Thursday, January 19, 2017

ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিকভাবে এর বিস্তার এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল   

সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ:) সহ আরো কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী ব্যাংকের পরিকল্পনা ওআইসিতে গৃহীত হয়। ১৯৭৪ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সদস্যভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের সক্রিয় সহযোগিতায় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক নামের একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালের জেদ্দাকে কেন্দ্র করে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে সর্বপ্রথম ইসলমী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর পূর্বেই সোশ্যাল ব্যাংক নামে মিশরে একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে ইসলামী ব্যাাংক প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, কুয়েত, সৌদী আরব প্রভৃতি দেশে বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার জন্য এগিয়ে আসে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। 
                                                        See this video:
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামীর অবদান
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে একটি বড় পরিবর্তন আসে ১৯৮৩ সালে, যখন ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক প্রথম ব্যাংক - ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে সুদমুক্ত, অংশীদারিত্বভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর পথ প্রশস্ত হয়। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য, যা আদর্শিক চিন্তা, সংগঠনিক প্রচেষ্টা, নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়।

আদর্শিক প্রেক্ষাপট
জামায়াতে ইসলামীর মূল রাজনৈতিক ও আদর্শিক লক্ষ্য ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যার অন্যতম স্তম্ভ সুদবিহীন অর্থনীতি। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ইসলামী বিধানের পরিপন্থী। এই আদর্শ থেকেই তারা ইসলামী ব্যাংকিং চালুর জন্য সচেতনতা সৃষ্টি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠান গঠনে ভূমিকা
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠায় সরাসরি অংশ নেন জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা মীর কাসেম আলী, যিনি ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বিদেশি বিনিয়োগ সংগ্রহ, ব্যাংকের নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরিচালনা পর্ষদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া জামায়াত-ঘনিষ্ঠ আরও অনেক অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী ব্যাংকের সাথে যুক্ত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক সংযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা
জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও অন্যান্য মুসলিম দেশের ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীদের সমর্থন আদায়ে তারা সক্রিয় ছিলেন। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও আল রাজি ব্যাংক-এর মতো প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এ বিনিয়োগ করে।

মানবসম্পদ ও আদর্শিক কর্মী
ব্যাংকটি পরিচালনার ক্ষেত্রে জামায়াতের আদর্শিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ দলের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন থেকে আসা সদস্যরা ব্যাংকে নিয়োজিত হয়ে এর প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। ফলে ব্যাংকটি শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি আদর্শিক মিশন হিসেবে পরিচালিত হতো।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
জামায়াতে ইসলামী ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসেবে নয়, বরং সমাজে ন্যায়ভিত্তিক একটি অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেও উপস্থাপন করেছিল। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলেই বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ইসলামী ব্যাংকিং একটি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ধারায় পরিণত হয়েছে।

উপসংহার
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার মাধ্যমে দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং চালু হয়। এই উদ্যোগের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক প্রভাব, সংগঠনিক দক্ষতা এবং নেতৃত্বের অবদান ছিল সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ। আজ বাংলাদেশে যে ইসলামী ব্যাংকিং একটি শক্তিশালী খাত হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
 
বি. দ্র. : ২০১৫ সালে নানা অভিযোগ তুলে আওয়ামী সরকার জামায়াত ইসলামীর কাছ থেকে ব্যাংকটির মালিকানা ছিনিয়ে নেয়। এরপর ব্যাংকটির পরিচালনায় পরিবর্তন আনা হয় এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব হ্রাস পায়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও বিপ্লবে আওয়ামী অবৈধ দখলদার সরকার বিদায় হওয়ার পর পুনরায় ব্যাংকটিতে জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কিছু পরে (ডিসেম্বর ২০২৪) বিএনপির এক নেতার সমালোচনার জবাবে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ইসলামী ব্যাংক দখল করেনি জামায়াতে ইসলামী, ডাকাতের বেশে নতুন ডাকাতরা ৫ আগস্টের পর ব্যাংক দখল করতে গিয়েছিল। তারা পালিয়ে এসেছে। জামায়াতে ইসলামী ব্যাংক দখল করেনি, বরং এই ব্যাংক তার মায়ের কোলে ফিরে এসেছে।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts