়তাবাদের প্রসারে ভূমিকা রাখতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই সময় তিউনিশিয়াতে দুইটি ধারা ছিল: ডবংঃবৎহরুবফ বষরঃব এবং অৎধনরুবফ বষরঃব তিউনিশিয়ার সরকার নাসেরের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চললেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানকে তাদের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করতো। অতএব বৈধ যথাযথ অনুমতি না নিয়ে কায়রো আসার অভিযোগে ঘানুসিসহ তাঁর বন্ধুদের ভঁমরঃরাবং আখ্যায়িত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের জন্য তিউনিশিয়া দূতাবাসের পক্ষ থেকে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়। তিউনিশিয়ার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বর্গুইবা কায়রো সফরের প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করে এবং মিশর সরকার সকলকে মিশর ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়।
কায়রোতে থাকাকালীন সময়ে ঘানুসি আরব জাতীয়তাবাদের স্বরূপ দেখে হতাশ হন। এই প্রসঙ্গে তামিমি মন্তব্য করেন:
But to Ghannouchi’s great disappointment, the few months he spent in Egypt had exposed him to a different image of Nassirism and of Egypt. He did not find in Egypt what he had always imagined of “ambition for progress, of Arab solidarity, and of unwavering support for the causes of justice and equality.” He thought he would find the Egyptians enthusiastically mobilized behind Nassir. But he found a disaffected people who were more preoccupied with the arduous task of earning their living than with upholding the ideals of Nassirism. The songs and the speeches that he, and millions of Arabs around the world, had listened to on the radio and believed in to the extent of idolizing Nassir, were empty slogans, mere propaganda, that did not correspond to any of the realities he saw in the Egyptian streets.
কায়রো থেকে ঘানুসি আলবেনিয়া যাওয়ার জন্য মনস্থ করে ফ্লাইটে টিকিট বুকিং দিতে যান। সেখানে তাঁর জনৈক বন্ধু আলবেনিয়া না গিয়ে সিরিয়া যাওয়ার তাঁকে পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী তিনি সিরিয়া যান। ঘানুসি যখন সিরিয়া যান তখন সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। তামীম মন্তব্য করেন: When Ghannouchi arrived in Damascus the conflict within the Nationalist camp in Syria between die supporters of Nassirist reunification and Ba’th Party separatism was most severe.
১৯৫৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মিশর, সিরিয়াসহ the United Arab Republic গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৬১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তা বিলুপ্ত ঘোষিত হয়। সিরিয়ার বাথ পার্টি আরব ইউনিয়নে নাসের ও মিশরের অযাচিত হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেনি। ১৯৬১ সালে তা বিলুপ্ত হলেও ১৯৬৪ সাল নাগাদ সিরিয়ার রাজনীতিতে আরব ইউনিয়নে আবার যুক্ত হওয়া প্রশ্নে বাথ পার্টি ও নাসেরের অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে মাঝে বিরোধ চরম পর্যায়ে ছিলো।
ঘানুসি সিরিয়া আসার পর কৃষি বিজ্ঞানের পরিবর্তে সাহিত্য ও দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্রদের মাঝে বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিলো বাথপার্টি ও নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদের দর্শন এবং সেক্যুলারিজম ও ইসলাম (a conflict had been going on between the secularists, who campaigned for the exclusion of religion from public life, and the Islamists, who defended the role of religion as a source of guidance in both the public and private realms)
ইসলামিস্টদের জন্য সহায়ক ছিলো মসজিদের খতিব আদিব সালিহ এর খুতবা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ও Al-Hadarah al-Islamiyah (Islamic civilization) ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হিসাবে তাঁর বক্তব্যে শহীদ হাসানুল বান্না ও মাওলানা মওদুদীর চিন্তাধারা ফুটে উঠতো। ঘানুসি তাঁর লেখনী দ্বারা আকৃষ্ট হতে থাকেন। সেই সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্ন সকলের সামনে এসে পড়ে এবং ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ঘানুসি সে সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগদান করেন।
১৯৬৫ সালে ঘানুসি তুরস্ক, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস সফর করেন। ছুটির সময় ছাত্ররা ইউরোপ ভ্রমণ করা দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ছিলো। ঘানুসি উক্ত ভ্রমণের সময় প্রায় তিন মাস জার্মানিতে একটি ফার্মে ও বেলজিয়ামে একটি রেস্টুরেন্টে এবং নেদারল্যান্ডসে একটি ছোট ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন। ইউরোপ ভ্রমণকালে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার বাস্তব চিত্র দেখে হতাশ হয়ে পড়েন এবং তাঁর চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন হতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে অ্যারাবিজম থেকে ইসলামিজমের দিকে তিনি ধাবিত হন। সেই সময় মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রভাব কিভাবে কমানো যায় এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক হতো। ঘানুসিও এই সব বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। ইসলামপন্থীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অসুস্থ দিকগুলো তুলে ধরতেন। এই সব আলোচনায় ড্রাগ, সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি, পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা সভ্যতার ভূমিকা তুলে ধরা হতো।
ঘানুসি মিশর থেকে বহিষ্কৃত হলেও সিরিয়া আসার পরও মিশরের জামাল আবদুন নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর মোহ ছিল কিছুদিন। কিছু বন্ধুসহ Egyptian al-Ittihad al-‘Arabi al-Ishtiraki (Arab Socialist Union), স্থানীয় শাখা al-Ittihad al-Ishtiraki (the Socialist Union) দলে যোগদান করেন। নাসেরের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত উক্ত সংগঠন বিলুপ্ত করে al-Hizb al-Watani (the National Party)

গঠন করেন। ইউরোপ ভ্রমণ করে আসার পরেও এক বছরের মত তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। বিশেষভাবে ঝধঃর’ ধষ-Sati’ al-Husri(1879-1968) আরব জাতীয়তাবাদের উপর লেখনী তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রতি তাঁর মোহ কমতে থাকে এবং তিনি তাঁর মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। তামিমির ভাষায় :

The foundations of the nationalist ideology were shaken within him as he progressed in the study of philosophy and as a result of the impact left on him by the European tour and the writings he had already read. He felt ill equipped in the fierce discussions he used to have with the members of the Islamic trend. His resistance grew weaker and weaker. He was becoming increasingly convinced that the arguments of the nationalist ideology were brittle. For one, they could not provide him with satisfactory answers to several questions. He asked himself and asked his party associates: “What is Arab nationalism? What is the difference between Nassirism and the Ba’th?

মনের নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে ঘানুসির কাছে পরিষ্কার হয় যে, হুরসীর আরব জাতীয়তাবাদের দর্শনের সাথে ফ্রেন্স জাতীয়তাবাদী দর্শনের খুব একটা পার্থক্য নেই। এছাড়া ধর্মের ব্যাপারে আরব জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে হতাশ করে। তাঁর কাছে এটা পরিষ্কার হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান মূলত ইসলামের প্রতি মানুষ যেন আকৃষ্ট না হয় তার বিকল্প হিসাবে পাশ্চাত্যেরই সৃষ্টি। আরব জাতীয়তাবাদের নামে তিনি মূলত মরীচিকার পেছনে দৌড়িয়েছেন। He was shocked to discover that the dream he lived for, the dream of Arab nationalism, was an illusion আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর মনে সংশয় সৃষ্টি হওয়ার পর relationship of Arab nationalism to Islam নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনাধারী বন্ধুদের সাথে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ঘানুসি সেই সময় তাঁর মনের নানা প্রশ্নের উত্তর জানা এবং alternative to nationalism-এর সন্ধানে ইসলামী স্টাডি সার্কেলে যাওয়া শুরু করেন। নাসিরুদ্দিন আলবানী, শাইখ আদিব সালিহ, শাইখ আলবুত্তি এবং ওয়াহবা আয-যুহাইলী প্রমুখ স্কলারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদের আলোচনা সভায় যোগ দেয়া শুরু করেন। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তিনি আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তা ত্যাগ করেন।
১৯৬৬ সালের ১৫ জুন রাত তাঁর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উক্ত রাতের অনুভূতি তিনি এইভাবে ব্যক্ত করেন:

That very night I shed two things off me: secular nationalism and traditional Islam. That night I embraced what I believed was the original Islam, Islam as revealed and not as shaped or distorted by history and tradition. That was the night I was overwhelmed by an immense surge of faith, love, and admiration for this religion to which I pledged my life. On that night I was reborn, my heart was filled with the light of God, and my mind with the determination to review and reflect on all that which I had previously conceived.

সিরিয়াতে অবস্থানকালে ইখওয়ানসহ কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠনে যোগদান করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি কোন সংগঠনে যোগদান না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দুই বছর হাসানুল বান্না, মওদুদী, সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, আল্লামা ইকবালসহ বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদের বই-পুস্তক অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। তিউনিশিয়াতে ইসলামপন্থীদের উপর চরম যুলুম নির্যাতন চলায় নাসিরুদ্দিন আলবানীসহ অনেকই তাঁকে পরামর্শ দেন তিউনিশিয়ার অবস্থার উন্নতি না হলে দেশে ফেরত না যেতে। অপরদিকে তিনি লক্ষ্য করেন, তিউনিশিয়া স্বাধীন হলেও শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে ফ্রেন্স। তিউনিশিয়াতে স্বীকৃতি পেতে হলে ফ্রান্সের একটি সনদ প্রয়োজন; তাই তিনি ১৯৬৮ সালে দামেশকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর ফ্রান্সে যান এবং অধ্যাপক সান্ডারসের তত্ত্বাবধানে The Qur’anic Approach to Education.” বিষয়ে মাস্টার্স থিসিস করার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন। ফ্রান্সে সেই সময় শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন চলে। কিন্তু তিনি কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় যোগ দান করেননি। ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে তাবলিগ জামাতের সাথে পরিচিত হন। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (১৮৮৫-১৯৪৪) এই জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। এই জামায়াত বিভিন্ন বাসায় গিয়ে নক করতো এবং মানুষদেরকে মসজিদে গিয়ে ঈমান ও আমলের বয়ান শুনতে আহবান জানাতো। তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে ঘানুসি বলেন : Living with the tabligh community provided me with immunity and protection from fierce winds and added a new dimension to my molding. Never ever before had I had such an experienc তাবলিগ জামাতে শরিক হওয়ার পরই দাওয়াহ কার্যক্রম করার জন্য তিনি রাস্তায় বের হন এবং বিভিন্ন স্থানে যান। তাঁর তাবলিগি গ্রুপের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন বলে তাঁকে ইমামতি করতে হতো এবং বিভিন্ন স্থানে বয়ান করতে হতো। তাবলিগের কাজে তিনি শ্রমজীবী মানুষদের সাথে মিশেন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেন।

সেই সময় স্কলারশিপ ছাড়া ফ্রান্সে থাকা-খাওয়ার খরচ যোগানো খুব কষ্টকর ছিলো। নাইট গার্ড হিসাবে কাজ পেলে ছাত্ররা সৌভাগ্য মনে করতো। থাকার জায়গা, হালাল খাবারসহ নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে তিনি ফ্রান্সে এক বছর ছিলেন।

ফ্রান্সে যেসব মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করতো তাদের খুব অল্প সংখ্যক ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতো। ছেলে-মেয়েরা অবাধ-মেলা মেশা করতো। কোন ছাত্রের গার্লফ্রেন্ড না থাকলে অস্বাভাবিক মনে করা হতো। সে সময় তিনি ফ্রান্সের খ্রিস্টান ক্যাথলিক ছাত্রদের একটি ক্লাবে যান। উক্ত ক্লাবে ছেলে-মেয়েরা শালীনতা বজায় রেখে চলতো এবং পরিবেশ ছিল clean, seduction-free and acceptable ক্যাথলিক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ফ্রান্সের সমাজ, সভ্যতা ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পান। সে সময় প্যারিস শহরে একটি মসজিদ ছিলো; আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত হামজা আবু বকর তা তত্ত্বাবধান করতো। তাকে অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটি তেমন শ্রদ্ধা করতো না। তিনি ঘানুসিকে উক্ত মসজিদে কোন ইসলামী দাওয়াহ তৎপরতা চালানোর অনুমতি প্রদান করেননি। তখন প্যারিসে জনৈক ইরানি ছাত্রের নেতৃত্বে ইসলামিক সোসাইটি গঠিত হয়। তার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই ঘানুসি ইরানের স্কলার বাজারজান (১৯০৭-১৯৯৫) এর লেখনীর সাথে পরিচিত হন। ১৯৭৮ সালে শাহের আমলে খোমেনি তাঁকে শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করার জন্য পাঠান। ইরান বিপ্লবের পর ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেন কিন্তু একই বছরের নভেম্বর মাসে তিনি নিজেকে ‘ক্ষমতাবিহীন প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যায়িত করে পদত্যাগ করেন। ইসলামিক সোসাইটিতে ইরানি বন্ধুদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে তিনি শিয়াদের দর্শন বিশেষভাবে তাদের পঞ্চম ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ আলবাকের ও ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেকসহ বার ইমাম সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। কিছুদিন পর ঘানুসি সোসাইটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। সোসাইটির উদ্যোগে নিয়মিত সেমিনার করা হতো। ড: মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ তাতে বক্তব্য রাখতেন। ড: হামিদুল্লাহ ফ্রেন্স ভাষায় কুরআন অনুবাদ করেন এবং Majmu’at al-Watha’iq as-Siyasiyah Lil’ahd an Nabawi wal-Khilafah ar-Rashidah (The set of Political Documents During the Era of the Prophet and the Rightly Guided Caliphate সহ অনেক গ্রন্থ রচনা করেন।
ফ্রান্সে অধ্যয়নরত তিউনিশিয়ার ছাত্ররা বুর্গুবিয়ার পদত্যাগের দাবিতে সভা-সমাবেশের আয়োজন করে। একই সময় ঘানুসি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে সভা-সমাবেশ করেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক Vincent Monteuil প্যলেস্টাইনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন। অবশ্য পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

ঘানুসির তিউনিশিয়া প্রত্যাবর্তন

ঘানুসি ফ্রান্সে এসে তাবলিগ জামাতে যোগ দেয়ার পর লম্বা দাড়ি রাখেন এবং প্যালেস্টাইনি স্টাইলের টুপি পরতেন। তিউনিশিয়ার শ্রমিকরা ছুটিতে বাড়ি গেলে ঘানুসির পরিবারকে তা জানায়। এতে ঘানুসির পরিবার খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিলো উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মডার্ন ঘানুসি দেশে ফিরবে। তাই তাঁকে দেশে ফেরত নেয়ার জন্য তাঁর বড় ভাই বিচারপতি মুখতারকে পাঠানো হয়। তিনি ছোট বেলায় হেফজ করলেও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতেন না। ঘানুসিকে ফেরত নেয়ার জন্য মায়ের অসুস্থতার গল্প তৈরি করেন। তিউনিশিয়া থেকে সিরিয়া যাওয়ার পর লিবিয়ার ত্রিপলিতে তিন বছর আগে ঘানুসির সাথে মায়ের দেখা হয়। ঘানুসির বড় ভাই যখন তাঁকে নেয়ার জন্য আসেন সে সময় তিনি চার মাসের জন্য তাবলিগের একটি গ্রুপের সাথে পাকিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে স্থলপথে বাড়ি রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তাঁরা স্পেনে কর্ডোভা পরিদর্শন করে অতীত মুসলিম সভ্যতার হারানো নিদর্শনাবলি দেখে উভয়ই কান্না করেন।

তিউনিশিয়া আসার পর ঘানুসি যাইতুনিয়া দেখতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন মসজিদে একজন শাইখের চারপাশে কিছু যুবক ও বৃদ্ধ স্টাডি সার্কেল করছে। তা দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে পারিবারিক কারণে তিনি ফ্রান্সে ফেরত না গিয়ে তিউনিশিয়াতে দর্শনের শিক্ষক হিসাবে চাকরি নেন। শিক্ষকতার পেশা শুরু করার পর তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। সে সময় The philosophy curriculum and the generation of loss শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন তিউনিশিয়ার নতুন প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। তাই শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে তিনি কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
জমিয়ত আলমুহাফিযাতু আলা আলকুরআন গঠন


ঘানুসি সিরিয়া থেকে ফেরার পর শাইখ আবদুল ফাত্তাহ মুরুরসহ ১৯৬৯ সালে শাইখ হাবিব মুস্তাবিকে প্রধান করে কুরআন সংরক্ষণ সংস্থা গঠন করেন। শাইখ মুস্তাবি সরকারি দলের সদস্য ছিলেন এবং উক্ত সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করার পরও সরকারি দলে ছিলেন। তিনি বলতেন ‘ইসলামের জন্য কাজ করার কারণে তাঁকে দল ছাড়তে হবে কেন?’ উক্ত সংস্থা গঠন করার পর ঘানুসি মসজিদ কেন্দ্রিক ইসলামী দাওয়াহ কার্যক্রম আরম্ভ করেন। তিনি বিভিন্ন চিন্তা-চেতনা সম্পন্ন ছাত্রদের সামনে চমৎকারভাবে আলোচনা করতেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন। শাইখ আব্দুল কাদের সালামাহ, শাইখ আহমদ বিন মিলাদ, শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ মুরুর, শাইখ আলখিয়ারীসহ অনেক মুসলিম যুব নেতৃবৃন্দ পর্যায়ক্রমে উক্ত কাজে শামিল হন।

ঘানুসির মিশর সফর ও সমাজ সংস্কার চিন্তাধারা


ঘানুসি ১৯৭৫ সালে মিশর ভ্রমণ করেন এবং ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। দেশে ফিরে হাসানুল বান্নার চিন্তাধারার কিছুটা সংস্কার করে ‘তিউনিশিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার’ প্রস্তাবনাসহ প্রবন্ধ লিখেন। তিনি পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা ও বুর্গুবিয়ার শাসনের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাঁর মতামত তুলে ধরেন। এইভাবে গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী অন্যান্য মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবদুহ (১৮৪৯-১৯০৫) ও জামাল উদ্দিন আফগানির প্যানইসলামিজমের চিন্তাধারাও (১৮৩৮-১৮৯৭) তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করে। আফগানির দৃষ্টিতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরামর্শভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা না করার কারণে মুসলিম বিশ্বে দুরবস্থার অন্যতম কারণ। আব্দুহুর চিন্তাধারার অনুসারী আল্লামা রাশিদ রেযা (১৮৬৫-১৯৩৫)-র দৃষ্টিতে সঠিক ইসলামের অনুসরণের অভাবেই মুসলমানদের এই করুণ অবস্থা। ঘানুসি তাঁদের সকলের চিন্তাধারা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।

ঘানুসি তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের শুরুতে শিক্ষাব্যস্থার প্রতি গুরুত্ব দেন। আসসাদিকিয়া স্কুলের শিক্ষা-ক্যারিকুলামের আলোকে আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধনের প্রয়াস চালান। উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কুরআন শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি, আইন, বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা দেয়া হতো। শিক্ষকগণ পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রদেরকে ইসলামের সোনালি যুগের বিভিন্ন কাহিনী শোনাতো। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী একদিকে আধুনিক জ্ঞানার্জন করে যোগ্যতা অর্জন করতো এবং একই সাথে ইসলামী মূল্যবোধ তার হৃদয়ে বদ্ধমূল হতো। ঘানুসি লক্ষ্য করেন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্কার আন্দোলনে কিছুটা অবদান রাখা সম্ভব হলেও দেশ পরিপূর্ণভাবে ইসলামী সমাজব্যবস্থার আলোকে পরিচালিত না হলে পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতার প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি পরিপূর্ণ ইসলামী রেনেসাঁর জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর উক্ত সিদ্ধান্তের ফলে আলজামাআহ আল ইসলামিয়ার মাঝে বিভক্তি দেখা দেয়। কেননা এতে বিভিন্ন মাযহাব, আশআরি, শিয়া বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলো। তাদের একটি অংশ নিজেদেরকে প্রপ্রেসিভ ইসলামিস্ট বলে দাবি করেন এবং তাঁরা হানাসুল বান্না, সাইয়েদ কুতুবের হাকিমিয়্যাহ, জাহিলিয়্যাহ প্রভৃতি কনসেপ্টের সমালোচনা করেন। ইসলামী আন্দোলন শুরু করার পর ঘানুসি পাশ্চাত্য ঘেঁষা বুদ্বিজীবীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। ইসলামী রেনেসাঁর কাজ শুরু হওয়ার পর ঘানুসি যেই ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হন তা ছিল অবধারিত। এই জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন।
১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি তিউনিশিয়াতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে ঘানুসির জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়।
মূলত ক্ষমতাসীন দাস্তুরিয়া পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আহমদ আল-মিস্ত্রির নেতৃত্বে উক্ত আন্দোলন শুরু হয়। তাঁর সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এক অংশ যোগ দেয়। তাঁরা সরকারের স্বৈরাচারী নীতির সমালোচনা করেন এবং দেশে কোন বাকস্বাধীনতা নেই বলে অভিযোগ পেশ করেন। ঘানুসির উক্ত সুযোগ কাজে লাগান এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগে তাঁদের সাথে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। অবশ্য সেই সময় গণতন্ত্র ও ইসলামের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে আরব বিশ্বে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এমনি প্রেক্ষিতে ইসলামী চিন্তাবিদদের কেহ কেহ মনে করেন মুসলিম বিশ্বের বর্তমান দুরবস্থার পেছনে অনেকগুলো কারণের অন্যতম হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে আদল (ন্যায় বিচার) ও শূরা (পরামর্শ) ভিত্তিক রাষ্ট্রপরিচালনা না করা। শাইখ আব্দুহসহ অনেক চিন্তাবিদ শূরা ব্যবস্থাকেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের আইন পরিষদের সাথে তুলনা করেন। আল্লামা রশীদ রেদা (১৮৬৫-১৮৯৩৫) মনে করেন, ইসলামের মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে দুইটি : ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাওহিদ আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শূরা ভিত্তিক দেশ পরিচালনা। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ায় মুসলমানদের মাঝে এই উভয় ভিত্তিই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে বিধায় মুসলমানদের এই দুরবস্থা।

শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে ঘানুসির চিন্তাধারা
বুর্গুবিয়া, পাশ্চাত্যের অনুসারী এবং মার্কসবাদীদের কাছ থেকে ঘানুসি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। সেই সময় শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে তিউনিশিয়ায় আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের ২৬ জানুয়ারি শ্রমিক ধর্মঘটে পুরো তিউনিশিয়া অচল হয়ে পড়ে এবং শ্রমিক বনাম সরকারের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হয়। উক্ত সংঘাতে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে মারা যায়। মার্কসবাদীরা উক্ত শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ঘানুসি ভাবেন বামপন্থীরাই শুধু মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলবে কেন? অথচ মানুষের সমস্যা সমাধানের আন্দোলনের সাথে ইসলামের কোন সংঘাত নেই বরং ইসলাম মানব সমস্যা সমাধানে চমৎকার দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অতএব, তিনি দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে মনস্থ করেন। তিনি মনে করেন ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যে অধিকার দিয়েছে তা তুলে ধরার এটা এক মহাসুযোগ। শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে ঘানুসি মন্তব্য করেন :

We realized that God did not create us for the purpose of opposing the communists, but in order to accomplish the objectives of Islam, which may agree in part with communism as it may agree in part with any other ideology. One of Islam’s fundamental objectives is to establish justice in the world. The value of justice is the greatest value in Islam, and Just is one of the attributes of God. How could we then have embroiled ourselves in opposing those, even if they were Marxists, who struggled for securing the interests of the poor and the oppressed? Learning from the examples set by the Prophet, we decided that defending justice should be our foremost priority.

১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লব


১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেনির (১৯০২-১৯৮৯) নেতৃত্বে ইরান বিপ্লব সাধিত হয়। খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসনে থেকে আমেরিকার সমর্থিত মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীকে এক সফল বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন। যদিও শিয়া দর্শনের ভিত্তিতে উক্ত বিপ্লব হয় রাশিদ ঘানুসি উক্ত বিপ্লবকে স্বাগত জানান। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উক্ত বিপ্লবের পর সমাজ বিপ্লবের এক ঢেউ জাগে। তিউনিশিয়াতেও ইসলামী জাগরণ সৃষ্টিতে ইসলামপন্থীদের মাঝে নতুন এক প্রেরণা জাগে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পাশ্চাত্যের সমর্থিত ক্ষমতাধর স্বৈরশাসককেও প্রবল জন সোতে ভাসিয়ে দেয়া সম্ভব। তিনি লক্ষ্য করেন যে, উক্ত বিপ্লবে ধনী ও গরিবের বৈষম্যের কারণে বিপুল জনগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ইসলামের নামে সংগঠিত ইরান বিপ্লবকে সমর্থন দেয়। উক্ত বিপ্লবের সফলতা ঘানুসিকে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামের সুষম অর্থব্যবস্থা যে মাযলুম মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি তা জনগণের মাঝে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জাগায়। তিউনিশিয়াতে শিয়া নেই বললেই চলে। অতএব, ঘানুসি ইরান বিপ্লবকে শিয়া বিপ্লব হিসাবে না দেখে উক্ত বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে তিউনিশিয়ায় সমাজ বিপ্লব সাধনে ব্রতী হন।  ঘানুসির দৃষ্টিতে ইমাম খোমেনি, হাসানুল বান্না ও মওদুদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক কয়েকটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে: ১. আশ-শুমলিয়্যাহ- তাঁরা সকলইে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ২. আলওয়াতানিয়্যাহ- তাঁরা দেশের সমস্যা সমাধানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন ৩. আল-ইস্তেশলালিয়্যাহ- তাঁরা পাশ্চাত্যের কালচার ও রাজনৈতিক গোলামি থেকে মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে ইসলামী কালচার অনুসরণের প্রতি আহবান জানান ৪. আস-সালাফিয়্যাহ- ইসলামের মূল উৎস থেকে
See this link: তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ড. রাশিদ ঘানুসি (২য় পর্ব) ।

Popular Posts