Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts
Showing posts with label chhatrasangbadbd's Article. Show all posts

Friday, April 20, 2018

কাব্যের দায় মিটিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ এগিয়ে গেছেন আদর্শের ঝাণ্ডা হাতে -তৌহিদুর রহমান



বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচেক, সব্যসাচী লেখক, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর পর কবিকে নিয়ে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা অসম্ভব রকমের খারাপ অভ্যাস আছে। তা হচ্ছে, আমরা বেঁচে থাকতে কাউকে যথাযথ মূল্যায়ন করি না, আবার মরণের পরে তাকে নিয়ে কিছুদিন উৎসাহ দেখাই। তারপর সব ভুলে যাই। আমাদের মধ্যে আরো একটা বিষয় প্রকটভাবে আটকে আছে, তা হচ্ছে রাজনীতি। আমরা সবকিছুর সাথে রাজনীতি যুক্ত করে ফেলি। সৈয়দ আলী আহসান আমাদের বড় কবিদের মধ্যে একজন। সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে তার মৃত্যুর পরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল এখন তা নেই। আমরা ইতোমধ্যেই তাকে ভুলতে বসেছি। কেন এটা হবে? তার কবিতা তখনও যা ছিল এখনও তাই আছে। একই কথা প্রযোজ্য কবি শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রে। সৈয়দ আলী আহসানের মুত্যুর পরে তাকে নিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ ভালো একটা কবিতা লিখেছিল। আমাদের উচিত অগ্রজদের নিয়ে কাজ করা। তাদের বাঁচিয়ে রাখা।’

আজ যেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাহিত্য সমালোচকের কথার প্রতিফলন আমরা পরতে পরতে দেখতে পাচ্ছি। আজ আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজেই নিজের উদাহরণ হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। এত বড় একজন লেখক, কবি, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ অথচ তাকে আমরা একদম ভুলে গেছি। গুণী এই লেখক বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে যে আমরা কতভাবে খেদমত গ্রহণ করেছি তার ইয়ত্তা নেই! তিনি টানা দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড সম্পাদনা করেছিলেন। আর তাই হয়তো কবি গোলাম মোহাম্মকে আমরা কিছুটা হলেও চিনতে পেরেছি। তা না হলে কবি গোলাম মোহাম্মদও অনেকের মতো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতেন। তাই কবি গোলাম মোহাম্মদকে বাঁচিয়ে রাখার সম্পূর্ণ কৃতিত্বটা দিতে চাই অত্যন্ত উদার ও বড় মনের মানুষ কবি আবদুল আবদুল মান্নান সৈয়দকে। কবি গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচেক, সব্যসাচী লেখক, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দকে।
পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্যের জন্য সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা কবি গোলাম মোহাম্মদের ‘আলোকদিয়ার আলোর ছেলে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
আলোকদিয়ার আলোর ছেলে কোথায় চলে যায়,
সেই বেদনা বুকের ভেতর কেবল মোচড় খায়।
আলোকদিয়ার সবুজ জুড়ে কিসের বিষাদ নামে
নবগঙ্গা ব্যথায় কাঁপে বরুনাতৈল গ্রামে
পাখিগুলোর কণ্ঠে করুণ সুর
কোথায় গেল সেই ছেলেটি সে আজ কত দূর
নীল আকাশে কাঁপন জাগে সেই ছেলেটি কই
আকাশ নীলে ব্যথার প্রলেপ কষ্টে ফোটে খই
গ্রামে গ্রামে বৃক্ষলতায় কান্না ঝরে পড়ে
সেই ছেলেটির জন্য কাঁদে মানুষ ঘরে ঘরে
মাঠে মাঠে বাতাস কাঁদে ফসল ওঠে কেঁদে
সেই ছেলেটির জন্য কত ব্যথার গাঁথা বেঁধে
মানুষ তারে ভালোবাসে ফেলে চোখের পানি
মাগফেরাতের দোয়া করে স্মৃতির আঁচল টানি।
কবি গোলাম মোহাম্মদকে আমি পুরোপুরি পাঠ করেছি। কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড প্রস্তুত করেছিলাম প্রায় দুই বছর ধরে। সে সময় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ সার্বক্ষণিক পাশে থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা পালন করেছি। তখন দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে, তার কাব্য নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে। তখনই আমরা বুঝেছি যে গোলাম মোহাম্মদ একজন বড় মাপের কবি। তার সমগ্র রচনা জাতির সামনে উপস্থাপিত করার দায়িত্বটা আমাদেরই ছিল, কিন্তু আমরা তা পারিনি। আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা ছিল, আছে। তা আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সম্প্রতি কবি গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গীত সমগ্র পুরোটা সম্পাদনা করেছি। সাধারণ ভাষায় লেখা অতি অসাধারণ অসংখ্য গান মুগ্ধ করার মতো। রচনা সমগ্র প্রথম খণ্ডের কাজ করার সময় আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছ থেকে যে দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম তা এখন পাথেয় হিসেবে কাজে দিচ্ছে। আমি জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশের প্রথিতযশা লেখক, কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকের সাথে কাজ করেছি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শিখেছি। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের সাথে এক বছর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদের সাথে অনেকগুলো বইয়ের কাজ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কবি বেনজীর আহমদের ‘হেমন্তিকা’ ও ‘জিন্দেগী’ কাব্যগ্রন্থ এবং শাহাবুদ্দীন আহমদের ‘চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা’। বিভিন্ন লেখকের অন্তত দুই হাজারের অধিক গ্রন্থ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে সম্পাদনা, সংশোধন, পরিমার্জন করেছি। কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে, ভুল হলে অগ্রজদের কাছ থেকে শিখেছি। এখনো প্রতিনিয়ত শিখছি অনেকের কাছ থেকে। এই সব উঁচুস্তরের মানুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে মণি-মাণিক্য সঞ্চয় হয়েছে অনেক। যা মনের মণিকোঠায় তুলে রেখেছি সযতনে। আজ আমাদের মাথা আছে কিন্তু সেই মাথার উপরে আচ্ছাদন নেই। কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে সহসা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কয়েকটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম। আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব, একেএম নাজির আহমদ, অধ্যক্ষ আব্দুর রব, কথাশিল্পী জামেদ আলী, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ ছিলেন এক একটি নক্ষত্র। কথাশিল্পী জামেদ আলী ছাড়া খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অন্যদেরকে আমরা হারিয়েছি। তাদের অভাব এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের মতো বহুভাষাবিদ একই সাথে কুরআন-হাদিস, বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফেকাহ, কবিতা, ছন্দ, অর্থনীতি, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তাই বলছিলাম যে, আজ আর আমাদের মাথার উপরে ছাতা নেই। আমরা যে হাজার হাজার কাজ করেছি কিন্তু কোথাও নিজের নামটা পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। আমরা নাম-জসের পাগল ছিলাম না, ছিলাম কাজের পাগল। আবদুল মান্নান তালিব প্রায়ই বলতেন, মুসলমানরা দুনিয়াতে এমন বড় বড় কাজ করেছেন অথচ নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। না জানি আত্মপ্রচারের দায়ে দণ্ডিত হয়ে পরকালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় কিনা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পাল্টেছে অন্যের ওপরে নিজের নামটা না দেখলে অনেকে মনোক্ষুণœ হয়, কাজ করা ছেড়ে দেয়, এমনকি সংগঠন ত্যাগ করে। নিজের গলা থেকে আল্লাহর রজ্জু পর্যন্ত খুলে ফেলে।
কবি গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কবি ছিলেন কাজপাগল একজন মহৎ মনের মানুষ। কাজের গন্ধ পেলে তিনি আদেশের অপেক্ষা করতেন না। ঝাঁপিয়ে পড়তেন কাজে। নীরবে নিভৃতে অসংখ্য গান কবিতা লিখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি শুধু লিখেই গেছেন কিন্তু তা প্রকাশের কোনো পেরেশানি তার মধ্যে লক্ষ করিনি। আমাদের উচিত তার সমগ্র কর্মকাণ্ড জাতির সামনে উপস্থাপিত করা, তুলে ধরা।
কবি গোলাম মোহাম্মদের প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন আমেজের। তার প্রতিটি কবিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভিন্ন। তবে আশর্দিক দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে তা অভিন্ন। তার কবিতার অন্তর্গত ভাব একগুচ্ছে জমা করলে বুঝা যায় তা এক একটি তসবিদানার মতো, কিন্তু অবিচ্ছন্ন সূত্রে একত্র করলে দেখা যাবে তা জমাট ঈমানী শক্তিতে একতাবদ্ধ। তার প্রতিটা কবিতার আলাদা স্বাদ স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করা খুবই সহজ। তার এক একটি কবিতা পাঠ করে, তার গান শুনে মুগ্ধ হতে হয়। তাকে পাঠ করে ও শুনে কাটিয়ে দেয়া যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিংবা বছর। পাঠক শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করার বিমোহিত করার ক্ষমতা যে লেখক বা কবির যত বেশি সেই লেখক বা কবির কালোত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফল বলে আমরা মনে করি।
উপমা, অলঙ্কার, ভাববিন্দু মিলে সৃষ্টি হয়েছে তার কবিতার শরীর। তার কবিতা বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্ন ভাব অলঙ্কারে প্রকাশিত হলেও তার যোগফল কিন্তু একটাই। আর তা হলো আদর্শ। এই আদর্শিক বুনন সহজে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তার মতো অধিক সহজ সরল সাবলীল ভাষায় কবিতার জমিন এত নিখুঁতভাবে ভরাট করতে ইতঃপূর্বে অন্য কোনো কবিকে দেখা যায়নি। সুচ সুতা, সেলাই বুনন, কারুকাজ সবই কবির একান্ত নিজের। সবক্ষেত্রেই কবির নিজের নিপুণতা নিজেই ধরে রেখেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামি গানের স্বতন্ত্র একটা ধারা তৈরি করেছেন, যা কালজয়ী। কবি মতিউর রহমান মল্লিক সেখান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসে আদর্শিক ও বৈপ্লবিক নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করেছেন। মল্লিক থেকে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে কবি গোলাম মোহাম্মদ অতি সহজ সরল ও মোলায়েম ভাব-ভাষায় সৃষ্টি করেছেন তার গীতিকাব্য। যা পাঠক-শ্রোতাকে আবিষ্ট করে। ধরে রাখে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোহাম্মদের বিশেষ কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি সব সময় একদম পরিচিত শব্দে তার কাব্য-গানের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। চেনা শব্দে এভাবে কাব্য ভাষা ও বিষয় অাকর্ষণ করতে ইতঃপূর্বে খুব কম কবিকেই দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরল। তার প্রতিটা কবিতা গান পরস্পর থেকে আলাদা তবে তা নতুন আঙ্গিকে নতুন কাব্যভাবনায় সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে পাঠকের আকর্ষণ তার প্রতি।
পথহারা জনগণকে জাগিয়ে তোলার সেরা হাতিয়ার হচ্ছে কবিতা। সেই আদিকাল থেকে তাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে কবিতাই সব সময় আদৃত হয়ে আসছে। কবিতা মানুষকে সুন্দরের স্বপ্ন দেখায়। মনকে করে তোলে সতেজ। কবিতার মাধ্যমে খুব সহজে মানুষের মনে আদর্শের বীজ বুনে দেয়া যায়।
গত শতাব্দী থেকে বলা যায় দুনিয়া জুড়ে মানুষের মধ্যে আত্মোপলব্ধি ও আত্মানুসন্ধানের ঢেউ জেগে উঠেছে। মানুষ খুঁজতে শুরু করেছে আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক ঠিকানা। নিজের যা আছে তাই নিয়ে সে জেগে উঠতে চাই। বেঁচে থাকতে চাই আপন ঐতিহ্য নিয়ে। আমরা জানি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক রাস্তা ধরেই এগিয়ে চলে মানব সভ্যতা। আর সে কারণেই আজ মুসলিম জাতিও সামনে এগিয়ে যেতে চায় তার স্বর্ণখচিত দ্যুতিময় অতীত ঐতিহ্যের পথ ধরে। মুসলমানদের আছে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। আছে দেড় হাজার বছরের গৌরবময় সোনালি ইতিহাস। এরই ধারাবাহিকতায় যেসব মনীষী আদর্শিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষর রেখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ তাদের অনেকের মধ্যে একজন। আমাদের পূর্বসূরি কবি গোলাম মোস্তফা, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ হচ্ছেন সেই আদর্শের একেকজন সিপাহসালার।
আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতাকে নাস্তিক্যবাদ ও আদর্শহীনতার কবল থেকে মুক্ত করার একটা প্রয়াস শুরু হয়েছিল। এ প্রচেষ্টার অনেকখানিই সফল হয়েছে নব্বই দশকে এসে। একঝাঁক বিশ্বাসী কবি এই প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি সোলায়মান আহসান, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি মুকুল চৌধুরী, কবি হাসান আলীম, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি গাজী এনামুল হক প্রমুখ। এরা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করতে অনেকটাই সফল হয়েছেন। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া এই ধারা আজ অবধি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এটা দৃঢ়তার সাথে বলা যায়।
আদর্শবাদী কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন আশির দশক থেকেই। কিন্তু তার প্রায় সব কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে নব্বই দশকে এসে, কোন কোনটা তারও পরে। নব্বই দশকের শেষে কবি গোলাম মোহাম্মদের সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑঅদৃশ্যের চিল (১৯৯৭), ফিরে চলা এক নদী (১৯৯৮), হিজল বনের পাখি (১৯৯৯), ঘাসফুল বেদনা (২০০০) হে সুসূর হে নৈকট্য (২০০২), এছাড়া ছড়াগ্রন্থ ছড়ায় ছড়ায় সুরের মিনার (২০০১) এবং নানুর বাড়ী (২০০২)। কবির প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থই নন্দিত এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, যা সচরাচর হয় না।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলামী সাহিত্যের দিকনির্দেশক আবদুল মান্নান তালিব, বিদগ্ধ আলোচক নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, বর্তমান বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি আল মাহমুদ, বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সাহিত্য সমালোচক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কবি, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক গোলাম মোহাম্মদকে যখন কবি হিসেবে গ্রাহ্যের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং বিশেষভাবে তার কবিতাকে উচ্চকিত করেন তখন সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই এই কবিকে সমীহ না করে পারেন না। এ দিক দিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ সৌভাগ্যবান এবং সার্থক।
আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব বলেন, ‘ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। নিজের জীবন ও সাহিত্য কর্মকে এজন্য উৎসর্গিত করেছিলেন। এ ব্যাপারে তার সমগ্র কাব্যকর্মে কোনো জড়তা অস্পষ্টতা নেই। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক বিশ্বে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ কবিকণ্ঠ।’ (ভূমিকা, কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র)
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, ‘কবিতা লিখতেন গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫৯-২০০২), গান লিখতেন, ছবি আঁকতেন। তাঁর ছোট প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন শিল্পকোণ। মানুষটি ছিলেন যেন একটি বিজনতার অধিবাসী, স্মিতহাস্যময়, স্বল্পভাষী। ছন্দোবদ্ধ পদ লেখেন যাঁরা, তারা সবসময় পদ্যে পড়ে থাকে, কবিতায় উত্তীর্ণ হয় না। গোলাম মোহাম্মদের কবিতায় পেতাম কবিতারই আস্বাদ। আমার স্বভাব হচ্ছে, ভালো-লাগাটুকু অনেক সময় লিখে, অন্তত মুখে, জানানো। গোলাম মোহাম্মদকে একাধিকবার আমি জানিয়েছি, তাঁর কবিতা আমার ভালো লাগছে।’ (হিজল বনের পাখি, কবি গোলাম মোহাম্মদ স্মারক, পৃষ্ঠা ৭)
এরপর তার সমসাময়িক প্রায় সকলেই কবিকে নিয়ে লিখেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রায় সব কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সংগঠক তাকে পাঠ করেন, তাকে নিয়ে ভাবেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। এটা তার অনেক বড় পাওয়া। তার গানের ভক্ত শিশু, ছেলে, বুড়ো, যুবা সকলেই।
‘সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে
আমাকেই রাখিও রহমান
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভীক
নির্ভয়ে সব করে দান।’
(কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২১৩)
‘কাশেমের মায়ের কোল হয়নি খালি
খালি হলো কোটি কোটি মায়েদের কোল,
কোটি কোটি বুকে জ্বলে ব্যথার আগুন
শাহাদাত ভাঙছে সকল আগল।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১২)
‘হলদে ডানার সেই পাখিটি
এখন ডালে ডাকে না
মনের কোণে রঙিন ছবি
এখন সে আর আঁকে না।
এখন কেন হচ্ছে মানুষ খুন
দুঃখের আগুন জ্বলছে অনেক গুণ…।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৪)
‘হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি
দেয় না সাড়া নীরব গহিন বন
বাতাসে তার ব্যথার গুঞ্জরণ।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৫)
কবি গোলাম মোহাম্মদ এ ধরনের অজস্র গানের জনক। আসলে গানের মাধ্যমেই তার পরিচিতিটা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি- এই পঙ্ক্তি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই মনের মাঝে ভেসে উঠে একটি নাম একটি ছবি, তা হলো কবি গোলাম মোহাম্মদ। ‘পাঞ্জেরি’ শব্দটি শুনলেই যেমন মনের মাঝে ভেসে ওঠে কবি ফররুখ আহমদের কথা। ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি শুনলেই ভাবতে থাকি নজরুলের কথা। সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে- শুনলেই মন ছুটে যায় সাগর দাড়িতে- কবি মাইকেল মধুসূদনকে মনে পড়ে যায়। ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা- শুনলেই চিন্তা করি কবি গোলাম মোস্তফার কথা। এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে শুনলেই পল্লীকবি জসিম উদ্দীন সামনে এসে হাজির হয়। এমনিভাবে কে ঐ শুনালো মোরে আজানের ধ্বনি- শোনামাত্রই কায়কোবাদকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। আরো অনেক কবিই আমাদের অন্তরকে নাড়া দেয় গভীরভাবে। প্রত্যেক কবির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে আলাদা করে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। তেমনি কবি গোলাম মোহাম্মদের অনেক গান কবিতা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, সেসব চরণগুলো শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কবি গোলাম মোহাম্মদের নাম। লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি-(নজরুল) তেমনি লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা লিখেও অনেকেই পাননি কবি খ্যাতি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো অসংখ্য গানের স্রষ্টা কবি গোলাম মোহাম্মদ। সুর যত সহজে মানুষের মনে ঝংকার তোলে সাহিত্যের অন্য কোন মাধ্যমে অত সহজে মানুষের মনে স্থান করে নেয়া যায় না। এদিক দিয়ে গোলাম মোহাম্মদ এগিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে। আমার মনে হয় গান না লিখলে গোলাম মোহাম্মদ কখনো এতটা জনপ্রিয় ও কালজয়ী হতে পারতেন না।
কবি গোলাম মোহাম্মদ একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন- যেখানে থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা। স্বপ্ন দেখতেন মানবতার জয়গানের, স্বপ্ন দেখতেন কালজয়ী এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার। যে সভ্যতা ধারণ করেছিলেন সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হযরত মুহাম্মদ সা:। সুন্দর সেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান কবিতা। যা অনেক দিক থেকেই সাহিত্য আকাশে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। যা প্রতিনিয়ত অনেক আদর্শবাদী মানুষের মনে অনুরণিত হয়, হচ্ছে।
গানের মতো তার কবিতাও পাঠকমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যা শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন সুপণ্ডিত সাহিত্য সমালোচকরা। তার কবিতার কিছু উদাহরণ পেশ করা হলো-
‘পাখি
পাখিরে তোর ঈমান বড়ই পাকা
আহা!
তোর গানে যে মনের বিনয় মাখা।
(পাখিরে তোর, হিজল বনের পাখি)
‘হাতটারে সাফ কর সাফ কর দিল
মুছে যাবে যন্ত্রণা সব মুশকিল
তাল তাল আন্ধার পাপ কর দূর
পুষ্পিত দিন পাবে ঘ্রাণ সুমধুর।’
(হাসতো নিখিল, অদৃশ্যের চিল)
‘তৃতীয় বিশ্বের যুবক মাত্রই বিষণ্ণতার রোগী
তার সামনে অন্ধকার, মহানগরীর ডাস্টবিনের মতো
পচা রাজনীতির আস্ফালন!’
(ফসলহীন সময়ের কথা, ফিরে চলা এক নদী)
‘সেও তো ধ্বনির কাজ
তোমার প্রভুর নামে পড়
অনন্ত ভাবের ফুল ফুটে হলো
ভাষার বাগান।’
(হরফের সাঁকো, ঘাস ফুল বেদনা)
শব্দে-ছন্দে, ভাব-কল্পনায়, আদর্শ-উদ্দীপনায়, আশা-ভালোবাসায় গোলাম মোহাম্মদের অনেক কবিতা অতুলনীয়, অসাধারণ ও অনন্য। পাঠক পুলকিত, শিহরিত ও চমকিত হয় তা পাঠ করে। তার কবিতা পাঠক সহজেই হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। তার কবিতা মনকে আন্দোলিত করে, উদ্দীপিত করে, বিমোহিত করে। তার কবিতায় ছন্দের অপূর্ব দোলা আছে। তার কবিতায় কোথাও ছন্দের ভুল পরিলক্ষিত হয় না। পাঠক মাত্রেই মোহনীয় সেই ছন্দ দোলায় দুলতে থাকে এবং একজন আদর্শবান, বড় ও ভালো মানুষ হবার স্বপ্ন জাগে মনে। দায়িত্বশীল, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ গড়তে সহায়তা করে তার লেখা। স্বপ্ন ভরা উদ্দীপনাময় তার কবিতা নতুন প্রজন্মের পাথেয় হতে পারে।
আমি মনে করি গোলাম মোহাম্মদ একটি কালজয়ী প্রতিভা। বিশেষ করে গানের মাধ্যমে তিনি সুদীর্ঘকাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার গান আবেদন ছড়াবে যুগ যুগ ধরে। তার সৃষ্টিসম্ভার প্রকাশিত হলে পাঠক, সাহিত্যালোচক তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমাপের চিত্রশিল্পী। ছিলেন সংগঠক। সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ, বড় মাপের মানুষ। কবি, শিল্পী, সংগঠক হিসেবে তিনি যতটা পরিচিতি লাভ করেছেন, তার থেকে অধিক পরিচিতি পেয়েছেন গীতিকার হিসেবে। তার গান কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল এদেশে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার মুক্তি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক কবি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবতাবাদী কবি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

Thursday, April 12, 2018

বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী এবং রিসালায়ে নুর -আলী আহমাদ মাবরুর


বিংশ শতকে মুসলিম বিশ্বে যে কয়জন বড় মানের শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় সংস্কারক আবির্ভূত হয়েছিলেন তুরস্কের বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার মধ্যে অন্যতম। তার গোটা জীবন, সংগ্রাম এবং সাধনা আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক। নুরসীকে তুরস্কের ইসলামের পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার জীবনের অনন্যসাধারণ কাজটি হলো রিসালায়ে নুর (ইংরেজিতে বলা হয় দ্য বুক অব লাইট)। মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে যেভাবে সাইয়্যেদ নুরসী তার রিসালায়ে নুরে পর্যালোচনা করেছেন, তা অন্য কোন বইতে আমরা সেভাবে আর পাই না। এই গ্রন্থে আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। রিসালায়ে নুর হলো সেই অসাধারণ সৃষ্টি যা বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীকে আজও চির অম্লান করে রেখেছে।

নুরসী তার জন্মভূমি তুরস্কে উস্তাদ বদিউজ্জামান হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি এমন একজন বিদ্বান ছিলেন যিনি শুধুমাত্র ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই নয় বরং একই সঙ্গে আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (সায়েন্স অব ন্যাচার বা ন্যাচারাল সায়েন্স) এবং এর অগ্রগতি সম্বন্ধেও দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, ধর্মীয় সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং মানুষের মুক্তি সংগ্রামের লড়াকু একজন সৈনিক। তার শিষ্য বা ছাত্র কয়জন কিংবা কতজন মানুষ তার কাজ থেকে উপকৃত হয়েছে তার কোন সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায় না। কেননা তুর্কি নামক জাতিটির আজকের এই উত্থানের পেছনেও বদিউজ্জামান এবং তার রচনাবলির ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রচন্ড ধরনের প্রতিকূল একটি ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে থেকেও পুরোটা জীবন জুড়েই তিনি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করে গেছেন। শত নির্যাতনেও তিনি আপস করেননি বরং সার্থকতার সাথে একটি সফল আন্দোলনের সূতিকাগার রচনা করার জন্য নিজ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
উস্তাদ বদিউজ্জামান ১৮৭৭ সালে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের বিটলিস নামক জেলার অধীনে নুরস্ নামক একটি গ্রামে জন্ম নেন। এই নুরস্ গ্রামে জন্ম নেয়ার কারণেই তার নামের শেষে নুরসী শব্দটি যোগ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সাইয়্যেদ অর্থাৎ রাসূলের (সা.) বংশধর। পিতার দিক থেকে বিচার করলে তার আদি পুরুষ ইমাম হাসান (রা.) আর মায়ের দিক থেকে তার আদি পুরুষ ইমাম হোসাইন (রা.)।
৯ বছর বয়স পর্যন্ত নুরসী তার পরিবারের সাথেই ছিলেন। সেই সময়ে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় বড় ভাই মোল্লা আব্দুল্লাহর কাছে। আব্দুল্লাহও ইসলাম সম্বন্ধে খুব ভালো জ্ঞান রাখতেন। পরে নুরসী খুব অল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসায় তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পান। ফটোগ্রাফিক মেমোরি (একবার পড়লেই সেটাকে মনে রাখার ক্ষমতা), উৎকর্ষ মানের বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহসের কারণে নুরসী অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আশপাশের মানুষও তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার জন্য তাকে সমীহ করতে শুরু করে। তৎকালীন সময়ের অটোম্যান আলেমরা শিশু-কিশোরদের জন্য যে সিলেবাস বা কারিকুলাম নির্ধারণ করেছিলেন নুরসী মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার পুরোটাই আত্মস্থ করে ফেলেন। তার প্রতিভা দেখে তার শিক্ষক মোল্লা ফেতুল্লাহ তাকে বদিউজ্জামান বা যুগের বিস্ময় নামে অভিহিত করতে শুরু করেন। তার মেধা ও মুখস্থ বিদ্যার কদর করতেন পূর্বতুরস্কের প্রায় সব আলেমই। সেই সময় পর্যন্ত ইসলামিক বিজ্ঞানের ওপর যে ৯০টি রচনাবলি ছিল বদিউজ্জামান নুরসী তার সবটাই বেশ কম সময়ের মধ্যে মুখস্থ করে ফেলেন। অথচ সাধারণভাবে তৎকালীন যে কোন সাধারণ ছাত্র এই একই কোর্সটি সুসম্পন্ন করতে গড়ে ১৫ বছর সময় নিতেন।
নিজ এলাকার পড়াশোনা শেষ করার পর নুরসী চলে যান ভ্যান নামক পূর্ব তুরস্কের একটি প্রদেশে। সেই সময়েই নুরসী প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন যে, বর্তমান সভ্যতার ক্রীড়নকেরা আধুনিক বিজ্ঞানের যে নানা দিক আবিষ্কার করেছেন সেগুলো আসলে মুসলমানদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে। কেননা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে ভিত্তি করে যদি ইসলামের বার্তা মানুষের কাছে না পৌঁছানো যায় অর্থাৎ ইসলামকে যদি বিজ্ঞানময় হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা না যায় তাহলে ইসলামের দাওয়াতি কাজ করে খুব একটা সফল হওয়া যাবে না। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখা ও নানা অগ্রগতিকে আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। এবারও বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গণিতশাস্ত্র, প্রাণিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল এবং দর্শনের ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ভ্যান প্রদেশে জীবনের যে ১৫টি বছর পার করেন তার পুরো সময়টাই তিনি স্থানীয় উপজাতি ও গ্রামবাসীদের শিক্ষক ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সেই এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালু করেন স্থানীয়ভাবে যার নাম দেয়া হয়েছিল হরহর। এই ১৫ বছর সময়ের মধ্যেই, নুরসী যুক্তিবিদ্যা বিশারদ ইসমাইল গেলেনবেভির বুরহান নামক বইটির উপর একটি নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণও রচনা করেন।
ইউরোপীয় আধুনিক বিজ্ঞান এবং ইসলামের প্রথাগত বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে উস্তাদ নুরসী এই উভয় ধারার বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই অনুভূতি থেকেই তিনি পূর্ব তুরস্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘মেদরেসেত-উজ জেহরা’। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য তার সরকারের সমর্থন দরকার ছিল। সরকারি মহলের কাছ থেকে এই সহযোগিতা পাওয়ার অভিপ্রায়েই নুরসী ইস্তাম্বুলে গমন করেন। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকার যেই বাড়িতে নুরসী সেই সময়ে থাকতেন তার দরজায় তিনি একটি পোস্টার লাগিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল ‘এখানে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়, সব প্রশ্নের উত্তরও এখানেই মিলে যায়- যদিও এখানে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।’
ধীরে ধীরে ইস্তাম্বুলের আলেমদের সাথেও নুরসীর পরিচয় হয়। তারা নুরসীর কাছে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা নিয়ে আসতেন, নুরসীও তার বেশ সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিতেন। তাই নুরসীর ব্যাপারে তারা সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ফলে চারিদিকে নুরসীর বেশ সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। আসলে নুরসী তার ঘরের দরজায় সেই পোস্টারটি লাগিয়েছিলেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আর তার সেই কৌশল বেশ কাজেও দিয়েছিল। কিন্তু যেই সরকারি মহলের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় তিনি ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন, তা তিনি পাননি, ফলে তার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও তখন পূরণ হয়নি। ইস্তাম্বুলের ক্ষমতাসীন খেলাফত সেই সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং বিংশ শতকের শুরুতে হুট করে সৃষ্ট হওয়া চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তাই নুরসীর ডাকে তারা সাড়া দিতে পারেননি। আর এর পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তারও পরে তুরস্কে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে পরিস্থিতি পুরোই পাল্টে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে নুরসীকে তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি স্থগিত করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নুরসী তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ রিসালায়ে নুর লেখার কাজে হাত দেন। এই বইটিতে ইসলামের বৈজ্ঞানিক চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে যেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘মেদরেসেত-উজ-জেহরা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার অনেকটাই এই রিসালায়ে নুরের মাধ্যমেই পূরণ হয়ে যায়।
ইস্তাম্বুলে নুরসী আরো বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেন। সেই সময়গুলোতে তিনি আসলে রাজনৈতিক ময়দানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিলেন। ইস্তাম্বুল থেকে আবার ভ্যানে ফিরে আসার পর তিনি স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে ইসলাম সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন। তিনি গ্রামবাসীকে সেই সময়ে যেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন সেগুলোকে পরবর্তীতে এক জায়গায় করে তিনি ‘আল মুনাজারাত’ নামক একটি বইও রচনা করেন। এরপর নুরসী চলে যান দামেস্কে। সেখানে তিনি উমাইয়াদ মসজিদে বেশ কিছু খুতবা প্রদান করেন। সেই খুতবাগুলো পরবর্তীতে ‘দ্য দামেস্কাস সারমন’ নামক একটি বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নুরসী এরপর যোগ দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তিনি ছিলেন একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার। আর ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সদস্যই ছিল তার ছাত্র। তুরস্কের পূর্বাঞ্চলকে রাশিয়ান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি সেই যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে যখন চারিদিকে গোলাগুলির বিকট শব্দ তখনও ট্রেঞ্চে বসে তিনি শ্রুতিলিখন এবং অনুলিখনের মাধ্যমে ‘সাইনস অব মিরাকুলাস ইনিমিটেবিলিটি’ বা ‘ইশারাত আল ইজাজ’ নামক একটি বই রচনা করেন যা পবিত্র কুরআনের পর্যালোচনা ও ভাষ্য হিসেবে আজও সবর্জন স্বীকৃত হয়ে আছে।
রাশিয়ার সেনারা যখন বিটলিস অঞ্চলটি দখল করে নেয়, তখন তারা নুরসীকে আহত অবস্থায় আটক করে এবং তারা তাকে সাইবেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একটি কারাগারে নুরসী আড়াই বছর বন্দী ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টাতে তিনি কাজ করার মত বা কিছু লেখার মত অবস্থায় ছিলেন না, পরিবেশও ছিলো না তেমন। কিন্তু সেই প্রতিকূলতার মধ্যেও নুরসী তার সহযাত্রী অন্যান্য বন্দীদের মাঝে নিয়মিতভাবে ধর্মীয় আলোচনা করতেন।
একদিন রুশ জেনারেল নিকোলাস বন্দিশিবির পরিদর্শনে এলে সকল বন্দী দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু বদিউজ্জামান নুরসী না দাঁড়িয়ে বসে থাকলেন। রুশ জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন- বোধ হয় তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছো? নুরসী বসেই উত্তর দিলেন- তোমাকে চিনবো না কেন! তুমি নিকোলাস। রুশ জেনারেল ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো- যদি তুমি জেনে-বুঝে আমাকে সম্মান প্রদর্শন না করে থাকো, তাহলে তুমি রাশিয়ার ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছো। এই কথা শুনার পর ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক বদিউজ্জামান নুরসী নির্ভীক কণ্ঠের এমন সাহসী উচ্চারণের কথা শুনে বন্দিশিবিরে বন্দীরা পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেল। রাগে-ক্ষোভে অপমানে রুশ জেনারেল নিকোলাসের চেহারা লাল বর্ণ হয়ে উঠলো। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো নিকোলাসের চোখে। এই পরিস্থিতিতে বন্দী শিবিরের অন্যান্য বন্দীরা ভাবলো এখনই বোধ হয় নুরসীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করার জন্য নেয়া হবে। কিন্তু উস্তাদ নুরসীর চোখে মুখে ছিল না কোন ভীতির চিহ্ন। তিনি চিন্তাহীন চিত্তে দুনিয়া ও আরশের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন। রুশ জেনারেল নিকোলাস রাগান্বিত হয়ে নুরসীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে প্রস্থান করলেন।
মৃত্যুদন্ডের আদেশেও নুরসীর মুখের স্নিগ্ধ হাসির সামান্যতম কমতি ছিল না। তিনি দৃপ্ত পায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বেদির দিকে এগিয়ে চললেন। রুশ জেনারেল আশ্চর্য হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সৌম্য-শান্ত সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে তাকে হত্যা করে হবে- এটা জানার পরও নুরসীর মুখে ফুটে ছিল স্বর্গীয় হাসি। তারপর উস্তাদ নুরসী মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চাইলেন। অন্যদিনের চেয়ে তিনি তুলনামূলক দ্রুততার সাথে নামাজ আদায় করলেন। রুশ জেনারেল অবাক হয়ে নামাজের ভেতরে উস্তাদ নুরসীর একাগ্রতা লক্ষ করছিলেন। নামাজ আদায়ের এই দৃশ্য রুশ জেনারেল নিকোলাসের মনে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অবশেষে নিকোলাস সাইয়্যেদ নুরসীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর সাইয়্যেদ বদিউজ্জামান নুরসীকে বললেন যে ইসলাম তোমাকে এতটা নির্ভীক ও আত্মমর্যাদাশীল করেছে, আমি সেই ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
শেষ দিকে অবশ্য নুরসী কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং সেইন্ট পিটার্সবার্গ, ওয়ারশ এবং ভিয়েনাকে পাড়ি দিয়ে তিনি ১৯১৮ সালের ২৫ জুন আবারও ইস্তাম্বুলে এসে পৌঁছান। এর পরপরই সেখানকার প্রশাসন তাকে দারুল হিকমাতে ইসলামিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সা¤্রাজ্য পরাজিত হয়। এর পরপরই সা¤্রাজ্যের বিশাল একটি এলাকা ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান এবং গ্রিকদের হাতে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে দখলদারদের হাত থেকে তুরস্ককে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। সেই যুদ্ধে নুরসী ‘কুভা-ই-মিল্লিয়ে’ বা ন্যাশনাল ফোর্সকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন, উৎসাহ প্রদান করেন। আংকারায় থাকা সরকারও নুরসীর এইসব কাজে খুশি হয়ে তাকে আংকারাতে আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণ পেয়ে নুরসী আংকারায় গেলে সেখানে তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তবে নিজে ভালো সংবর্ধনা পেলেও আংকারার প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরকে দেখে নুরসী মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি লক্ষ্য করেন যে, পার্লামেন্টে যেসব ডেপুটি কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই ধর্ম সম্বন্ধে খুবই অসচেতন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে তাদের তেমন একটা আগ্রহও নেই। এমনকি তাদের অধিকাংশই নিয়মিত নামাজও আদায় করে না।
এই পরিস্থিতি দেখে নুরসী তাদের সামনে একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন যাতে তিনি নামাজের গুরুত্ব ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এর পর দেখা যায় যে, পার্লামেন্টের অনেক ডেপুটি নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। কিন্তু নুরসীর এই কার্যক্রম এবং পার্লামেন্ট ডেপুটিদের ওপর তার এই প্রভাব সেক্যুলার নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে অসšুÍষ্ট করে তোলে। নুরসীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আতাতুর্ক তাকে প্রথমে পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার এবং গোটা পূর্ব তুরস্কের ধর্মীয় প্রকল্পগুলোর প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নুরসী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরই তিনি আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৪ সালে যখন অটোম্যান খেলাফতের পতন হয় তখন কুর্দিস্তান থেকে শায়খ সাইয়্যেদেও বিদ্রোহ নামক একটি বিদ্রোহের উত্থান হয়। যদিও এই বিদ্রোহে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না তথাপি এই বিদ্রোহে মদদ দেয়ার অভিযোগেই নুরসীকে ১৯২৫ সালে ইস্তাম্বুলে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইস্তাম্বুল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বুরদুর নামক একটি এলাকায়। এর পর তাকে নেয়া হয় ইসপার্তায়। একটা পর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক ইসপার্তার বারলা নামক একটি গ্রামে গৃহ অন্তরীণ করে রাখা হয়। গৃহবন্দী রাখার কারণে প্রশাসন যেমন তার ওপর নজরদারি করতে সক্ষম হয় এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষগুলোর সাথেও তার মেলামেশাটি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
১৯২১ সালের আগ পর্যন্ত নুরসীর যেই জীবন, তখন তিনি কিছুটা হলেও বিশ্বরাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিশ্লেষকরা এই সময়টাকে ‘সাইয়্যেদের প্রথম অধ্যায়’ নামে অভিহিত করেছেন। আর ১৯২১ সালের পরের থেকে জীবনের বাকি অংশটিকে তারা ‘সাইয়্যেদের দ্বিতীয় অধ্যায়’ নামে সংজ্ঞায়িত করেছেন। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টিতেই বদিউজ্জামান নুরসী অন্যসব বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে কুরআনের সাধনায় ব্যস্ত করতে শুরু করেন। এই সময়েই তার অনবদ্য সৃষ্টি রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিও তিনি রচনা করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নুরসী আসলে মুসলমানদের ঈমান সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে নাস্তিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবে মুসলমানদের ঈমান যেভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছিল তাকে প্রতিরোধ করে ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য তিনি বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, নির্বাসনে গিয়েছেন। তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েকবার। আর সবশেষে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালানোর মিথ্যা অভিযোগে তার বইগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন।
বারলাতে সাইয়্যেদ নুরসী দীর্ঘ ৮টি বছর নির্বাসনে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি রিসালায়ে নুরের তিন-চতুর্থাংশ রচনা করতে সক্ষম হন। তার এই বইটিতে গোটা তুরস্কে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি একটি নতুন ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেন। আজ অবধি এই ধরনের কৌশল দ্বিতীয়টি আর কোথাও দেখা যায়নি। তিনি শর্ত আরোপ করেন যে, যারাই তার ছাত্র হতে চাইবে তাদেরকে তার লেখা এই রিসালায়ে নুরের একটি কপি আরবি অক্ষরে লিখে দিতে হবে। সেই সাথে নতুন আরেকজন লোককেও খুঁজে নিয়ে আসতে হবে যেও কিনা একটি কপি লিখবে। অর্থাৎ একজন ছাত্রকে দিয়ে তিনি দু’টি কপি লিখিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইসপার্তা এবং বারলাতে তার যত ছাত্র ছিল, তারা সবাই তার ডাকে সাড়া দিয়ে রিসালায়ে নুরের একটি অনুলিপি লিখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রিসালায়ে নুরকে তারা গোপনে বিতরণ করতেও শুরু করেন। এভাবে শুধু বারলা বা ইসপার্তা নয়, একটা সময়ে গোটা তুরস্কেই রিসালায়ে নুর ছড়িয়ে পড়ে।
রিসালায়ে নুরের এই জনপ্রিয়তায় ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশাসন সাইয়্যেদ নুরসীকে বারলা থেকে ইসপার্তায় স্থানান্তর করে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। বরং তাকে আরো ১২০ জন ছাত্রসহ ‘এসকিসেহির’ নামক একটি কারাগারে প্রেরণ করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পতন ঘটাতে নতুন সংগঠন তৈরি করার অভিযোগ আনা হয়। লম্বা একটি সময় পর ‘এসকিসেহির’ কারাগার থেকে নুরসী মুক্তি পান। এরপর তাকে আবারও কাস্তামনু প্রদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানেও তিনি ৮টি বছর নির্বাসনে পার করেন। নুরসীকে থামানোর এত চেষ্টার পরও তার রিসালায়ে নুরের লেখা এবং বিতরণকে বন্ধ করা যায়নি। প্রতিটি ছাত্র নতুন নতুন ছাত্রকে দিয়ে একটার পর একটা অনুলিপি সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে একদিকে যেমন নুরসীর শিষ্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে ঠিক তেমনিভাবে গোটা আনাতোলিয়ার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে নুরসীর রিসালায়ে নুরও পৌঁছে যায়।
১৯৪৩ সালে সাইয়্যেদ নুরসী এবং তার ১২৬ জন ছাত্রকে ডেনিজলির হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আংকারার দক্ষ একদল শিক্ষাবিদ এবং বিচারপতিদেরকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয় যারা রিসালায়ে নুরের প্রতিটি তথ্য পর্যালোচনা করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে তারা বইটিতে কোনো ক্ষতিকর কিছু পাননি বলে জানান। এর পরই ১৯৪৪ সালে নুরসীকে সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। বিচার চলাকালীন সময়ে নুরসী ৯টা মাস জেলে ছিলেন। এই সময় তাকে তার কোন ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এবারও বেশ কয়েক দফা তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়। নুরসীকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় এমিরদাগে, সেখান থেকে আফইয়োনে। তবে যতই নির্বাসনে বা কারাবরণে নেয়া হোক, নুরসী এক মুহূর্তের জন্যও তার কাজ বন্ধ করেননি।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রশাসন তার বইগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৫০ সালে তুরস্কে বহুদলীয় প্রথা চালু হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনেই ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয় লাভ করে। এর পরই আসলে নুরসী এবং তার শিষ্যরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করেন। সারাটি জীবন কুরআনের চর্চায় লিপ্ত থাকার পর ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ ২৫ রমজান উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী ইন্তেকাল করেন। পরের দিন উলু মসজিদে লক্ষ লক্ষ মানুষ তার জানাজায় অংশ নেয়। তারপর তাকে হালিলুর রহমান নামক মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়। এর ঠিক দুই মাস পর তুরস্কে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় যার পরপরই তুরস্কে নতুন করে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়। একদল পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তা ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই আবারও উস্তাদ নুরসীর কবরকে আক্রমণ করে। তারা এই মহান কুরআন সাধকের মৃতদেহ সেই গোরস্থান থেকে উঠিয়ে নেয় এবং অজানা একটি জায়গায় নিয়ে যায়- যার পরবর্তী গন্তব্য সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু আর জানা যায়নি।
মৃত্যুর আগ দিয়ে বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ ছাত্র এবং রিসালায়ে নুর রচনার নেপথ্যের অন্যতম সহযোগী সাইয়্যেদ আহমেদ হুসরেভ এফেন্দিকে তার পরবর্তী দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান- যার একমাত্র দায়িত্ব হবে নুরসীর মৃত্যুর পর রিসালায়ে নুরের এই প্রকল্পটিকে পূর্বের গতিতেই অব্যাহত রাখা।
নুরসী যতদিন জীবিত ছিলেন, তখনই হুসরেভ এফেন্দি তার ঘনিষ্ঠ মহলে ‘উস্তাদ আল থানি’ বা দ্বিতীয় গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হুসরেভ এফেন্দি ছিলেন খুবই দক্ষ একজন ক্যালিওগ্রাফি শিল্পী। নুরসী জীবিত থাকা অবস্থায় হুসরেভ এফেন্দি ততদিন রিসালায়ে নুর অনুলিপিকরণ এবং বিতরণের মূল দায়িত্বে ছিলেন। সকল ছাত্রের মধ্যে নুরসী একমাত্র তাকেই রিসালায়ে নুরে কোন ধরনের সংযোজন, সংশোধন বা বিয়োজনের অধিকার দিয়েছিলেন। আর তিনি সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বিশেষ করে নুরসী যতদিন জেলে ছিলেন, তিনি তখন রিসালায়ে নুর নামক প্রকল্পটি যোগ্যতার সাথেই অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন।
উস্তাদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দি আগের মতই তার কাজ অব্যাহত রাখেন। তিনি রিসালায়ে নুরের মূল চেতনা রক্ষার ব্যাপারে একটুও আপস করেননি। বরং রিসালায়ে নুরকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং গোটা তুরস্কের মানুষের ঈমান ও আমলকে সুরক্ষা এবং তা আরো মজবুত করার ব্যাপারে তিনি কার্যকর উদ্যেগ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও উস্তাদ নুরসীর দিকনির্দেশনা মুতাবিক তিনি কুরআনের একটি তাফসির কপিও প্রস্তুত করেন। কুরআনের এই নতুন ধারার তাফসিরের নাম দেয়া হয় ‘তেভাফুকলু কুরআনে কারীম বা দ্য কুরআন ইন কনগ্রুয়াস অ্যালাইনমেন্ট’। উল্লেখ্য, কুরআন পড়তে পড়তেই উস্তাদ নুরসী একটা সময় আবিষ্কার করেন যে দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর সকল নাম, সিফাতি নামগুলো যেমন আল্লাহ, রব এবং কুরআন এবং কুরআনের অন্য সব শব্দ, একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। হয় একই পৃষ্ঠায় একটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলোকে পাওয়া যায় বা অন্য কোনো পৃষ্ঠায়। কুরআনের শব্দগুলোর এহেন মিল ও সাদৃশ্যকে উস্তাদ নুরসী কুরআনের আরেকটি মোজেজা হিসেবে সনাক্ত করেন।
যাহোক, উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দির হাত ধরেই পরবর্তীতে তুরস্কে হায়রাত ফাউন্ডেশনের জন্ম হয় যারা আজ অবধি উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর কার্যক্রম ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করছে এবং বিশ্বজুড়ে নুরসীর আবিষ্কার ও চেতনাকে বিশেষ করে রিসালায়ে নুরকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, রিসালায়ে নুর প্রসঙ্গে। রিসালায়ে নুর মহাগ্রন্থ আল কুরআনের উপর অনন্যসাধারণ একটি গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়ে আছে। ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের ওপর বিগত ২০০ বছরে যতগুলো পুস্তক রচিত হয়েছে রিসালায়ে নুর তার মধ্যে অন্যতম। এতদিন পশ্চিমের অনেক জায়গাতেই অবশ্য রিসালায়ে নুর তেমন একটা পরিচিত ছিল না। এমনকি অনেক মুসলমানও এই বিষয়ে ততটা অবগত ছিলেন না, তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এখন পাল্টাচ্ছে। মোট ১৩০টি অধ্যায়ে এই বইটি বিভক্ত এবং মোট পাতার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ধর্মতত্ত্ব, ধর্মদর্শন এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন তোলা হয় তার অনেকগুলোই পাওয়া যাবে এই বইটিতে। রিসালায়ে নুরটি রচনা করা হয় ১৯২৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে। রিসালায়ে নুর নিয়মিত অধ্যয়ন করেন এমন পাঠকেরা দাবি করেন যে, রিসালায়ে নুরের অধ্যয়ন তাদের মধ্যকার ঈমানের দৃঢ়তাকে মজবুত করেছে, আধ্যাত্মিক শক্তিকে বলিষ্ঠ করেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকেও শানিত করেছে। রিসালায়ে নুর অধ্যয়নে বিবেকের কাছে তারা আরো পরিষ্কার হয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইসলামকে আরো গভীরভাবে জানার আকাক্সক্ষাও তৈরি হয়েছে বলে এই পাঠকেরা জানান।
পাঠকদের মতে রিসালায়ে নুর কোন সাধারণ গ্রন্থ নয় বরং এটি ইসলামের শরিয়তের নির্দেশিত ইবাদতের একটি পদ্ধতি বা মেথোডোলোজি নিরূপণ করেছে। আর রিসালায়ে নুরের বিষয়বস্তু কোনদিনই সেকেলে হবে না, এটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বর্তমান সামাজিক ও বৈশ্বিক কাঠামোতেও বইটা একই রকম জীবন্ত হয়ে রয়ে গেছে। রিসালায়ে নুরকে আবার গতানুগতিক তাত্ত্বিক কোনো বই হিসেবেও বিবেচনা করা যাবে না বরং এটা ভীষণ রকমের ব্যবহারিক একটি বই। রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিতে অনেকগুলো ‘কেন’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তরও মিলবে। বইটিতে মহাবিশ্বের গঠন ও পরিচালনা নিয়েও ইসলামের ব্যাখ্যাগুলোকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিশেষ করে অসীমতা বা ইনফিনিটি বা কন্টিজেন্সি বিষয়ে বিজ্ঞান যেসব বিতর্ক উত্থাপন করেছে তারও উত্তর এই বইটিতে পাওয়া যাবে।
কুরআনের বিভিন্ন কালামকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে রিসালায়ে নুর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একক নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে প্রমাণ করেছে। শেষ বিচারের দিন এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থান নিয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তারাও তাদের কৌতূহল মিটাতে পারবেন এই বইটি থেকে। যারা নবী মোহাম্মাদ (সা.) সত্যিকারভাবেই আল্লাহর রাসূল কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখান তারাও খুব স্পষ্ট উত্তর এই বইটি থেকে পেয়ে যাবেন। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পৃথিবীর সৃষ্টি, বিবর্তনবাদ প্রভৃতি বিষয়ে ইসলামের অবস্থান ও মূল্যায়নও বইটিতে পাওয়া যাবে।
একই সঙ্গে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তরও মিলবে রিসালায়ে নুরে। বিশেষত সাধারণ প্রচলিত জ্ঞানের বাইরে ঐশ্বরিক জ্ঞান কিভাবে একজন মানুষকে পরিণত করে কিংবা বৈষয়িক জীবন দর্শন কিংবা অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবন ধারণ করার ব্যাপারে অথবা আল্লাহর নেয়ামতকে ব্যবহার করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করা যায় তার কিছু উপায় এই বইটিতে পাওয়া যাবে। বয়স হয়ে গেলে অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগেন, হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু এই বইটিতে প্রবীণদের নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, বয়স্ক হওয়াও আল্লাহ তায়ালার একটি নেয়ামত এবং তাই সেই বয়সে পৌঁছে হতাশা নয় বরং তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা দরকার।
পাশাপাশি, মুসলমানরা কেন সভ্যতার বিনির্মাণে এবং জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লো, ইসলামে নারীদের কি অবস্থান বা সম্মান নির্ধারণ করা হয়েছে, কিংবা হুদুদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি, দাস প্রথা নিয়ে ইসলামের বক্তব্য কি- সেগুলোও জানা যাবে এই রিসালায়ে নুর থেকে। আমরা কিভাবে অন্য ধর্মের মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করবো কিংবা কিভাবে তাদের সাথে সহাবস্থান করবো সেই প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও এই বইটি থেকে আমরা ধারণা পাবো। এক কথায় বলতে গেলে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী রচিত এই রিসালায়ে নুর বা বুক অব লাইটটি প্রকৃতার্থেই আলোকময় একটি বই, যা আলোর দিশারি হয়ে মুসলমানদেরকে আলোর পথে নির্দেশনা দেবে বহুযুগ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা, যিনি এই বইটি লিখেছেন, যারা এর অনুলিপি রচনা করেছেন কিংবা যারা প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগতভাবে বইটিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি যেন তাদের সবাইকে তাদের পরিশ্রমের এবং আত্মত্যাগের উত্তম জাজা দান করেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

Friday, April 6, 2018

সময়ের কসম, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত


মহাগ্রন্থ আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে আল আসর। এই সূরাটির আয়াত তিনটি। এটি কুরআনের ছোট সূরাগুলোর অন্যতম। এই সূরাটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপকতর। লেখার শিরোনামটি এই সূরারই প্রথম অংশের অর্থ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই সূরাতে সময়ের শপথ নিয়ে মানুষ যে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত তা তুলে ধরেছেন, তার পাশাপাশি কারা ক্ষতির কবল থেকে মুক্ত থাকবে সে কথাও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। সূরাটির পুরো অর্থ নিম্নে তুলে ধরা হলো- সময়ের কসম। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথা ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে। (আল কুরআন : সূরা আসর)

ছোট্ট এই মাক্কি সূরাটিতে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায়, মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতা, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং ধ্বংসের পথ বর্ণনা করেছেন। মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে বদলে দেয়ার জন্য এই সূরার অনুসরণই যথেষ্ট। এই সূরার তাৎপর্য উপলব্ধি করে কাজ করতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। ইমাম শাফেয়ি (রহ:) বলেন, মানুষ যদি এই একটি সূরা অর্থাৎ সূরা আসর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েত তথা সফলতার জন্য যথেষ্ট। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ওবাইদুল্লাহ বিন হিসন (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবিদের মধ্য থেকে যখন দুই ব্যক্তি মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শোনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না।’ (তাবারানি)
মহান আল্লাহর এখানে সময়ের কসম করার যথার্থ যুক্তি আছে। আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কোনো বস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব, অভিনবত্ব প্রকাশের জন্য কখনও কসম বা শপথ করেননি বরং যে বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার ক্ষেত্রেই তিনি সত্যতা প্রমাণ করতেই কসম খেয়েছেন। সময় অতি মূল্যবান একটি বিষয়। সময় বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে বোঝায়। এটি কোনো দীর্ঘ সময়ের অর্থে নয়। ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান অতীতে নিপতিত সময়কে বোঝানো হয়েছে। অতীতের কসম হলো ইতিহাসের সাক্ষ্য। বর্তমানের কসম হলো বর্তমানের অতিবাহিত সময়। মানুষকে কাজের জন্য সময় দেয়া হচ্ছে। সময় এক ধরনের মূলধন। মূলধন নামক মানুষের এই সময় দ্রুতই অতিবাহিত হচ্ছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে ইমাম রাযি (রহ:) একজন মনীষীর উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন- তাহলো, একজন বরফ বিক্রেতার কথা থেকেই আমি সূরা আল আসরের অর্থ বুঝতে পেরেছি যে বাজারে জোর গলায় চিৎকার করে বলছিল, দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি (বরফ) গলে যাচ্ছে। তার এ কথা শুনে আমি বললাম, এইটিই হচ্ছে আসলে ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ বাক্যের প্রকৃত অর্থ।
মানুষকে যে সময় (আয়ুষ্কাল) দেয়া হয়েছে তা বরফ গলে যাওয়ার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একে যদি নষ্ট করে দেয়া হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কাজেই চলমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, সূরা আসরে বর্ণিত চারটি গুণাবলিশূন্য হয়ে যে মানুষ যে কাজেই নিজের জীবনকাল অতিবাহিত করে- তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা ছাড়া কিছুই নয়। পরীক্ষার হলে যে ছাত্র প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করেছে, তাকে পরীক্ষার হলে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেয়ার কাজে ব্যয় করেছে একমাত্র সে-ই লাভবান হচ্ছে। আর রেজাল্টের দিন সেই ছেলেটিই সফলতা অর্জন করবে।

এ সূরায় চারটি গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা সময়ের বহমান ¯্রােতে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে : ১. যারা ঈমান এনেছে ২. যারা সৎকাজ করতে থেকেছে ৩. যারা পরস্পরকে হকের উপদেশ দিতে থেকেছে এবং ৪. যারা পরস্পরকে সবর বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে থেকেছে। প্রথম কাজ হলো ঈমান আনা। শুধুমাত্র মুখে স্বীকার করলেই তাকে ঈমান আনা বলা হয় না বা ঈমানের দাবি পূরণ হয় না। বরং ঈমানের তিনটি ধাপ রয়েছে। তা হলো অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, তারপর মুখে স্বীকৃতি তথা বিশ্বাস অনুযায়ী মুখে প্রকাশ করা, তৃতীয়ত বাস্তবে কাজে পরিণত করা। আল্লাহ বলেন, আসলে তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূল (সা:)-এর প্রতি ঈমান এনেছে এরপর কোনরূপ সন্দেহে পতিত হয়নি। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৫)

দ্বিতীয়ত, ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে তারা যারা আমলে সালেহ তথা সৎকাজ করতে থেকেছে। কুরআনের পরিভাষায় সালেহাত সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে, যে কাজের মূলে ঈমান আছে এবং যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:) প্রদত্ত হেদায়েতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে তা সৎকাজ। ঈমানের পর সৎকাজের বর্ণনার অর্থ হলো ঈমানবিহীন কোনো সৎকাজের পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নেই। সৎকাজবিহীন ঈমান একটি দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমান ও সৎকাজ বীজ আর বৃক্ষের মতো। আল্লাহ এবং বান্দার হক আদায়, মা-বাবার খেদমত করা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর হক আদায় করা, অপরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ সৎকাজ।
ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার পরবর্তী দু’টি গুণ হলো- যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা পরস্পরকে হক কথা বলা, হক কাজ করা এবং ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক না থেকে সম্মিলিতভাবে একটি সৎ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে নিজে হকের ওপর অবিচল থাকার পাশাপাশি অন্যকেও এ পথে আহ্বান করতে হবে। মনে রাখতে হবে সমাজে একা একা ভালো থাকা যায় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি ভালো থাকবেন ঘরে কিংবা মসজিদের কোণে বসে তার পক্ষে তা সম্ভব হবে না। কারণ সমাজের ক্ষতির প্রভাব তার ওপরও কোনো না কোনো ভাবে পড়বে। ফলে একা একা হকের পথে থেকেও তিনি আসলেই ভালো থাকতে পারবেন না। সবাইকে ভালো পথে হকের পথে সত্যের পথে নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভালো থাকা সম্ভব।
চতুর্থ গুণটি হলো সবর বা ধৈর্য। হকের নসিহত করতে গিয়ে বা হকের সমর্থন করতে গিয়ে যে সব সমস্যা ও বাধার মুখে নিপতিত হতে হয় তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। হক এবং বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যেখানেই হক সেখানেই বাতিল আঘাত হানার চেষ্টা করে। হক তথা সত্য পথে থেকে সফলতা অর্জন করতে গেলে বাধা-বিপত্তি আসবেই। ধৈর্যের সাথে তার মোকাবেলা করতে হবে। আর ধৈর্যশীলদের জন্যই আল্লাহর পুরস্কার নির্ধারিত।

লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, March 23, 2018

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদ গানের নতুন জগৎ -ড. নঈম আহমেদ


শিল্পী গায়ক নয়তো মোদের আসল পরিচয়
আল কুরআনের কর্মী মোরা বিপ্লবী নির্ভয়
শিল্পী থেকে কর্মী বড়
সুর ছড়িয়ে যাই ॥

বাংলা গানের জগতে মতিউর রহমান মল্লিক একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতসাধক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন সে-সময় গণমাধ্যমে ইসলামী গান অবহেলিত ছিলো। বিশেষভাবে খালি কণ্ঠে বাজনা ছাড়া গান কল্পনাই করা হতো না। সময়ের দাবি অনুযায়ী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী গানের নতুন দিগন্ত তিনি সৃষ্টি করেন। [দ্র. আহমদ বাসির সম্পাদিত মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, ঢাকা: মর্নিং ব্রিজ, ২০১৭, পৃ. ১৯] স্বকণ্ঠে স্বরচিত ও নিজের সুরারোপিত গানের অ্যালবাম প্রতীতি: এক (১৯৯৩) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রতীতি: দুই (১৯৯৪) এই পরিচয়কে আরো বেশি প্রতিষ্ঠা দান করে। গীতিকার হিসেবেও তিনি সফলতার পরিচয় দেন। ঝংকার (১৯৭৮), যত গান গেয়েছি (১৯৮৭), প্রাণের ভেতরে প্রাণ (২০১০) এবং অপ্রকাশিত গীতিকাব্য চিরকালের গান তাঁর গানের সঙ্কলন একজন গীতিকার ও সঙ্গীত সাধকরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন একাধিক গানের সঙ্কলন।
মতিউর রহমান মল্লিক কিভাবে ইসলামী সাংস্কৃতিক জগতে আসেন এবং গানের প্রতি অনুরাগী হলেন সে বিষয়ে নিজের মন্তব্য : ‘আমি একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের পরিবারে আগে থেকেই একটি জারির দল ছিলো। আমার আব্বা ঐ জারি দলের জন্য বিশাল বিশাল জারি গান লিখে দিতেন। আর এই গান আমার ছোট চাচা আমাদের এলাকায় গেয়ে বেড়াতেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা আমাদের আত্মীয়স্বজন ছিলো। আমার আব্বা কবিতা লিখতেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে আমার আব্বা ২-৩ মাইল দূরে গিয়ে পত্রিকা পড়ে আসতেন। রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করতেন, সেই আসরে আমার বড় ভাই কবিতা পড়েছেন। যে কবিতা ফররুখ আহমদ নিজে অনুমোদন করেছেন। ছোটবেলা থেকে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এবং অনেক গান লিখেও ফেলেছিলাম। যার সবগুলোই ছিলো প্রেমের গান। আমি যখন ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম, তখন আমার গান লেখার মোড় ঘুরে যায়। দেশ, মুসলমান, ইসলামী আন্দোলনের জয়গান লেখা শুরু করলাম। প্রেমের গানের লেখার পর্ব ছুটে গেল।’ [আবিদ আজমের নেয়া মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, রহমান তাওহীদ সম্পাদিত রিদম, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৭]
মতিউর রহমান মল্লিকের জীবনকালেই ‘কবি’ অভিধা তার নামের সাথে অবিভাজ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রধানত কবি, যদিও এ যাবৎ প্রকাশিত তার কবিতার সংখ্যা তার রচিত গানের তুলনায় কম। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, কবি না হলে কেউ গান লিখতে পারে না। পৃথিবীর সকল গীতিকারই মূলত কবি। অনেক খ্যাতনামা কবির প্রখ্যাত অনেক কবিতাও গান আকারে গীত হয়ে থাকে। কবিতার মধ্যে যেমন মিল, ছন্দ, ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি রয়েছে, গানের মধ্যেও তার উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে গানের মধ্যে গীতলতার দিকটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, গান একটি নির্দিষ্ট সুর, তাল-লয় ও আকারে সীমাবদ্ধ থাকে, কবিতার ক্ষেত্রে অতটা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই গান রচনার সময় কবিকে অধিকতর সচেতনতা ও শিল্পবোধের পরিচয় দিতে হয়। সেজন্য গীতিকার যখন শব্দ নিয়ে খেলা করেন, তখন তাকে সুর-তাল-লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে সজাগ-সতর্ক থাকতে হয়। গানের সফলতা অনেকটা এর ওপর নির্ভরশীল। মতিউর রহমান মল্লিকের কবি-স্বভাবের মধ্যে গীতিধর্মিতার প্রাবল্য তাকে একজন সার্থক এবং বহুলপ্রজ গীতিকার হিসেবে সাফল্য ও খ্যাতি এনে দিয়েছে। মল্লিক নিজে একজন সুগায়ক ছিলেন। গান রচনার সাথে সাথে তিনি তাতে সুরারোপ করতেন ও গাইতেন। [মুহম্মদ মতিউর রহমান, মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্যকর্ম, পৃ. ১৬১] সার্থক গীতিকার হওয়ার জন্য এটা এক অপরিহার্য গুণ। যিনি গায়ক তিনি গানের সুর, তাল, লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। সার্থক গান রচনার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। তাঁর মধ্যে সে গুণের কমতি ছিল না। তাই তার রচিত গান সার্থক বলা যায়। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার মধ্যে গীতিকার হিসেবে তার সাফল্য তুলনামূলকভাবে অধিক।
তারুণ্য-যৌবনের কবি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের সুরেলা পাখি। মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বাণী ও সুরের মৌলিকতা ও বৈচিত্র্য বিশেষত্বপূর্ণ। উত্তরাধিকারের পথে নতুন বাঁক-বদল। তাঁর গানের কথার বিষয় নানা মাত্রিক, নানা সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি। ইসলামী আন্দোলনের পথপরিক্রমায় জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে তিনি গানের সম্ভার রচনা করেন। তাঁর গানের বিষয়বৈচিত্র্যকে নি¤েœাক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা: ক. হামদ, খ. নাতে রাসূল সা., গ. ইসলামী আন্দোলন, ঘ. দেশপ্রেম, ঙ. প্রকৃতি, চ. আধুনিক জীবনমুখী, ছ. আধ্যাত্মিক/ মৃত্যুচেতনা, জ. ইসলামী সংস্কৃতি, ঝ. বিবিধ।
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর।
আল্লাহর প্রশংসামূলক বা তাঁর গুণের কথামালাসম্পন্ন সুরারোপিত গানকে হামদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে মানুষ প্রেরিত হয়েছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। আর প্রতিনিধির কাজ হলো আল্লাহর ইবাদত করা। সেই দিক বিবেচনায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করা। সৃষ্টিশীল মানুষ যারা হেদায়াত প্রাপ্ত তারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বিশেষভাবে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর গুণ, কার্যাবলি ও মহিমা নিয়ে সৃজনশীল কাজ করে থাকেন। রাসূল সা:-এর সময়ে যে সমস্ত সাহাবী কবিতা লিখতেন তারা প্রধানত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই লিখতেন। হাসসান ইবনে সাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ সাহাবী আল্লাহর প্রশংসা, গুণাবলি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, ফেরদৌসী প্রমুখ সাহিত্যিক হামদ রচনায় বিশ^সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই ধারা পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিককালেও কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর মহিমা কীর্তনে সৃষ্টিশীল। আল্লামা ইকবাল এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় স্মরণীয়, বরণীয় ও প্রভাবশালী। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগে অসংখ্য কবি আল্লাহর প্রশংসামূলক কবিতা লিখেছেন। আধুনিককালে কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসন, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদ বিপুল পরিমাণে হামদ রচনা করেছেন।
এই ধারায় মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা গানের ভুবনে হামদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর একজন কৃতজ্ঞ বান্দা, কবি-সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি বাংলা গানে নতুন সুর, ছন্দ, কথা, আবহ ও বাঁক এনেছেন। গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতো একই মতাদর্শের পথিক হয়েও একক গানের জগৎ নির্মাণ করেন। ‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীত পর্বের কিছু দৃষ্টান্ত :
দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো দীপ্ত সৃষ্টির জন্য
দেখবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কত না অনন্য ॥

বিহঙ্গ তার পক্ষ দোলায়
দূর বিমানে শূন্য কোলায়
কে রাখে ভাসিয়ে তারে ভাবনা সামান্য॥

সমতল আর পর্বতমালা
এই কোলাহল ঐ নিরালা
কার মহিমা জড়িয়ে রাখে গহনও অরণ্য॥
[প্রতীতি]

মাঠ ভরা ওই সবুজ দেখে
নীল আকাশে স্বপ্ন এঁকে
যার কথা মনে পড়ে
সে যে আমার পালনেওয়ালা॥
[প্রতীতি]

এসো গাই আল্লাহ নামের গান
এসো গাই গানের সেরা গান
তনুমনে তুলবো তুমুল
তূর্য তাল ও তান॥
[প্রতীতি]

বিশ্বজগতের বিশাল ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি যে কোন মানুষকে বিস্মিত ও ভাবুক করে তোলে। সৃষ্টিশীল কবি মতিউর রহমান মল্লিক গানের খাতায় এই পৃথিবীর রূপে-রসে-রঙে-রেখায় মনোযোগ দিয়ে আবেগে আপ্লুত এই ভেবে যে, আল্লাহ কিভাবে কী অসীম নির্মাণশৈলীতে এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের রহস্য, চারপাশের পরিবেশ, চাঁদ-সূর্য-তারা-আলোকমালা, নদী-সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য-জলাশয় এবং এই সবের মাঝে সুন্দরের সন্ধানে কবি আল্লাহর মহত্ত্ব ও অসীম কুদরত অনুভব করেছেন ও দেখেছেন। সৃষ্টির মাঝেই ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যে অনন্য সে অনুভব করার জন্যও শ্রোতাকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ যে পালনকর্তা ও রিজিকদাতা সে কথাও গভীরভাবে গানে ব্যক্ত করেন।
‘প্রতীতি’ প্রথম গানের সংকলনে এই হামদগুলো স্থান পায়। সৃষ্টির মাঝে ¯্রষ্টার ছায়া ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন গীতিকার। কিছু কিছু গানে সুফি মতের প্রভাব লক্ষণীয়। সুফি মতের কেন্দ্রে আছে আল্লাহর ধারণা। বিভিন্ন সুফি মতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার: আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকিক বলখি, ইব্রাহীম আদম, রাবিয়া বসরী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (Semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহ্ প্রেম ও পাপভীতিই এই মতের সুফিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্রেমকামীরূপে কল্পনা করেছেন যাঁরা তাঁদের মতে, আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সুফিরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর Manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হলো প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্রেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সুফিরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্রেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্রেমানলেÑ হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহ। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্বÑ যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহম’ বোধে। এই মতের সুফিদের মধ্যে বায়জিদ বোস্তামি, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। [আহমদ শরীফ, বাংলার সুফি সাহিত্য, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৩, পৃ. ২৪] অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। সৃষ্টি মাত্রই ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্রহ্মেতে লীন। সুফি মতে, আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্ভূ জ্যোতি’। Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতো প্রকাশ। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সুফিব্রত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ‘ইনসানুল কামেল’। প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের। মতিউর রহমান মল্লিক উভয় ক্ষেত্রেই মনোযোগী।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ
নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া
পাখির গানে গানে
হাওয়ার তানে তানে
ঐ নামেরই পাই মহিমা
হলে আপনহারা ॥
আল্লাহ নামের গান গেয়ে দেখ
কেমন লাগে নামের সুর
ঐ নামে যে যাদু রাখা
ঐ নামে যে শহদ মাখা
পান করে দেখো কী মধুর ॥
[ঝংকার]

আজকে আমার প্রাণ-সাগরে
আল্লাহ নামের নুর
উথাল পাথাল ঢেউ তুলেছে
যেনো পাহাড় তুর ॥
[ঝংকার]

হাত পেতেছে এই গোনাহগার
তোমারি দরগায় খোদা তোমারি দরগায়
শূন্য হাতে ওগো তুমি
ফিরাইও না হায়, মোরে ফিরাইও না হায় ॥
আমার কণ্ঠে এমন সুধা
দাও ঢেলে দাও হে পরোয়ার
যদি পিয়ে এই ঘুমন্ত জাত
ভাঙে যেনো রুদ্ধ দ্বার।
[ঝংকার]
‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীতের পর ‘ঝংকার’ গীতিকাব্যে মতিউর রহমান মল্লিক হামদে আরো বৈচিত্র্য আনেন। আল্লাহ নামের উচ্চারণে, রূপে ও মহিমায় কবি দিশেহারা। তাঁর নামের গুণের মুগ্ধতায় কবি নূরের উজ্জ্বলতায় পাখিদের গানে, ঝরনার সুরে, সবুজে ও রোদে আল্লাহ নামের মহিমা অনুভব করেছেন। প্রাকৃতিক সবকিছুতেই তিনি ¯্রষ্টার সৃজনশৈলী লক্ষ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ গানের কথায় শিল্পসম্মত রূপে প্রকাশ করেন।
তুমি দয়ার অথৈ পারাবার
দুঃখের সাগর তুমি কর পার
পাপী তাপি সব গোনাহগার
চাহি তোমার করুণা।-
[যত গান গেয়েছি]

আমাকে দাও সে ঈমান
আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে
অসংকোচে
গায় জীবনের গান।
[যত গান গেয়েছি]

কথায় কাজে মিল দাও আমার
রাব্বুল আলামিন
আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লায়
রাখো বিরামহীন।
[যত গান গেয়েছি]

ঈমানের দাবি যদি কোরবানি হয়
সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার
প্রভু দয়াময়।
[যত গান গেয়েছি]

আমি পাখির কাছে বললাম
নদীর কাছে শুধালাম
তোমাদের গান তোমাদের সুর
কেন এমন মনোহর
কেন এমন সুন্দর
ওরা বললো শুধু বললো:
আমাদের কণ্ঠে ¯্রষ্টার নাম
অঙ্গে অঙ্গে তার সৃষ্টি দাম
আমাদের গান আমাদের সুর
তাই তো এমন মনোহর
তাই তো এমন সুন্দর।
[যত গান গেয়েছি]

যখন পথের দিশা দিয়েছো খোদা
তখন বিপথে তুমি নিও না
যেই পথ কোরানের
যেই পথ রসূলের
সেই পথ ছেড়ে যেতে দিও না।
[যত গান গেয়েছি]
‘যত গান গেয়েছি’ পর্বের হামদে মতিউর রহমান মল্লিক বাস্তব জীবন সংগ্রাম-আন্দোলনের দুর্গম পথে এবং ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন, করুণা ও সাহায্য চেয়েছেন এবং তাকেই সহায়-সম্বল ভেবেছেন। নিজেকে গোনাহগার-পাপী হিসেবে উপস্থাপন করে পরকালের অথৈ সাগর পারাপারের জন্য আকুল আবেদন করেছেন। সেই সাথে সেই ঈমানের জন্য দরখাস্ত করেছেন যে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে স্বেচ্ছায় ফাঁসির মঞ্চে নির্ভীকভাবে দাঁড়াতে পারেন; আল্লাহর রাজ কায়েমের জন্য জিহাদে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের ময়দানে লড়াকু হতে ঈমানের জোর চাই, ঈমানের দাবি যে কোরবানি সেই কোরবানির জন্য সেই শক্তি কামনা করেছেন কবি আল্লাহর কাছে। যে পথ কোরআনের ও রাসূলের সেই পথের ঠিকানা যেহেতু একবার আল্লাহ দয়া করে দিয়েছেন সেই পথে যেন চলতে শক্তি দেন, সেই দোয়া করেছেন। আল্লাহর মহিমা ও গুণের কথা কবি ফুল-পাখি-নদীসহ প্রকৃতির কাছে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছেন এক আল্লাহর অসীম অনন্ত মহিমা। পরবর্তী গীতিকাব্য ‘প্রাণের ভেতরে প্রাণ’-এ হামদ নেই। অন্যান্য বিষয়ে গান আছে।
মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায় এভাবে-
ক. আল্লাহর গুণাগুণ, রূপ-অরূপ, শক্তি-মহিমা-শ্রেষ্ঠত্ব, সর্বাত্মক সত্তার প্রশংসা তাঁর হামদে প্রকাশিত;
খ. জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেছেন ও করুণা চেয়েছেন;
গ. বিশেষভাবে জীবন সংগ্রামে, ত্যাগে, লড়াইয়ে, কঠিন বিপদে ও দুঃখে জয়ী হতে আল্লাহর কাছে সাহায্য-সহযোগিতা ও শক্তি প্রার্থনা করেছেন;
ঘ. মহান রবের প্রতি গভীর বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা-প্রেমের পরিচয় হামদের মাঝে প্রতিফলিত;
ঙ. আল্লাহর মহত্ত্বের সাথে সাথে পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব কায়েমের কথাও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন;
চ. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উজ্জীবনে এই হামদগুলো অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী;
ছ. সুর সংযেজনের দিক থেকে মৌলিকত্ব ও নতুনত্ব লক্ষণীয়।

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের সুর কবি নিজেই করেছেন নিজ সঙ্গীত প্রতিভায়। একদম নতুন সুর সংযোজন ঘটিয়েছেন এইসব হামদে যা বাংলা গানে অভিনব। নজরুলের গানের বা হামদের দূরগত প্রভাব থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব নেই এতে। শেষের দিকে কিছু গানে অন্যরাও সুর দিয়েছেন।
লেখক : কবি ও গবেষক

Thursday, March 15, 2018

ইসলামী আন্দোলনের সামাজিক প্রভাব -এইচ এম জোবায়ের


ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী বিপ্লব প্রচেষ্টার নাম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াত, কুফুর, শিরক এবং ইসলামবিরোধী অপশক্তিকে সবদিক থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন সামনে এগিয়ে চলে। জাহেলিয়াতের ফুলশয্যায় আয়েশরত কুফরি শক্তি নড়ে চড়ে বসে। তাদের সাথে হাত মেলায় সমাজের ধনিক-বণিক ও এলিট শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদীরা। এসব প্রভাবশালী মহলের নিমক খাওয়া আমজনতা মেষপালের ন্যায় দল নেতার অনুসরণ করে চলে মাত্র। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বুঝে না বুঝে ইসলামী আন্দোলন এবং এর অনুসারীদের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। রাষ্ট্রশক্তি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতায় সদা সম্মুখ সেনানীর ভূমিকা পালন করে। আপাতদৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন তিরস্কার, উপহাস এবং হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হয়। প্রভাবশালী লোকদের বিরোধিতা ও কতিপয় দুর্বল লোকদের সমর্থনপুষ্ট ইসলামী আন্দোলন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে এবং এর অনুসারীগণ অনেকটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হন। এহেন পরিস্থিতিতে এ আন্দোলনকে প্রভাবহীন মনে হলেও কার্যত ও দীর্ঘ মেয়াদে এ আন্দোলনের প্রভাব সমাজের প্রতিটি দিক ও বিভাগে মেঘলুপ্ত সূর্যের ন্যায় বিরাজমান থাকে। সময়ের ব্যবধানে মেঘ কেটে গিয়ে ইসলামী আন্দোলন নামক সূর্য উঁকি দেয় স্বমহিমায়, অতঃপর সমাজের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে বিপ্লবের বীজ বপনের উপযোগী করতে ক্রমাগত প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। আন্দোলনের উর্বর জমিন ফসল ফলানোর উপযোগী হওয়ামাত্র আষাঢ়ের বর্ষণের ন্যায় বিপ্লব এসে যায় এবং সেই বিপ্লবের সু-ঘ্রাণ বসন্ত বাতাসের মত শীতের সকল জরা-জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলন সক্রিয় থাকা একটি বড় নেয়ামত। এর প্রভাব বৃক্ষরূপী সমাজের পাতা থেকে শেকড় পর্যন্ত প্রোথিত। ইসলামী আন্দোলনের সামাজিক প্রভাব নিয়েই আজকের আলোচনা।

বর্তমান সমাজ ও ইসলামী আন্দোলন
অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্ট মতে, বর্তমানে বংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫.৮৯ কোটি। শিক্ষার হার ৬২.৭% এবং সাক্ষরতার হার ৭+ বছর ৬৩.৬%। বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুপাতে এই শিক্ষার হার মোটামুটি চলনসই বলা যেতে পারে। দিন দিন বাড়ছে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা। সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্নীতির মাত্রা। বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫তম। বিশ্লেষকগণ একে ভাল বলেননি। দুর্নীতি সূচকে ভাল থেকে খারাপ, এই তালিকায় এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫। অথচ এর আগের বছর অবস্থান ছিল ১৩৯। অর্থাৎ ছয় ধাপ অবনতি হয়েছে। খাত ভিত্তিক হিসেবে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা, এনজিও উল্লেখযোগ্য। এসব খাতে সেবা নিতে গিয়ে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ অবৈধ লেনদের এবং হয়রানির শিকার হন। পক্ষান্তরে আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাবো এই সেক্টরগুলোর কর্ণধার, কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, বিসিএস ক্যাডার, নন ক্যাডার এবং মেধাবী ব্যক্তি। তাদের দেশী-বিদেশী সনদ দেশের সুনাম, উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন এবং দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি রোধে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে বিপরীত ভূমিকা পালন করে চলেছে। চারদিকে নৈরাজ্য, অরাজকতা, মারামারি, খুনাখুনি ও অমানবিকতার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে একাকী পথ চলছে ইসলামী আন্দোলন। কাদায় বসবাস করেও যার অনুসারীদের গায়ে কোন কাদা লাগে না। কুরআন-হাদিসের শিক্ষা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় না থাকায় সেখান থেকে পাস করা লোকেরা পুঁজিবাদী বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বের হন এবং তাদের দিন-রাতের সকল কাজ-কর্মে দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, লুটপাট, হিং¯্রতা, অমানবিকতা ও বিবেকহীনতারই পরিচয় পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কুরআন-হাদিসের নিখাদ ও পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন-অনুশীলন ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীদের মধ্যে থাকায় তারা বিবেক, মূল্যবোধ ও উদারতার এক সুউচ্চ মানদন্ডে অবস্থান করেন। ফলশ্রুতিতে তাদের চরিত্রে সততা, দক্ষতা, মানবিকতা এবং স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠতা ও জবাবদিহিতার এক অপূর্ব বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।

অফিস-আদালতে এই সৎ ও আন্তরিক লোকদের প্রমোশন কম হলেও সহকর্মীগণ আড়ালে তাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হন। বসগণ তাদের কঠিন ও জটিল কাজগুলো এই ব্যক্তিদের দ্বারাই করিয়ে নিয়ে থাকেন। উন্নত চারিত্রিক মাধুর্য নিয়ে সমাজে বাস করা এ ধরনের লোকদের প্রভাব সমাজেও দেখতে পাওয়া যায়। তাদের নৈতিক প্রভাব পুঁজিবাদীদের আর্থিক প্রভাবকে ম্লান করে দেয়।
ধর্ম-দীন ও ইসলামী আন্দোলন
ধর্ম ও দীনের মধ্যে পার্থক্য- আকাশ ও জমিন। কুরআন নাজিলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং রাসূল (সা) প্রেরণের মহান উদ্দেশ্যের দিকে তাকালে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়- ইসলাম কতিপয় আনুষ্ঠানিক বন্দেগিসর্বস্ব কোন ধর্মের নাম নয়। বরং আল ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। মানবজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পথনির্দেশনার একমাত্র আলোকবর্তিকা হচ্ছে দীন ইসলাম। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে হতাশার এক করুণ চিত্র সামনে আসে। দীন ইসলামকে নিয়ে মনগড়া আলোচনা এবং অনুসরণের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। আলেমসমাজের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা, মূর্খদের কল্পিত ও পূর্ব পুরুষদের দোহাইমূলক অনুসরণ, রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও লোকদেখানো ইসলাম মানা এবং এক শ্রেণির জ্ঞানপাপী ও অর্ধ শিক্ষিত মানুষের আংশিক ইসলামের দাওয়াত, প্রচার ও অনুসরণ আমাদের জাতিকে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ও তৎপরতা নিয়ে কাজ করছে ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীগণ ইসলামকে লোকদেখানো অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধার্মিকতার নিষ্প্রাণ খোলস থেকে বের করে এনেছেন। তারা ইসলাম ও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন, গুরুত্বহীন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করেন না এবং ফরজকে ফরজ ও নফলকে নফলের স্থানে রাখেন। ফলশ্রুতিতে তারা গোঁড়ামি, সঙ্কীর্ণতা, একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত হয়ে উদারতার নীতি গ্রহণ করেন। নীতি হিসেবে উদারতা বরাবরই ময়দানে জয়ী হয়ে থাকে। তাই ইসলামকে যারা ‘কমপ্লিট কোড অফ লাইফ’ হিসেবে মানার চেষ্টা করেন তারা সমাজে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন। তাদের ব্যক্তিত্ব ও সহনশীলতার কাছে সমালোচকরাও হার মানে। নগদ লাভ ও ক্ষমতাসীনদের সাময়িক প্রভাবের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের দাওয়াত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে না মানলেও মনে মনে ঐ লোকগুলো ইসলামী আন্দোলন ও এর অনুসারীদের সমর্থকে পরিণত হন। তাই বলা যায়, একমাত্র ইসলামী আন্দোলনই পতনোন্মুখ এই সভ্যতার পতন ঠেকাতে পারে।
জেল-জুলুম-নির্যাতন
এক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তি সবসময় ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকেন। নমরূদ, ফেরাউন, আবু জাহেলদের অনুসারীর সংখ্যা প্রতি যুগেই বেশি ছিল, এখনো তাই। প্রতিষ্ঠিত কায়েমি স্বার্থবাদ কখনোই কুরআনের রাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বরদাশত করেনি। তারা নানান বাহানায় আন্দোলনের কর্মীদের ওপর হামলা, মামলা, জুলুম-নির্যাতন ও প্রাণ হরণ করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- ইসলামী আন্দোলকে নিস্তেজ করা এবং বিপ্লবীদের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী তাদের এই প্রচেষ্টা সৃষ্টির শুরু থেকেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে আসছে। বিপরীতে দুর্বল লোকদের ওপর প্রতিষ্ঠিত শক্তির জুলুম নির্যাতন সাধারণ মানুষের কৌতূহলের কারণ হয়েছে এবং এ আন্দোলনকে জানার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আল্লাহর রাসূলের প্রিয় সাহাবী খুবাইব ইবনে আদি (রা) কে শূলিতে চড়ানোর দৃশ্য যেমন হযরত সা’ঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী (রা) কে পরবর্তীতে বারবার মর্মপীড়া দিয়েছে তেমনি হযরত বেলাল (রা) এবং হজরত খাব্বাব (রা) দের ওপর চালানো সীমাহীন নিপীড়ন আরবের মানুষকে অনুসন্ধিৎসু করেছে ইসলামকে জানার ও মানার ব্যাপারে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী আন্দোলনের ওপর নিকট অতীতে চালানো জুলুম-অত্যাচারের প্রভাব সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সাধারণ মানুষের অন্তরে কী পরিমাণ পড়েছে তা চিন্তাশীল মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। বরং বলা যায় বিরোধীদের সকল অপতৎপরতা বুমেরাং হয়েছে। নির্যাতিতের পরিবারের উপর এর প্রথম প্রভাব পড়েছে। পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যারা ইসলামী আন্দোলনকে অপছন্দ করতেন তারা এই সময়ে এসে অনুধাবন করেন যে, সত্যিই, আন্দোলনই সঠিক। তারা দেখেন তাদের নিকটজনকে বিনা কারণে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে, জেলে দিনের পর দিন আটকে রাখা হচ্ছে। নিকটজনের পাশাপাশি পাশের বাড়ির এবং গ্রামের সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন- এই নিরীহ, গরিব, মেধাবী ছেলেটির তো কোন দোষ নাই, তাহলে কেন তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? এই ধরনের হাজারো প্রশ্ন নিজেকে নিজেই করে তারা উত্তর পান- সত্যিই এরা সঠিক পথে আছে। এভাবে বিরোধী মহলের অপপ্রচার, হত্যা, নির্যাতন ও জুলুম ইসলামী আন্দোলনের জন্য যুগ যুগ ধরে প্রচারের ভূমিকা পালন করে আসছে। আন্দোলনকে কোটি টাকা খরচ করে যে প্রচারণা চালানো লাগতো বিরোধী বন্ধুগণ বিনা পয়সায় তা করে দিচ্ছেন।
ছাত্র ও তরুণ সমাজ
সুপিরিয়র টেকনোলজির যুগে অভিভাবকদের চিন্তার শেষ নেই। সন্তান স্কুল-কলেজে গিয়ে কী করছে? আদৌ যাচ্ছে কি-না? পড়ালেখা ঠিকঠাক চলছে তো? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন অভিভাবকদের চিন্তায় ঘুরপাক খায় সারাদিন। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন, প্রত্যাখ্যাত হয়ে বান্ধবীকে নির্যাতন-হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি পত্র-পত্রিকার নিয়মিত খবরের অংশ বিশেষ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের হাতে থাকায় তাদের মাঝে এমন কিছু অসৎ চিন্তা ও কর্ম পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণ বিবেকবান মানুষের চিন্তার বাইরে। স্মার্ট ফোন বা আই ফোন এবং হাই স্পিডি ইন্টারনেট এমন কোমলমতীদের হাতে পড়ছে যারা এর ব্যবহারের সীমা-পরিসীমা বোঝার জ্ঞান রাখে না। প্রযুক্তির অপব্যবহার তরুণ-যুবকদের চরিত্রকে উগ্রতা, হিং¯্রতা, অনমনিয়তা, কুটিলতা এবং অনৈতিকতার অতল গহবরে পৌঁছে দিচ্ছে। ইন্টরনেটের নিষিদ্ধ সাইটগুলোয় বিশেষত ছাত্রদের অবাধ বিচরণ অবক্ষয়ের শেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফায়িং অথরিটিজ (সিসিএ) এর এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অষ্টম হতে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীদের ৬৯ শতাংশই ইন্টারনেটে আসক্ত। এদের মধ্যে আবার ৮৩ শতাংশ ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এই যখন দেশের তরুণ যুবকদের অবস্থা তখন ইসলামী আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু শিক্ষার্থী উপর্যুক্ত অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে তাদের স্যালুট। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী যখন মদ-গাঁজা-ইয়াবা সেবন থেকে বিরত থাকেন, বান্ধবীদের সাথে অহেতুক আড্ডাবাজিতে লিপ্ত না হন, মুখ থেকে দুই অক্ষরেরও কোন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করেন তখন এই নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বন্ধু মহলে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। সচেতন-বিবেকবান অনেকেই তাদের পথ অনুসরণে এগিয়ে আসেন। জওহর দোদায়েভ: এসএসসি পরীক্ষা চলাবস্থায় পরীক্ষার হলে বাহির থেকে সমাধান হাতে পায়। বন্ধুরা সবাই মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে যায়। কিন্তু জওহর দোদায়েভ সমাধান হাতে পাওয়ার সাথে সাথে তা স্যারের সামনেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তার এই সততা পরীক্ষার হলের সবাই অত্যাশ্চর্যের মত উপভোগ করে। এই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের সংস্পর্শে থাকা একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর নির্মল চরিত্র।

পেশাজীবী মহল
জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ কত পেশাই না বেছে নেন। ইসলামের মূলনীতি মেনে যে কোন পেশাই গ্রহণ করা যায়। তবে কিছু পেশা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য অতীব জরুরি যেমন- ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, বিচার, সাংবাদিকতা ইত্যাদি। একজন ডাক্তার তার বিদ্যা ও আন্তরিকতা দিয়ে একজন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারেন। একজন শিক্ষক তার মেধা ও অভিজ্ঞতা থেকে পাঠদানের মাধ্যমে দেশের জন্য ভবিষ্যৎ সৎ, দক্ষ ও আদর্শবান নাগরিক উপহার দিতে পারেন। একজন সাংবাদিক তার লেখনীশক্তির মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতা, মাদক, দুর্নীতি দূর এবং দেশে আইন ও ইনসাফের শাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন আইনজীবীর কাছে অধিকারহারা মানুষ আইনগত সহায়তার মাধ্যমে অধিকার ফিরে পেতে পারেন। কিন্তু উক্ত পেশার কেউ যদি নীতি ও দীনহীন হন তবে তার কাছে সেবার পরিবর্তে দুর্ভোগ, অকল্যাণই উপহার পাওয়া যেতে পারে। যেমন- একজন অপেশাদার ও বদমেজাজি ডাক্তার চোখের অপারেশন করতে গিয়ে রোগীকে বেশি যন্ত্রণা দিতে পারেন এবং তার অপূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় রোগীর চোখের আলো চিরদিনের জন্য নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। একজন হলুদ সাংবাদিকের কলম কখনো সমাজের মানুষের বিপথগামিতার কারণ হতে পারে। একজন অসৎ বিচারকের রায় নিরপরাধ মানুষের জীবন হরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে সর্বত্র এই চিত্রই বিরাজমান। হাতেগোনা ব্যতিক্রমীদের সবাই চেনেন, জানেন। তাদের সেবা মানুষের হৃদয়-মন কেড়ে নেয়। তাদের সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং অমায়িক ব্যবহার সেবাগ্রহীতার মনে গেঁথে যায়। ইসলামী আন্দোলনই এ ধরনের অগণিত মানুষ তৈরি করেছে। এদের চরিত্র ও কর্মের উপমা প্রতিটি পেশায় অল্প হলেও দেখতে পাওয়া যায়।

পরিশেষে সূরা আল বাকারার ৩০ নম্বর আয়াত দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই। সেখানে আল্লাহপাক পৃথিবীতে মানুষ নামক খলিফা পাঠানোর কথা বলেছেন। খলিফা অর্থ- প্রতিনিধি। তিনি আসল মালিক নন বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। মালিক তাকে যে কাজ যেভাবে করার জন্য আদেশ দিয়েছেন তাকে সে কাজ ঠিক সেভাবেই আঞ্জাম দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি বলেই বিবেচিত হবে। প্রতিনিধির কোন স্বাধীন ক্ষমতা নেই, মালিকের দেয়া কিছু এখতিয়ারই তাই এখতিয়ার। প্রতিনিধির কোনো স্বতন্ত্র ইচ্ছাশক্তি নেই, মালিকের ইচ্ছার বিলকুল বাস্তবায়নই হবে তার একমাত্র পেরেশানির কারণ। ইসলামী আন্দোলন এই চেতনাকে শাণিত করে। এই শাণিত চেতনার লোক সমাজে যত বেশি হবে বিপ্লব তত ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Popular Posts