Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts
Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts

Wednesday, August 8, 2018

বিপদে হতাশা ও সুখে অহঙ্কার -জাফর আহমাদ


মানব সভ্যতার ইতিহাস বড়ই বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতির পালাবদলের মতো মানুষের মনও বদলায়। দূর অতীত থেকে মানবজীবনের কর্মচঞ্চল অঙ্গনে পদে পদে এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। শরতের প্রকৃতি যেমন সবদিক সবুজ শ্যামল দেখা যায় এবং মন নেচে উঠে সবুজের সমারোহে কিন্তু সে তখন ভুলে যায় যে, সবুজের এই সমারোহ একদিন তিরোহিত হয়ে পাতা ঝরার মওসুমও আসতে পারে। মানুষের প্রকৃতি অনেকটা এ রকমই। কখনো সে সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে এবং শক্তি-সামর্থ্য লাভ করলে সে তখন অহংকার করে বেড়ায়। তার মনের কোণে এ কথা একবারও উঁকি দেয় না যে, এই শক্তি-সামর্থ্য ও সম্পদের পাহাড় বা প্রভাব-প্রতিপত্তি পাতা ঝরা মওসুমের মতো যে কোন সময় চলে যেতে পারে। আল্লাহর রাসূল একবার নয় বেশ বার বলেছেন অহংকার করো না।

আবার এই মানুষটিই কোন বিপদে পড়লে আবেগে উত্তেজনায় কেঁদে ফেলে, বেদনা ও হতাশায় ডুবে যায়, তার সারা মন-মস্তিষ্ক এতটা বেসামাল হয়ে পড়ে যে, আল্লাহকে পর্যন্ত গালমন্দ করে বসে এবং তাঁর সার্বভৌম শাসন কর্তৃত্বকে অভিসম্পাত করে নিজের দুঃখ- বেদনা লাঘব করতে চেষ্টা করে। তারপর যখন দুঃসময় পার হয়ে গিয়ে সুসময় এসে যায় তখন আবার সেই আগের মতই দম্ভ ও অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং সুখ-ঐশ্বর্যের নেশায় মত্ত হয়। এ হচ্ছে মানুষের নিচতা, স্থুলদৃষ্টি ও অপরিণামদর্শিতার বাস্তব চিত্র।
মানুষের এ নিচপ্রকৃতি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে আমাদের ক্ষমতাসীনদের মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর শাসকেরা যখন পরিপূর্ণরূপে ক্ষমতা পায় তখন তার অতীতের হীন অবস্থার কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য হীনতর অবস্থার কথা। ফলে তারা সারা রাজ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করে, জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায় এবং তারা আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয়। তারা আল্লাহর আজাবের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে ও বলতে থাকে। যারা এগুলো বলে, তাদেরকে তারা ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করে। তাদের আত্মম্ভরিতার মাত্রা এতটুকুই বেড়ে যায় যে, ‘কই তোদের রব? কই তোদের রবের আজাব? তোদের প্রভু তো রক্ষা করতে আসে না? (নাউজুবিল্লাহ) বরং উল্টো আমরাই সুখ-ঐশ্বর্যের সাগরে ভাসছি, চারদিকে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের ঝাণ্ডা উড়ছে। প্রকৃতপক্ষে এরা নিজেরাই পাগল হয়ে পড়েছে। শয়তান ওদের সামনে রঙিন পৃথিবীর স্বপ্ন বার বার উপস্থাপন করে মোহাবিত করে তুলে। আল্লাহ তা’আলাও তাদের কৃতকর্মকে সুদৃশ্য করে দেন। ফলে তারা আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে। তার মধ্যে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করে। তার কাছে সত্য মিথ্যা, শিরকও তাওহিদ, পাপ ও পুণ্য এবং সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্র অর্থহীন মনে হয়। তার কাছে এখানকার ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশ, বস্তুগত উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং শক্তি ও কর্তৃত্বই মনে হবে কল্যাণকর। প্রকৃত তত্ত্ব ও সত্যের ব্যাপারে মাথা ব্যথাই থাকবে না।
প্রথমে বলেছিলাম এ ধরনের ব্যক্তিদের কার্যাবলিকে শোভন বা সুদৃশ্য বানিয়ে দেয়া হয়। আল কুরআনে কখনো আল্লাহর কাজ কখনো শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। যখন বলা হয়, আল্লাহ তার কাজগুলো আরো শোভন করে দেন তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের কাছে স্বভাবতই জীবনের এ সমতল পথই সুদৃশ্য অনুভূত হতে থাকে। আর যখন বলা হয় শয়তান তার কার্যাবলি শোভন করে দেয়, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, এ চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি অবলম্বনকারীদের সামনে শয়তান সব সময় একটি কাল্পনিক জান্নাত পেশ করে থাকে এবং বলে আশ্বাস দিতে থাকে শাবাশ বেটারা এগিয়ে যাও।
এগুলো তাদের নিচ সহজাত প্রবৃত্তির একটি নিকৃষ্টতর প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছু নয়। মহান করুণাময় আল্লাহ তা’আলা তাদের দুঃসাহসিক ভ্রষ্টতা ও অসৎকার্যাবলি সত্ত্বেও নিছক তাঁর অনুগ্রহ ও করুণার কারণে তাদের শাস্তি বিলম্বিত করছেন। তাদের সংশোধিত হবার সুযোগ দেয়াই উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা এ অবকাশ কালে ভাবছে, আমাদের সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য কেমন স্থায়ী বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আমাদের এ বাগানে কেমন চিরবসন্তের আমেজ লেগেছে, যেন এখানে শীতের পাতা ঝরার মওসুমের আগমনের কোন আশঙ্কাই নেই।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এমন এক সময় আসা বিচিত্র নয় যখন আজ যারা অস্বীকার করছে, তারা অনুশোচনা করে বলবে, হায়, যদি আমরা আনুগত্যের শির নত করে দিতাম! ছেড়ে দাও এদেরকে, খানাপিনা করুক, আমোদ ফুর্তি করুক এবং মিথ্যা প্রত্যাশা এদেরকে ভুলিয়ে রাখুক। শিগগির এরা জানতে পারবে। ইতঃপূর্বে আমি যে জনবসতিই ধ্বংস করেছি তার জন্য একটি বিশেষ কর্ম-অবকাশ লেখা হয়ে গিয়েছিল। কোন জাতি তার নিজের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ধ্বংস হতে পারে না, তেমনি সময় এসে যাওয়ার পরে অব্যাহতিও পেতে পারে না।” (সূরা হিজর : ২-৫)
অপরাধ করার সাথে সাথে আল্লাহ কাউকে গ্রেফতার করেন না। আর এই জন্য নির্বোধরা ধারণা করে নিয়েছে যে, ইসলাম, ইসলামী হুকুম-আহকাম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের সাথে অসদাচরণ করা হলেও কিছু হয় না। অথচ আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেক জাতিকে শুনবার, বুঝবার নিজেকে শুধরে নেবার জন্য কী পরিমাণ অবকাশ দেয়া হবে এবং তার যাবতীয় দুষ্কৃতি ও অনাচার সত্ত্বেও পূর্ণ ধৈর্য সহকারে তাকে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে তা আল্লাহ পূর্বাহ্নেই স্থির করে নেন। যতক্ষণ এ অবকাশ থাকে এবং আল্লাহর নির্ধারিত শেষ সীমা না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ঢিল দিতে থাকেন। এই নির্ধারিত সময়সীমা কিয়ামত পর্যন্ত হতে পারে। আবার এমনটিও হতে পারে যে, তাদের কর্মকাণ্ড যদি বিকৃতির চরম পর্যায় ধারণ করে তাহলে তার কর্মের অবকাশ কমিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। যার নজির আমাদের সামনে অনেক রয়েছে।
ঢিল দেয়া বা ধ্বংস করে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, এখানেই সব শেষ। বরং আখিরাতে তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ বলেন, যারা নিজেদের রবের দাওয়াত গ্রহণ করেছে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে আর যারা তা গ্রহণ করেনি তারা যদি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং এ পরিমাণ আরো সংগ্রহ করে নেয় তাহলেও তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য এ সমস্তকে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে তৈরি হয়ে যাবে। এদের হিসেব নেয়া হবে নিকৃষ্টভাবে এবং এদের আবাস হবে জাহান্নাম, বড়ই নিকৃষ্ট আবাস। (সূরা রাদ : ১৮)
এই দুই প্রকারের মাঝে সফলকামী আরো কিছু মানুষ ও দল আছে যারা উভয় অবস্থায় ভারসাম্যনীতি অবলম্বন করে। সুখ এলে আল্লাহর শোকরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায় আর দুঃখ যাতনা ও বেদনা এলে ধৈর্যধারণ করে। সবরকারি ব্যক্তি বা দল কালের পরিবর্তনশীল অবস্থায় নিজের মানসিক ভারসাম্য অটুট রাখে। সময়ের প্রত্যেকটি পরিবর্তনের প্রভাব গ্রহণ করে তারা নিজেদের রঙ বদলাতে থাকে না। বরং সব অবস্থায় একটি যুক্তিসঙ্গত ও সঠিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলে। যদি কখনো অবস্থা অনুকূলে এসে যায় এবং সে ধনাঢ্যতা, কর্তৃত্ব ও খ্যাতির উচ্চাসনে চড়তে থাকে তাহলে শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকারের নেশায় মত্ত হয়ে বিপথে পরিচালিত হয় না। আর কখনো বিপদ-আপদ ও সমস্যা-সঙ্কটের করাল আঘাত তাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে তাহলে এহেন অবস্থায়ও সে নিজের মানবিক চরিত্র বিনষ্ট করে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে সুখৈশ্বর্য বা বিপদ-মুসিবত যে কোন আকারেই তাকে পরীক্ষায় ফেলা হোক না কেন উভয় অবস্থায়ই তার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অপরিবর্তিত ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তার হৃদয়পাত্র কখনো কোন ছোট বা বড় জিনিসের আধিক্যে উপচে পড়ে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক

Tuesday, August 7, 2018

তুরস্কে সাদাত পার্টির ভোট কি আসলেই কমেছে? -রহমত উল্লাহ

তুরস্কের নির্বাচনের ফলাফলে সাদাত পার্টির আসন না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশি গবেষকদের কাছ থেকে। এ নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে নিরপেক্ষ একটি বিশ্লেষণের অনুরোধ করেছেন অনেকেই। সে কারণেই এ লেখা।
সাদাত পার্টির ভোট বেড়েছে দ্বিগুণ

২০১৫ সালের ১ নভেম্বরের নির্বাচনের তুলনায় ২৪ জুনের নির্বাচনে সাদাত পার্টির ভোট সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০১৫ সালের ১ নভেম্বরে সংসদ নির্বাচনে সাদাত পার্টি ০.৭% ভোট পেয়েছিল। ভোট সংখ্যা ছিল : ৩ লাখ ২৬ হাজার ৫০টি। গত ২৪ জুনের নির্বাচনে সাদাত পার্টি পেয়েছে ১.৩ শতাংশ ভোট। প্রাপ্তভোট ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩১টি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাদাত পার্টি ভোট বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। (দেখুন : ইয়েনি শাফাক পত্রিকার নির্বাচনী তথ্যসমগ্র)।

সাদাত পার্টি কেন আসন পেল না?

তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু সমীকরণ রয়েছে। এ সমীকরণ না জানলে সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর অর্জনের মূল্যায়ন করা কঠিন।
১. তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে কোনো দল মোট ভোটের সর্বনিম্ন ১০% না পেলে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এ কারণে ২০০২ সাল থেকে সংসদে সাদাত পার্টির অংশগ্রহণ নেই।
২. ২৪ জুন জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা দলগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ১০% ভোটের শর্ত ছিল না। ফলে সাদাত পার্টি থেকে কয়েকজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু জোটবদ্ধ হলেও রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক পৃথক প্রার্থী দেয়ায় সমীকরণ বদলে যায়।
৩. ২৪ জুনের নির্বাচনে ৫টি দল সর্বনিম্ন ১০% ভোটের কোটা পূরণ করায় সব প্রদেশেই এ ৫টি দলের প্রার্থীরা ভোট বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছেন। সংসদ সদস্যদের জয়ের ক্ষেত্রে দেশব্যাপী মোট ভোটে এগিয়ে থাকা দলের প্রার্থী, এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দলের প্রার্থী……. এভাবে নিচের দিকে নামা হয়। তা ছাড়া জোটের হিসেবের ক্ষেত্রে প্রথমে জোটের প্রাপ্তভোট অনুযায়ী প্রদেশগুলোতে বিজয়ীদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এরপর প্রদেশগুলোতে জোটবদ্ধ দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট অনুয়ায়ী বিজয়ী প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়।
ফলে দেখা গেছে, সাদাত পার্টি কোনো প্রদেশেই সংসদ সদস্যদের জয়ী করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট না পাওয়ায় সংসদ সদস্য পায়নি।

সাদাত পার্টির কেউ কি সংসদে যেতে পারছে না?

দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থীকে জয়ী করাতে না পারলেও সাদাত পার্টির পক্ষ থেকে সিএইচপির ব্যানারে ৩ জন সদস্য জয় পেয়েছেন। এ তিন সংসদ সদস্য দলীয় ব্যানার ব্যবহার করতে পারবেন কি-না তা বলা মুশকিল।
সাদাত পার্টি কেন এ কে পার্টির সঙ্গে জোট করলো না সে সম্পর্কে বিশ্লেষকদের বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। তবে তুরস্কে ইসলামী রাজনীতির প্রবর্তক নাজিমুদ্দিন এরবাকানের দল ভেঙে বেরিয়ে আসা রজব তাইয়্যেব এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুলের নেতৃত্বে গঠিত এ কে পার্টির সঙ্গে প্রথম থেকেই দূরত্ব বজায় রেখে আসছে সাদাত পার্টি।
লেখক : তুরস্ক প্রবাসী পিএইচডি শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক

Tuesday, July 17, 2018

আত্মীয়-স্বজনের সাথে গড়ে উঠুক জান্নাতী সম্পর্ক -ড. মো: আকতার হোসেন

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং নিজের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। (বুখারি ও মুসলিম)
রাবি পরিচিতি :

আনাস ইবনে মালিক (রা) ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী, খাদিমে রাসূল, ইমাম, মুফতি, মুয়াল্লিমে কুরআন, মুহাদ্দিস, খ্যাতিমান রাবি, আনসারি, খাযরাজি ও মাদানি। কুনিয়াত আবু সুমামা ও আবু হামযা। উনার উপাধি ‘খাদিমু রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরতের দশ বছর আগে ৬১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মালিক ইবন নাদর এবং মাতা উম্মু সুলাইম সাহলা বিনতু মিলহান আল-আন সারিয়্যা। উম্মু সুলাইম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) খালা হতেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) যখন মদীনায় আসেন তখন প্রসিদ্ধ মতে আনাসের বয়স দশ বছর। রাসূল (সা) একটু স্থির হওয়ার পর আনাসের মা একদিন তাঁর হাত ধরে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর খাদিম হিসেবে পেশ করেন। হযরত আনাস (রা) সর্বদা রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের সান্নিধ্যে থাকতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তাঁর খিদমতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের সাথে প্রায় সকল অভিযান যেমনÑ বদর, উহুদ, খন্দক, কুরায়জা, মুসতালিক, খাইবার, হুনাইন ও তায়িফ ইত্যাদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
হযরত আনাসের মৃত্যুসন ও মৃত্যুর সময় বয়স সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হিজরি ৯৩ সনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তখন তাঁর বয়স হয়েছিল একশো বছরের ঊর্ধ্বে। কুতন ইবন মুদরিক আল-কিলাবী জানাযার নামায পড়ান। বসরার উপকণ্ঠে ‘তিফ্ নামক স্থানে তাঁর বাসস্থানের পাশেই কবর দেয়া হয়। হযরত আনাস ছিলেন দুনিয়া থেকে বিদায়গ্রহণকারী বসরার শেষ সাহাবী। সম্ভবত একমাত্র আবুত তুফাইল (রা) ছাড়া তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো সাহাবী জীবিত ছিলেন না। মৃত্যুকালে হযরত আনাস মোট ৮২ জন ছেলেমেয়ে রেখে যান। তাদের মধ্যে ৮০ জন ছেলে এবং হাফসা ও উম্মু আমর নামে দুই মেয়ে। তা ছাড়া নাতি-নাতনীর সংখ্যা ছিল আরও অনেক।
তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মোট ২২৮৬। মুত্তাফাক আলাইহি ১৮০, বুখারি এককভাবে ৮০ এবং মুসলিম এককভাবে ৭০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর ছেলে এবং নাতীদের থেকেও বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম আলোচ্য হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা মানুষের মাঝে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দয়া ও সহযোগিতার মূলভিত্তি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নষ্ট হলে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। বর্তমান সময়ের পত্রিকার পাতায়, অনলাইন ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়াসহ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় সমাজের অনেক মুসলমানই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ও আত্মীয়স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। আত্মীয়স্বজনের সাথে মিলনের সেতুবন্ধকে ছিন্ন করে চলেছেন। আপন পিতা-মাতাকে পাঠাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেক পিতা-মাতা ছেলেমেয়ে বেঁচে থাকার পরও জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন।

আত্মীয় কারা:

ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝায় মা ও বাবার দিক থেকে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দেরকে। সুতরাং পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এবং তাদের ঊর্ধ্বতন ও নিম্নতম ব্যক্তিবর্গ ও সন্তানগণ। এরা সবাই আরহাম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত। এদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম কারণ বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
“এবং তারা (রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়) আলাহর বিধান মতে তারা পরস্পর বেশি হকদার।” (সূরা আহজাব, আয়াত : ৬)
কারো মতে আত্মার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়। সাধারণত রক্ত, বংশ কিংবা বৈবাহিক সূত্র থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শরয়ী বিধান অনুযায়ী আত্মীয়স্বজনের আলাদা আলাদা হক বা অধিকার আছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ওয়াজিব। শরয়ী কারণ ছাড়া সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পূর্ণ হারাম। আলাহর বাণী,
“আর তোমরা আলাহকে ভয় কর, যার নামে একে অন্যের নিকট হতে অধিকার চেয়ে থাক এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ আলাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।” (সূরা নিসা-১)

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব:

কুরআন ও হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আলাহতা’আলা বলেন, তোমরা এক আল্লাহ তায়ালার এবাদাত করো, কোনো কিছুকেই তাঁর সাথে অংশীদার বানিয়ো না এবং পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, যারা ( তোমাদের) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এতীম, মেসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, কাছের প্রতিবেশী, পাশের লোক, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত (দাস দাসী, তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার করো), অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে কখনো পছন্দ করেন না, যে অহংকারী ও দাম্ভিক। ( সূরা আন নেসা-৩৬)
হাদীসের আলোকে জানা যায়, কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে আলাহ তার সাথে নিজ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন, আলাহ বলেন, “আমি রহমান, আমি রাহেমকে (আত্মীয়তার বন্ধন) সৃষ্টি করেছি। রাহেম নামটিকে আমি নিজের নাম থেকে নির্গত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (বুখারি, আহমাদ ও তিরমিজি)
নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না বলে ঘোষণা করেছেন। যেমনÑ জুবাইর ইবনে মুতঈম (রা) থেকে বর্ণিত আলাহর রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম ইরশাদ করেছেন,
“আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল আলাহতা’আলা কবুল করেন না। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন, “আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমার রাতে (আলাহর নিকট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না। (আহমাদ) এ কারণেই রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন “যে ব্যক্তি আলাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।” (বুখারি)
হজরত আয়িশা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম ইরশাদ করেন, রাহেম (আত্মীয়তার সম্পর্ক) আরশের সাথে ঝুলানো রয়েছে। সে বলে, যে আমাকে জুড়ে দেবে, আলাহ তাকে জুড়ে দেবেন। যে আমাকে ছিন্ন করবে আলাহ তাকে ছিন্ন করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)
আমাদের প্রিয়নবী সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম ছিলেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মূর্তপ্রতীক। আবু সুফিয়ান (রা:) ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হিরাক্লিয়াস তার কাছে রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সম্পর্কে বিবরণ জানতে চান। তিনি বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে যে, “তিনি আমাদের আলাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিক শুভ্রতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।”
হযরত আবদুলাহ ইবনে আনাস (রা:) বলেন, “যখন রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম মদিনায় আগমন করেন, তখন আমি তার নিকটবর্তী হলাম। যখন আমি তার চেহারা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম, বুঝতে পারলাম যে, নিঃসন্দেহে এটি কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। তিনি প্রথমে যে কথা বলেছিলেন তাহলো, “হে লোকসকল, ইসলামের প্রচার কর, গরিবদের অন্ন দান কর, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা কর, রাতের বেলায় নামায আদায় কর, তাহলে তোমরা সহজে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিজি)
আমর ইবনে আস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামকে প্রকাশ্যে বলতে শুনেছি, অমুকের বংশধররা আমার বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষক নয়। আমার বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষক হলো আলাহ এবং নেককার মুমিনগণ। তবে তাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আমি তা সজীব রাখার চেষ্টা করব। (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আবু বকর (রা:) খালাতো ভাইকে অর্থনৈতিক সাহায্য করতেন। ইফকের ঘটনায় এ ভাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছিলেন। এতে তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি ঠিক করলেন এ ভাইকে সাহায্য করবেন না। কিšু— মহান আলাহ এটা পছন্দ করলেন না। (সূরা নূর : ২২) ফলে আবু বকর (রা) তার সিদ্ধান্ত বদলালেন।
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন পিতা-মাতা। কুরআন ও হাদীসের আলোকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরজ আইন ইবাদত। কুরআনে আলাহ বারবার তার নিজের ইবাদতের করার পরই পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আলাহ বলেন,
“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। পিতা-মাতা উভয়ে বা তাদের একজন যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদেরকে ‘উফ’ বলবে না। তাদেরকে ধমক দেবে না এবং তাদের সাথে সম্মানজনক বিনম্র কথা বলবে। মমতাবশে তাদের জন্য নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করে রাখবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাদেরকে দয়া করুন যেমনভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)
শিরকের পরে ভয়ঙ্করতম কবিরা গুনাহ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন, কঠিনতম কবিরা গুনাহ আলাহর সাথে শিরক করা, এরপর পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। (বুখারি)
পিতা-মাতার খিদমতকে নামাযের পরেই সর্বোত্তম আমল বলে ঘোষণা করে প্রিয়নবী সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল হলো সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা এবং পিতা-মাতার খিদমত করা। (বুখারি ও মুসলিম)
রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম আরো বলেন, “পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আলাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আলাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি)
রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন,
“তার ধ্বংস হোক, তার ধ্বংস হোক, তার ধ্বংস হোক!! বলা হলো, কার কথা বলছেন ইয়া রাসূলালাহ! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার কোনো একজনকে বা উভয়কে বার্ধক্যে পেয়েছে, অথচ জান্নাতে যেতে পারল না।” (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, তিন ধরনের ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না; তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি; দাইয়ুস অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি যার স্ত্রী ব্যভিচারিণী অথচ সে তাতে বাধাদান করেনি বা তার প্রতিকার করেনি এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী। (নাসাঈ)
হাদিসের সূত্র মতে মাতা-পিতার মৃত্যুর পরেও সন্তানের জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে যায় । সেগুলো হলো, ১) মাতা-পিতার জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা, ২) তাঁদের কৃত ওয়াদা এবং বৈধ অসিয়তসমূহ পালন করা, ৩) তাঁদের বন্ধুদের সাথে সুন্দর আচরণ করা এবং ৪) তাঁদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় এবং সুন্দর আচরণ করা। (আল আদাবুল মুফরাদ)
এভাবে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের হকের ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে যা স্বল্প পরিসরে উলেখ করা সম্ভব নয়।

শেষ কথা :

আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের প্রতি অবহেলা সীমাহীন। ফলে আমাদের মাঝ থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদি লোপ পাচ্ছে এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। অথচ পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজন হক আদায় করা একজন মুমিনের জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে এ ব্যাপারটি অনুধাবন করা সকলের জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Saturday, July 14, 2018

মুমিনের দুনিয়াদারি এবং তাকওয়া -ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

বিশ্বাসের নাম ঈমান। এ বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি। এ বিশ্বাস রাসূলের প্রতি। তাওহিদ রিসালাত ও আখিরাতই বিশ্বাসের অন্যতম মৌল বিষয়। আল্লাহ মানুষকে হেদায়েত করার জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। হযরত মুহাম্মদ সা. শেষ নবী এবং তারপর আর কোনো নবীর আগমন ঘটেনি বা ঘটবে না। আল্লাহ প্রত্যেক নবী বা রাসূলের প্রতি অহি বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে মুহাম্মদ সা. কে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, (হে নবী!) আমি আপনার প্রতি অহি পাঠিয়েছি, যেমন করে অহি পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং তার পরবর্তী নবী-রাসূলদের প্রতি। আর অহি পাঠিয়েছি ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার সন্তানদের প্রতি। আর আমি দাউদকে দান করেছি জাবুর কিতাব। এ ছাড়া এমন রাসূল পাঠিয়েছি যাদের ইতিবৃত্ত পূর্বে আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমনও অনেক রাসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি। আর আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথোপকথন করেছেন সরাসরি। সুসংবাদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রাসূলদের পাঠিয়েছি, যাতে রাসূলদের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মতো কোনো অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী বিজ্ঞানময়। আল্লাহ আপনার প্রতি যা নাজিল করেছেন তা তিনি জেনে শুনেই নাজিল করেছেন। আল্লাহ নিজেই এর সাক্ষী এবং ফিরেশতারাও সাক্ষী। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা নিসা : ১৬৩-১৬৬) এ সবের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই ঈমান।
যার ঈমান আছে তিনিই মুমিন। নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা প্রতিটি মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সব নবী- রাসূলকে আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন মানুষকে হেদায়েত করার জন্য। সব নবীর দাওয়াত ছিল অভিন্ন। তাদের কাউকে অস্বীকার করা ঈমান না থাকার শামিল। পবিত্র কুরআনের আগে হযরত দাউদ আ.-এর ওপর জাবুর, হযরত মূসা আ.-এর ওপর তাওরাত এবং হযরত ঈসা আ.-এর ওপর ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছিল। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরআন নাজিলের পর অন্যসব আসমানি কিতাবের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে ওইসব কিতাব আমল করা যাবে না।
আজকের পৃথিবী কত আনন্দময়। কত আড়ম্বরপূর্ণ। আমাদের জীবন ও চালচলন কত জৌলুসপূর্ণ। আমরা কত আরামপ্রিয়। সুন্দর বাড়িতে থাকি। ভালো খাবার খাই। নরম বিছানায় ঘুমাই। ফ্যান-এসি ছাড়া থাকতে পারি না। একটু কষ্ট সহ্য হয় না। যার উছিলায় আল্লাহ তায়ালা এ আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই মহামানব রাসূলে আরাবি সা. এর জীবনযাপন কেমন ছিল তা কি আমরা কখনো জেনেছি বা জানার চেষ্টা করেছি? হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পরিবার পরিজন পরপর দুই বেলা জবের রুটি দ্বারা পরিতৃপ্ত হননি। এ অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকাল হয়েছে। (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ একবেলা খেয়েছেন তো আরেক বেলা না খেয়ে থেকেছেন। এই ছিল বিশ্বনবীর ঘরের অবস্থা।
হযরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে গমন করে দেখলাম, তিনি একটি খেজুর পাতার চাটাইয়ের ওপর শায়িত আছেন। চাটাইয়ের ওপর কোন চাদর বা বিছানা ছিল না। তাঁর পবিত্র দেহে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঠেস দিয়েছিলেন খেজুরের আঁশ ভর্তি একটি চামড়ার বালিশে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন তিনি যেন আপনার উম্মতকে সচ্ছলতা দান করেন। পারস্য ও রোমের লোকদের সচ্ছলতা প্রদান করা হয়েছে। অথচ তারা কাফির, আল্লাহ তায়ালার ইবাদতবিমুখ। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র ওমর! তুমি কি এখনো এ ধারণা রাখছ? তারা তো এমন সম্প্রদায়, যাদের পার্থিব জীবনেই নিয়ামত দান করা হয়েছে। অন্য এক বর্ণনাতে রয়েছে, তুমি কি এতে খুশি নও, তারা দুনিয়া লাভ করুক আর আমাদের জন্য থাকুক পরকাল। (বুখারি ও মুসলিম)
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. ইরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মিসকিন অবস্থায় জীবিত রাখুন। মিসকিন অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং মিসকিনদের সঙ্গে হাশর করুন। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বললেন, তা কেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, মিসকিনগণ ধনী লোকদের থেকে ৪০ বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবে। হে আয়েশা! কোনো মিসকিনকে তোমার দরজা থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না। অন্তত খেজুরের একটি টুকরা হলেও তাকে দিয়ে দিও। হে আয়েশা! মিসকিনকে ভালোবাসবে এবং তাকে নিজের কাছে স্থান দিবে। তাতে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে তোমাকে নিজের কাছে স্থান দান করবেন। (তিরমিজি)
গরিব-মিসকিনকে কাছে টানতে মহানবীর সা. নির্দেশ রয়েছে। অসহায়কে ভালোবাসতে রাসূলুল্লাহ সা. এর পক্ষ থেকে বিশেষ উপদেশ এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ এরূপ লোককে দেখে যাদের ধন-সম্পদ, স্বাস্থ্য-সুস্থতা সব দিক দিয়ে তোমাদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি দান করা হয়েছে। তখন সে যেন তার নিজের তুলনায় নিম্নপর্যায়ের লোকদের দিকে লক্ষ্য করে। (বুখারি ও মুসলিম)
কেউই পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার বিবেক ও প্রবৃত্তি মহানবী সা. এর আনীত জীবনব্যবস্থার অনুগামী হয়। অতএব, আমরা হুজুর সা. এর সুন্নাতের তাঁবেদারির ওপর অটল ও অবিচল থাকি। তিনি যেসব নিষেধ করেছেন সেসব থেকে পুরোপুরি দূরে থাকি ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত সার্বক্ষণিক আপসহীন সংগ্রাম ও চেষ্টা চালিয়ে যাই। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনে কঠোর চেষ্টা ও সাধনা করবে, আমি তাদের আমার দিদার লাভের যাবতীয় পন্থাগুলো দেখিয়ে দেব। চেষ্টা বান্দার দায়িত্ব সাফল্য আল্লাহর জিম্মায়। সুতরাং একদিকে নফস বা কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা অন্যদিকে ইবাদত-বন্দেগি ও সৎ কাজগুলো বাস্তবায়নে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রত্যেক মুমিন বান্দার প্রতি অত্যাবশ্যক। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ্ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক সা. বলেন, দোজখ অবৈধ কামনা-বাসনা ও অবাঞ্ছিত লোভ-লালসার দ্বারা বেষ্টিত এবং জান্নাত দুঃখ-দৈন্য ও কষ্ট-ক্লেশ কার্যাবলির দ্বারা আবৃত। (বুখারি ও মুসলিম) হযরত জুবায়ের বিন নুফাই রা. হতে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত- হযরত রাসূলে পাক সা. বলেন, আমার কাছে এই মর্মে অহি আসেনি, আমি সম্পদ সঞ্চয় করব এবং আমি একজন ব্যবসায়ী হবো বরং আমার কাছে এই মর্মেই অহি এসেছে যে, হে রাসূল! আপনি আপনার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করুন এবং তার সিজদাকারী হোন, অর্থাৎ ইবাদত করুন। আর আজীবন সর্বকাজে তার দাসত্ব অবলম্বন করুন। (রায়হাকি)
হযরত হাসান রা. হতে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত, হযরত রাসূলে পাক সা. বলেন, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা সমস্ত অন্যায়ের মূল। (রায়হাকি) হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে মরফু সূত্রে বর্ণিত, হযরত রাসূলে পাক সা. বলেন, যখন মানুষ মারা যায় তখন ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করেন, এ লোক কী কী আমল (আল্লাহ পাকের নিকট) পেশ করেছে। কিন্তু সমাজের লোক জিজ্ঞাসা করে, এ লোক কী কী সম্পদ বা লোকজন রেখে গেছে। (বায়হাকি) হযরত নাফে রহ. বলেন, একদিন হযরত ইবনে ওমর রা. কাবাগৃহের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর ঘর! তুমি কত বড় এবং তোমার সম্মান কত বেশি। কিন্তু একজন মুমিন ব্যক্তির মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমার চেয়েও অনেক বেশি। (তিরমিজি) অন্য বর্ণনায় এসেছে, মহানবী সা. ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্য আসমানে দু’টি দরজা আছে। একটি দিয়ে তার নেক আমল আসমানে ওঠে। আর অপরটি দিয়ে আসমান থেকে তার রিজিক নাজিল হয়। যখন সে ইন্তেকাল করে, তখন দুটি দরজাই তার জন্য ক্রন্দন করে।
তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা, আত্মসংযমশীল হওয়া। এককথায় বলতে গেলে আত্মশুদ্ধি বা খোদাভীতি। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। আর যিনি তাকওয়া অনুযায়ী জীবন ধারণ করেন তাকে বলা হয় মুত্তাকি। তাকওয়া অর্জনের প্রধান উপায় হলো আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি হলো অন্তর সংশোধন, খাঁটি করা, পাপমুক্ত করা। আল্লাহ তায়ালার স্মরণ, আনুগত্য ও ইবাদত ব্যতীত অন্য সমস্ত কিছু থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখাকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়।
মানুষের আত্মিক প্রশান্তি, উন্নতি ও বিকাশ সাধনের জন্যও আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। আত্মশুদ্ধি মানুষকে বিকশিত করে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আত্মাকে পূতপবিত্র রাখল সেই সফলকাম হবে, আর সে ব্যক্তিই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষিত করবে। (সূরা শাম্স : ৯-১০) মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা শু-আরার ৮৮-৮৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন, সেদিন ধনসম্পদ কোনো কাজে আসবে না আর না কাজে আসবে সন্তান-সন্ততি। বরং সেদিন সে ব্যক্তিই মুক্তি পাবে, যে আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় করবে ও কুপ্রবৃত্তি হতে বেঁচে থাকবে, তার স্থান হবে জান্নাতে। (সূরা নাযিয়াত: ৪০-৪১) আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকওয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। তাই ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। (সূরা হুজুরাত : ১৩) মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়। (সূরা আনফাল : ২৯) রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, জেনে রেখ; শরীরের মধ্যে একটি গোশতপিণ্ড রয়েছে, যদি তা সংশোধিত হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়। আর যদি কলুষিত হয়ে যায় তবে গোটা শরীরই কলুষিত হয়ে যায়। মনে রেখ, তা হলো কলব বা অন্তর। (বুখারি ও মুসলিম) মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে সত্যিকারের মুমিনের জিন্দেগি ধারণ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : কবি ও গবেষক;
প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Thursday, July 12, 2018

মধ্যযুগ : হুজুগ ও বাস্তবতা -জিয়াউল হক


‘মধ্যযুগীয়’ বলে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের হেয় করার প্রচেষ্টা মাঝে মাঝেই দেখা যায় আমাদের তথাকথিত ‘প্রগতিশীল মহল’ বলে পরিচিত একটি মহল থেকে। পর্দা করে চলা নাকি ‘মধ্যযুগীয়’। ইসলাম চর্চা করাটাও ‘মধ্যযুগীয়’! মাথায় টুপি ধারণ করা, সুন্নতি লেবাস বলে পরিচিত পোশাক পরলে, নারী-পুরুষের অবাধ ও যথেচ্ছ মেলামেশার বিরোধিতা করলে, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড থাকার ধারণার বিরোধিতা করলে ‘মধ্যযুগীয়’ আখ্যা পেতে হয়।

এইতো সেদিন হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক তেরো দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। সেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার নামে অবাধ যৌনাচার, অশীলতা বন্ধসহ ইসলামি কৃষ্টি ও কালচারকে সমুন্নত করার ব্যাপারে কিছু দাবিদাওয়া ছিল। দাবিগুলো প্রকাশ পাওয়া মাত্র সারাদেশের ‘প্রগতিশীল’ বলে পরিচিত বাম-রাম-নাস্তিক মহলটি চিৎকার করে ওঠে, হেফাজতের দাবি মেনে নিলে দেশ নাকি ‘মধ্যযুগে’ ফেরত যাবে।
মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বাম রাজনীতিবিদ আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বলতে শুনি, আলেম-ওলামারা, জামাত-শিবিরের লোকেরা নাকি দেশকে ‘মধ্যযুগে’ ফিরত নিতে চায়!
সমস্যা হলো ‘মধ্যযুগ’ কাকে বলে? সে বিষয়টাই তারা জানেন না। ‘মধ্যযুগ’ বলতে কোন যুগকে বোঝানো হয়, সে যুগে বিশ্বের কোন দেশ কী পর্যায়ে ছিল, সে ব্যাপারে এদের বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও তারা তোতাপাখির মত ঐ একই গান গেয়ে চলেছে! অথচ ‘মধ্যযুগ’ মুসলমানদের জন্য ছিল স্বর্ণযুগ!!
বস্তুত ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত এই প্রায় এক হাজার বছর সময়কালই হলো মধ্যযুগ। এই মধ্যযুগকে আবার Early Middle age, High Middle Age এবং Late Middle Age মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
এই যে প্রায় এক হাজার বছর (সঠিকভাবে বললে বলতে হয় ৯৭৪ বছর)। এ সময়কালটা বিশ্ব ইতিহাসে দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমটা হলো, এই সময়কালেই বিশ্বের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটে, রাসূলুলাহ সা: নবুওয়াত পান এবং আল কুরআন নাজিল হয়। আর এরই হাত ধরে স্থানকালপাত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের সামনে মুক্তির দুয়ার খুলে যায়। আর এরই ওপরে ভিত্তি করে মদীনার ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার বিস্তার ঘটে এবং তার অতি উচ্চ একটা স্তর আমরা দেখতে পাই আন্দালুসে, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৪৯২ সাল পর্যন্ত।
দ্বিতীয় যে কারণ, সেটা হলো, এই সময়কালেই বিশ্বে প্রথমবারের মত ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের উত্থান ঘটে। খ্রিষ্টধর্মকে পুঁজি করে ‘হলি রোমান এম্পায়ার’ জুড়ে এ সন্ত্রাসের বিস্তারও ঘটে দ্রুত। এ সময়কালে ইসলামি বিশ্বের বাইরে, পূর্বে বা পশ্চিমের বিশাল এলাকায় অজ্ঞতা আর শোষণের মাত্রায় এক ভিন্নতা আসে, অধঃপতন ও বর্বরতার আরও এক ধাপ নিচে তারা নেমে যায়।
আজ আমরা যে ভূখন্ডকে ইউরোপ বলে জানি, সেই ইউরোপে খ্রিষ্টানরা প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের দলে দলে হত্যা করেছে, খ্রিষ্টবাদের নামে ইনকুইজিশন কোর্টের মাধ্যমে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা ‘অ্যারিয়ান’ খ্রিষ্টানদের কচুকাটা করেছে। চার্চের পাদ্রিরা ধর্মের নামে সাধারণ জনগণকে শোষণ করেছে। ‘পিটারসপেনি’ নামে পোপের জন্য চাঁদাবাজি করেছে, কিন্তু সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে কোনো কাজই তারা করেনি।
এর বিপরীতে ঐ একই সময়ে ইসলাম যে অঞ্চলে গেছে, সে অঞ্চলেই মানুষের মুক্তি ঘটেছে, তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এ রকম বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে দুইজন পদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রের তুলনামূলক বিচারে। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে কর্ডোভার জনসংখ্যা ছিল দশ লাখেরও বেশি, সেখানে ৩০০০ মসজিদ, ৮০০ স্কুল ছিল। আরও ছিল ৩০০ হাম্মামখানা।
সেই একই সময়কালে ইউরোপে পঞ্চাশ হাজারের বেশি জন সংখ্যাধ্যুষিত কোন শহরের অস্তিত্বই ছিল না! হাম্মামখানার কথাতো কল্পনাও করতে পারত না তারা! জনগণের জন্য কোন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না।
১০০০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ যখন স্যাঁতস্যাঁতে কাদা-পানিতে গিজিগিজি করছে, তখন আন্দালুসের অলিগলিতে পাকা সড়ক! ইউরোপ যখন ঘন আঁধারে নিমজ্জিত, আন্দালুসের রাস্তায় রাস্তায় তখন পথচারীদের জন্য সড়ক আলোকিত করে জ্বলছে বাতি!! ইউরোপে সবচেয়ে বড় পাঠাগারও যখন মাত্র ছয়শতের মত বই নিয়েই কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আন্দালুসের পাবলিক লাইব্রেরিটা অর্ধ মিলিয়ন তথা পাঁচ লক্ষাধিক বইয়ে ঠাসা!
এই ছিল তথাকথিত মধ্যযুগে মুসলিম ও ইউরোপীয় সমাজের তুলনামূলক চিত্র। আমার জানতে ইচ্ছা করে, আমাদের ‘সবজান্তা’ তথাকথিত প্রগতিশীল নেতা-নেত্রীরা ‘মধ্যযুগ’ বলতে ঠিক কোন চিত্রটিকে বুঝিয়ে থাকেন! না, তারা না বুঝেই কেবল ‘মধ্যযুগ’ ‘মধ্যযুগ’ বলে খেঁকশিয়ালের মতো ‘হুক্কাহুয়া’ রব তোলেন!
কোন সন্দেহ নেই যে, হুজুগপ্রবণ বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করতেই তারা এই অপপ্রচার ছড়াতে তৎপর হন। এদের এ অপচেষ্টাকে রুখতেই হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Wednesday, July 11, 2018

রমজান পরবর্তী মাসসমূহে একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য -ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

রমজান মাস রহমত বরকত এবং নাজাতের সওগাত নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছিল। খুব দ্রুত আবার তা চলে গেলো। কিন্তু রেখে গেছে অনেক স্মৃতি। অনেক ভালোলাগার আবেশ। এখনও কিছু খেতে গেলে মন কেঁপে ওঠে, মনে হয় রোজা রেখেছি! আবার একটি বছরের অপেক্ষা! ভাগ্যে আছে কি না মহান আল্লাহ ভালো জানেন। তবে এ মাসে যারা সিয়াম পালন করেছে তারা অনেক ব্যাপারে সরাসরি মহান আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলার সাথে সিয়াম পালনকারীদের সম্পর্কগুলো নিম্নরূপ:
ক. মহান আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা সূরা আল বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেন, হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল।এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি হয়ে যাবে
খ. এমন একটি মাসের সাথে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম যে মাসের মর্যাদা সকল মাসের থেকে বেশি এবং হাদিসে যাকে ‘সায়্যিদুস শুহুর’ বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ সে মাসেই আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি সূরা আল বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, রমজানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সংবলিত, যা সত্য-সঠিক পথদেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোজা রাখা অপরিহার্য।
গ. এমন একটা মাসের সাথে যুক্ত ছিলাম যে মাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু কাজ থেকে বিরত থাকলেও রাত্রে কোন কাজ থেকে বিরত থাকার দরকার ছিল না। যা নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমেই বলা হয়েছে,
ঘ. আমরা এমন একটা মাস অতিক্রম করেছি যে মাসে ছিললাইলাতুল কদর, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। সেটাও আল কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন, কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশি ভালো, ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাজিল হয়।এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।(সূরা আল কদর)
রমজান মাসে আমরা অসংখ্য হাদিসের মুখোমুখি হয়েছি। যে সব হাদিসের মাধ্যমে রাসূল সা. মানবতার সফলতার কথা, মানুষের পুরস্কারের কথা, তাদের নিরাপত্তার কথা এমনকি তাদের মুক্তির চূড়ান্ত বয়ান সেখানে বর্ণনা করেছেন।

চলুন তার কিছু বর্ণনার সাথে আমরা পরিচিত হই।

ক.
আমরা এমন মাসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম যে মাসে বদর যুদ্ধ হয়েছে। ঈমান এবং কুফরের মাঝে সরাসরি সংঘাত হয়েছে এবং চূড়ান্তভাবে ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। এ বিষয়ে অনেক আয়াত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যুদ্ধের কিছু পূর্বে রাসূল সা. এই ক্ষুদ্র কাফেলার বিজয়দানের জন্য অত্যন্ত আবেগঘন এক দোয়ায় বলেন, ইবন আব্বাস রা. বদরের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, রাসূল সা. তার হাত উঁচু করে বললেন: ‘হে আল্লাহ তুমি যদি এই দলকে ধ্বংস করে দাও তাহলে এই পৃথিবীতে কখনও কেউ আর আর ইবাদত করবে না’।…
খ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গী-সাথীদের এ মর্মে সুসংবাদ শোনাতেন, ‘তোমাদের সমীপে রমজান মাস এসেছে। এটি এক মোবারক মাস। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এতে জান্নাতের দ্বার খোলা হয়। বন্ধ রাখা হয় জাহান্নামের দরোজা। শয়তানকে বাঁধা হয় শেকলে। এ মাসে একটি রজনী রয়েছে যা সহস্র মাস হতে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো’। নাসায়ী : ২৪২৭; মুসনাদ আহমাদ : ৮৯৭৯; শুআবুল ঈমান : ৩৩২৪
গ.
যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, শয়তানকে আটক করা হয়। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যখন রমজানের প্রথম রাত্রি আগমন করে শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের সকল দরোজা বন্ধ করে দেয়া হয়; খোলা রাখা হয় না কোন দ্বার, জান্নাতের দুয়ারগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়; বদ্ধ রাখা হয় না কোন তোরণ। এদিকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, ‘হে পুণ্যের অনুগামী, অগ্রসর হও। হে মন্দ-পথযাত্রী থেমে যাও’।আবার অনেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এমনটি করা হয় রমজানের প্রতি রাতেই’। তিরমিযি : ৬৮২; ইবনমাজা : ১৬৪২; ইবনহিব্বান : ৩৪৩৫
ঘ.
এ মাসে যারা সিয়াম সাধনা করছে এবং মহান রবের কাছে কিছু প্রত্যাশা করেছে তাদের দোয়া বিফলে যাবে না। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন: তিন ব্যক্তির দু‘আ রদ হয় না। ন্যায়বিচারক শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি যখন সে আল্লাহর কাছে দু‘আ করে..।(তিরমিজি)
ঙ.
এমন একটি মাসের সাথে আমরা ছিলাম যে মাসে কোন ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় রোজা রেখেছে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে সাওম পালন করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
সম্মানীয় পাঠক, আমরা কি কখনও একটিবার হৃদয় দিয়ে ভেবেছি, আমাদের সিয়াম সাধনার পুরস্কার মহান আল্লাহ নিজে প্রদান করবেন! দুনিয়াতে কোন বড় মানুষের হাত থেকে সামান্য প্রাইজ পেলেই তা ছবি আকারে বাঁধাই করে রাখি, কেউ বেড়াতে এলে তাকে দেখাই, সবাই বাহবা প্রদান করে আরো কত কী!!
চ.
আমরা যারা সিয়াম পালন করেছি তাদের ব্যাপারে রাসূল সা. এর সুমহান ঘোষণা হচ্ছে- আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন “প্রত্যেক আদম সন্তানকে তার নেক আমল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: তা অবশ্য সিয়ামের প্রতিদান ছাড়া; কারণ সিয়াম আমার জন্য আর আমিই তার প্রতিদান দেবো। কেননা আমার কারণে সিয়াম পালনকারী তারযৌনকার্য ও আহার বর্জন করে থাকে। (বুখারি ও মুসলিম)
ছ.
বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য একমাত্র সিয়াম ছাড়া, কারণ তা কেবল আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেবো। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। যদি তোমাদের কেউ সিয়াম পালন করে, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে; যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তবে সে যেন বলে, আমি সিয়াম পালনকারী। ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন, নিশ্চয়ই সিয়াম পালনকারীর মুখের না-খাওয়াজনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক প্রিয়। রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছেÑ একটি যখন সে ইফতার করে, অন্যটি যখন সে তার রব আল্লাহর দিদার লাভ করবে তখন আনন্দ প্রকাশ করবে।”
জ.
রমজান মাসে যে রোজাদারকে ইফতার করাবে তার এ কাজ তার গুনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার কারণ হবে। রাসূল সা. এ ব্যাপারে বলেন: হযরত যায়েদ বিন খালেদ জুহানি রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে।কিন্তুরোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি হবে না। (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিকোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার এ কাজ তার গুনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে বাঁচাবার কারণ হবে।
ঝ.
সিয়াম পালনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন সিয়াম সুপারিশ করবে।আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও যৌনাচার হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি রাতের ঘুম থেকে তাকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।’ (আলবানী, সহীহ আল জামি)
আমরা প্রাগুক্ত সকল আয়াত ও হাদিসের সাথে একটি মাস অতিবাহিত করেছি। প্রতেকটা আমলের সাথে যুক্ত ছিলাম। মহান আল্লাহ নিজেই আমাদের পুরস্কার হবেন, এ আশা আমরা অবশ্যই লালন করি। সাওম এবং আল কুরআন আমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে এ বিষয়টি সুনিশ্চিত। তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। আমাদের কোন শঙ্কা নেই। ইনশাআল্লাহ আমরা নাজাত পেয়ে যাবো।
কিন্তু রমজান মাস চলে গেলে আমাদের অবস্থাতো ভিন্ন হয়ে যায়। পরের মাসের প্রথম দিন থেকে আমাদের অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। কেন হয়? কারণ, শয়তান আবার অবমুক্ত হয়ে যায়। তার যত বাহিনী আছে তাদের নিয়ে সে বনি আদমের পেছনে শতভাগ লেগে যায়। সে আল্লাহর গোলামদের বিপথগামী করার সকল জাল বিস্তার করে। আমরাও তার জালে আটকে যাই। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হলো? মহান আল্লাহ এবং রাসূলের সরাসরি এতো আয়াত এবং হাদীস উপেক্ষিত হয়ে শয়তান জয়ী হয়ে যাবে? মহান আল্লাহর এতো এতো দয়া, রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা সত্ত্বেও শয়তানের শয়তানিকিভাবে সিয়াম সাধনাকারী মুমিনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে? আমরা যদি প্রকৃত অর্থে রমজান পরবর্তী আবার রমজান পূর্ব মাসের মত হয়ে যাই তাহলে সিয়াম সাধনার শিক্ষা কোথায় গেলো? আমরা পুরো একটি মাস কী অর্জন করলাম?
সাওমের মাসের সব প্র্যাকটিস যদি পরের মাস সমূহে বাদ হয়ে যায়, তাহলে আমরা হিপোক্রেট হয়ে গেলাম না? গোপাল ভাড়ের মত স্রষ্টাকে একটু ধোঁকা দেয়া হয়ে গেলনা ?সব নসিহত, সব বক্তব্য, সব মোনাজাত, সব কাকুতি-মিনতি নতুন মাসের পহেলা দিন থেকে বাদ গেল? তাহলে আমরা কি আসলেই রমজানের স্পিরিটে ছিলাম,না অভিনয় করেছিলাম? নাকি একমাস আমল করে সারা বছর আমলহীন থাকার লাইসেন্স পেয়ে গেলাম? নাকি মহান রবের সাথে তামাশা করেছি (নাউজুবিল্লাহ)। অথবা চূড়ান্তভাবে বলতে হবে রোজার মাসে এমন শক্তি অর্জন হয়নি যার মাধ্যমে পরবর্তী মাসগুলোতে শয়তানের সাথে ডিফেন্স করতে পারি।
সম্মানীয় ভাই ও বোনেরা আসুন আমরা আবারও গভীর মনোনিবেশ সহকারে একবার ভেবে দেখি, মহান আল্লাহ এবং রাসূল সা. কতগুলোআয়াত আর হাদিস বলেছিলেন আমার আপনারমত রোজাদারের ব্যাপারে? তিনি তো সেই রব যিনি আসমান জমিনের মালিক, তিনি তো সেই যিনি আমাকে আপনাকে ইচ্ছা করলেই মৃত্যু দিতে পারেন, তিনি তো সেই আল্লাহ ইচ্ছা করলেই নিঃস্ব করতে পারেন, তিনি তো সেই রব ইচ্ছা করলে অসুস্থ করে দিতে পারেন, শরীরের শক্তি কেড়ে নিতে পারেন, তিনি সেই রব্বুল আলামিন যিনি ইচ্ছা করলে সন্তান কেড়ে নিতে পারেন, তিনি পারেন আমাদেরসন্তান না দিতে, তিনি পারেন দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে, পারেন সবার সামনে অপমান করতে,সুন্দর চেহারা কুৎসিত করে দিতে!! তাহলে কেন কোন জিনিস আমাদের সকলকে রমজান পরবর্তী তার স্মরণ থেকে বাধা দিল?
আমরা সকলে পাগল দেখেছি নিশ্চয়? সকলেই কি আজন্ম পাগল ছিলো? সকলেকি আজন্ম বিকলাঙ্গ ছিলো? না বন্ধুরা না! তাহলে আমাদের কোন্ শক্তি আল্লাহ থেকে গাফিল করতে পারে? তিনি তাই আফসোস করে সূরা আল ইনফিতার এর ৬-৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন “হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে,যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন”।
অতএব, আমরা কোনভাবেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করব না। আমরা শয়তানকে বিজয়ী হতে দেবো না। মহান রবের নির্দেশ মেনে চলবো। রোজা পরবর্তী মাসসমূহে আল্লাহ এবং রাসূল সা. এর পক্ষ থেকে যা করতে বলা হয়েছে, সে সব কাজ করার মাধ্যমে এবং রোজার মাসে অর্জিত তাকওয়ার শক্তি দিয়ে পাপের সকল অন্ধকার দু’পায়ে মাড়িয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের মহাসড়কে উপনীত হবই ইনশাআল্লাহ।
রোজার মাসে অর্জিত তাকওয়া পরবর্তী এগারোটি মাসে কার্যকর করার জন্য নিম্নোক্ত আমলসমূহ অত্যাবশ্যকভাবে পালন করার চেষ্টা করতে হবে।

শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা আদায় করতে হবে

সকল কাজ পূর্ণ এখলাস তথা একমাত্র মহান আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন: “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।” (সূরা আল-বাইয়্যেনাহ :৫)

সময় মত সালাত আদায় করা

সিয়াম পালনের সময় যেমন সালাতের গুরুত্ব ছিল, সিয়াম পরবর্তী কোনোভাবেই যেন জামাআতে সালাতের গুরুত্ব হ্রাস না পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ (সূরা নিসা :১০৩)
এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামাজ আদায় করা। (সহীহ মুসলিম : ২৬৩
-রমজানের ন্যায় কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াত ও তরজমা শিক্ষার কাজ অব্যাহত রাখা
-রোজার মাসের ন্যায় কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা
-সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া।
-রমাদান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
-ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ মুসলিম]

বশি বেশি দান-সদাকাহ করা

রমজান মাসের পর অন্যান্য মাসেও বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।বিশেষ করে ইয়াতিম, বিধবা ও গরিব মিসকিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হাদীসে এসেছে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’-আল-বুখারী।
মানুষকে দ্বীনের কাজে আহবান করা। রমজানের শিক্ষার আলোকে এ কাজটি অব্যাহত রাখতে পারলে পরবর্তী মাসসমূহে আল্লাহর পথে চলা অত্যন্ত সহজ হয়। শয়তান কম ধোঁকা দিতে পারে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ :৩৩)।
হাদিসে এসেছে, ‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’ [সুনান আত-তিরমীযি)

সর্বদা তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা

তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এ সিদ্ধান্ত প্রতি মুহূর্তে প্রতি ক্ষণে গ্রহণ করতে হবে। কেননা তাওবাহ করলে মহান আল্লাহ খুশি হন। আল-কুরআনে এসেছে “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায়,তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’’ (সূরা আত তাহরীম : ৮)]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি।” (সহীহ মুসলিম)
তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে, “হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের ওপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’
এর ফজিলত ও মর্যাদার ব্যাপারে বলা হয়েছে: “যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ (সহীহ আল বুখারী)

গরিব, মিসকিন ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খাদ্য খাওয়ানো।

মহান আল্লাহ আল কুরআনে বলেছেন: আর আল্লাহর মহব্বতে মিসকিন,ইয়াতিম এবং বন্দীকে খাবার দান করে । (সূরা আদ-দাহর: ৮)
এ বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া।’’ (আল-বুখারী )

আল্লাহর যিকর বা স্মরণ করা

বেশি বেশি মহান আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাসবিহ পাঠ করা। সময় পেলেই সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,লা ইলাহা ইল্লাল্লা, আল্লাহু আকবার,পড়া।এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলোসুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,লা ইলাহা ইল্লাল্লা, আল্লাহু আকবার যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহ পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহু আকবার পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তিলা ইলাহা ইল্লাল্লা পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবেআলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিনপড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। (মুসনাদ আহমাদ )

প্রত্যেক সপ্তাহর সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোজা রাখা। হাদিসে এসেছে এসব দিনে ব্যক্তির আমল মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়।

-আইয়ামে বিজের রোজা রাখা। অর্থাৎ আরবি মাসের ১৩,১৪ এবং ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করা।
-কোন অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা মনে আসলে আল্লাহ এবং রাসূল সা. এর সাথে প্রাগুক্ত সম্পর্কগুলো অবশ্যই স্মরণ করার চেষ্টা করা।
মূলত যিনি সিদ্ধান্ত নিবেন রোজার মাসের শিক্ষা এবং তাকওয়া অবশ্যই বাকি এগারোটি মাস বহন করবেন, লালন এবং পালন করবেন মহান আল্লাহ অবশ্যই তার নিয়তকে পরিপূর্ণ করবেন। আর যিনি অবহেলা করবেন, তিনি অবশ্যই শয়তানের কাছে পরাজিত হবেন। রোজার তাকওয়া এবং শিক্ষা তাকে বাঁচাতে পারবে না। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো যে, রোজার মাসে মহান আল্লাহর রহমতে যে সকল ব্যাপারে শয়তানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি, সে সকল ব্যাপারে কোনোভাবেই শয়তানকে আর বিজয়ী হতে দিব না। আল্লাহ তা‘আলা এ সিদ্ধান্তে অটল থাকার তৌফিক দান করুন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

ইসলামের দৃষ্টিতে সাহিত্যচর্চার অপরিহার্যতা -গাজী নজরুল ইসলাম


সাহিত্য জীবনের ফুল, সমাজের কুঞ্জ, মানবের জীবনালেখ্য। মন ও মননের আয়না। সাহিত্যে ফুটে ওঠে মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্মৃতি-বিস্মৃতি, আনন্দ বেদনার উপাখ্যান। ব্যক্তি-পরিবার, সংসার-সমাজ, রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ জীবন ও জগতের, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের, শিক্ষা ও সংস্কৃতির, শিল্প ও কারুকার্যের, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের, ব্যবসায় ও বাণিজ্যের, দ্বন্দ্ব ও বিগ্রহের, মনীষা ও মননশীল লেখ-চিত্রই হলো সাহিত্য।

সাহিত্যে রচিত হয় জীবনের বন্দনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গাথা, সৃষ্টি ও স্রষ্টার রহস্যপঞ্জি।
সাহিত্য শিক্ষার বাহন, জ্ঞানের সিন্ধু, বিবেকের হাতিয়ার, বুদ্ধি-বৃত্তির চালিকাশক্তি।
সাহিত্য দিয়ে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে, অপরকে জানতে পারে, বিশ্বকে বুঝতে পারে, স্রষ্টাকে ধারণায় ধারণ করতে পারে।
পৃথিবীতে সকল জিনিসের দু’টি করে দিক আছে। একটি ভালো দিক অপরটি মন্দ দিক। একটি সুন্দর-অপরটি কুৎসিত। একটি পবিত্র-অপরটি অপবিত্র। একটি সত্যের অপরটি মিথ্যার। ইংরেজি প্রবাদ : Truth is beauty and beauty is truth. সত্যই সুন্দর এবং সুন্দরই সত্য।
সাহিত্যেরও দুটি দিক। একটি সত্যের এবং সুন্দরের অপরটি মিথ্যার এবং কুৎসিত। সাহিত্যে সত্য এবং সুন্দরের সৃষ্টিই হলো আসল কাজ। সত্য ও সুন্দর সাহিত্যই সত্যপন্থী (হক) মানুষ সৃষ্টি করতে পারে। অসত্য এবং অসুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি করে বাতিলপন্থী মানুষ (বে-হক)। সত্য-সুন্দর ও হকপন্থীরাই আল্লাহ পাকের প্রতিনিধি (খলিফা)। অসত্য অসুন্দর এবং বাতিলপন্থীরাই আল্লাহবিরোধী-তাগুতি। হক ও তাগুতপন্থীর দ্বন্দ্ব দুনিয়ায় অবধারিত ঘটনা।
আল্লাহ পাক কুরআনে এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা যারা আল্লাহতে ঈমান এনেছ, তারা সাধনা করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফরিতে ঈমান এনেছ, তারা সাধনা সংগ্রাম করে তাগুতের পথে।’’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৭৬)
সাহিত্যেও সাধনা আছে লড়াই আছে। যারা হকপন্থী তাদের কলমের সাধনা চলে সত্যের পথে, আল্লাহর পথে, আর যারা বাতিলপন্থী তাদের কলমের সাধনা চলে তাগুতের পথে।
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, “ আল্লাহ তোমাদের কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আল আলাক : ৪)
সাহিত্য রচিত হয় কলমের সাহায্যে। অতএব সাহিত্যে চলে কলমের সাধনা-কলমের লড়াই। একদলের কলম চলে সত্য ও হকের পথে- আরেক দলের কলম চলে বাতিল ও তাগুতের পথে।
যারা বাতিলের পথে কলম চালায় তাদেরকে কুরআনে বলা হয়েছে গা’বুন। অর্থ বিভ্রান্ত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের (সাহিত্যিক)/লেখকদের অনুসরণ করে। বিভ্রান্ত কলম লেখকদের (কবি-সাহিত্যিক) যারা সমর্থন করে তা উদ্ভ্রান্ত।” (সূরা আশ্-শোয়ারা : ২২৪) এরা বাতিল, বিভ্রান্ত, নোংরা, অশ্লীল, কামোদ্দীপক, যৌন আবেদনমূলক, অবৈধ প্রেম-চর্চা, শারাব-সাকি, ঘৃণা-পাপাচার, দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ, হিংসা-অহংকার, উচ্ছৃঙ্খলতা-লড়াই-যুদ্ধ-উন্মাদনামূলক সাহিত্য লেখে। আর এদের অনুসারীরা উদ্ভ্রান্ত ন্তের মত ঐসব অশ্লীল অসৎ উন্মাদনামূলক সাহিত্য কিংবা কবিতা পঙক্তি পাঠ করে সমাজকে কলুষিত করে। ফ্যাসাদ বাধায়, ভোগ-সম্ভোগে কাতর হয়- নগ্নতায় বিভোর হয়- ফলে সমাজে নৈরাজ্য-উচ্ছৃঙ্খলতা-ধর্ষণ-খুন-রাহাজানি, লুটপাট- অবৈধ-সম্ভোগ এবং দখলদারিত্ব অবশ্যাম্ভাবী হয়ে ওঠে। এরা পরনিন্দা পরহিংসা, মিথ্যা অপবাদ, অহেতুক কাহিনী সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষ ঈমানদার হকপন্থী সত্য ও সুন্দরের পূজারিদের হেয়প্রতিপন্ন করে। এমনকি তাদের লেখায় তারা স্রষ্টা-সৃষ্টি, তৌহিদ-রেসালাত এবং ঈমানকে অস্বীকার করে। মহান আল্লাহ পাক এই সাহিত্যিকদের লেখা সাহিত্য-কবিতা অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। তৎকালীন আরবে যারা তথাকথিত জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ছিল তাদেরকে প্রায়শই ‘কবি’ বলা হতো। আর ঐ সব নামধারী কবিই ছিল উপরিউক্ত বিভ্রান্ত উদ্ভ্রান্ত কবিতা ও সাহিত্যের জনক। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা ঐসব কবিকে নিন্দাবাদ জানিয়ে তারা বিভ্রান্ত এবং তাদের অনুসারীদের উদ্ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ঐ আয়াত নাজিল হওয়ার পর হক ও সত্যপন্থী কবিদের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা, হাস্সান ইবনে সাবেত, কাব ইবনে মালেক প্রমুখ প্রখ্যাত সাহাবী কবি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসূলুুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আল্লাহ পাক তো এই আয়াত নাজিল করেছেন। আর আমরাও তো কবিতা রচনা করি, সাহিত্য রচনা করি। এখন আমাদের উপায় কী? রাসূলুল্লাহ (সা) তার স্বভাবসুলভ ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, অধৈর্য হয়ো না, বরং আয়াতের শেষ অংশটাও পাঠ করো। এখানে বলা হয়েছে, তোমাদের কবিতা-সাহিত্য যেন ঐরূপ অনর্থক ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লিখিত ব্যতিক্রমধর্মীদের মধ্যে শামিল। সূরার শেষাংশে এরশাদ হয়েছে, “ইল্লালাজিনা আমানু অ আ’মিলুস সালিহাতি অ যাকারাল্লাহু কাছিরা….।” (সূরা আশ্-শোয়ারা : ২২৭) অর্থাৎ তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। এখানে উদ্ধৃত আয়াতে কালিমাগুলির মর্মকথা হলো এই যে, প্রথমাংশে কাব্য ও সাহিত্য চর্চার ঐ দিকগুলোকে কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে যা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়। যেমন যা অসত্য ও অসুন্দর, অশ্লীল ও উদ্ভ্রান্ত, যৌন-পাপাচারে সম্পৃক্ত, যা আত্মগর্ব, আত্মঅহংকারে, পরনিন্দায়-তিরস্কারে, মুশরিকি আচার আচরণে পরিপূর্ণ। এসব কাব্য ও সাহিত্যচর্চায় আল্লাহ পাকের অবাধ্যতা কিংবা স্মরণ থেকে বিরত রাখা হয়। অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নিন্দাবাদ-অবমাননা, উন্মত্ত প্রণোদনা সৃষ্টি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা, পরকীয়া, ধর্ষণ, হত্যা সর্বোপরি কদাচার ও অশ্লীলতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এই ধরনের কবিতা ও সাহিত্য নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয়।
অপরপক্ষে যেসব কবিতা ও সাহিত্য অশ্লীলতা, অস্পৃশ্যতা, কদাচার, ব্যভিচার, পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্ত সেগুলো আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ইল্লালাজিনা আমানু অ আ’মিলুস সালিহাতি” বলে এ আয়াতের মাধ্যমে সত্যপন্থী কবি সাহিত্যিকদের ব্যতিক্রমধর্মী বলে ঘোষণা করেছেন।
কোন কোন কবিতা ও সাহিত্য তো জ্ঞানগর্ভ বিষয়বস্তু ও উপদেশমালা সংবলিত হওয়ায় তা এবাদতযোগ্য এবং সওয়াবের অন্তর্ভুক্ত।
হযরত উবাই ইবনে কা’বের রেওয়াতে আছে, “ইন্না মিনাশ শোয়ারাল হিকমা” অর্থাৎ কতক কবিতা বা সাহিত্য জ্ঞানগর্ভ হয়ে থাকে। (বুখারি)
হাফেজ ইবনে হাজার বলেন, এই রেওয়াতে ‘হিকমত’ বলে সত্যভাষণ বোঝানো হয়েছে।
ইবনে বাত্তাল বলেন, যে কবিতা ও সাহিত্য আল্লাহ তায়ালার একত্মবাদ, তাঁর জিকির এবং ইসলামের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা বর্ণিত হয় সেই সাহিত্য ও কবিতা কাম্য ও প্রশংসনীয়।
নিম্নবর্ণিত রেওয়াতে আরো সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে এই মর্মে যে,
হজরত ওমর ইবনে বারিদ তার পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) আমার মুখ থেকে উমাইয়া ইবনে আবু সালতের এক শ’ লাইনের কবিতা-সাহিত্য শ্রবণ করেন।
মুতারিক বলেন, “আমি কুফা থেকে বসরা পর্যন্ত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা)-এর সাথে সফর করেছি। প্রতি মনজিলেই তিনি কবিতা সাহিত্য পাঠ করে শোনাতেন।
তাবারি – প্রধান প্রধান সাহাবী ও তাবেয়ি সম্পর্কে বলেন, তারা কবিতা ও সাহিত্য রচনা করতেন, শুনতেন এবং শুনাতেন।
ইমাম বুখারি (রহ) বলেন, “হযরত আয়েশা (রা) কবিতা বলতেন।
আবু ইলালা ইবনে ওমর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উক্তি থেকে বর্ণনা করেন, যে কবিতা ও সাহিত্যের বিষয়বস্তু উত্তম ও উপকারী হলে তা ভালো এবং অশ্লীল ও গুনাহের হলে তা মন্দ। (ফাতহুল বারী)
সূরা আশ্ শোয়ারার ঐ আয়াতের শেষাংশে এমন সব কবিকে আলাদা করা হয়েছে, যাদের রয়েছে চারটি বৈশিষ্ট্য:
যারা মুমিন অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)কে মানেন এবং আখিরাতে বিশ্বাস করেন।
নিজেদের কর্মজীবনে যারা সৎ, যারা ফাসেক, দুষ্কৃতকারী ও বদকার নন। নৈতিকতার বাঁধন মুক্ত হয়ে যারা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেন না।
আল্লাহকে যারা বেশি বেশি স্মরণ করেন। নিজেদের সাধারণ অবস্থায়, সাধারণ সময়ে এবং নিজেদের রচনায়ও। কবিতা ও সাহিত্য এমন যেন না হয় যে কবিতা ও সাহিত্য বড়ই তত্ত্বকথাসম্পন্ন, গভীর প্রজ্ঞা আওড়ানো অথচ ব্যক্তিজীবনে তার কোন লেশ মাত্র নেই।
তারা এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী কবি, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কারো নিন্দা করে না এবং ব্যক্তিগত, বংশীয় বা গোত্রীয় বিদ্বেষে উদ্ধুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বালায় না।
কিন্তু যখন তাগুতি ও জালেমের মুকাবিলায় সত্যের প্রতি সমর্থন দানের প্রয়োজন দেখা দেয় তখন তার কণ্ঠকে, লেখনীকে সেই একই কাজে ব্যবহার করে যে কাজে একজন মুজাহিদ তার তীর ও তরবারিকে ব্যবহার করে। সবসময় আবেদন নিবেদন করে টিকে থাকা এবং বিনীতভাবে আর্জি পেশ করে যাওয়াই মুমিনের রীতি নয়। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে কাফের ও মুশরিক কবিরা ইসলাম ও নবী (সা)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ, দোষারোপ ও অপবাদের যে তাণ্ডব সৃষ্টি করে এবং ঘৃণা বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ায়, তার জবাব দেয়ার জন্য নবী করীম (সা) নিজেই ইসলামী কবি সাহিত্যিকদের উদ্বুদ্ধ করতেন এবং সাহস জুগিয়েছেন। তিনি কা’ব ইবনে মালেক (রা) কে বলেন, “আহযুহুম ফা অল্লাজি নাফছি বি ইয়াদিহি লাহুম আশাদ্দু আ’লাইহিম মিনান্নাবলি।” অর্থাৎ ওদের নিন্দা করো কারণ সেই আল্লাহর কসম যার হাতের মুঠোয় আমার জীবন আবদ্ধ। তোমার কবিতা (সাহিত্য) যেন ওদের জন্য তীরের চেয়েও বেশি তীক্ষè ও ধারালো।
হযরত হাস্সান ইবনে সাবেত (রা) কে বলেন, “আহজিহিম অ জিবরিলা মায়া’কা” এবং “ক্কুল অ রুহুল কুদুসে মায়া’কা”। অর্থাৎ তাদের মিথ্যাচারের জবাব দাও এবং জিবরিল তোমার সাথে আছে এবং বলো পবিত্র আত্মা তোমার সাথে আছে।
তাঁর উক্তি ছিল, “ইন্নাল মু’মিনু ইয়াজহাদু বি সাইফি অ ছানাহু”। অর্থাৎ মুমিন তলোয়ার দিয়েও লড়াই করে এবং তার কণ্ঠ দিয়েও।
উপরের আলোচনায় বুঝা গেল ইসলামের দৃষ্টিতে সাহিত্য কিংবা কবিতা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।
আজ বিশ্বব্যাপী ইসলামবিরোধী তাগুতি শক্তির সমর্থক কবি, সাহিত্যিকরা কুফরি ও মুশরিকি চিন্তা-চেতনার অনুসারী হয়ে তাদের সকল প্রকার মেধা-যোগ্যতা, যুক্তি-চিন্তা সহকারে ইসলামবিরোধী সাহিত্য, কবিতা-গান রচনা করে সুরলহরির রমরমা জাঁকালো অনুষ্ঠান করে প্রজন্মের তাবৎ কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী এমনকি একদল চিন্তাশীল ব্যক্তিকে উদ্ভ্রান্ত করে সুপরিকল্পিতভাবে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বকে অশ্লীলতা এবং পাপাচারের গ্লানিতে পরিপূর্ণ করে নগ্নতা ও বেহায়াপনায় দেশ-জাতি-বিশ্বকে নরককুণ্ডের ব্ল্যাকহোল বানিয়ে ফেলছে। ধর্ষণ, খুন, অবৈধ ভোগ- সম্ভোগের বিলাস কামুকতায় অযাচিত নেশার ঘোরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্মাদ বানিয়ে নিজস্ব সত্তাকে বিলীন করে ফেলছে। এর মোকাবেলায় এখন বড়ই প্রয়োজন অধিকতর মেধা-মনন প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিদীপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিভাবান কবি ও সাহিত্যিক সৃষ্টি করা তীরের মত দ্রুতগামী এবং তরবারির মত ক্ষুরধার লেখনীর যার প্রতিঘাতে বাতিল কিংবা তাগুতি, জালেম কিংবা স্বৈরাচারের ভোগ বিলাসে উন্মত্ত-উদ্ভ্রান্ত ক্ষমতালিপ্সুতার সহযোগী তথাকথিত কবি-সাহিত্যিকদের পরাভূত করা যায়। তাদের অসত্য ও অসুন্দর, অশ্রাব্য ও অশ্লীল কবিতা-সাহিত্যের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায় কিংবা ইসলামী কবিতা ও সাহিত্য তাদের ওপর বিজয়ী রূপে আবির্ভূত হয়।
ইদানীং কালের উদ্ভ্রান্ত তাগুতপন্থী তথাকথিত কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি ‘রঙিলা রাসূল’, ‘স্যাটানিক ভার্সেস’, ত্বিন-যায়তুনের অপব্যাখ্যা, আজানকে বেশ্যার চিৎকার বলা, কোরআনি আন্দোলনকে তথাকথিত জিহাদি ও জঙ্গি আখ্যায়িত করা, অতি আধুনিকতার লেবেলে কুরআন ঘোষিত পর্দাপ্রথার অবগুণ্ঠনকে ছিন্ন ভিন্ন করার পাঁয়তারা, নগ্ন-নারীদেহ প্রদর্শনী ও ভোগ লালসার বিকিকিনিতে তথাকথিত ‘র‌্যাগ ডে’, ‘লাভ ডে’, ‘থার্টি ফার্স্ট ডে’ প্রভৃতি অশ্লীল ও বেলেল্লাপনার মৌজ-মহড়া ইত্যাদির বিপরীতে শালীন ও পরিশীলিত সত্য ও সুন্দরের আহবানে ইসলামী সাহিত্য রচনার ক্ষুরধার চর্চা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।

Friday, June 15, 2018

মালয়েশিয়ার নির্বাচন বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত -মতিউর রহমান আকন্দ


মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান মুসলিম দেশ। তিনটি সালতানাত ও ১৩টি রাজ্যের সমন্বয় গঠিত মালয়েশিয়া। এর আয়তন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লাখ। রাজা হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান। দীর্ঘ দিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকার পর ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় মালয় স্বাধীনতা লাভ করে। তখন থেকে মালয়েশিয়ার সরকার ও রাজনীতিতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা হচ্ছে মালয়। এ ছাড়াও ১৩০টি ভাষা প্রচলিত আছে। মালয়েশিয়াতে শরিয়াহ আইনের পাশাপাশি সিভিল কোর্টও রয়েছে। সাধারণত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য শরিয়াহ আইনের প্রচলন। যদি কেউ চায় সাধারণ আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে। মালয়েশিয়া সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক ধর্মের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মালয়েশিয়ার জনসংখ্যা আনুপাতিক হার হচ্ছেÑ মুসলিম ৬১.৩%, বৌদ্ধ ১৯.৮%, খ্রিষ্টান ৯.২%, হিন্দু ৬.৩%, কনফুসিয়াস ১.৩% এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ১.২%।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাধীন মালয় যুক্তরাষ্ট্র, স্বশাসিত সিঙ্গাপুর, পূর্বতন ব্রিটিশ উপনিবেশ সারাওয়াক ও সাবা (উত্তর বোর্নিও) একত্রিত হয়ে মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্র পরিত্যাগ করে।
মালয়েশিয়ার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সুদূর অতীতে এ অঞ্চলে হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এখানে ইসলামের আগমনের পূর্বে বৌদ্ধ রাজত্ব লাংকাসকা ও পরে বৌদ্ধ রাজত্ব শ্রীবিদয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিলো। ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে মালাক্কার রাজবংশ কর্তৃক ইসলাম গ্রহণের পর মালাক্কা এলাকায় ইসলাম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘আরব বণিকদের মারফত মালয়ে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। সিঙ্গাপুরের তেমানিক রাজা পরমেশ্বর (১৩৯৬-১৪১৪) প্রথমে মজাপাহিত ও পরে পাই সেনাবাহিনী দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মালাক্কায় পালিয়ে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন (নাম ইস্কান্দার শাহ) এবং এক নতুন রাজবংশ স্থাপন করেন। এই বংশ ১৫১১ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের কর্তৃক উৎখাত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এখানে ক্ষমতায় ছিলো। এ সময়ে মালয়বাসীদের সাহিত্য, আইন এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ প্রতিফলিত হয়। পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ওলন্দাজ, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা মালাক্কা সালতানাত এবং মালয় এলাকা দখল করে নিলে তারা তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এদেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়।
মুসলমান শাসকদের পরিবর্তে খ্রিষ্টান শাসকদের আগমনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। উপরন্তু মুসলমানদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তাদের প্রভাব বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উপনিবেশ যুগে সবচেয়ে ক্ষতিকর যে দিকটির সূচনা হয়, তা হলো মালয়াতে ব্যাপক সংখ্যক অমুসলমানের বাহির থেকে আগমন। চীন এবং ভারত থেকে অসংখ্য বহিরাগতকে সাম্রজ্যবাদীরা মালয়ানে স্থান দেয়। ফলে সেখানে মুসলমানরা তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর দেখা গেল যে, বহিরাগতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শতকরা ৫০-এ। স্বাভাবিক কারণেই তারা তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিরাট শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মালয়েশিয়া একটি বহুজাতিক দেশে পরিণত হয়।
এক সময় মালয়েশিয়ার রাজনীতি ছিল সম্প্রদায়ভিত্তিক। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-বিরোধ মালয়েশিয়াতে জাতীয় সংহতির পথে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তেমনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখে। জাতীয় সংহতি অর্জনের লক্ষ্যে সেখানে United Malays National Organization (UMNO), Malays Chinese Association I Malayan Indian Congress মিলে ঐক্যজোট গড়ে তোলা হয় এবং ‘রুকনেগার ঘোষণা’ নামে পঞ্চশীলা নীতির ভিত্তিতে জাতীয় আদর্শবাদের কথা ঘোষণা করা হয়। জাতীয় আদর্শবাদের এই পঞ্চশীলা নীতি হচ্ছে : স্রষ্ঠার প্রতি বিশ্বাস, সুলতান ও দেশের প্রতি আনুগত্য, সংবিধানের প্রতি সমর্থন, আইনের শাসন এবং সদাচরণ ও নৈতিকতা। এ সকল মূলনীতির অর্থ ব্যাখ্যা করার জন্য ঐ ঘোষণার সাথে কতকগুলো ভাষ্যও জুড়ে দেয়া হয়। যেমন, ইসলামকেই মালয়েশীয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ধর্ম বলে ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য ধর্মের কোন ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দান করা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক নাগরিকই ‘মহানুভব রাজা’র প্রতি সত্যিকারভাবে অনুগত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। তৃতীয়ত, প্রত্যেক নাগরিকই সংবিধান সংরক্ষণ ও সমর্থন করবে। এ তৃতীয় সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত সম্প্রদায়গত প্রশ্নাদিতে মালয়েশীয় সরকারের নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বিবৃত হয়, যেমন- ইসলাম ধর্মের বিশেষ মর্যাদা, মালয়ীদের বিশেষ অধিকার ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব অর্জনের অধিকার। অ-মালয়ীদের ওপর মালয়ীদের বিশেষ আইনগত ও রাজনৈতিক মর্যাদাদানের উদ্দেশ্যে এ সকল নীতি নির্দেশিত হয়। চতুর্থ ভাষ্যে আইনের চোখে সমান নীতি নির্দেশিত হয় এবং আরোপিত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে বিভিন্ন দিকের স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়। পঞ্চম ভাষ্যে কোন গোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে, এমন কোন আচরণে লিপ্ত না হওয়ার জন্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সাধারণভাবে আহ্বান জানানো হয়।
মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা ইসলামের দাওয়াতি কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রতি মনোযোগ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছাত্র, তরুণ ও যুবসমাজের মাঝে ইসলামের চেতনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সচেতন ও বুদ্ধিজীবীদের আচার-আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় হয়েছে। মালয়েশিয়াতে রাজনৈতিক ময়দানে সাধারণভাবে ইসলামী আন্দোলন যতটা শক্তিশালী, যুব ইসলামী আন্দোলন তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানে প্রধানত দুটো সংগঠন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তার একটি হলো Ankatan Belia Islamia Malayasia সংক্ষেপেABIM অর্থাৎ মালয়েশীয় ইসলামী যুব আন্দোলন এবং অন্যটি হলো Partia Islam Malaysia সংক্ষেপে PAS বলে অভিহিত করা হয়।
১৯৬৯ সালে National Union of Malayasian Muslim Students (PKPIM) এর বার্ষিক সাধারণ সভায় ‘আবিম’ গঠিত হয়। তিনটি লক্ষ্যের ভিত্তিতে এ সংস্থাটি গড়ে ওঠে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের দ্বীনি দাওয়াতি কাজে তৎপরতা অব্যাহত রাখার সুযোগ দেয়া, দ্বিতীয়ত মালয়েশীয় সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম যুবকদের স্বার্থকে সংরক্ষণের জন্য একটি যুব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা এবং তৃতীয়ত মালয়েশীয়ার ইসলামী বিপ্লবের জন্য ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ রচনা করা। এসব উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য ‘আবিম’ বিভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করে। এর মধ্যে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী চেতনা জাগ্রত করার জন্য বই-পুস্তক প্রকাশ, বক্তৃতা ফোরাম, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির আয়োজন করা; আন্দোলন ও সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে অধিকতর জানার জন্য ‘স্টাডি গ্রুপ’-এর ব্যবস্থা করা; ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের ওপর গবেষণা ও অধ্যয়নে উৎসাহ প্রদান করা; ইসলামী আন্দোলনের জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া; সংগঠনের ভেতর ও বাইরের- এমনকি দেশ ও বিদেশের মুসলিম ভাইদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী ও সুসংহত করা এবং যে সমস্ত ইসলামী সংগঠন সত্যিকার অর্থে ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযেগিতা করা।
যে কোন যুবক বা ‘যুবমনা’ ব্যক্তি ইসলামী আদর্শের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতিতে ‘আবিম’-এর সদস্য হতে পারে। শিক্ষাবিদ, পেশাদার কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের সর্বস্তরের লোক এর সদস্য হতে পারে। আবিম মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।
মালয়েশিয়া স্বাধীনতা লাভের ৭ বছর পর ১৯৬৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মাহাথির মোহাম্মদ। এর মাধ্যমে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। এর ১৭ বছর পর ১৯৮১ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবিমের প্রেসিডেন্ট তরুণ জনপ্রিয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিজের সমর্থনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। আনোয়ার ইব্রাহিম নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। অনায়াসেই তিনি যে কোন ব্যক্তিকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারতেন। আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন UMNO-এর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন এবং মাহাথিরের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। প্রথমে সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন। ১৯৯৩ সালে তিনি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পান। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর মাহাথিরের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। যার ফলে আনোয়ার ইব্রাহিমকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এক সময় তাকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৪ সালে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সব অভিযোগ থেকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে খালাস দিলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর বিরোধী দলগুলো নিয়ে জোট করে তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রীতিমত হইচই ফেলে দেন। তখন তিনি ৩১টি আসনে বিজয় লাভ করে বিরোধী দলের নেতায় পরিণত হন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের নির্বাচনে ভাল ফলাফল করেন। এক কথায় ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালের এসে তিনি নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হন। কথিত সমকামিতার মিথ্যা অভিযোগে তাকে আবারো কারাগারে যেতে হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন নাজিব রাজাক।
নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বিনিয়োগ তহবিল থেকে ৭০ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে। ক্রমেই নাজিব ও তার পরিবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়ে। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পতন হতে থাকে। জীবন ধারণের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যায়। জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সেবার ওপর সরকার নতুন নতুন কর আরোপ করে। ফলে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালে ডা: মাহাথির মোহাম্মদ নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি আবারো রাজনীতির মাঠে আসেন। আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নিজের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেন। এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিমকে আদালতে হাজির করা হলে মাহাথির মোহাম্মদ আদালত কক্ষে আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুতপ্ত হওয়ার কথা জানান আনোয়ার ইব্রাহিমকে। তাকে কারাগারে পাঠানো ছিল একটি মস্তবড় রাজনৈতিক ভুল তাও তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের নিকট স্বীকার করেন। তখন থেকেই মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠে। বেছে নেয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনকে।
২০১৮ সালের ৯ মে নির্বাচনে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২২২টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে তারা বিজয় লাভ করে। তন্মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত পিকেআর পায় ৪৯টি আসন, ডিএপি (চাইনিজদের দ্বারা গঠিত দল) পায় ৪২টি আসন, পিপিবিএম (মাহাথিরের গড়া নতুন দল) পায় ১২টি আসন, আমানাহ (পাস ভেঙে গড়া নতুন দল) পায় ১০টি আসন। এর বাইরে সেবাহ হেরিটেজ পায় ৮টি আসন। এই দলটির সঙ্গে পাকাতান হারাপানের অনানুষ্ঠানিক জোট ছিল। ফলে আসন দাঁড়িয়েছে ১২১টিতে।
নির্বাচনের পর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মালয়েশিয়ার রাজা ইয়াং দি পারতুয়ান এগং আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিঃশর্ত ক্ষমা ঘোষণা করেন। ১৬ মে ২০১৮ সালের দুপুর ১২টায় আনোয়ার ইব্রাহিম কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মাহাথির ও আনোয়ার ইব্রাহিমের চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তীতে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম শিগগিরই রাজনীতিতে ফিরছেন বলে জানিয়েছেন। বাস্তবতা হলো তিনিই হতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ার রাজনীতির এ ঘটনা বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। আমরা যদি বিগত ১০০ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাই সারা পৃথিবীতে গত ১০০ বছরে নানান পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে বিশ্ব আজ এক নতুন ধারার রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর পূর্ব ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে। সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠী সমাজতন্ত্রের রঙে নিজেদের রঙিন করতে সচেষ্ট হয়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মুসলমানদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্দিন। ইসলামী আদর্শের অনুসারী হওয়ার কারণে মুসলমানদেরকে নানানভাবে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। গণহারে হত্যা করা হয় মুসলমানদের। সমাজতন্ত্রের ৭০ বছরের ইতিহাসে মুসলমানরা নানাভাবে আক্রান্ত হয়। অবশেষে এ মতবাদ বিলুপ্ত হয়।
সমাজতন্ত্রের উত্থানের মুহূর্তে ১৯২৪ সালে তুর্কি খেলাফতের পতনের পর মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের আশ্রয় নেয়ার স্থানসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তনের সূচনা হয়। মুসলমানরা স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে পৃথিবীর দিকে দিকে স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে থাকে। এর মাঝে ঘটে আরেকটি স্পর্শকাতর ঘটনা যা মুসলমানদের অনুভূতিতে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। ১৯৬৭ সালে ইহুদিরা মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসে অগ্নিসংযোগ করে। এর প্রতিক্রিয়া হয় মুসলমানদের মধ্যে। মুসলমানরা বুঝতে সক্ষম হয় ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এ চেতনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় ওআইসি। ওআইসি-এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয় ইরান বিপ্লব। বিগত ৩৯ বছর যাবৎ ইরান পৃথিবীর পরাশক্তি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে আছে। ইরান আজ মুসলিম বিশ্বের এক প্রতিষ্ঠিত সম্ভাবনাময় শক্তি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে তুরস্কে। ক্ষমতায় আসেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা নাজিমুদ্দিন আরবাকান। এরপর থেকে তুরস্কে ক্ষমতার পালাবদলে এরদোগান প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ১৯৯০ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ে আলজেরিয়ায় জাতীয় পরিষদের ২৩১টি আসনের নির্বাচনে ইসলামী সালভেশন ফ্রন্ট ১৮৮টি আসনে বিজয় লাভ করে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবশিষ্ট আসনের নির্বাচন বানচাল করে দেয়া হয়। ইসলামী নেতৃবৃন্দের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। হাজার হাজার মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ২৭ বছর পর সে দেশে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর অত্যন্ত ষড়যন্ত্র করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক জান্তা মিসরের জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সেখানে পরিবর্তনের লক্ষণ দৃশ্যমান। মাধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্ব পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এ পরিবর্তনের মূল শক্তি হচ্ছে ইসলাম। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার জন্য যারা ভূমিকা পালন করছে তাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠছে।
যে ওআইসি গড়ে উঠেছিল মুসলমানদের ঐক্যের প্লাটফর্ম হিসেবে সেখানে কার্যকর ভূমিকা পালনের লোক ছিল সীমিত। বলতে গেলে এরদোগান ব্যতীত কেউ অর্থবহ ভূমিকা পালন করেননি। সেখানে মালয়েশিয়ার নির্বাচন আরেকজন উদীয়মান বিশ্ব নেতৃত্বকে ওআইসির প্লাটফর্মে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ইরান, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ প্রতিনিধিগণ ওআইসিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বের এ সংগঠিত প্লাটফর্ম দিকে দিকে ইসলামের গতি সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্যান্য ভূমিকা পালন করবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হবে। মালয়েশিয়ার নির্বাচন বিশ্বরাজনীতির সেই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটকে দ্রুত সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Friday, April 27, 2018

ঘরে ঘরে হতে হবে পাঠাগার হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে বই -সালাহউদ্দিন আইউবী


মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে জ্ঞানের দিক থেকে। যে জ্ঞানের সূচনা হয়ে থাকে পড়ার মাধ্যমে। যে কারণে পৃথিবীতে আগত যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলের জীবনগঠনের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রথম বাণী ছিল ‘পড়’। পৃথিবীর যেসব মহামানব আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের কর্মের শুরু সেই পড়া থেকেই। অসভ্য, বর্বর জাতিগুলোর সভ্যতার দিশা দেয়া হয়েছে যুগে যুগে পড়ার নতুন নতুন কৌশলের মাধ্যমে। পড়া মানুষকে এক উচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সবখানে পড়ুয়া শ্রেণীর কদর সম্পূর্ণই আলাদা। দিকভ্রান্ত জাতির পথের দিশা হয়ে বারবার সুন্দর সমাধান দিয়েছে পড়–য়া জাতি।
বই পড়তে পারাটা একটা ম্যাজিকের মতো। হাজার বছরের সমস্ত মানুষের কথা ইচ্ছে করলেই জানা যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই বেড়ানো যাচ্ছে মিসর, বেবিলন মেসোপটেমিয়া, ভারতবর্ষের সেই প্রাচীন সভ্যতায়।
পড়ার অভ্যাস করতে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা খুবই দুর্ভাগা যাদের পড়তে শেখার সুযোগ হয়নি। তাদের চেয়েও দুর্ভাগ্য তাদের যারা পড়তে শিখেও পড়ল না।
মানুষ সাধারণত খুব নিকট অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না। জৈবিক ধারণাতেই তাদের জীবন চালিত। অতীত বলতে তাদের থাকে কিছু স্বার্থগত স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ বলতে কিছু সঞ্চয় পরিকল্পনা। খাওয়া খাদ্য বাসস্থানের স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প কিছু ইতর শ্রেণীর প্রাণীর থাকে। জ্ঞানের শুরু থেকে মানুষ খুঁজে গেছে মানুষের সাথে পশুর পার্থক্যটা আসলে কত দূর? সেই পার্থক্যের সত্যিকারের উপলব্ধির জন্য আল্লাহর বাণী পাঠালেন পড়ো তোমার প্রভুর নামে। জানিয়ে দিলেন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। তাই সক্রেটিস বলেছিলেন তুমি নিজেকে জানো।
বই মানুষের চিন্তার খোরাক। বই পড়ে মানুষ চিন্তার জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। বই না পড়ে যে মানুষ নিগূঢ়তম চিন্তার জগতে ঢুকতে পারে না, তা নয়। কিন্তু ওটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যথোপযুক্ত লোক খুঁজে নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলাপ চালানো হতে পারে এক ধরনের চিন্তার খোরাক। বই হচ্ছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে সহজতম পদ্ধতি হাজার বছরের মানুষের চিন্তার ইতিহাসকে সংযুক্ত করার। হয়ত ভবিষ্যতে এর চেয়ে সহজ কোনো উপায় বের হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব সুন্দর করে বলেছেন, মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরবতা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবতার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া ওঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয় মাথার ওপরের কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত বন্যা বাঁধ আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!

জীবন বদলে দিতে পারেন
আপনি যদি প্রতিদিন ৩০-৬০ মিনিট স্টাডি করেন তবে প্রতি সপ্তাহে আপনার একটি বই সম্পন্ন হয়। প্রতি সপ্তাহে একটি বই সম্পন্ন হলে প্রতি বছর সম্পন্ন হয় ৫০টি বই। আর আপনি যদি সিলেকটিভ ফিল্ডে ৫০টি বই সম্পন্ন করেন তবে প্র্যাকটিকেল ফিল্ডে একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হয়। কারণ মেজর ইউনিভার্সিটিতে একটি পিএইচডি প্রোগ্রামে সিলেবাসে ৪০ থেকে ৫০টি বই পড়ানো হয়ে থাকে। যদি এভাবে বছরে ৫০টি বই স্টাডি ধারা অব্যাহত রাখেন তবে পরবর্তী ১০ বছরে আপনার পঠিত বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০তে। যেখানে বিশ্বের মানুষ গড়ে মাত্র একটি বইয়ের কম স্টাডি করেন সেখানে সিলেকটিভ ফিল্ডে আপনি যদি ৫০০ বই স্টাডি করেন তবে আপনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কতটা উচ্চমার্গে উত্তীর্ণ হবেন, ভাবতে পারেন?
সত্যি বলতে আপনি যদি প্রতিদিন ভোর বেলায় ৩০-৬০ মিনিট স্টাডি করার অভ্যাস করতে পারেন তবে এটি আগামী দশ বছরের মধ্যে আপনাকে আপনার ফিল্ডের smart reader, most knowledgeable, most expert, highest paid successful person এ উন্নীত করবে আপনি পৃথিবীর এমন কোন successful person পাবেন না যারা daily study habit এর মাধ্যমে নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনেননি।
আমার পরিচিত বইপড়–য়া একজন ব্যক্তিত্ব হলেন অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের নির্বাচিত সাবেক ভিপি, একসময়ের রাজপথ কাঁপানো তুখোড় ছাত্রনেতা। যিনি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই সরকারি অর্থায়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানাবিধ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। তাকে আমি তার ব্যক্তিজীবনের অবিস্মরণীয় এই যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম- তিনি শুধু বলেছিলেন ‘আমি কখনো দিনের বেলা ঘুমাই না। সবাই যখন ঘুমাতো আমি তখন পড়ালেখা করতাম। ফজরের নামাজের পর সবসময় কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পড়ালেখার অভ্যাস আমার ছিল ; এখনো যেটা আমি অব্যাহত রেখেছি।’

ব্যবহারিক টিপস
১.আপনার study field সিলেক্ট করুন ও সিলেবাস তৈরি করুন।
২.টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ও সকল প্রকার ইলেকট্রিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার একটি নিয়মতান্ত্রিকতার আওতায় নিয়ে আসুন এবং সময় অপচয় রোধ করুন।
৩.দিনের সকল কাজের লিস্ট করুন এবং সময় ও অগ্রাধিকার অনুযায়ী শিডিউল তৈরি করুন।
৪.প্রতিদিন ফজরের আগে ঘুম থেকে জাগুন।
৫.পড়ালেখার মাধ্যমে দ্বীনের কাজ শুরু করুন এবং আপনার মনে ইনভেস্ট করুন।
আগামীকাল থেকে তো অনেক কিছুই শুরু করলাম, এবার না হয় আজ থেকে শুরু করি, কেমন?

বই পড়ার কৌশল
সবার পড়ার ধরন এক রকম নয়। একেকজনের পড়ার ধরন একেক রকম। অভিজ্ঞতার আলোকে শেয়ার করছি : নতুন কোনো বই পেলেই বই ও লেখকের নাম এবং কতটা ভালো করে দেখি। লেখক পরিচিতি থাকলে একনজর দেখা উচিত। অনেক সময় মূল মলাট উল্টালেই লেখকের কথা চোখে পড়ে । এটা অবশ্যই পড়তে হবে। তাতে বইয়ের মূল বক্তব্যটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
এরপর পড়া শুরু হয় সূচিপত্র থেকেই। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন অধ্যায় পেলে সেখানেই কৌতূহলী মন নিয়ে আগে ঢু মারি। তা না হলে সকল অধ্যায় সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে প্রথম অধ্যায় থেকেই করতে থাকি। হাতের কাছে লাল কালির কলম থাকতেই হবে। লাল কালির কলম ছাড়া মার্কিং করা কঠিন। সচরাচর লাল, নীল এবং সবুজ তিনটি কলম এবং অনেক ক্ষেত্রে text liner অথবা marker pen ব্যবহার করা যায়।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলোতে বা কোন বিখ্যাত ব্যক্তি বা মনীষীর উক্তি পেলে লাল কালি দিয়ে underline বা text liner দিয়ে mark করে রাখি। তবে অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলিতে সবুজ, কখনো নীল কালি ব্যবহার করি; যাতে বিষয়ের ভিন্নতা সহজেই চোখে পড়ে। এতে করে পরবর্তীতে এই বিষয়টা খুঁজে বের করতে অনেক সহজ হয়।
কোন নতুন বই ও লেখকের নাম উল্লেখ থাকলে লাল কালি দিয়ে গোল চিহ্ন দিই। ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশি কোনো শব্দ পেলে গোল চিহ্ন দিয়ে ডিকশনারি থেকে অর্থ বের করে পাশের ফাঁকা জায়গায় অ্যারো চিহ্ন দিয়ে রাখি। নতুন কোন পারিভাষিক শব্দ তার এ টু জেড অভিধান ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করি বা পড়ে ফেলি (ব্যস্ততা না থাকলে)!
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর পাশে তারকা চিহ্ন ব্যবহার করি। খুব বেশি হলে তিন তারকা অপেক্ষাকৃত কম হলে দু’টি বা তার চেয়েও কম হলে একটি তারকা চিহ্ন ব্যবহার করি।
মজার হাসির কোন প্রসঙ্গ পেলে হাসির emoji আটকানোর চেষ্টা করি অথবা হা-হা-হা লিখে রাখি।
বিস্ময়কর অবাস্তব ঘটনা বা প্রসঙ্গ এলে!!! দিই। ভালোলাগা লাইনটুকু তৎক্ষণাৎ আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। কোন বিষয়ে লেখকের মতের সাথে অমিল হলে পরে নিজস্ব মতামত লিখে রাখি কালো কালিতে। অত্যধিক ভালো লাগলে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাসূচক কথাবার্তাও লেখার চেষ্টা করি।
আর একটি কথা বই পড়া যখন শুরু করি তখন পৃষ্ঠার উপরে নিজের স্বাক্ষর বানানসহ বাংলা ইংরেজি ও হিজরি তারিখ- সন – বারের নাম এবং সময় লিখে রাখি। সম্পূর্ণ বই তাড়াহুড়ো করে শেষ করার জন্য কখনোই খুব বেশি তাড়া অনুভব করি না বলেই স্বাভাবিক গতিতে ধীর-স্থিরভাবে তা পড়ার চেষ্টা করি। তবে কখনো কখনো বই সাইজে ছোট এবং অত্যধিক ভালোলাগার হলে এক বৈঠকে শেষ হয়ে যায়।
বই পড়ার সময় আরেকটি কাজ খুবই জরুরি তাহলো নোট রাখা। অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি হাতের কাছে রাখার নোটবুকে তৎক্ষণাৎ টুকে রাখা পৃষ্ঠা নম্বরসহ। বইয়ের রিভিউ লেখা বা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনে নোটবুকে চোখ বুলালেই যথেষ্ট। যদিও এটা আমার সবসময় করা হয়ে ওঠে না। তবে চেষ্টা করছি নিয়মিত করার। বই পড়া শেষ হলে শেষ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর দিন-তারিখ সময়ের উল্লেখপূর্বক নিজস্ব মতামত সংক্ষেপে লিখে ফেলি।
আর একটা কথা, সচরাচর ধার করে বই পড়ি না । বই ধার করা ও ধার দেয়া যদিও পছন্দের কাজ।
আমার সংগ্রহে বেশকিছু গ্রন্থের পিডিএফ ফাইল রয়েছে। ল্যাপটপ বা মোবাইলের মাধ্যমে মাঝে – মধ্যে তা থেকে পছন্দসই বই পড়ে থাকি । তবে সত্য বলতে- হার্ডকপি পড়ার মজাই অন্যরকম।
নতুন বা পুরাতন বইয়ের গন্ধে অন্যরকম এক আকর্ষণ বোধ করি যা আমার কাছে খুবই ভালো লাগার। তবে কখনও দীর্ঘ সময় বা স্বল্প সময়ে সফরে থাকলে সেখানে হার্ডকপি বহন করা সম্ভব না হলে pdf file থাকলেও পড়ার ক্ষুধা মেটানো যায়! সময়টাও বেশ সুন্দর কাটে। সে হিসাবে পছন্দের কয়েকটি বইয়ের পিডিএফ ফাইল সব সময় মোবাইলে রাখি। টুকটাক পড়িও!
সর্বোপরি, বন্ধুদের আড্ডায় বা কারো সাথে গল্পের সময় বইয়ের অনুরূপ প্রসঙ্গ এলে পরে ওইসব বইয়ের শিক্ষণীয় বিষয় বা লব্ধ জ্ঞান তাদের সাথে নিজের মতো করে শেয়ার করি এবং তাদের কেউ বইটি পড়তে উৎসাহিত করি।
‘বাঙালির বই পড়ার আগ্রহ প্রবল কিন্তু বই কেনার বেলায় এসে অবলা।’- সৈয়দ মুজতবা আলী।
কিন্তু বর্তমানে, আমাদের বই কেনার বেলায় যেমন অবহেলা! facebook আসার পরে অনেক ক্ষেত্রে facebook আসক্তির কারণে বই পড়ার বেলায়ও তেমনি অবহেলা।
আসুন! নিজে বই পড়ি, সুন্দর জীবন গড়ি এবং অন্যদেরকেও বই পড়ায় উৎসাহিত করি।

শিশুদেরকেও বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত
গবেষণায় দেখা গেছে যেসব বাচ্চাকে ছোটবেলায় বই পড়ে শুনানো হয় তারা তাদের counterpart বা অন্য বাচ্চারা যাদেরকে বই পড়ে শুনানো হয় না, তাদের চেয়ে ভালো পাঠক হয়। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা বই পড়ার সাথে পরিচিত হয়। যাদের বাসায় ছোটখাটো লাইব্রেরি থাকে তাদেরও ভালো পাঠক হিসেবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কেবল বই পড়া যথেষ্ট নয়, কিশোরদেরকে বইয়ের আলোচনায় যুক্ত করতে হবে। সে একটা বই পড়ে কি বুঝতে পারল, কি নতুন তথ্য শিখলো, কোন জিনিসটার সাথে সে একমত, কোন জিনিসটার সাথে একমত নয় তাদেরকে এই ধরনের প্রশ্ন করতে হবে। অবশ্যই প্রথম দিনেই কোন শিশু এই পদ্ধতিতে অসাধারণ কিছু করে ফেলতে হয়ত পারবে না, কিন্তু ২-১ বছরের মধ্যেই তারা ভালো পাঠক হয়ে উঠবে, চিন্তা করতে শিখবে। নিজের মতো করে অ্যানালাইসিস করবে। বেশিরভাগ সময়েই আমরা বাচ্চাদেরকে এই প্রশ্নগুলি করি না। আমরা নিজেরাও এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত নই। কিন্তু একবার এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত হলে এটা কি সূর্যের ভবিষ্যৎ সময়ের জন্য অনেক ফলপ্রসূ কিছু হবে।
শিশু-কিশোরদেরকে যাচ্ছেতাই শিখতে দেয়া যাবে না। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে কেবল বইটি পড়লেই কোনো জিনিস সত্য হয়ে যায় না। যেকোনো বিষয়কে যুক্তি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দিয়ে যাচাই বাছাই করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যেকোনো দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভালো reference লাগে এটাও তাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো উচিত।
সূত্র মতে, যেসব শিশু-কিশোর কোন কিছু শেখার পরে অন্যদের সাথে শেয়ার করছে, তার বন্ধুদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যে কোন জিনিসের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছে তারা অনেক ভালো শিখছে, তাদের analytical skill বাড়ছে। যারা আলোচনা করে শিখছে, অন্যের মত এবং চিন্তার সাথে পরিচিত হচ্ছে, কয়েক বছরের ব্যবধানে যারা কেবল নিজে নিজে পড়ছে তাদের তুলনায় অনেক গভীর জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠছে। শিশু-কিশোররা বই পড়ার পরে তাদেরকে এই বইয়ের ওপর নিজের ভাষায় একটা summary লিখতে বলা যেতে পারে, ৫ মিনিট এই বইয়ের ওপর কথা বলতে দেয়া যেতে পারে। এটাও তাদের বুঝ শক্তিকে আরও শাণিত করবে। তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে তাদের নিজের মতকে ডিফেন্ড করার কৌশল শেখাতে হবে। এই জিনিসগুলো রাতে খাবার টেবিলে গল্প বা আড্ডার সময় করা যেতে পারে। কোন একটা ছুটির দিনে পরিবারের সবাই নিজের পছন্দমত বই পড়বেন এবং পারস্পরিক knowledge sharing session করবে এরকম কিছু একটা করা যেতে পারে।
শুধু বিনোদনের জন্য নয়, তাদেরকে ধীরে ধীরে জ্ঞানমূলক বই এবং নিজের লেভেলের চেয়েও কিছুটা কঠিন বইয়ের দিকে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই শুরু হতে হবে আনন্দের কিছু দিয়ে, সহজ কিছু দিয়ে। তাদেরকে feedback দিতে হবে। কি ভালো করেছি কি আরো ভালো করা যেত এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদেরকে একটা কাজ আরও সুন্দর করে করার, শেখার সুযোগ দিতে হবে। এই বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে- হ্যাঁ তুমি চেষ্টা করছো এবং উন্নতি লাভ করছো। ভালো কিছু করা যে সহজ না এবং উন্নতি একটা নিয়মিত পদ্ধতি- এ বিষয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন।
সবশেষে তাদের সাথে অন্তরঙ্গতার কোনো বিকল্প নেই। আপনি কয়েকটা মজার বই দিয়ে তাদের সাথে আপনার সম্পর্কের সূচনা করতে পারেন। এই বই হয়তো তার জীবন বদলে দেবে একজন কিশোর হয়ে উঠবে আগামীর ভালো পাঠক, লেখক কিংবা অ্যানালিস্ট।

লেখালেখির পূর্বশর্ত গভীর অধ্যয়ন
পড়ার মাধ্যমে পুঞ্জীভূত জ্ঞানের সমষ্টি একসময় লেখনীশক্তি দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলাও প্রথমে মানুষকে পড়তে বলেছেন এর পরেই কলমের ব্যবহার করতে বলেছেন অর্থাৎ লেখার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। শুধুমাত্র পড়ার জন্য পড়ার চেয়ে অনেক উত্তম হলো লেখার জন্য পড়া। লিখতে না পারলেও অন্তত কোন একটা বিষয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা থাকা এবং সে বিষয়ে নলেজ শেয়ার করা এবং সম্ভব হলে অবশ্যই লেখা উচিত। আর লেখালেখি করতে হলে গল্পের বইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানমূলক বই পড়া খুবই দরকার। ধরুন আপনি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তে ভালোবাসেন। বিনোদনের জন্যই উনার বই খুবই সুপাঠ্য কিন্তু গেম তৈরিতে অংশগ্রহণের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। পশ্চিমা সভ্যতার উন্নতির পেছনে একটা বড় নিয়ামক হলো গেম তৈরি। তারা প্রতিদিন নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। এটা তখনই সম্ভব যখন আপনি জ্ঞানমূলক বই পড়বেন।
পৃথিবীর সেরা গ্রন্থ দিয়ে
পাঠাভ্যাসের উন্মোচন হোক

যুগে যুগে বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে কিছু গ্রন্থ। আর যারা পাল্টাতে চেয়েছে তারাও সবার আগে চেষ্টা করেছে সেই গ্রন্থগুলোর আদি-অন্ত পড়ে ফেলার।
মোঙ্গলরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে বাগদাদের কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। পুরো বাগদাদকে শ্মশান বানিয়ে দিয়েছিল। তারা মুসলিম উম্মাহ সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা করেছিল তা হলো তারা কয়েক লক্ষ বই সংবলিত ‘দারুল হিকমাহ’ নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটা ধ্বংস করেছিল। মানবসভ্যতা মহামূল্যবান বইগুলো এক এক করে ফোরাত নদীতে ফেলে দিয়েছিল। ফুরাতের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বইয়ের স্তূপের কারণে! দীর্ঘদিন ফুরাতের সেই পানি বাগদাদ বাঁশি ব্যবহার করতে পারেন কারণ, তা ঐসব বইয়ের কালি আর মন্ডতে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল!
মঙ্গলবার সেই কয়েক লক্ষ বই এ জন্যই ধ্বংস করেছিল যে, তারা শুনেছিল, তখনকার দিনের দুই বিশ্ব পরাশক্তি, superpower, রোমান ও পারস্য সভ্যতার ধ্বংস করতে পেরেছিল যে যাযাবর, পশ্চাৎপদ, বর্বর আরবরা, তাদের মূল শক্তি নিহিত ছিল এই বইয়ের মধ্যেই। এই কারণেই তাদের সমস্ত রাগ ছিল বইয়ের ওপরে!
বস্তুত তাদের বিশ্বাস আর ধারণা অমূলক ছিল না। মুসলমানরা একটামাত্র বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপদটা সাধন করতে পেরেছিল। সেই বই তথা আরবি ভাষায় সেই কিতাবটা হলো ‘আল কুরআন’। মহাবিশ্ব al-quran! এটা এমন একটা বই যে, এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ সংশয় নেই, থাকার উপায় নেই।
এই একটিমাত্র বই বর্বর অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ আরব জাতিকে মহা ক্ষমতাধর করে তুলেছিল। এতটা ক্ষমতাধর যে, তারা ছয় হাজার বছরের ঐশ্বর্য ও শক্তিসমৃদ্ধ পারস্য সাম্রাজ্যকে, সাড়ে চার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মহাশক্তিধর রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে তাদের ওপরে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
সঙ্গত কারণেই মোঙ্গল তাতাররা ভীত ছিল তাদের ক্ষমতা, নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে, তাই তারা মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করার পাশাপাশি তাদের সমাজ থেকে সব বই ধ্বংস করেছিল।
ইতিহাস কিন্তু সেই মুঘল সেই বর্বর তাতারদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছে। বাগদাদ আক্রমণ ও সেখানে তাদের দ্বারা পরিচালিত পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞের মাত্র ৪০ বছরের মধ্যেই তাতাররা, মোগলরা নিজেদের অজান্তেই ইসলামের কাছে তথা বিস্ময়কর গ্রন্থ, আল কুরআনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দেয়। মোগলরা, তাতাররা মুসলমান হয়ে যায়!
এর কারণটা কী ছিল? একমাত্র দৃশ্যমান কারণ এটা ছিল যে, তারা প্রায় ১১ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা ও তাদের সমাজ তাদের সমস্ত বইপত্র ধ্বংস করার পরেই যে গুটিকতক মুসলমানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তার বেশিরভাগই তাদের হাতে বন্দিনী নারী ও মুসলিম নারী। এই নারীদের প্রায় সবাই ছিলেন শিক্ষিতা। তারা প্রত্যেকেই নিজের মন-মগজে শত শত বই এবং মহা বিস্ময়কর গ্রন্থ আল কুরআনের শিক্ষাকে ধারণ করে রেখেছিলেন।
তাতাররা বই ধ্বংস করেছিল বাগদাদের ১১ লক্ষ বই পাঠককে হত্যা করেছিল বটে কিন্তু তারপরেও যে একটি বই পাঠক পাঠিকা কি নিজেদের বিকৃত লালসা মেটানোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই মাত্র গুটিকতক বই পাঠিকার হাতে মাত্র চল্লিশ বছরের মধ্যে তারা নিজেদের লালিত ঐতিহ্য সাম্রাজ্য সভ্যতাকে বিসর্জন দেয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমান হয়ে যায়! কি অসাধারণ ক্ষমতা সেই বইয়ের! ভাবতে গেলেও বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়।
আজ মুসলমান তরুণ যুবকদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে কম। কুরআন তেলাওয়াত এর কিছুটা অভ্যাস থাকলেও যথাযথভাবেই মহাগ্রন্থ অধ্যয়নের কোন ইচ্ছাই আজ যুবসমাজের নেই।
কী লজ্জা! কী নির্মম পরিণতি! নিদারুণ মানসিক বিকৃতি!!
মুসলমান যুবক তরুণদের শোচনীয় মানসিক বিপর্যয় নিয়ে ভাবতে গেলে ক্রোধে-আক্রোশে, অনুতাপে আর অনুশোচনায় চেতনা বিবশ হয়ে আসে যেন, চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসে, চোখ ভিজে যায়!
নিজেদের বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে, করাতে হলে সকল কিছুর আগে আশ্রয় নিতে হবে সেই বইয়ের কাছে, ডুবতে হবে বইয়ের সাগরে, এর পাতায় পাতায়, বিচরণ করে বেড়াতে হবে, নিজেদের সজ্জিত করতে হবে নতুন করে। তাই আমার প্রতিদিনের সকালটা শুরু হোক পৃথিবীর সেরা গ্রন্থ আল কুরআন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে।

প্রিয় বন্ধুরা
যুগে যুগে জ্ঞানচর্চাকারীরাই মসনদে সমাসীন ছিলেন। আজ মুসলমানরা বসনিয়া থেকে আরাকান পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে নির্যাতিত, অত্যাচারিত, ক্ষমতাচ্যুত, বিচ্যুত। কিন্তু এই মুসলমানরাই এক সময় ছিল পৃথিবীর সেরা জাতি। সোনালি সেই ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই। মুসলমানদের ঘরে ঘরে ছিল বই পড়ার অভ্যাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি উদ্যোক্তা ও পরিচালক ছিল মুসলমানরা। বাগদাদের দারুল হিকমা পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগারটি ছিল গ্রানাডায়। গ্রানাডার এই লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ। ঐ একই সময়ে ইউরোপ জুড়ে সবচেয়ে বড় যে পাঠাগারগুলো ছিল তা ছিল মূলত খ্রিস্টান পাদ্রীদের মঠে বা গির্জায়। আর ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতে, পুরো ইউরোপব্যাপী কোন গির্জা বা মঠে চার শতের বেশি বই ছিল না। (সূত্র : History of the reign of Ferdinand and Isabella the Catholic. William H prescott, 1837, pp.188)
সে সময় মুসলিম জনমানসই এমন ছিল যে, ছেলে-বুড়ো নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিব সবাই বই-পাগল ছিলেন। প্রতিটি বাড়িতে ছিল গ্রন্থাগার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি। কে কার চেয়ে বেশি বই জোগাড় করতে পারে, তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত সমাজবাসীর মধ্যে। একে অপরকে উপহার হিসেবে তারা বই দেয়া নেয়া করতেন। কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলেও উপহার হিসেবে বই নিয়ে যেতেন। ইতিহাসে দেখা যায় স্বয়ং খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম উপহার হিসেবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন বই। তার নিজের যে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল সেখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ষাট হাজার।
আর পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের গবেষণায় এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ১০ শতাব্দীতে ইউরোপের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি অবস্থান ও বইয়ের বাজার বসতো মুসলিম আন্দালুস তথা স্পেনে।
সেই সমাজে কেবল পুরুষদের বেলাতেই যে এরকম মনোজাগতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটে ছিল তাই নয়, নারীদের বেলাতেও এরকম একইভাবে উত্তরণ ঘটেছিল। তার প্রমাণ আমরা পাই খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের আমলে এ ঘটনায়।
রাজ পরিবারের এক যুবকের বিয়ে দেয়ার জন্য খলিফা উপযুক্ত পাত্রী খুঁজছিলেন। তিনি নিজে অত্যন্ত বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী, তেমনি তিনি রাজ পরিবারের জন্য সেরকমই একটি পাত্রী খুঁজছিলেন।
তাই খলিফা এক বিস্ময়কর ঘোষণা জারি করলেন পাত্রীর খোঁজ চেয়ে। তিনি ঘোষণা করলেন; গ্রানাডা শহরে যে বাড়িতে বিবাহযোগ্য এমন পাত্রী রয়েছে, যে পাত্রী একদিকে পুরো আল কুরআন মুখস্থ করেছে অর্থাৎ কুরআনে হাফেজ এবং এর পাশাপাশি ইসলামের যে কোন একটি হাদিসশাস্ত্র যার মোটামুটি জানা আছে সেরকম পাত্রীর অভিভাবকরা যেন তাদের বাড়ির বারান্দা বা বেলকুনির বাইরে রাতের বেলায় প্রজ্জ্বোল্যমান বাতি টাঙিয়ে রাখেন।
কেবল খলিফাকেই নয়, পৌর গ্রানাডাবাসীকে অবাক করে দিয়ে সে রাতে শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বেলকুনিতেই প্রজ্জ্বোল্যমান বাতি টাঙানো হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কেমন যুবতী মেয়ের উপস্থিতি ছিল, যে মেয়েটি একাধারে কুরআনে হাফেজ আবার অন্যদিকে হাদিস শাস্ত্রেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।
প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন, মুসলমান হিসেবে মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যারা ভাবেন, মুসলিমদের একটি স্থায়ী ও অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য যারা নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। হতাশাগ্রস্ত মুসলিম যুবসমাজের আগামীর আলোর দিশারি হিসেবে যারা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটনের স্বপ্নধারা বিভোর। বিপ্লব বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক সোনালি সমাজের কারিগর হিসেবে যাদের গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই মানুষগুলোকে স্বপ্ন দেখতে হবে এক নতুন বিপ্লবী জ্ঞানচর্চাময় সমাজের। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে পাঠাগার, হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে বই, নিজে অধ্যয়ন করে জানিয়ে দিতে হবে, আবার সেই সোনালি সমাজ আমরা গড়ব এই বই হাতে নিয়ে- পৃথিবীকে আলোকিত করব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

Popular Posts