Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts
Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts

Thursday, July 18, 2019

পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটা


এইচ,এম,হুমায়ুন কবির কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : বৈরি আবহাওয়ার মধ্যে  ঈদুল আযহার ছুটিতে পর্যটকদের পদচারণায় এখনই মুখরিত হয়ে উঠেছে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের বেলাভূমি সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা।
যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়বে দিগন্ত জোড়া আকাশ আর সমুদ্রের রাশি রাশি নীল জল আর সমুদ্রের নীল জলের তরঙ্গায়িত ঢেউ কাঁচভাঙ্গা ঝন ঝন শব্দের মত আছরে পড়ছে কিনারায় ও উড়ে যাচ্ছে সাদা গাংচিলের দল এদিক ওদিক-মাছ শিকারের জন্য লড়াকু জেলেরা ট্রলারে ও নৌকায় ছুটে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে তা উপভোগ করা যায়।
 বৈরি আবহাওয়ার মধ্যেও ঈদুল আযহার আনন্দ উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী পরিবার পরিজন নিয়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে এসেছেন। কলাপাড়া-কুয়াকাটা নদীতে বর্তমানে তিনটি ব্রিজ হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ ভাল থাকায় এ বছর সবার্ধিক পর্যটকের আগমনে কুয়াকাটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। 
দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের উন্মাদনায় পুরো সৈকতে এখন আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করছে। নানা বয়সি পর্যটকদের আগমনে রাখাইন মার্কেট, ঝিনুকের দোকান, খাবারঘর, চটপটির দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেনাকাটার ধুম পরেছে। সোমবার বিকেল থেকে হোটেল মোটেলগুলোতে পর্যটকরা উঠতে শুরু করেছে। সৈকতের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নাই। কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। এরই মাঝে সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখা, লাল কাকড়ার অবিরাম ছোটাছুটি, বালুকা বেলায় প্রিয়জনের সাথে হাঁটাহাঁটি, আর সমুদ্রের মোহনীয় গর্জন শুনতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কুয়াকাটায় ছুটে এসেছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নানা বয়সের হাজারো মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সৈকত লাগোয়া নারিকেল বাগান, ইকোপার্ক, ইলিশপার্ক, জাতীয় উদ্যান, শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার, সীমা বৌদ্ধ বিহার, সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলখ্যাত ফাতরার বনাঞ্চল, ফকির হাট, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, আড়াই শতবর্ষী নৌকা, লেম্বুর চর, শুঁটকিপল্লী ও কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টে শিশু-কিশোর যুবক যুবতীসহ নানা বয়সী পর্যটকদের পদচারণায় এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে। সৈকতে বেড়াতে আসা নানা বয়সী পর্যটকরা স্মার্ট ফোনে সেলফি ও ভিডিও ক্লিপস সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ব্যাপক টহল অব্যাহত রয়েছে। 
ঈদের ছুটিতে যশোর থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী কালাম ও নুবাইবা দম্পতি জানান, সৈকতের অপরূপ দৃশ্য দেখে অসাধারণ লেগেছে। দর্শনীয় স্পটে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখেছি। শিক্ষার্থী  রাইকা, নওসিন ও মিশু জানান, প্রথমবারের মত কুয়াকাটায় এসেছি। খুব ভাল লেগেছে। সুযোগ পেলে প্রকৃতির টানে বার বার ছুটে আসব এখানে। অপর এক শিক্ষার্থী উম্মে কবির হাবিবা বলেন,সমুদ্রে উন্মাদনার সাথে গোছল করার ছবি তুলে এফবিতে পোস্ট করেছি। যোগাযোগ, অপরূপ সৈকতের সৌন্দার্য্য এছাড়াও একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের লোভনীয় দৃশ্য অবলোকন করা যায়। তাই বন্ধুদেরকে এফবির মাধ্যমে আহ্বান করেছি বলে ওই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন।
রুচিসম্মত খাবার পরিবেশনার নিশ্চিয়তা নিয়ে খাবার হোটেল মালিকরা জানান, ঈদ উল আযহার ছুটিতে পর্যটকদের ব্যাপক চাপ রয়েছে। আমরাও চেষ্টা করছি পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী খাবার পরিবেশনে। 
কুয়াকাটা সমুদ্র রিসোর্ট হোটেল ব্যবস্থাপনা পরিচালক. বাংলা ভিসনের সাংবাদিক মো. মিরন জানান, ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। ঈদের পরদিন থেকে কুয়াকাটায় আগাম বুকিং অনুযায়ী পর্যটক রয়েছে। চলতি মাসের ১৬ তারিখ পর্যস্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি ধারণা করছেন। ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোনের মো.খলিলুর রহমান  জানান, ঈদ উপলক্ষে পর্যটকদের ব্যাপক চাপ রয়েছে। নিরাপত্তা দিতে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ থানা পুলিশ দর্শনীয় স্থানে টহল রয়েছে।
এ দিকে কলাপাড়া রাবনা বাঁধ নদীর মোহনায় দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রায় ঈদের দিন বিকেল থেকে দর্শনার্থীদের পদভারে গোটা বন্দর এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিদিন শত শত লোক পায়রা সমুদ্র বন্দরে  পরিবারÑপরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন। এটিও এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। রাবনাবাঁধ নদীর মোহনায় দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রায় ঈদের দিনে ঘুরতে আসা বাকেরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী মোসা. নাজরাতুন নাইম রুজি বলেন, দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রা বন্দর কলাপাড়ায় হওয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমরা গর্বিত। এখানে ঈদের ছুটিতে ঘুরতে এসে খুবই ভালোই লেগেছে। ভবিষ্যতে এখানে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় স্থান হয়ে দাঁড়াবে।    
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সভাপতি মো. মুনিবুর রহমান বলেন, কুয়াকাটায় আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইনশৃঙ্গলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
See this video:

Wednesday, July 10, 2019

ক্ষুদ্র ঋণ ও কর্জে হাসানা প্রসঙ্গ



ড. মো. নূরুল আমিন : গত মাসের ১৫ তারিখে স্থানীয় একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে উত্তরায় একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কর্তৃক কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার নয়ারহাট এবং খানারচর গ্রামের দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায় সমিতি, মহাজনী সংস্থা ও এনজিওসমূহের ক্ষুদ্র ঋণের সম্ভাব্যতার উপর সম্পাদিত একটি সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা উপলক্ষে এই সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছিল। সমীক্ষায় প্রত্যেকটি গ্রামের ১০০টি করে মোট ২০০টি পরিবারকে একটি পূর্বপ্রস্তুতকৃত প্রশ্নমালা সরবরাহ করা হয়। নির্বাচিত পরিবারসমূহের সকলেই ছিলেন মুসলিম। প্রশ্নমালার মাধ্যমে এই মুসলিম পরিবার ও ঋণগ্রহিতাদের কাছ থেকে তাদের ধর্মীয় অঙ্গীকারের বিষয়টিও ক্ষুদ্র ঋণের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে ঋণ তাদের আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে এবং ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কতটুকু কমিয়েছে তার প্রায়োগিক যথার্থতাও পরীক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ধরনের সমীক্ষায় বাংলাদেশে সম্ভবতঃ এই প্রথম। সমীক্ষাটির জন্য আমি Bangladesh Institute of Islamic Thoughts (BIIT) কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

সমীক্ষার ফলাফল ব্যাপক ও বহুমুখী। এই নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে তার সবকিছু আলোচনা করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তথাপিও এই সমীক্ষার মাধ্যমে বেরিয়ে আসা কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমি কিছুটা আলোচনা করা জরুরি বলে মনে করছি।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামের অনেক সদস্যই তাদের দারিদ্র্যকে যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়েছেন। পাশাপাশি উৎপাদনমূলক বা আয়বর্ধক কাজের জন্য নয়, বরং অপেক্ষাকৃত ধনীদের জীবনযাত্রা প্রণালী অনুকরণের জন্য ও বেশী বেশী ঋণের জন্য তারা এনজিওদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ঋণ পরিশোধের সাপ্তাহিক কিস্তি প্রদানের বাধ্যবাধকতা, উচ্চ সুদের সমস্যা এবং ঋণের অন্যান্য কঠোর শর্তাবলী তাদের ঋণমুখী হওয়া থেকে নিবৃত করতে পারেনি। ফলে বহুমুখী ঋণের জালে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকসহ সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমূহ কর্তৃক ভোগ্য ও বিলাসপণ্যের জন্য ঋণ চালু করার ফলে গ্রামের মানুষের Multiple indebtedness বেড়েছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, গ্রামে এখন এমন লোক খুব কম আছে যারা ঋণগ্রস্ত নয়। ঋণ নিয়ে তারা স্বচ্ছন্দে টিভি, ফ্রিজ কিনছে, খাট পালঙ্ক ও ঘরের আসবাবপত্র কিনছে। এমনকি ঘরও তৈরি করছে। মেয়ের বিয়ের যৌতুক দিচ্ছে। এর সবই সুদভিত্তিক ঋণ।
সমীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি আইটেম ছিল ঋণগ্রহিতা পরিবারের লোকদের ধর্মানুশীলনের ব্যাপারে। দেখা গেছে যে, তারা নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, কুরআন তেলাওয়াত করেন এমনকি হজ্বও করেন। সুদ আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশনা আছে। প্রশ্ন উঠেছে, একজন ঈমানদার মুসলমান যিনি নামাজ রোজা করেন, যাকাত দেন তিনি কি সুদী ঋণ নিতে পারেন? যদি না পারেন, নিচ্ছেন কিভাবে?
এক এজেন্সি থেকে কর্জ নিয়ে অন্য এজেন্সির কর্জ পরিশোধ করার কথা আমি আগেই বলেছি। কৃষি এবং শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে আগে পেপার ট্রানজেকশনের বিষয়টি বহুল আলোচিত ছিল। এখন ক্ষুদ্র ঋণও এই রোগ থেকে মুক্ত নয়। গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওগুলো থেকে ঋণ নিয়ে লগ্নি ব্যবসা করেন এই প্রমাণও ইতিপূর্বে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও সুইডিশ সিডাসহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। এই ঋণ এবং সুদের জাল যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। একজন মুসলমান ঋণ পরিশোধ না করে মারা গেলে তার জানাযা হয় না। এ কথাটিও আমরা এখন মনে করি না। আমাদের আলেম উলেমারাও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের সমাজে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে অনেকগুলো মূল্যবোধ ছিল। সুদখোর, ঘুষখোর এদেরকে সকলেই ঘৃণা করতো। তখন এখনকার মত গ্রামে-গঞ্জে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ছিল না। তফসিলি বা বাণিজ্যিক ব্যাংক তো কেউ নামই শুনেনি। মহকুমা পর্যায়ে সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাংক এবং জেলা পর্যায়ে ল্যান্ডমর্গেজ ব্যাংক ছিল। তারা গ্রামীণ সমবায় সমিতি এবং সমবায়ী সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদী   কর্জ দিতো। এই কর্জ ছিল সুদভিত্তিক, এই সুদভিত্তিক সমবায় সমিতি অথবা কর্জের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল কম। ১৭৯৩ সালের সূর্যাস্ত আইনের পর বৃটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুরা রাতারাতিভাবে এই দেশের জমিদারী প্রথার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত এখানকার জমিদারদের শতকরা ৯৮ ভাগই ছিল হিন্দু। হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ববাংলার মহাজনী প্রথা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। সমবায় সমিতি, সমবায় ব্যাংক ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হিন্দুরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট এগিয়ে যায়। সুদী লেনদেনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তাদের মধ্যে শরিয়া প্রতিপালনের প্রবণতা ছিল। যেহেতু ইসলামে সুদ হারাম সেহেতু তারা সুদী লেনদেনকে এড়িয়ে চলতেন। সুদখোরদের সাথে তারা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন না। একইভাবে ঘুষখোরদেরও তারা ঘৃণা করতেন।  একজন মুসলমান নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, হজ্জ করবে আবার সুদ নেবে এবং দেবে এটা কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। আমি আমার বাবা, চাচা, আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমান পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কর্জে হাসানার ব্যাপক প্রচলন দেখেছি। ওশর ব্যবস্থাও ঐ সময় সক্রিয় ছিল। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন গরীব হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কর্মসংস্থান ছিল না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে অন্যের কাছে হাতপাতা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু আমরা তাদের তা করতে দিতাম না। আমরা প্রত্যেক গৃহস্থ পরিবার থেকে ওশরের ধান তুলে তাদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিতাম এবং তাদের সারাবছরের খোরাকির জন্য তা যথেষ্ট ছিল। মাদ্রাসা/এতিমখানাও ওশরের ফসলে চলতো। আমাদের গ্রামে কদবানু নামে একজন মহিলা ছিলেন, পাশের গ্রামে তার বিয়ে হয়েছিল। তার কোনও সন্তান ছিল না, তার স্বামী ছিলেন উদ্ভ্রান্ত দরবেশ; সংসারের কোন খবর নিতেন না। খড়ম পায়ে গ্রামে গ্রামে হাঁটতেন। কদবানু খুবই বিপদগ্রস্ত ছিলেন। কদবানু যেহেতু আমাদের গ্রামের মেয়ে গ্রামের মুরুব্বীরা ঠিক করলেন কদবানুর সহযোগিতার দায়িত্ব গ্রামই নেবে, গ্রামের বাইরে কারুর কাছে তিনি হাত পাততে পারবেন না। আমৃত্যু তিনি এ সেবা পেয়েছেন। এখন দিন বদলেছে। আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে হারিয়ে ফেলছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের মতো শিক্ষিত ছিলেন না। তাদের ঈমানী চেতনা ছিল। তারা কোরআনের একাংশকে বিশ্বাস ও অপরাংশকে অবিশ্বাস করতেন না। আমরা যারা ঈমানদার বলে নিজেদের দাবী করি তারা কি সুদ হারামের কুরআনী নির্দেশ পালন করতে পারেনা?
আমার অগ্রজ প্রতীম ও মুরুব্বী সাবেক সচিব ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ শাহ আব্দুল হান্নান সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কর্জে হাসানার একটি বিস্মিত ইস্যু তুলে এনেছেন। কর্জে হাসানা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ইন্সট্রুমেন্ট। তার প্রবন্ধ থেকে আমি এখানে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
কোরআনের কয়েকটি আয়াতে ‘করজে হাসানা’র কথা বলা হয়েছে। করজে হাসানার অর্থ হচ্ছে এমন ঋণ বা করজ দেয়া যেটা সময়মতো পরিশোধ করা হবে; কিন্তু দাতা কোনো অতিরিক্তি অর্থ বা বেনিফিট নিতে পারবেন না। এর উদ্দেশ্য ছিল, সমাজের একটি প্রয়োজন পূর্ণ করা। সেটি হচ্ছে- ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরেও নানা কারণে মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের করজে হাসানার দরকার হতে পারে। সবসময় ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না। কিন্তু সম্ভাবনা থাকে যে, পরে তা থাকবে। এবং সেই অর্থ দিয়ে করজ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। সুদকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। ফলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে  সুদের ভিত্তিতে অর্থ নেয়া সম্ভব ছিল না বা উচিত নয়। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা করজে হাসানার নিয়ম করে দিয়েছেন; যেন মানুষ সাময়িকভাবে করজে হাসানা নিতে পারে সুদ ছাড়া এবং পরে তা দিয়ে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে করজে হাসানার বিষয়ে কুরআনের আয়াতগুলো দিচ্ছি : “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ‘করজে হাসানা’ দিতে প্রস্তুত, তাহা হইলে আল্লাহ তাহাকে কয়েক গুণ বেশি ফিরাইয়া দিবেন। হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত। আর তাহাদের নিকট তোমাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে (বাকারা-২৪৫)।
আল্লাহ বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্য থেকে বারোজন সর্দার নিযুক্ত করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি। যদি তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর, জাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় করজে হাসানা দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। অতঃপর, তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতভাবেই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে (আল মায়িদাহ-১২)।
কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম করজে হাসানা দেবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহু গুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার। (আল-হাদীদ-১১)। নিশ্চয় দানশীল ব্যক্তি ও দানশীল নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে করজে হাসানা দেয়, তাদের দেয়া হবে বহু গুণ এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার (আল-হাদীদ-১৮)। যদি তোমরা আল্লাহকে করজে হাসানা দান কর, তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, সহনশীল (আত-তাগাবুন-১৭)।
“আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি ইবাদতের জন্য দ-ায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দ-ায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব, তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হয়েছেন। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে নিয়োজিত হবে। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু আবৃত্তি করো। তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু (আল মুযযামমিল-২০)।”
কর্জে হাসানার ব্যবস্থাটি দুর্ভাগ্যবশত: বাংলাদেশে গৌণ হয়ে পড়েছে। তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসার ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম দেশসমূহের ফোরাম ‘ডিএইট’-এর সাথে আমি দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত ছিলাম এবং বাংলাদেশ সরকারের আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে সদস্য দেশগুলোর মাইক্রোক্রেডিট এবং দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত বিষয়গুলো অধ্যয়ন করার আমার সুযোগ হয়েছিল। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশরসহ প্রত্যেকটি দেশেই কর্জে হাসানা প্রথা ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। সুদের কারণে এসব দেশে মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাপকতা পায়নি। শ্রীলংকায় শরণদ্বীপ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মুসলমানরা আমানা নামে একটি ব্যাংক স্থাপন করেছে। ব্যাংকটি বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের RDS Program ও কর্জে হাসানার নীতিমালা অনুসরণ করে বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করেছে।  চীনের মুসলমানরাও বহু বছর কর্জে হাসানা পরিচালনা করে আসছেন।  বেইজিং শহরে কূটনেতিক জোনের সাথেই নভোটেল থেকে পায়ে হেঁটে ম্যাক ডোনাল্ডের দিকে পাঁচ মিনিট গেলেই তাদের একটি বিরাট ইসলামিক কমপ্লেক্স পাওয়া যাবে।  সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, শপিং সেন্টারের পাশাপাশি একটি ব্যাংকও আছে যেখানে সদস্যদের শুধু কর্জে হাসানা দেয়া হয়। ফিলিপাইনের ম্যানিলা, লসবেনস, মিন্দানাও এবং কালাম্বা শহরেও মুসলমানদের বেশ কিছু সমিতি আছে যেখানে সদস্যরা কর্জে হাসানার লেনদেন করেন।
ইসলাম সুদকে হারাম করেছে। সাথে সাথে তার বিকল্পও বাতলে দিয়েছে। আমাদের উচিত ঈমানকে রক্ষা করা এবং এই সুযোগ গ্রহণ করা।

Monday, July 8, 2019

নরেন্দ্র মোদিরা কি পারবেন কাশ্মীর হজম করতে?


আবদুল হাফিজ খসরু: দলের সভাপতি অমিত শাহকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমনি এমনি বানাননি নরেন্দ্র  মোদি। এরা দু’জনই দাঙ্গা কবলিত রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা। ২০০২ সালে আহমেদাবাদের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার অন্যতম প্রধান অভিযুক্তও এই দু’জন। এবারে বিজেপির নির্বাচনী এমন কিছু স্পর্শকাতর এজেন্ডা ছিল যা বাস্তবায়নে অমিত শাহর মত দলীয় প্রভাবশালী লোকটিকে লোকসভা ও মন্ত্রিসভায় দরকার ছিল  মোদির। যেমন মুসলিম নারীদের তিন তালাক আইন বিলুপ্তি, কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন ধারা বিলোপ, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক পুঞ্জি (এনআরসি) তৈরি করে বাংলাদেশের উপর শরণার্থী চাপ সৃষ্টি, অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ, কংগ্রেসের মতো বৃহৎ দলকে নির্বাচনে কারচুপি করে হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতার বাইরে রাখার মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন প্রভৃতি।
ইসরাইলের কাছে নরেন্দ্র  মোদি ও তার দল দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইসরাইলের নির্বাচনী প্রচারণার একটি ছবি দেখলাম। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মেক্রনের মত বিশ্বনেতাদের পাসাপাশি নরেন্দ্র  মোদির ছবিও শোভা পাচ্ছে তেলআবিবের রাস্তা-ঘাটে। ইহুদীবাদী ইসরাইল ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের এই সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই চাক্ষুষ প্রমাণ।  মোদির এই দুঃসাহসের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি লবি।
গত ৫ আগস্ট লোকসভায় ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল ২০১৯’ পাসের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেল ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (এ) ধারা। বিলুপ্তি ঘটলো কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা। আরো বিলুপ্তি ঘটলো কাশ্মীরের ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত থাকার শর্তও। এজন্যই নরেন্দ্র  মোদিরা সেখানে সেনাসংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি করলেন। যাতে বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরি জনগণ তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করতে না পারে।
স্বাধীন কাশ্মীর রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করেছিল ১৯৪৯ সালের ২৭ মে কাশ্মীরি গণপরিষদে পাস হওয়া একটি বিলের মাধ্যমে। প্রস্তাব পেশ করার সময় বলা হয়েছিল যদিও ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও ভারতের তরফ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে যে পরিস্থিতি তৈরি হলে গণভোট নেওয়া হবে এবং গণভোটে ভারতভুক্তি যদি গৃহীত না হয়, তাহলে “আমরা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করবো না।” এই বিলটি একই বছরের ১৭ অক্টোবর ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় সংযোজিত হয়। এই ধারা বলে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ছাড়া সর্বময় ক্ষমতা কাশ্মীরিদের দেয়া হয়। অলিখিত চুক্তি ছিল, যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হলে, দু’ পক্ষই নিজেদের পূর্বতন অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে।
কিন্তু কাশ্মীরে আর গণভোটও হয় না, সাত লক্ষ ভারতীয় সেনাও অপসারণ করা হয় না। সর্বশেষ দু’দিন আগে কাশ্মীর হারালো তার স্বায়ত্বশাসন। ভারত পূর্ণ করলো তার দখলের ষোলকলা। এই জনপদের কতিপয় নেতার টালবাহানার কারণে সোয়া কোটি কাশ্মীরী জনগণের জীবনে নেমে এলো সাময়িক অন্ধকার। নরেন্দ্র  মোদিদের প্লান হলো, কাশ্মীরে এখন জনমিতি যুদ্ধ পরিচালিত করবে। সারা ভারতের হিন্দুত্ববাদী লোকজন দিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করাবে এবং মুসলমানদের সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে। ইসরাইল প্রথমদিকে যেভাবে ফিলিস্তিনীদের ভূমি ক্রয় করে বহিরাগত ইহুদীদের পুনর্বাসন শুরু করেছিল। ঠিক সেভাবেই ভারতীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো কাশ্মীরের ভূমি ক্রয় করাবে এবং একপর্যায়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর বানাবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (এ) ধারা বলে এতদিন কাশ্মীরে যা কেউ পারতো না।
নরেন্দ্র  মোদিকে এইভাবে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে হলে জাতীয় অর্থনীতির বিশাল একটি অংশ এখন কাশ্মীরের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। কাশ্মীর ফ্রন্টে অবস্থিত প্রায় দশ লক্ষ সেনা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের বিশাল ব্যয়ভার বহন উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশটির অগ্রগতি নিশ্চিত বাধাগ্রস্থ করবে। লক্ষাধিক কাশ্মীরি ইতিমধ্যে জীবন দিয়েছেন। অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করা তাদের নিকট এখন স্বাভাবিক বিষয়। যে জাতি তাদের শহীদদের জন্য কবর প্রস্তুত রাখে, যে প্রজন্ম আযাদীর স্লোগান দিতে দিতে বড় হয় তাদেরকে দমানো যায় না। কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর সাথে এখন যোগ দিবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোও। যারা এতদিন রাজনৈতিকভাবে সমাধান চাইতো তারাও সশস্ত্র হতে বাধ্য হবে। অনেক বেশী বিক্ষিপ্ত, চোরাগুপ্তা ও গেরিলা আক্রমণের শিকার হতে হবে ভারতীয় বাহিনীকে। শুধু কাশ্মীরে নয় সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ধরণের চোরাগুপ্তা হামলা। বিমান ছিনতাই, রাজনৈতিক নেতাদের গুমের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যের ৫টিই এখন খৃস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ। এগুলোও কাশ্মীরের মত এতদিন বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। কাশ্মীরের এই ঘটনার পর রাজ্যগুলোর অস্বস্তি আরো বাড়বে। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলো আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের শ্যোন দৃষ্টি রাজ্যগুলোর উপর। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের রাজ্যগুলোকে নিয়ে পৃথক স্বাধীন খৃস্টান রাষ্ট্র গড়ার মেকানিজম এগিয়ে রেখেছে তারা। এছাড়াও নরেন্দ্র  মোদিকে আরো সামাল দিতে হবে অন্যান্য রাজ্যের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র মাওবাদী, দলিত ও শিখ সংগঠনগুলোকে।
নরেন্দ্র  মোদি জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুতে কথাবার্তা হয়তো আটকাতে পারবেন। ওআইসির কাগুজে বাঘের হুংকারকে হয়তোবা সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু চিরশত্রু চীন ও পাকিস্তানকে কিভাবে নিবৃত্ত করবেন? যেখানে চীনের শ্যোন দৃষ্টি পড়ে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনের উপর। ইতিমধ্যে দু-দু’টি যুদ্ধে তারা জড়িয়েছে! মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ অনেকগুলো মুসলিম দেশে রয়েছে ভারতের প্রায় এক কোটি শ্রমিক। যাদের রেমিটেন্সে ভারতের অর্থনীতির চাকা ঘুরে। নরেন্দ্র  মোদি কি মনে করছেন, এসব মুসলিম দেশের সুবিধাবাদ সরকারগুলো সবসময়েই তার পাশে থাকবে? নরেন্দ্র  মোদিরা কী পারবেন ভারতীয় আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে সৃষ্ট তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাধারণ জনগণের তীব্র ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতে?
যদি মনে করা হয় যে, ইসরাইল ফিলিস্তিনে নিপীড়ন চালিয়ে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে-সদম্ভে টিকে আছে তো তারাও কাশ্মীরে তা পারবেন, তাহলে নিশ্চিত ভুল করবেন। ইসরাইল একই সাথে অনেকগুলো ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম। তাদের সেই সক্ষমতা আছে। তারা অস্ত্র বানায় ও রপ্তানি করে। স্বয়ং ভারতের সাথে ঘনিষ্টতার মূলে রয়ে ইসরাইলী অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায়। ভারতকে অস্থীতিশীল করে রাখতে পারলে মার্কিন-ইসরাইলের অস্ত্র ব্যবসায় চাঙ্গা থাকবে। মার্কিন রাজনীতির শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ইসরাইলী লবিস্টগ্রুপ। মার্কিন বিশাল নৌবহর তাদের রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুুত থাকে। আশে পাশের মুসলিম দেশগুলোর দালাল শাসকদের সে হাত করে নিতে পেরেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব নেই, যা সামাল দিয়ে তাকে বহি:শত্রু মোকাবেলা করতে হবে। এরপরও হামাস ও হিজবুল্লাহর মত ছোট ছোট কিছু গেরিলা বাহিনীর কাছে নিয়মিতই নাকানি চুবানি খেতে হয় ইসরাইলকে।
ইসরাইলের সক্ষমতার ধারে কাছেও নেই নরেন্দ্র  মোদির ভারতের। নিম্নমানের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের বিশাল সংখ্যক সেনা দিয়ে ইসরাইলী স্টাইলে কাশ্মীর দখলে রাখার দু:স্বপ্ন দেখছেন  মোদি! দীর্ঘদিন কাশ্মীরকে দখলে রাখা ভারতের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। যেমন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মার্কিনীদের আফগানিস্তানে টিকে থাকা।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

চীন ও ভারতের সম্পর্ক এবং পাকিস্তান



আশিকুল হামিদ : আজকের নিবন্ধে এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে। কারণ, শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য পরিচিত দেশ দু’টির সামনে নতুন এক প্রতিবন্ধক তৈরি হয়েছে। সে প্রতিবন্ধক এরই মধ্যে প্রাধান্যেও এসে গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে বলার আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্পর্কে বলা দরকার। এর প্রথম কারণ, এই সময়ে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা চলছে আর সাবেক ক্রিকেটার হিসাবে ইমরান খানের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও সুখ্যাতি রয়েছে। বহু রসাত্মক গালগল্পের নায়কও তিনি। বড়কথা, ‘শত্রু রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও ভারতে এখনো তার জনপ্রিয়তা কম নয়। অনেক ভারতীয়র সঙ্গেই ইমরান খানের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইলেই তিনি অন্য পাকিস্তানী সরকার প্রধানদের মতো অন্ধ ভারতবিদ্বেষী হতে পারবেন না।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, ইমরান খান আসলেও ভারতবিদ্বেষী হতে চাননি। তিনি বরং প্রথম বিদেশী সরকার প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরই সূত্র ধরে ধারণা করা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইমরান খানকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। আশপাশের সব দেশের, এমনকি মরিশাস ও কিরগিস্তানের সরকার প্রধানদের পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিস্ময়করভাবে বাদ পড়েছেন ইমরান খান। এর কারণ হিসেবে পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হামলাকেন্দ্রিক যুদ্ধমুখী উত্তেজনার পাশাপশি পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের আগে ইমরান খানের বিভিন্ন বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচনী  প্রচারণা চালানোর সময় দেয়া প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মোদি’ নয়, ‘নরেন্দ্র মোডি’ বলেছেন এবং তুমি তথা ‘তুম’ ও ‘তুমহারা’ বলে এমনভাবে তুলোধুনো করেছেন, যা শুনে মনে হয়নি যে, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলে দু’দেশের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কে আদৌ কোনো শুভ পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনের পরে ইমরান খান অবশ্য কিছুটা হলেও কথা ও সুর পাল্টেছিলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে আলোচনা ও বন্ধুত্বের কথাও বলেছেন।
ইমরান খান কিন্তু তাই বলে কাশ্মীর প্রশ্নে ইঞ্চি পরিমাণও সরে আসেননি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময়ও প্রকারান্তরে ভারতকে তিনি হুমকিই দিয়েছেন। চীন যে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে এবং যে কোনো যুদ্ধ বা সংকটে পাকিস্তানের পাশেই থাকবে- সে কথাটা যথেষ্ট জোর দিয়েই ভারতকে শুনিয়েছেন তিনি। এসব কারণের পাশাপাশি অতি সম্প্রতি আবারও যুক্ত হয়েছে কাশ্মীর সমস্যার প্রশ্ন। ক’দিন আগে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় ইমরান খান কাশ্মীরকে ভারতের দখলমুক্ত করার ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন। এর ফলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই দূরত্ব এমন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে- যখন দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র গণচীন ও ভারতের মধ্যে তিক্ততার নতুন এক প্রতিবন্ধক নিয়ে শান্তিকামী বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক সমরাস্ত্র রয়েছে বলেও দেশ দু’টির সম্পর্কে অবনতি ঘটলে আশংকার সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রতিবন্ধক তথা তিক্ততার সর্বশেষ কারণ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, চীন বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। চীন সেই সাথে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং যথেষ্ট প্রশস্ত টানেল বা খালও খনন করে চলেছে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাবে তার জিন জিয়াং প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি ভারত আর আগের মতো পাবে না। পানির প্রায় সবটুকুই বরং চলে যাবে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাঁধটি সম্পূর্ণরূপে চালু হলে আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর কৃষি ও চাষাবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এসব রাজ্য সেচের জন্য প্রধানত ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর নির্ভরশীল।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বিবৃতিতে বলেছে, চীনের তৈরি বাঁধের কারণে বিশেষ করে কৃষিনির্ভর আসাম সর্বনাশের মুখে পড়বে। পানির সংকটে পুরো রাজ্যই স্বল্প সময়ের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। আসামের পাশাপাশি ভারতের ভবিষ্যতও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে বলেও সাবধান করে দিয়েছে দলগুলো। তারা সেই সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘শত্রু প্রতিবেশি’ চীনের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক করে সমাধান বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে দাবি জানিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এমনকি বিজেপির অনেক নেতাও। এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ব্রহ্মপুত্রের উৎস তিব্বতে এবং চীনে এর নাম সাংপো। ভারত রয়েছে চীনের নিচের দিকে, যেমনটি বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের ‘ভাটিতে’। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী সাংপো বা ব্রহ্মপুত্রের পানি ভাটির তথা নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলেই ভারত এতদিন নদটির পানি পেয়ে এসেছেÑ যেভাবে বাংলাদেশ এক সময় পেতো ভারত থেকে নেমে আসা গঙ্গা এবং অন্য ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি। সব নদ-নদীর পানিই ভারতের পর বাংলাদেশ হয়ে গিয়ে পড়তো বঙ্গোপসাগরে।
অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে ফারাক্কা, গজলডোবা ও টিপাইমুখসহ ভারতের নির্মিত অসংখ্য ছোট-বড় বাঁধের কারণে। পানির তীব্র অভাবে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে এখন মরুকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাঁধের ভয়ংকর কুফল সম্পর্কে নিজেরা জানেন বলেই চীনের বাঁধ ও এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ভারতের সকল দলের নেতারা। খবরে জানা গেছে, ‘চীনপন্থি’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিÑ সিপিআইএমও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চীনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার দাবি জানিয়েছেন। এটাই অবশ্য যে কোনো দেশের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য- যার ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে দেখা যায়।
ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে চীন ও ভারতের তিক্ততা কোনদিকে কতটা গড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হলেও জানিয়ে রাখা দরকার, দেশ দুটির সম্পর্ক কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। চীন ও ভারত ১৯৬২ সালে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়েও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তিক্ততার অবসান ঘটাতে পারেননি। কাশ্মীর প্রশ্নে চীন পাকিস্তানের পক্ষে ভ’মিকা পাল করে চলেছে। চীন এখনো ভারতের রাজ্য অরুণাচলকে নিজের ভ’খন্ড বলে মনে করে। এর বাইরেও দীর্ঘ সীমান্তের অসংখ্য এলাকায় দেশ দুটির সেনারা মাঝে-মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। গত বছর ২০১৮ সালের প্রথম দিকেও ডোকলাম সীমান্তে ছোটখাটো যুদ্ধ করেছে চীন ও ভারত। ওই এলাকায় এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি।
এভাবেই এগিয়ে চলেছে চীন ও ভারতের অবন্ধুসুলভ তথা শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে দু’ দেশের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়ে দু’ দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ভুটান সংলগ্ন ভূখন্ড ডোকলামের মালিকানা নিয়ে তীব্র উত্তেজনাকর ও সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে ভারত ওই সময় হঠাৎ ৯৩টি চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক তথা অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছিল। এর ফলে ভারতে চীনের রফতানিই কেবল অনেক কমে যায়নি, বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাও সৃষ্টি হয়েছিল।
নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারত সরকার অভিযোগ করেছিল, দেশটির বাজারে বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চীন নাকি তার উৎপাদন খরচের চাইতেও কম মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। এর ফলে একদিকে ভারতে চীনা পণ্যের বিক্রি বাড়ছে অন্যদিকে ক্রমাগত কমছে ভারতীয় পণ্যের বিক্রি। এভাবে ভারতের দেশীয় পণ্য মার খাচ্ছে এবং ক্ষতি স্বীকার করতে গিয়ে অনেক শিল্প-কারখানা এমনকি বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে মোবাইল ফোনের মতো বেশি প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি ইস্পাতের তৈরি ভারি অনেক পণ্যও রয়েছে। মূলত দেশীয় পণ্যকে নিরাপত্তা দেয়ার অজুহাত দেখিয়ে অতীতেও ভারত চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে দেখেছে। কিন্তু পরিস্থিতিতে উন্নতি হয়নি। সে কারণেই ৯৩টি পণ্যের ওপর নতুন করে এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার।
অন্যদিকে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারতকে ‘ভয়াবহ কুফল’ ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করেছিল চীন। দেশটির কমিউনিস্ট সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের এ ধরনের ‘দুর্বল সিদ্ধান্তের জন্য’ চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ সাময়িকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সত্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ কুফল ভোগ করার জন্য ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। চীনা পণ্যের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক ও শত্রুতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার চীনা কোম্পানিগুলোকে ভারতে বিনিয়োগ করার এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর আগে ‘দ্বিতীয়বার’ ভেবে দেখার এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। এর ফলে ধারণা করা হয়েছিল, এককেন্দ্রিক কঠোর কমিউনিস্ট সরকারের অধীনস্ত বলে চীনের কোনো কোম্পানির পক্ষেই সরকারকে পাশ কাটিয়ে ভারতে বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা উৎপাদনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তেমন অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাবে ভারতে উৎপাদনকাজে নিয়োজিত অসংখ্য চীনা শিল্প-কারখানা এবং চাকরি হারাবে হাজার হাজার ভারতীয় শ্রমিক। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর। শুল্কবিরোধী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এ বিষয়টিকেই চীন সামনে নিয়ে এসেছিল।
দেশ দু’টির অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডোকলামকেন্দ্রিক সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। কারণ, চীনে ভারতের রফতানি কমেছিল ১২ দশমিক তিন শতাংশ তথা এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য হলো, রফতানি কমলেও একই সময়ে চীন থেকে ভারতের আমদানি বেড়েছিল প্রায় দুই শতাংশÑ মার্কিন মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার। অর্থাৎ একদিকে ভারতের আয় কমেছে এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার, অন্যদিকে কমার পরিবর্তে উল্টো চীনের আয় বেড়েছে পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার!
জানা গেছে, এমনিতেই ভারতের তুলনায় চীন চার হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করে থাকে। এমন অবস্থায় ভারত শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করলে এবং সিদ্ধান্তটি বজায় রাখলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে কমিউনিস্ট দেশটিকে। জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন যদি ভারতে চীনা কোম্পানিগুলোর শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং চীনের শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা যদি ভারতে আর বিনিয়োগ না করেন তাহলে ভারতীয় শ্রমিকরা তো চাকরি হারাবেই, অন্য অনেকভাবেও ভারতকে যথেষ্ট পরিমাণে খেসারত দিতে হবে।
এজন্যই ডোকলামের দখল ও মালিকানাকেন্দ্রিক সংকটের ঘটনাপ্রবাহে ভারতের প্রতি সংযম দেখানোর আহবান এসেছিল বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। ভারতে আশ্রিত চীনের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে চীনা বৌদ্ধদের আরো বেশি সংখ্যায় তীর্থে আসার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে ভারতের উচিত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, শান্তি বজায় রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো। যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও ভারতের কেউই জিততে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন দালাইলামা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই বিরাট প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ডোকলামের দখল ও মালিকানা নিয়ে সৃষ্ট সংকট সকল বিচারেই অত্যন্ত আশংকাজনক। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলেও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কামনা করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও চায় চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাতে সংঘাতমুখী না হয়। এশিয়ার এ অঞ্চলের জন্য তো বটেই, বিশ্বশান্তির জন্যও চীন ও ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া ও বন্ধুত্বপূর্ণ থাকা দরকার।
এ প্রসঙ্গেই ব্রহ্মপুত্রের ওপর চীনের নির্মিত বিশাল বাঁধ এবং জিন জিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলকেন্দ্রিক সমস্যাকে সামনে আনা দরকার। বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে বৈঠকে বসারও আগে ভারতের উচিত বাংলাদেশকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়া। তেমন অবস্থায়ই ভারত চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার আশা করতে পারে। এখন দেখা দরকার, ভারত ঠিক কোন পথে পা বাড়ায় এবং চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ সত্যিই স্থায়ী প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে কি না! বলা দরকার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারতেন। তেমন সদিচ্ছার প্রকাশও তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে ঘটিয়েছেন। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অসম্মানিত করেছে। একই কারণে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য বিরোধ ও সংঘাতে ভারত অন্তত পাকিস্তানের সহযোগিতা পাবে না বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।

প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির হত্যাকাণ্ড ও একটি বিভ্রান্তি



ড. মো. নূরুল আমিন : ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতি বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলন ও দল মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান, মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি তার জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের জবাব দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে খাঁচার মধ্যে পড়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ২০ মিনিট পর্যন্ত তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। আদালত তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনও ডাক্তারও ডাকেনি। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তার এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, তার এই মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহান নেতার অকাল মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শাহাদাতের মৃত্যু। জেলখানায় সরকারি নির্যাতন উপেক্ষা ও অবহেলায় ছয় বছরে তিনি এতই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, জালেমের কারাগারে জালেম নির্মিত কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, ঠাণ্ডা মাথায় খুন। এই খুনের সাথে মিশরের সামরিক শাসক জেনারেল সিসিও তার সহযোগী কর্মকর্তাবৃন্দ, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতালিপ্সু শাসকরা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলামী বিদ্বেষী ইহুদিবান্ধব শক্তি ও রাষ্ট্রসমূহ যৌথভাবে জড়িত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর বেশির ভাগ মিশরের গণতান্ত্রিক ও ইসলামী পুনরুত্থানে শংকিত ছিল। তারা মুরসি হত্যাকাণ্ড ও ইখওয়ান ধ্বংসে সিসিকে সহায়তা করেছে বলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। ড. মুরসি বহু প্রতিভার অধিকারী একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। মিশরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রথিতযশা প্রকৌশলী, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী উঁচুমানের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কুরআনে হাফেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান। রাজনীতির কথা বাদ দিলেও তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, ইসলামী ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত মননশীল একজন ব্যক্তি। কারাগারে তার প্রতি আচরণ ছিল নিকৃষ্ট ও অমানবিক। তাকে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কুরআন ছিল তার প্রাণ। কুরআনী বিধান বাস্তবায়ন ছিল তার জীবনের লক্ষ্যমাত্রা। কারাগারে তিনি জালেমদের কাছে এক জিলদ কুরআন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি তাদের কাছে কারাগারে একটা কুরআন চেয়েছিলাম, তারা দেয়নি। কিন্তু ওরা জানেনা ৪০ বছর আগে আমি কুরআন মুখস্ত করেছি। কুরআনকে ছু’তে চেয়েছিলাম,” একজন মুমিনের জীবনে এই ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক।

ড. মুরসি ডায়াবেটিস এবং লিভার ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এই উভয় রোগের চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং সময়ে সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া তার মৌলিক অধিকারের অপরিহার্য অংশ ছিল। জেলখানায় তাকে চিকিৎসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার রক্তের সুগার লেবেল কমে যাওয়ায় তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হলে তিনি হয়তো এভাবে মারা যেতেন না। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের নেতা হিসেবে মিশরের অবৈধ সরকার ড. মুরসির প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো তো দূরের কথা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও সামান্যতম সম্মান প্রদর্শন করেননি। অবশ্য মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লংঘন এবং গণহত্যায় পটু জেনারেল সিসির সরকারের কাছে এই দয়া, মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ আশা করাও বৃথা। মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর যেতে না যেতেই দেশটির সামরিক প্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালে রক্তাক্ত মিলিটারী ক্যুর মাধ্যমে ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ক্যুতে তার গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে প্রমাণিত হয় এবং তিনি গণহত্যার জন্য এক নির্মম কসাইয়ের খেতাব পান। তার নির্দেশে মিশরীয় সৈন্যরা ২০১৩ সালের ১৪ই আগস্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে একই দিন ১৫০০ লোককে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে যারা বেঁচেছিলেন তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানে তাদের সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। এখানেই শেষ নয়, ইখওয়ানুল মুসলেমিনকে বেআইনি ঘোষণা করে তাদের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেফতাকৃতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তার সৃষ্ট ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের জেল জরিমানা এবং ফাঁসির শাস্তি দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যের সরকারগুলো এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তারা নব্য এই ফেরাউনের এই নির্মম অমানবিকতার কোনও প্রতিবাদ করেনি বরং ইসরাইলের ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ইসলাম নির্মূলের হাতিয়ার হিসাবে সিসিকে ব্যবহার করেছে। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের গদীকে হুমকিমুক্ত করার জন্য মিশরের গণতান্ত্রিক উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য সিসিকে সহযোগিতা করেছে। এমনও শোনা গেছে যে, পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের একজন বাদশাহ স্বয়ং কায়রো বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত বিমানে কোটি কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বিমান থেকে নামেননি, আল সিসি বিমানে উঠে তাকে সালাম জানিয়ে এই তোহফা গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ইসলাম বিদ্বেষী শাসক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ইসরাইলকে নিয়ে মিশরের এই অবৈধ স্বৈরশাসককে শুধু উৎসাহিত করেনি বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকেও নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তারা ড. মুরসি ও তার দলের উপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে সিসিকে বাহবা দিচ্ছিলেন। ড. মুরসি কারাগারে কিভাবে আছেন তা দেখা ও জানার কারুরই সুযোগ ছিল না। তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দল কাউকেই তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে ড. মুরসির পরিবারের অনুরোধে বৃটিশ হাউজ অব কমন্স এর ফরেন এফেয়ার্স সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির একজন সাবেক সভাপতি ও এমপি জনাব ত্রিসপিন ব্লান্ট মিশর সফর এবং জেলখানায় ড. মুরসির অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে রাজি হন। জনাব ব্লান্ট মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে এই সফর করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির অবস্থা অবহিত হয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী সিসি প্রশাসন ড. মুরসির প্রতি এতই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিলেন যে, প্রায় ছয় বছরে মাত্র তিনবার তারা ড. মুরসির পরিবারকে তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল।
ব্লান্ট রিপোর্টে কয়েকটি মর্মান্তিক বিষয় উঠে আসে। ড. মুরসি ডায়াবেটিস ও লিভার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ মিশরীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি এই সেবা পাওয়ার যোগ্য। সেখানে তার চলাফেরা বা হাঁটা, ব্যায়ামেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। জেলকোড অনুযায়ী তিনি ভিআইপি মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তাকে সাধারণ কয়েদি হিসাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার ২৩ ঘণ্টাই তিনি অন্ধকারে থাকতেন, মাত্র এক ঘণ্টা আলোর মুখ দেখতেন। তাকে প্রদত্ত খাবারের মান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি খেতে পারতেন না। তিনি নিয়মিত অজু, গোসলের পানি পেতেন না। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা ও ওষুধ পথ্যের অভাবে তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছিল এবং তিনি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলেন। জনাব ব্লান্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে ড. মুরসি শীঘ্রই মৃত্যুবরণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। এটা মৃত্যু নয়, ঠাণ্ডা মাথায় খুন, নরহত্যা। বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা এই রিপোর্টের উপর তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি, কেন নেননি তা সবাই জানেন। তার মৃত্যু শহীদি মৃত্যু, আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করুন, তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন। আমরা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত কামনা করি।
ড. মুরসির শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামিক বিশ্ব একজন মহান নেতাকে হারালো। তার জীবন ও সংগ্রাম এবং ইসলামের জন্য ত্যাগ যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফ্যাসিষ্ট ও মিলিটারী ডিক্টেটার আল সিসির অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল ও ড. মুরসির ইসলামী সরকারের পতনকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের পতন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করছেন যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্তব্য ও বিশ্বাসটি সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র সফল হয়েছে। জনগণ নানা প্ররোচনার মুখেও বিপুল ভোটে ড. মুরসিকে জয়ী করে ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সা, ফ্যাসিবাদ, ইহুদী, খৃস্টান শক্তির ইসলাম বৈরিতা এবং প্রতিবেশী অগণতান্ত্রিক শক্তির মিথস্ক্রিয়ায় ড. মুরসিকে সরে যেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতার মোকাবিলা করতে হবে। দাওয়াত ও তরবিয়ত ব্যক্তি ও দলীয় চরিত্রকে পবিত্র ও সংহত করার জন্য তো থাকবেই। এখানে বিভ্রান্তির অথবা হতাশার কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-১



ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : গণমানুষের গণজোয়ার দেশ-বিদেশে অনেক দেখেছি । কিন্তু মিশরের শহিদ মুরসির মত এমন গণজোয়ার মনে হয় আর কোথাও দেখিনি । সেটা ছিল দীর্ঘ ৩০ বছরের কুখ্যাত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিশরের গণমানুষের অগ্রণী মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম ড. মোহাম্মদ মুরসির সফল সংগ্রামী মিছিলের গণজোয়ার । বিশ্ব কাঁপানো সেই মিছিল ছিল মিশরের চরম বিরক্তিকর স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে সাধারণ গণমানুষের ন্যায্য অধিকারের মিছিল । সেই মিছিল ছিল শোষণ, নিপীড়ন, জুলুম, অত্যাচার আর বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে । সেই মিছিল ছিল ঐতিহ্যবাহী মিশরের মুসলমানদের প্রাণের আদর্শ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মিছিল । সেই মিছিল ছিল আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর আইন কায়েমের বলিষ্ঠ স্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবারের’ মিছিল । তাই সেদিন ২০১২ সালে মিশরের লক্ষ-কোটি গণমানুষের প্রাণের নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন । কুখ্যাত স্বৈরশাসক হোসনী মুবারকের পতন হয়েছিল । মিশরের গণমানুষের সেদিনের মুক্তি ছিল স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসীর স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন । স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের বিজয় ছিল শান্তিকামী বিশ্ববাসীর অনিবার্য দাবী । তাই ড. মোহাম্মদ মুরসি সেদিনই বিশ্বজাহানের হৃদয়ের সেরা নেতা হয়ে গেলেন । সারা বিশ্বে ড. মোহাম্মদ মুরসির অগ্রযাত্রা কামনা করছিল ।

উল্লেখ্য যে,বিশ্বব্যাপী মহা আতংক এই মিশরের মানবতাবিরোধী কুখ্যাত স্বৈরশাসন । যুগ যুগ ধরে যারাই অত্যাচারী এই জালিমশাহীর বিরোধিতা করতে গিয়েছে তাদেরকেই স্বৈরাচারীর যাতাকলে নিস্পিষ্ট হতে হয়েছে । বিভিন্নভাবে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের অত্যাচার করা হয়েছে । অগণিত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের জেল জুলুম বা ফাঁসী দিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার সব অ¯্র ব্যবহার করা হয়েছে । কারাগারই নয় শুধু, পুরা মিশরই ব্রাদারহুডের নেতা কর্মী তথা গণ মানুষের কারাগারে পরিণত করা হয়েছে । হাসানুল বান্না,সাইয়েদ কুতুবদের মত অসংখ্য আল্লাহর শ্রেষ্ট মুজাহিদদেরকে সেখানে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয় । মিশরের সবুজ শান্ত ভ’মিতে লাল রক্তের জোয়ার বহানো হয় । ড. মোহাম্মদ মুরসির এ বিজয় হল ঐ সব ফাঁসি, জেল, জুলুম আর অত্যাচারের ফসল । বিজয়ী মিশর গণতান্ত্রিক বিশ্বে রূপ নিল বিজয় উল্লাস, ইসলামপ্রিয় বিশ্ববাসীর জন্য হয়ে উঠল মাইলফলক ,অন্য সবার জন্য হল প্রেরণার উৎস ।

 কিন্তু যারা মানবতা আর গণতন্ত্রের শত্রু আধিপত্যবাদী সেই সব পশ্চিমা দুষমণেরা মুরসির এ মহা বিজয়কে সামনে বাড়তে দিল না । অভিশপ্ত ইসরাইল চরম ক্ষিপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয়কে নির্মূলে টার্গেট নিল । ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে নিক্ষেপ করে মিশরের সেনাবাহিনী । নেতৃত্ব দিল প্রেসিডেন্ট মুরসির নিয়োগপ্রাপ্ত তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি । পশ্চিমাবিশ্বের মোড়লদের সহায়তায় প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড, মুরসিকে । মিথ্যা এক মামলা চাপিয়ে দিয়ে সেখানে বলা হয় মিশরের মধ্যে বিদেশের সন্ত্রাসীদের দিয়ে আক্রমণের ষড়যন্ত্রের গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান নায়ক প্রেসিডেন্ট মুরসি । তাই আসামী করা হয় মুরসি এবং তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের । সেই প্রহসনমূলক বিচারে অন্যায় স্বিদ্ধান্ত নেয়া হয় । বিচারে দেশোদ্রেীহিতার আসামী ঘোষণা দিয়ে মুরসিকে এক পর্যায়ে মৃত্যদন্ড দেয়া হয় । পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ বাতিল করে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় । বিশ্বনেতা ড. মোহাম্মদ মুরসিকে সেই থেকে কারাভ্যন্তরে সীমাহীন অবহেলা, অত্যাচার, হুমকী, মানসিক যাতনা ইত্যাদিতে আতংকিত করে ফেলে । তার ছেলে মেয়ে এবং পরিবারের অন্যান্যদের উপরও চালানো হয় সীমাহীন অত্যাচার । দলের নেতা কর্মীদের উপর কারাগারের ভিতর ও বাহিরে চলতে থাকে জেল জুলুমসহ অকথ্য রকমের নির্যাতন । এতোসব যন্ত্রণার ভারেই গত ১৭ই জুন ২০১৯ইং সাল মিশরের একটি আদালতে বক্তব্য দিবার সময় মহান এই নেতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়,‘আদালতের এজলাসে হঠাৎ পড়ে গিয়ে’ তার মৃত্যু হয় । গত ৭ ই মে মুরসি বলেছিলেন,তার জীবন হুমকীর মুখে।
সামরিক অভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত মিশরের ইতিহাসের প্রথম নির্বচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির লাশ কঠোর গোপনীয়তায় ১৮ ই জুন ভোরে কায়রোতে সরকারের লোক দিয়ে কড়া নিরাপত্তার সাথে দাফন করা হয় । এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে সারকিয়া প্রদেশের নিজ শহরে তার দাফনের অনুরোধ জানালে সরকার তা দেয় নি । তবে কায়রোর নসর এলাকায় গোপণীয় ওই দাফনে মুরসির পরিবারের সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হয় ।
মুরসির এ মৃত্যু বিশ্ববাসী মেনে নিতে পারছে না । সারা বিশ্ব মুরসির এমন নির্মম মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও শোকবার্তা জানাচ্ছে । তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন ,জালিমের কারাগারে শহিদ হয়েছেন মুরসি । কারাগারে নিক্ষেপ করে যারা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই জালিমদের ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না । আমাদের চোখে মুরসি একজন শহিদ । তিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছেন । ইতিহাস একনায়ক সেই জেনারেল সিসিকে ক্ষমা করবে না ,যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার যাবতীয় চক্রান্ত করা হয়েছিল । আদালতে নিজের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন তিনি । মিশরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা স্মরণ রাখবে । আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের শহিদ ভাইদের জন্য রহমত কামনা করছি । মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন । কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি । জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছে । তার দেয়া মৃত্যু দন্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা সব সময়ই নিরব থেকেছে ।
মিশরের জালিম শাসক হয়তো গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের অত্যাচার করে সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে । কিন্তু তাদের ত্যাগ - ইতিহাস মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না।
মিশরের ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এক বিবৃতিতে বলে,মুরসিকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে । চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি । দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে দেয়া হয়েছে । মৌলিক মানবাধিকারের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । আর এতে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে । হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মুরসির মৃত্যুতে বলেছে, তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । তার মৃত্যু ও আটকাদেশ নিয়ে একটি পূর্ণাংগ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ রিপোর্ট তৈরী করতে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আহবান জানিয়েছে । [চলবে]

গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-২



ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : [দুই]

কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার নিজের ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে শোক জানিয়ে বলেন,‘মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির হঠাৎ মৃত্যুর খবর পেয়ে মর্মাহত হয়েছি। তার পরিবার ও মিশরবাসীর জন্য সমবেদনা জানাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মকবুল আহমাদ ও সেক্রেটারি ড: শফিকুর রহমান গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন,মিশরের ইতিহাসে প্রথমবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিশরের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি দেশের একটি আদালতের এজলাসে রহস্যজনকভাবে ইন্তিকাল করার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তার রহস্যজনকভাবে ইন্তিকালে আমরা একজন স্বজন হারানোর গভীর বেদনা অনুভব করছি। ড. মুরসির রহস্যজনকভাবে ইন্তিকালে গোটা মুসলিম উম্মাহ গভীরভাবে শোকাভিভুত ও মর্মাহত। মিশরের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ড: মুরসিকে ২০১৩ সালে জে: আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি অবৈধভাবে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে প্রায় ৬ টি বছর অবৈধভাবে কারাগারে আটক রেখে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। সেই থেকেই মিশরের জনগণ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের উপর চলছে হত্যা,জুলুম, নির্যাতন । এছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছে । জে: সিসি মিশর থেকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও ন্যায় বিচার নির্বাসনে পাঠিয়ে গোটা দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে । সেখানে কারোর জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই । জে: সিসি সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ড: মুরসি আদালতের এজলাসে রহস্যজনকভাবে ইন্তিকাল করেছেন । এ ঘটনা মিশর সরকারের জুলুম নির্যাতনের জ্বলন্ত উদাহরণ । তারা বলেন, ইসলামী আদর্শ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তার এ আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও সকল মুক্তিকামী জনতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে । তারা আরো বলেন,আল্লাহ তায়ালা ড: মুরসির জীবনের সকল নেক আমল কবুল করে তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান করুন । আমরা তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজন,দলীয় সহকর্মী ও মিশরের শোক সন্তপ্ত জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে দোয়া করছি । আল্লাহ তাদের এ শোক সহ্য করার তৌফিক দান করুন ।
ড: মোহাম্মদ মুরসির ইন্তিকালে ছাত্রশিবিরের শোক: মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসির ইন্তিকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ও তাঁর শাহাদাতের কবুলিয়াতের জন্য সবাইকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির । যৌথ শোক বার্তায় ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন ও সেক্রেটারী জেনারেল মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন,সারা বিশ্বের ইসলামপ্রিয় কোটি জনতার প্রিয় নেতা মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি স্বৈরাচার জালিম শাসক আব্দুল ফাত্তাহ সিসির আদালতে থাকাবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন ) । ইসলামবিরোধী বর্বর শাসকের সাজানো মামলায় আটক থাকাবস্থায় জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি পরিবারের সান্নিধ্য, উন্নত চিকিৎসা - বঞ্চিত অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন । তাঁর এই বেদনাদায়ক ইন্তিকালে ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল,কর্মী ও বাংলাদেশের জনগণসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব গভীরভাবে শোকাহত ।
বিশ্ব বরেণ্য এই ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে শোকবাণী জ্ঞাপণ করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন,জনসেবা আন্দোলন,ফিলিস্তিনের হামাস, ব্রিটিশ সরকার প্রধান এবং বিশ্বের আরো অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ।
ড. মুরসির সোনালী জীবনমালা : মোহাম্মদ মুরসি ১৯৫১সালের ৮ই আগস্ট মিশরের আল শারক্বিয়্যাহর আল আদওয়াহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে। তার আব্বা ছিলেন একজন কৃষক । আম্মা ছিলেন সাধারণ গৃহিণী। মুরসিরা তিন ভাই ও দুই বোন । মেধাবী মুরসির প্রাথমিক ও সেকেন্ডারী স্কুলের লেখাপড়া সাফল্যের সাথে শেষ হয়েছে নিজ গ্রামে এর পর কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন । এর পর ১৯৭৫ - ৭৬ এ তিনি মিশর সেনাবাহিনীতে কাজ করেন । ১৯৭৮ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ১৯৮২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে অধ্যাপনা শুরু করেন । পরে আমেরিকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত । নাসার মত প্রতিষ্ঠানেও তিনি খুব সুনামের সাথে স্পেস শ্যাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে অনেক বড় ভ’মিকা রেখেছেন । এর পরে তিনি নিজ প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১০ সাল পর্যন্ত এভাবে সেখানে শিক্ষকতা করেন ।
তিনি ১৯৯২ সালে তিনি ইখওয়ানের সদস্য হন কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি ইসলামী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন । ১৯৯৫ ও ২০০০ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণ করেন এবং এমপি হিসেবে ইখওয়ানের পার্লামেন্টারিয়ান দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত এমপি হন অথচ তার পরিবর্তে তার বিরোধীকে জয়ী ঘোষণা দেয়া হয় । মিশরীয় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই নামকরা । ২০১১ সালের আরব বসন্তের ধাক্কায় মিশর যখন ভেংগে পড়ে, তিনি তখন বড় ভূমিকা পালন করেন । তিনিই সেই নেতা যিনি একদিকে ইখওয়ানের শুরা সদস্য আবার সমমনাদের নিয়ে গঠিত ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’গঠন করে উহাকে বিজয়ের মুখ দেখান । ২০১২ সালের নির্বাচনের আগে ইখওয়ান তাদের নেতা খায়রাত আশশাতেরকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থিতা ঘোষণা করে। পরে সাংগঠনিকভাবে মুরসিকেও প্রার্থী হৗয়ার জন্য নির্দেশ দেয় যেন খায়রাতকে বাতিল করা হলে তাকে ইখওয়ান সমর্থন দিতে পারে। তাই হল । খায়রাতকে বাতিল করা হল। পরে ইখওয়ান মুরসিকে সমর্থন জানায়। ২০১২ সালে ৫১.৭% ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী ঘোষিত হন। ২৪ শে জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষিত হন। শপথ নেন ৩ শে জুন ২০১২ তে। নতুনভাবে মিশরকে গড়ার সংগ্রাম শুরু করেন কেবল। কিন্তু পশ্চিমাদের চক্রান্তে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দলের সহকর্মীদেরসহ কারারুদ্ধ হন । [সমাপ্ত]

Sunday, July 7, 2019

মিসরের শহীদ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি প্রসঙ্গে



আশিকুল হামিদ : প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। নানাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতেও থাকবে। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে আন্দোলিত করে। বিশ্ববাসীর মনে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। গত ১৭ জুন মিসরের রাজধানী কায়রোর একটি আদালতে মৃত দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি ছিলেন তেমন একজন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে এ যুগের একজন মহামানব। অভিযোগ উঠেছে, মিসরে এ পর্যন্ত জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে আসলে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েফ এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু দেশ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। এর কারণ, তার মৃত্যু সাধারণ অসুস্থতার কারণে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ঘটেনি। তিনি মারা গেছেন আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে। জনাব মুরসি অজ্ঞান হয়ে মাটিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দীর্ঘ ২০ মিনিট পর্যন্ত সরকার কোনো চিকিৎসককে আনার ব্যবস্থা করেনি। অনেক পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সরকারিভাবেও প্রচার করে জানানো হয়, মোহাম্মদ মুরসি ইন্তিকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। পরদিন, ১৮ জুন তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে একই সময়ে জনাব মুরসির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতাই গায়েবানা জানাজায় শরিক হয়ে জনাব মুরসির মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছেন। তার নিজের দেশ মিসরে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটেছে। সেখানে প্রকাশ্যে কারো পক্ষে গায়েবানা জানাজা পড়া সম্ভব হয়নি। যারা পড়েছেন তারা গোপনীয়তা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, মিসরে এখন অবৈধ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির স্বৈরশাসন চলছে। দেশের সংবিধান সংশোধন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই এই জেনারেল আল-সিসিই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিথ্যা মামলায় কারাগারে ঢুকিয়েছিলেন। প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে জেনারেল সিসির সরকার জানিয়েছিল, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও কর্মকান্ডের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় জনাব মুরসিকে বন্দী করা হয়েছে। সে সময় থেকেই জনাব মুরসিকে করাগারে রেখেছে আল-সিসির সরকার।
অন্যদিকে ২০১৩ সাল থেকে বন্দী সাবেক প্রেসিডেন্ট বহুবার আদালতে অভিযোগ করেছেন, তার ওপর প্রচ- নির্যাতন চালানো হয় এবং তাকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে বাস করতেও বাধ্য করা হয়। তিনি দুর্গন্ধযুক্ত পচা ও বাসী খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তাকে কোনো ওষুধ ও চিকিৎসার সুযোগও দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে অন্য একটি তথ্যও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। বন্দী অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে জনাব মুরসি একবারের জন্য পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নামে মুসলিম হলেও আল-সিসির সরকার তাকে কোরআন শরীফও দেয়নি। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে জনাব মুরসি বলে গেছেন, তারা হয়তো জানেই না যে তিনি অর্থাৎ মোহাম্মদ মুরসি ৪০ বছর আগেই পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি শুধু কোরআন শরীফকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগটুকুও তাকে দেয়নি মুসলিম নামের আল-সিসির সরকার। এভাবে সব মিলিয়ে তাকে এত বেশি নির্যাতিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে, সাবেক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি তার জীবন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতিদের তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সবশেষে গত ১৭ জুন জনাব মোহাম্মদ মুরসির সে আশংকাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাকে আসলেও হত্যা করেছে আল-সিসির সরকার। না হলে একজন জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ২০ মিনিট পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মাটিতে ফেলে রাখা হতো না। একই কারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন। বিশ্বের মুসলিমরাও তাকে ‘শহীদ’ এর মর্যাদা দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে মোহাম্মদ মুরসির এবং সেই সাথে মিসরের ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, প্রায় ৮৪ বছর ধরে নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসিকে মেয়াদের এক বছরও পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। এর আগে প্রায় তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি। প্রচন্ড গণআন্দোলনের মুখে তার পতন ঘটে ১০ ফেব্রুয়ারি। হোসনি মোবারক ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার আট দিন পর। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা হিসেবে মোবারক চারবার প্রেসিডেন্ট পদে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। সেগুলো এমন নির্বাচন ছিল যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পাত্তাই পেতেন না। শেষবার ২০০৫ সালে নির্বাচনে মোবারক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেননি।
এভাবে সময়ে সময়ে লোক দেখানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মিসর আসলে ছিল অঘোষিত সামরিক শাসনের অধীনে। এরও শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে রাজা ফারুককে উৎখাত করার পর থেকে। প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা ফারুক বিরোধী অভ্যুত্থানের নেতা কর্নেল গামাল আবদেল নাসের। নাসেরের আমলে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলের সঙ্গে মিসরের যুদ্ধ হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংঘটিত সে যুদ্ধে গোটা বিশ্ব দাঁড়িয়েছিল মিসরের পক্ষে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নাসের সে সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোসেফ টিটোর সঙ্গে নাসের ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
অমন ভূমিকা ও অবস্থান সম্মানজনক হলেও মিসরকে প্রেসিডেন্ট নাসের গণতন্ত্রের পথে এগোতে দেননি, তিনি বরং সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার কৌশল হিসেবে তিনি এমনকি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণের অভিনয়ও করতেন। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসেছিলেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আরেক জেনারেল আনোয়ার সাদাত। ইসরাইলের সঙ্গে ক’টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে আনোয়ার সাদাত জনসমর্থন খুইয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর এক সদস্য তাকে প্রকাশ্য এক সামরিক অনুষ্ঠানে গুলী করে হত্যা করেছিলেন। আনোয়ার সাদাত মারা যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। এভাবেই মিসরে বছরের পর বছর ধরে চলেছে সামরিক শাসন। মুখে গণতন্ত্রের আড়াল নেয়া হলেও হোসনি মোবারকের ৩০ বছরই মিসর ছিল জরুরি অবস্থার অধীনে। মিসরে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হোসনি মোবারকের পতনের পর, ২০১২ সালের ৩০ জুন। প্রথম সে নির্বাচনে ৫১.২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ মুরসি। তিনি ছিলেন আল-ইখওয়ান আল-মুসলিমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী। ১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাববিদ ও রাজনীতিক হাসান আল বান্না। ১৯৪৮ সালে তাকে হত্যা করা হয়। একযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নেমে আসে সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতন। ১৯৫৪ সালে নাসেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতা-কর্মি ও সমর্থকদের ওপর চলতে থাকে প্রচন্ড নির্যাতন। সুদীর্ঘ এ সময়কালে মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন নেতাকে এমনকি ফাঁসিতেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। কিন্তু এত প্রতিক’লতার পরও মুসলিম ব্রাদারহুড শুধু টিকেই থাকেনি, গোপন তৎপরতার মাধ্যমে মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানেও পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্যই মোহাম্মদ মুরসি ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
কিন্তু নির্বাচিত হলেও এবং দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও গণভোটের মাধ্যমে সে সংবিধানকে পাস করিয়ে নিলেও রাষ্ট্রীয় কোনো একটি ক্ষেত্রেই মোহাম্মদ মুরসিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বা পদক্ষেপ নিতে দেয়া হয়নি। ড. মুরসি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। বাজেট ও ব্যয়সহ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে ২০১২ সালের আগস্টে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহিনীর কোনো সহযোগিতা পাননি। পাশাপাশি ছিল স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সাজিয়ে যাওয়া বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসন। অর্থাৎ সবদিক থেকেই প্রেসিডেন্ট মুরসি প্রচন্ড প্রতিক’ল এক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যার কারণে সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে জনকল্যাণমূলক কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল বারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। উল্লেখ্য, এই এল বারাদেই-ই প্রধান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক পরিদর্শক হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে ব্যাপক মানববিধ্বংসী সমরাস্ত্র রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সে মিথ্যাচারকে অবলম্বন করেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় মিসরেও এল বারাদেইকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তার কাছে এল বারাদেই চুপসে গিয়েছিলেন। তিনি এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা যে নীরবে বসে থাকেনি তারই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল আল-সিসির নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে। ২০১৩ সালের ৪ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থানে প্রমাণিত হয়েছে, মুরসি তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়ে মিসরে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে জানাজানি হতেও সময় লাগেনি। প্রমাণিত হয়েছে, এল বারাদেই এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা এতদিন নীরবে বসে থাকেনি। তারাই ঘটিয়েছিল মুরসি বিরোধী অভ্যুত্থান।
তারও আগে মূলত সেনাবাহিনীর অসহযোগিতাজনিত অক্ষমতাকে মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অযোগ্যতা হিসেবে প্রচার করেছে ক্ষমতালোভী চক্র। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল রারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। তারা সম্মিলিতভাবে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুরসি বিরোধী বিক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর রাতারাতি কোনো সুফল ভোগ করতে না পারায় তরুণরাও নতুন করে রাজপথে নেমে এসেছে। তারা লক্ষ্যই করেনি যে, প্রেসিডেন্ট মুরসির কথিত ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার পেছনে দায়ী আসলে ছিল সেনাবাহিনী। বিরামহীন উস্কানিতে বিক্ষুব্ধ তরুণদের পাশাপাশি মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজপথে আন্দোলন করেছে। সে অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী প্রসিডেন্ট মুরসিকে হঠাৎ ২০১৩ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং সংবিধান সংশোধন করাসহ বেশ কিছু শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছিল সেনাবাহিনী। ওদিকে মুরসির পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে শুরু হয়েছিল গণসমাবেশ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি সেনাবাহিনীর দাবি ও আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে মুরসি ঘোষণা করেছিলেন, জীবন দিতে হলেও অবৈধ কোনো শক্তির অশুভ ইচ্ছার কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না। তিনি বরং জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাংক্ষা এবং দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখবেন। প্রেসিডেন্ট মুরসির এই অস্বীকৃতি ও বলিষ্ঠ অবস্থান সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ইসলামবিরোধী পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক হিসেবে চিহ্নিত সাবেক ক’টনীতিক মোহাম্মদ এল বারাদেইসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দলের সমর্থন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই। সেদিন থেকেই কায়রোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন মুরসির সমর্থক লাখ লাখ নারী-পুরুষ। এসব স্থানে দিনের পর দিন অবস্থান করেছেন তারা। বন্দি প্রেসিডেন্ট মুরসির মুক্তি ও পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। তাদের ওপরই দিনের পর দিন ধরে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। তুরস্ক একে গণহত্যা বলেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি অস্ত্রের মুখে সমাবেশ পন্ড করতে এবং মুরসি সমর্থকদের রাজধানী কায়রো থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেও সেনাবাহিনীর পক্ষে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। কারণ, মোহাম্মদ মুরসি শুধু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টই ছিলেন না, ছিলেন এমন একদল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিওÑ যে দলটি নিষেধাজ্ঞা এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের মধ্যেও দীর্ঘ ৮৪ বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। জনপ্রিয়তারও শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল দলটি। অমন একটি দলকে কেবলই বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রাখা কিংবা নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে না। এরই মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়াও বইতে শুরু করেছিল বলেই মোহাম্মদ মুরসিকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, ৬৭ বছরের বেশি সময় ধরে সেনা শাসনে অতীষ্ঠ ও পিছিয়ে পড়া মিসরের সাধারণ মানুষও নতুন করে সেনাবাহিনীর অধীনস্থ হতে সহজে সম্মত হবে না। প্রেসিডেন্ট পদে মোহাম্মদ মুরসির পুনর্বহাল আর সম্ভব নয় সত্য, কিন্তু সংবিধান, গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে মিসরের জনগণ। সে ইঙ্গিত এর মধ্যে পাওয়াও যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আল-সিসির সেনাবাহিনী নতুন করে এক গভীর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ হবে না। সেনাবাহিনীকে বরং জনগণের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হবে।
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন হারাতে হলেও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রয়েছে এমন এক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড, ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতন পর্যন্ত নিষিদ্ধ অবস্থায় কাটানোর পরও যে দলটির প্রার্থী হিসেবেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। সুবিধাবাদী ও পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকদের সহযোগিতা নিয়ে সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করলেও তার দলই আবারও ক্ষমতায় আসতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। সব মিলিয়ে বলা যায়, মিসর আসলে নতুন করে এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মিসরকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। আবারও সুযোগ দিতে হবে গণতন্ত্রকে, যার সূচনা করতে হলে আয়োজন করতে হবে নতুন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। গণতন্ত্রসম্মত এই পথে যাওয়ার পরিবর্তে জেনারেল আল-সিসি যদি সামরিক শাসনের ভিত্তিকেই দৃঢ়মূল করার চেষ্টা চালান তাহলে সভ্য ও ঐতিহ্যের মুসলিম দেশটি এমনকি গৃহযুদ্ধেরও শিকার হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বলা দরকার, যা কিছুই ঘটুক না কেন মিসরের ভবিষ্যৎ সকল পরিবর্তনের পেছনে থাকবেন ‘শহীদ’ মোহাম্মদ মুরসি।

Saturday, July 6, 2019

বাংলাদেশ পীর আওলিয়ার দেশ


এইচ এম আব্দুর রহিম : বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশস্ত রাজপথ নিমার্ণে ইসলামের প্রভাব যে প্রকটভাবে কাজ করেছে তা সবারই জানা। ৫৯৫ খিস্টাব্দে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজা শশাংক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই এ দেশের অধিবাসী বৌদ্ধদের যে কঠোর অত্যাচার চালান, বহু বৌদ্ধ ধর্মালন্বীদের নির্মমভাবে হত্যা করে নিজের ব্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্রের মুখোশ যে খুলে দেন,তাও ইতিহাসে লেখা আছে। এমনকি এই রাজা শশাংক নিজের গাত্রদাহ মিটানোর জন্য অহিংসবাদী বৌদ্ধদের পূত বৃক্ষ বুদ্ধ গয়ার বোধি দ্রুম শেকড়শুদ্ধ উৎপাটন করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে ও কুষ্ঠাবোধ করেননি। হিন্দু রাজার এই অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক বৌদ্ধ পরিবার পাহাড়-জঙ্গলে দেশান্তরে পালিয়ে যান। জানা যায়, মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মর্দে মুজাহিদদের চেতনায় সমৃদ্ধ মাহাথির মুহাম্মদের পূর্ব পুরুষ এই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
 বাংলাদেশ এক সময় মাৎস্যন্যায় অবস্থায় দিন অতিবাহিত করেছে, তারপর এখানকার জনগণের মিলিত চেষ্টায় গোপাল নামে এক রাজা শাসন ক্ষমতায় এসেছেন। এখানে কিছুকাল বৌদ্ধ রাজত্বকাল প্রবহমান হলে ও আবার তা কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজত্বে পরিণত হয় সেন রাজ বংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর এই সেন রাজ বংশের অবসান ঘটে মুসলিমবীর সিপাসালার ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা। এখানে ইসলামের পতাকা বিজয় পতাকা উড্ডীনের মাধ্যমে। মুসলিম শাসন কায়েমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হওয়ার দিশা খোঁজে পেল। সত্যিকার অর্থে পরাধীনতার নির্যাতনের নিগড় থেকে মুক্ত হলো, সে রাজাদের জারি করা বর্ণবাদ ও কৌলন্য প্রথার জাঁতাকল থেকে রেহাই পেল। যে পুরোহিতদের দ্বারা ব্যাক্যাত যে শ্রেণি বিভাজন তাতে বলা হয়ে ছিল : ব্রাহ্মণ মস্তক হচ্ছে ব্রাহ্মণ, বাহু হল ক্ষত্রিয়, ঊরু হচ্ছে বৈশ্য আর পা হচ্ছে শুদ্র। এছাড়া আর ও অনুন্নত নি¤œশ্রেণির মহিন্দু ছিল। যারা হচ্ছে হাড়ি, ডোম, চান্ডাল বা চাঁড়াল। এসব নি¤œশ্রেণির হিন্দুকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো ও মানবতার অপমানে গুমরে মরছিল, মূল্যবোধ নানাভাবে নিগৃহিত হচ্ছিল। স্বাধীনতার চিন্তাটা উধাও হয়ে গিয়েছিল, স্বাধীনতা বলতে কোথাও কিছু ছিল না, ইসলাম এখানে মানবতার বিজয় বার্তা ঘোষণা করল। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের সূচনা হয় ৬২৮ খৃস্টাব্দে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকেই, তবে আরব বণিকদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলামের খবর এসে যায় । সেসব বণিকের বাণিজ্যে নৌজাহাজ সুদূর চীন-সুমাত্রা অঞ্চল পর্যন্ত যাতায়াত করতো বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ছুয়ে সেসব জাহাজ চীন-সুমাত্রা পর্যন্ত যাতায়াত করতো বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর সেসব জাহাজ দূরপ্রাচ্যে ইসলাম প্রচার করতে যেসব সাহাবে কেরাম যেতেন তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর এলাকায় সফর বিরতি দিয়ে এখানকার মানুষের সামনে ইসলামের বাণী এবং এর সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। তারা বোধকরি বাংলাদেশের উপকূলীয় বন্দর ছাড়া ভেতরে প্রবেশের মওকা পাননি সময়ের অভাবে। কারণ তাদের গন্তব্যস্থল ছিল দূরপ্রাচ্য। তখন চীন দেশের শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের গন্তব্য স্থল ছিল দূরপ্রাচ্য। তখন চীন দেশের শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য জগৎ জোড়া খ্যাতি ছিল। সেসব সাহাবায়ে কেরামের মাযার শরীফ আজও চীনের ক্যান্টন নগরীর ম্যাসেঞ্জার মসজিদ প্রাঙ্গণে যতেœর সাথে সংরক্ষিত আছে। বাংলার স্বাধীন সুলতান গ্যাস উদ্দীন আযম শাহের ইন্তিকালের পরে সুলতানের অমাত্য দিনাজপুরের ভাতুড়ির জমিদার বংশনারায়ণ গনেশ বাঙলার মসনদ দখল করলে পীরে কামিল হযরত নুর কুতবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলায়হি এই অত্যাচারী গনেশকে উৎখাত করার জন্য জৌনপুরের শাসনকর্তা ইব্রাহিম শরকীকে লেখেন : প্রায় তিনশ’ বছর হয়েছে বাঙ্গালার ইসলামের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি এখানে ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, সত্য-সুন্দরের কালো থাবা এ দেশটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। দেশ জুড়ে আঁধার নেমে এসেছে। মুসলিমদের জানমাল, ইজ্জত আব্রুর উপর আঘাত এসেছে। ইসলামের আলোক প্রতীক এখানকার মানুষের যেভাবে সত্য পথের দিশা দিয়ে আসছিল আজ তা হুমকির মুখে। এই মহা দুর্দিনে আপনি কেমন করে নিবিঘেœ মসনদে আসিন থাকতে পারেন? আপনি আপনার সুখের মসনদ থেকে উঠে আসুন। দ্বীনকে সংরক্ষণের জন্য অতিসত্বর এগিয়ে আসুন। আপনার তরবারী কোষবদ্ধ না রেখে কুফরের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা নির্বাপণে আপনি জোর কদমে অগ্রসর হন। আপনি তো জানেন বাঙ্গালা হচ্ছে পৃথিবীতে বেহেশত। কিন্তু সেই বেহেশতে দুনিয়ার কালো ছায়ায় ঢেকে ফেলেছে। এখানে অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়ন আর হত্যাকা-ের যে কারখানা চলছে তা দমন করতে আপনি আসুন আরামের মসনদে আর এক পলক ও বসে থাকবেন না। সেই দীর্ঘ ও জ্বালাময়ী পত্র পেয়ে ইবরাহিম শরীকী কোনরূপ কালক্ষেপন না করে বিরাট বাহিনী নিয়ে বাঙ্গালার বিপন্ন স্বাধীনতািেক বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন। এখবর শুনে সমুহ বিপদের আশঙ্কা করে জানে মরার ভয়ে কংশনারায়ন গনেশ হযরত নুরকুতবুর আলম (রা:) এর দরবারে এসে ক্ষমা চাইল এবং তার পুত্র যদুকে মুসলিম করার জন্য অনুরোধ করল। হযরত নুর কুরতুব আলম যদুকে ইসলামের রায়’আত করলেন এবং তার নাম রাখরেন জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। এ খবর পেয়ে ইবরাহিম শাহ জৌনপুরে ফিরে গেলেন বাঙ্গালার ৫৫৬ বছরের মুসলিম সুশাসনের মাঝখানে মাত্র ৩-৪ বছর বর্ণ হিন্দু শাসন একটি দু:স্বপ্নের মত কিংবা একটি ছন্দ বদ্ধ সুন্দর দীর্ঘ কবিতার একটি মাত্র পংক্তিতে একটি মাত্রার হেরফের হওয়ার মতো সামান্য ছন্দপতনের মত। ইতিহাসে রাজা গনেশ ঘৃনিত ব্যক্তি চি‎ি‎‎হ্নত ব্যক্তি হিসেবে রয়েছে ।স্বাধীন বাংলার দিকে নজর পড়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির । তারা হিন্দু কয়েকজন প্রভাবশালী অমাত্য ও জগৎশেঠদের সাথে আতাত করে এবং মসনদের লোভ দেখিয়ে মীর জাফর কে দলে ভিড়িয়ে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন পলাশির প্রান্তরে এক মহা প্রহসন মুলক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদৌল্লার কাছ থেকে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য হরন করে নেয়। স্বাধীন বাঙ্গালা,শাহে বাঙ্গালা,সুলতানে বাঙ্গালা পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়। নানা প্রকার দমন নীতি প্রয়োগ করে মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে । কিন্তু মুসলমানদের তারা দমাতে পারেনি। ইসলামী শিক্ষায় উজ্জীবিত মীর কাসিম,সুফী দরবেশ কফীর মজনুশাহ বিজ্ঞ আলিম হাজী শরীয়তউল্লাহ মর্দে মুজাহিদ সৈয়দ সিনার আলী তিতুমীরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জিহাদের ডাক দিয়েছেন,স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ নির্মাণ করতে অগ্রসার হয়েছেন। ১৮৫৭ খিস্টাব্দে সিপাহী জনতার মহা বিপ্লবের নেতৃত্বে সুফী দরবেশ আলেম ওলামা থাকার কথা সর্বজন বিদিত। পীর মহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া বন্ধী হয়েছেন। তার পরের ইতিহাস নতুন কৌশল সংগ্রামের ইতিহাস। হাজী শরিয়ত উল্লাহ এ দেশ কে হাজী হারুল হরব ঘোষণা করে জিহাদের যে ডাক দিয়ে ছিলেন । এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পড়ার স্পৃহা জাগিয়ে ছিল ঠিক একই মাত্রায় কৌশল ভিন্নতা এনে মাওলানা কেরামত আরী (রহ:)এ দেশকে হারুল আমান বা নিরাপদ ভুমি ঘোষণা করে মুসলিমদের স্বার্থ উদ্ধারের পথ ঘোষণা করে দিলেন। নবাব আব্দুল লতিফ তার দোয়া গ্রহন করে যে শিক্ষা আন্দোলনের সুচনা করলেন তাই পথ পরিক্রমে ১৯০৬ খিস্টাব্দের ডিসেন্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক দল গঠিত হল। এই সম্মেলনের আহবায়ক ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর ভারতের বিভিন্ন এলাকার এজেন্ডার ভঙ্গভঙ্গ বিষয় রাখার প্রস্তাব দিয়ে পত্র পাঠালেন যাতে বললেন, মুসলিমদের কোন রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে যে বঙ্গভঙ্গ হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পুর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছে । ঢাকা তার রাজধানী হয়েছে ।তার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস আন্দোলন করেছে। কিন্ত আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না।মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এজেন্ডায় এ বিষয়টি লিখে পত্র দিলেন। আমরা লক্ষ্য করি সব আন্দোলনে ইসলামের প্রভাব সক্রীয় ছিল।মাওলানা ভাসানি ১৯৫৭ খ্রীস্টাব্দে ৭ই ফেব্রƒয়ারি কাকমারী সম্মেলনে পাকিস্থান কে বিদায় জানিয়ে আচ্ছালামু আলাইকুম বলা ১৯৭১ সালের শেখ মুজিবের ভাষনে ইনসাল্লাহ বলা,৯ইমার্চ পল্টন ময়দানে ভাষানীর লাকুম দিনুকুম ওলিয়াদীন বলা,মেজর জিয়ার সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা ’৭১এর মহান মুক্তি যুদ্ধকালে প্রবাস থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইশতেহার ও নিদের্শাবলীতে আল্লাহ আমাদের সহায়,নাসরুম মিনাল্লাহী ফাতহুন কারীব প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করণের মাধ্যমে ইসলামের বৈপ্লবিক চেতনার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়।১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এব নির্দেশনামুলক ইশতিহারের শীর্ষে লেখা ছিল আল্লাহ আকবার এবং শেষ করা হয়ে ছিল আল্লাহর সাহায্য বিজয় নিকটবর্তী। এসব প্রেক্ষিতে বলা যায় চার লাখ মসজিদের এই দেশ, শত শত আল্লাহর ওলির স্মৃতি ধন্য এই দেশ তার স্বাধীন সত্তা মুখ্যত লাভ করেছে ইসলামের প্রভাবে । মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতারে গাওয়া হত :ওলি আল্লাহর বাংলাদেশ শহীদ গাজীর বাংলাদেশ, রহম করো রহম করো আল্লাহ, রহম করো আল্লাহ ।
লেখক :সাংবাদিক ।

Wednesday, March 6, 2019

সুদানের ড.হাসান আল তুরাবির চিন্তাধারায় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের সাথে সম্পর্ক


মুহাম্মদ নূরে আলম:
ড. হাসান আল-তুরাবি নামটি সুদানের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকলেও তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তিনি সুদান সংসদের স্পিকার, সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। সুদানের এই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ড. হাসান আল তুরাবি ছিলেন সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের একজন মেধাবী ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ। সুদানের মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, বহু ভাষাবিদ ও ইসলামী আন্দোলনের পাওয়ার শেয়ারিং থিউরির জনক। তার চেয়ে বড় কথা লন্ডন ও সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তুরাবি একই সঙ্গে ইসলামী ঐতিহ্য ও আইন বিশেষজ্ঞ, পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে সমসাময়িক ইসলামী ভাবনার অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার এবং ইসলামী জগতের অগ্রণী তাত্ত্বিক নেতা। তিনি একাধারে আলেম, মুফাসসির, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁর চিন্তাধারার আলোকেই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সুদান। একারণেই তিনি সুদানের একজন  সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তুরাবি একজন গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়ে ইসলাম আরও ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে। 
আজকে ইসলামী ও পশ্চিমা সভ্যতার ঠানাপোড়ন থেকে উঠে আসা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে তুরাবির নজির টানা জরুরী হয়ে পড়ে। এ কারণেই তাকে আধুনিক ইসলামী মননের অন্যতম সংকট বিশ্লেষক হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলিম বিশ্বের অবিসাংবাদিত নেতা এবং সুদানের বিরোধীদলীয় “পপুলার কংগ্রেস পার্টির” প্রধান ড. হাসান আল-তুরাবি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কল্যাণের কথা চিন্তা করে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার থিউরি আবিষ্কার করেন যা আমরা জানি পাওয়ার শেয়ারিং থিউরি নামে। এই থিউরির আলোকে মুসলিম বিশ্বের অনেক ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল এর কিছু সুফল ভোগ করে। এক সময় সুদানের সামরিক প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন বশির। এরপর থেকেই তিনি বশির সরকারের বিরোধিতা শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট বশিরের দীর্ঘ শাসনামলে তিনিই ছিলেন তার প্রধান সমালোচক। তিউনিসিয়ার আদলে দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই নেতা। তুরাবি ছিলেন একজন উদারপন্থী মুসলিম চিন্তাবিদ। তিনি ইসলামের অনেক বিষয়েই বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। এবং অনেক কঠোর ইসলামী বিধানের ব্যাপারে উদরতার পরিচয় দেন। তুরাবি মনে করতেন মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারীও হতে পারে। এমনকি অন্য যেকোনো ধর্মের নারী হলেও তিনি এতে কোনো সমস্যা আছে বলে বলে মনে করেন। তুরাবি নারী অধিকারের ব্যাপারে একজন সোচ্চার মুসলিম নেতা ছিলেন। বিস্তারিত পড়তে পারেন: [Hasan Turabi, Women in Islam and Muslim Society. London: Mile Stones, 1991.]
সুদানের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ড. হাসান আল তুরাবির মতে মুসলিম রাষ্ট্র মানে মুসলিম আধিপত্যশীল রাষ্ট্র। তবে ইসলামী রাষ্ট্র মানে যে রাষ্ট্রে ইসলামী নীতি-আদর্শকে কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, বরং প্রকাশ্য জনপরিমণ্ডলে চর্চা করা হয়। এর মানে হচ্ছে, যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সবকিছুই হবে ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। খ্রিষ্টানদের বেলায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতো তাদের ধর্মীয় যাজকদের মাধ্যমে। কারণ খ্রিষ্টান যাজকরা মনে করত, স্রষ্টা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না। ফলে তারা নিজেদেরকে স্রষ্টার খাস প্রতিনিধি মনে করত এবং সবসময় গণমানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করত। যদিও খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে রাজনীতির তেমন বিদ্বেষ ছিল না, বিদ্বেষ ছিল ধর্মীয় যাজকদের সাথে বিপ্লবীদের। এর বিপরীতে, ইসলামে কোনো মোল্লাতন্ত্র নেই। এখানে প্রত্যেক মানুষ সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সুতরাং ইসলাম ধর্মে শুধুমাত্র মোল্লারা নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষেরা। মুসলিমরাই ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। 
ড.হাসান আল তুরাবি ১৯৩২ সালে সুদানের কাসসালা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের শরিয়াহ আদালতের বিচারক। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের একটি মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা অর্জনের পর সুদানের রাজধানী খারতুমে আসেন আইন পড়ার জন্যে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন সুদানের বিখ্যাত খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি সেখানকার ছাত্র সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। ব্রাদারহুড তাঁর চিন্তা ভাবনার মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়। তিনি সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বলেছেন, The Islamic movement which I met at the university was quite an experience for me. All of the dead literature that I had learned by heart became alive. I saw everything in a different light.[ John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam. New York; Oxford University Press, 2001.]..এরপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্যে তিনি গমন করেন লন্ডনে এবং সেখানকার কিংস কলেজ থেকে আইনের উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর গমন করেন ফ্রান্সে; সেখানকার প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাচীন সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিএইচডি’র বিষয় ছিল ‘উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগ কতটা গ্রহণযোগ্য?’ হাসান আল-তুরাবির মত ইসলামী জ্ঞানের সাথে বৈশ্বিক জ্ঞানের এমন অসাধারণ সমন্বয় সৃষ্টিকারী দ্বিতীয়জন সুদানে খুঁজে পাওয়া দায়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলাম ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশে তিনি প্রচুর কাজ ও লেখালেখি করেন। ‘তাফসীর আত-তাওহীদ’ নামে তিনি একটি তাফসীর লিখেন, যেখানে সমসাময়িক সমস্যাগুলোর কোরআন ভিত্তিক সমাধান তিনি দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ইসলামী জ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় করা এখন খুবই প্রয়োজন। তিনি অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন, ইংরেজি ও আরবিতে তার অনেক বক্তৃতা রয়েছে; এগুলোর মাধ্যমে তিনি সুদানের দারিদ্র্যতা, গোত্রীয় সংকীর্ণতা, মাজহাব নিয়ে ঝগড়াসহ বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার উদার ও আধুনিক সমাধান সুদানের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছে। ফলে সুদানসহ বিশ্ববাসীর কাছে তার সম্মান ও মর্যাদা আকাশচুম্বী।
ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা যেসব অভিযোগ তোলে, ড. হাসান আল তুরাবি চমৎকারভাবে সেসব খ-ন করেন। বিশেষত, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে তিনি কিছু অসাধারণ বিষয় তুলে ধরেছেন, যা অমুসলিমদের সকল অভিযোগকে ধূলিসাৎ করে দেয়। নারী বিষয়ে তিনি একটি বিখ্যাত বই লিখেন, ‘Women between the teachings of religion and the customs of society’। এ বইয়ে ইসলামে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে তুরাবি যে বিপ্লবী ভাষ্য দিয়েছেন তা রীতিমত মৌলবাদী, নারীবাদী, মার্কসবাদী সব তরফের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তুরাবীর এই ভূমিকার ফলেই সুদানে মহিলা ভোটের হাওয়া ঘুরে যায় ইসলামী শক্তির পক্ষে এবং ইসলামিক আইডেন্টিটি ও নারীবাদী চেতনায় বিশ্বাসীরা সুদানে মার্কসবাদীদের ছাড়িয়ে যায়। তুরাবী এ বইয়ে প্রথমে যুগের মুসলিম সমাজে নারীদের ভূমিকার নজির দিয়েছেন এবং এই ভূমিকাকে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের সাথে সমন্বয়  করে বলতে চেয়েছেন : in the religion of Islam, a women is and independent entity, and thus a fully responsible human being. Islam addresses her directly and does not approach her through the agency of Muslim males.
এ বইটি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় রাখা হয়েছে। তিনি কেবল বই লিখেই বসে থাকেননি; ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে সুদানের নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির করার ক্ষেত্রে অসামান্য ত্যাগও স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং ইসলামের প্রতি অনড় অবস্থানের কারণে সুদানের সামরিক সরকার তাকে কারাগারে প্রেরণ করে। ২০০১ সাল থেকে প্রায় চার বছর কারাভোগ করার পর ২০০৫ সালে তিনি মুক্তি পান। এ মানুষটির বহুবিদ প্রতিভা বিশ্ববাসীকে কেবল অবাক করেই দেয় না, আত্মবিশ্বাসী মানুষকে সামনে চলার পথও খুঁজে দেয়।
১৯৬৪ সালে দেশে ফেরার পর ড. তুরাবি খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আহ্বান উপেক্ষা করে তৎকালীন সুদানী সামরিক শাসক ইব্রাহিম আবুদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে এক তীব্র ও ঝাঁঝালো বক্তৃতা দেন। সেই থেকে তুরাবি সুদানী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হাজির হন এবং আজও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। অনেকের ধারণা ১৯৮৯ সালে সুদানে ইসলামী শক্তির মদদে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যে উমর আল বশিরের সরকার ক্ষমতায় আসে তার প্রধান তাত্ত্বিক ও নেপথ্যের নায়ক আসলে তিনি। তুরাবির সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কয়েক দশকের মধ্যে সুদানী সমাজ ও রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইসলামের অন্তর্মুখিতা কাটিয়ে তিনি এটিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন যা অনেকের কাছে চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। দারফুরে গণহত্যার ঘটনায় বশিরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল আদালত।  ড. তুরাবি ছিলেন সুদানের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি ওই গ্রেফতারি পরোয়ানাকে সমর্থন করেছিলেন।  অবশ্য নিজের ওই কর্মকান্ডের জন্য তাকে মাসুল দিতে হয়েছে।  এ ঘটনার দুদিন পরই ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার।  এক সময়ের বন্ধু সামরিক শাসক বশিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি নিজের দল ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’ গড়ে তুলেছিলেন।  উচ্চশিক্ষিত তুরাবির ইংরেজি, ফারসি, জার্মান ও আরবি ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল।  ভাষাগত পান্ডিত্যের কারণেই বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তার কদর ছিল।  ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।  ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলি’র স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি ২০১৬ সালের ৫ মার্চ ইন্তিকাল করেন।
বর্তমান সময়ে প্রয়োজনের আলোকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ থিউরি গুলোকে সম্বনয় করা অতি জরুরি।  ইসলামের নিয়মগুলোকে বর্তমান সময়ের আলোকে ইন্টারপেইট করতে হবে বলে মনে করতেন তুরাবি।  পশ্চিমা বিশ্বের হলেই গ্রহণ করা যাবেনা এমন ধারণা করা ঠিক বলে মনে করতেন না তুরাবি।  ভালো কিছু গুলো গ্রহণ করার পক্ষে সব সময় তুরাবি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে তিনি প্রথম কাজ করেন খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নীতি-নির্ধারণী বিতর্কে সুদানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইব্রাহীম আবুদকে আক্রমন করেন। এটি চলমান আবুদবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি দেয় এবং বিরোধী দলের এই আন্দোলনে মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থানকে আরো মজবুত করে। এর ফলে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে আবুদ সরকারের পতন ঘটে। এই আন্দোলনের সফলতা এবং তুরাবী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অভিজ্ঞতা তুরাবির রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ। তুরাবির এই সাফল্য ঠিক সরাসরি ইসলামী কোন অবস্থান থেকে আসেনি বরং একটি সামগ্রিক সমস্যার তিনি একটি ইসলামী অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিলেন। তুরাবির নেতৃত্বের এই বিশেষ কৌশলই তাঁকে সুদানী রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যমণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তুরাবি একই সাথে সুদানের ব্রাদারহুডের নেতৃত্বও দিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে যেয়ে অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সাথে তার প্রতিদ্বদ্ধিতায় নামতে হয়েছে। এই প্রতিদ্বদ্ধিতায় তিনি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন এবং ব্রাদারহুডের মতো একটি এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানকে রীতিমত জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেছন।
হাসান আল তুরাবির চিন্তাভাবনার মূলে আছে তাঁর ইসলামকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। কিন্তু সেই রকম সামর্থ্য অর্জন করতে হলে তুরাবি মনে করেন আধুনিককালে ইসলামের তাজদীদ বা পুনরুজ্জীবন দরকার। এই কাজ করতে হলে প্রথমে চাই একালে মুসলিম সমাজের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সকল বিশ্বাসীকে এই পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া। তুরাবির মুসলিম ইতিহাস চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তাজদীদ। কারণ প্রতি যুগেই ইসলামের তাজদীদ প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যায় এবং ইসলাম পরিণত হয় একটি আচারসর্বস্ব জীবনীশক্তিহীন ধর্মে। অবশেষে দেখা যায় ইসলাম বিশ্বাসীরা এমন রীতিনীতি নিয়ে বসবাস করছে যাকে আর কোনভাবেই ইসলামসম্মত বলা চলে না। 
তুরাবি তাই মনে করেন ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এই তাজদীদ ও তাকলীদের (অতীতের অন্ধ অনুকরণ) পারস্পারিক উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বমানতা বরাবর ছিল। তুরাবি অবশ্য এটা মনে করেন না তাজদীদ মানে হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিকে পাল্টে দেয়া কিংবা নতুন পরিস্থিতির সাপেক্ষে কুরআন শরীফের পরিবর্তন ঘটানো। তুরাবির কাছে তাজদীদ মানে হচ্ছে: The revelation in the Qur’an is the comprehensive revelation of God’s eternal truth. However, the implications of that Qur’anic message for specific peoples, times and places do change.[ John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam. New York; Oxford University Press, 2001..]
১৯৬৫ সালে সুদান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেখানকার সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে তুরাবী যে মতামত দেন তার মধ্যে এরকম অভিব্যক্তি দেখা যায়। সুদান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৪ সালে আবুদ সরকারের পতনে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রাখা এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের সংসদ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি সিট পায়। কিন্তু ব্রাদারহুডের চাপে পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে বিল পাস হয়। এ ঘটনাকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করলে সেখানকার সুপ্রিম কাউন্সিল তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সার্বিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন, যার সদস্য হিসেবে তুরাবি কাজ করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যের মতো তুরাবিও আইন প্রণয়নে সংসদের চূড়ান্ত ক্ষমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং একই সাথে তিনি রিপোর্টের সাথে যোগ করে দেন: The Constituent Assembly is the agency entrusted with the exercise of the highest constitutional authority and it is an expression of the sovereignty which the constitutions establish for the Ummah after God.
এখানে তুরাবির ‘খোদার পরে’ শব্দটার ব্যবহার লক্ষণীয়। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বকে তিনি খোদায়ী কর্তৃত্বের আয়ত্তাধীন রেখেছেন যা তাঁর ইসলামী প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ। তুরাবী শুধুরিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, এই সাংবিধানিক সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি লেখেন: The Sudanese constitution is simply a collection of limbs amputated from foreign constitutions and imposed on the Sudanese people.
সুতরাং ধার করা ব্যবস্থা নয়; কার্যকর সংস্কার ও পুনর্জীবনের কাজ করতে হলে ইসলামের ভিত্তিতেই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তুরাবির পুনর্জীবনের জন্য দু’টি বিষয় চিহ্নিত করেছেন। একটি ফিকাহ্র পুনঃনির্মাণ, অপরটি শরীয়াহ্র বাস্তবায়ন। মুসলিম চিন্তার জগতে শরীয়াহ বিবেচিত হয় ইসলামী আইন হিসেবে যার উৎস হলো পবিত্র কুরআন ও রাসূলের (সা.) সুন্নাত। অন্যদিকে ফিকাহ্ হচ্ছে শরীয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, বিশ্লেষণ ও তার ফলাফল। তার মানে ফিকাহ্ হচ্ছে মানবীয় চিন্তাপ্রসূত, শরীয়াহ ঐশী জ্ঞানলব্ধ। ফিকাহ্ হচ্ছে শরীয়াহ্র উপর ভিত্তি করে মানবীয় সমস্যার সমাধান বের করার পদ্ধতি। মুসলিম সমাজের মধ্যকার সমতা ও ইনসাফের ধারণা যা কিনা শরীয়াহ্ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তাকে উপেক্ষা করা হলো। এর ফলে জন্ম হলো তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজের। ঐতিহাসিক অবক্ষয়ের ধাক্কায় যে তথাকথিত মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে তুরাবী মনে করেন এটিকে আজ বদলে ফেলা দরকার এবং ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই সংগ্রামে এগিয়ে আসা। তার কথা শোনা যাক:  A revolution against the condition of women in the traditional Muslim societies is inevitable and that is the task of Islamists to close the gap between the fallen historical reality and the desired model of ideal Islam.[ Hasan Turabi, Women in Islam and Muslim Society. London: Mile Stones, 1991.] তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার বলতে কি বোঝায়? তুরাবী একটা মডেল খাড়া করেছেন, যদিও এ মডেল প্রশ্নোর্ধ্ব নয়। তবুও বলতে হবে ইসলামী দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল একালে তাঁর মত দু’একজনই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এখানেই তুরাবীর সাফল্য। ইসলামবাদীরা এ মডেল থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভবিষ্যতের ইসলামবাদীরা এ মডেলের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অতিক্রম করে নতুন মডেল উপস্থাপন করবেন এ আশা করা যায়।
তুরাবী বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হবে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক। কোনভাবেই এটা স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা নয়। এখানে সরকারের ভূমিকা অনেকখানি সীমিত। আইন সামাজিক নিয়ন্ত্রনের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। নৈতিক বিধি, ব্যক্তির বিবেকবোধ এসবেরও গুরুত্ব রয়েছে এবং এসবই স্বাধীন মতামতের ব্যাপার। ইসলামের প্রতি মননশীল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে তা মোটেই নিয়ন্ত্রিত বা বিধিবদ্ধ হবে না। মূল ধারণাটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রে স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অমুসলিমের স্বাধীনতা নয়, মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার বহুত্বকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ইসলামের মূল তত্ত্বটা তৌহিদবাদী। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সেকুলার রাষ্ট্রের মতো নয়। ইসলামী রাষ্ট্রও সেকুলার নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ধর্মহীনতা আত্মবিভাজন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পথ পরিষ্কার করে

Popular Posts