সরদার আবদুর রহমান : বাংলাদেশের উত্তর জনপদ তথা বরেন্দ্রভূমির এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম নেতৃত্বের নাম খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ। বিংশ শতাব্দীর বিশ-ত্রিশ দশকজুড়ে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলকে বলতে গেলে একক নেতৃত্ব দিয়ে সেসময়ের অনগ্রসর মুসলিম সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন তিনি। একাধারে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য ডেপুটি স্পিকার, রাজশাহী জেলা বোর্ড এবং রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি এক গৌরবময় সময়কাল অতিবাহিত করেন। একই সময়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠত থেকে তিনি বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তৎকালীন সময়ে বঙ্গে অন্য কোন নেতার জীবন-ইতিহাস এরূপ দেখা যায় না।
খ্যাতিমান সমাজসেবক, রাজনীতিক ও আইনজীবী খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ তৎকালীন মালদহ জেলার (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা) অন্তর্ভুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার রাজারামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হেমায়েতুল্লা বিশ্বাস। এমাদুদ্দীন স্থানীয় স্কুল থেকে বৃত্তিসহ প্রাইমারি পাস করে কিছুকাল নবাবগঞ্জ হরিমোহন সরকারী হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে রাজশাহী সরকারী কলেজে ভর্তি হন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে এফ.এ. এবং ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পাস করার পর তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে এমাদুদ্দীন আহম্মদ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী শহরে ফিরে এসে রাজশাহী জজকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং স্বল্পকালের মধ্যেই আইন ব্যবসায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এসময় তিনি রাজশাহীর একডালা হাট লুট, হিন্দু গৃহবধূ পঙ্কজিনী অপহরণ, সরদহের নিকটে খোর্দ গোবিন্দপুর গ্রামের ডাকাতি প্রভৃতি কয়েকটি বিখ্যাত মামলায় একজন আইনজীবী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন : খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদের সময়কাল (১৮৭৫-১৯৩৬) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা এদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে ভারতীয় কংগ্রেস ও সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়া কাউন্সিল এ্যাক্ট, ১৯০৫ সালের বাংলা বিভাগ ও ১৯১১ সালের বাংলাবিভাগ রদ্, ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন, ১৯১৬ সালের লক্ষেèৗ-চুক্তি, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এসময়ে বাংলার মুসলমানগণ তাদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একই সময়ে রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বহু ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের সমাবেশ ঘটে। এঁদের মধ্যে বিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আইন ব্যবসায় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রাজশাহী পৌরসভা চেয়ারম্যান, জেলা বোর্ড চেয়ারম্যান, বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার হিসেবে প্রায় তিনদশক রাজনৈতিক উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে পশ্চাদপদ মুসলমানদের অগ্রগতি সাধনে সর্বাত্মœক চেষ্টা করেন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন মুসলিম স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন সমগ্র বাংলার আন্তরিক হিতাকাংখী। তাঁর মধ্যে আইনের পারদর্শীতা, রাজনীতিজ্ঞান ও দেশহিতৈষণার সমাবেশ ঘটে। উপমহাদেশের পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আজীবন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম বাংলায় তাঁর নেতৃত্ব যথেষ্ট গুরুত্বের অধিকারী। সমকালের সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর কর্মকা- ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে।
ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত : খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ রাজশাহীর (দক্ষিণ) মুসলমান নির্বাচকম-লীর প্রতিনিধিরূপে পরপর তিনবার বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার রাজশাহীর (দক্ষিণ) মুসলমান নির্বাচকম-লীর প্রতিনিধিরূপে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে (১৯২৭-২৯ খ্রি.) আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দীর্ঘ দশ বছর আইন পরিষদে রাজশাহীর গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বাংলার অবহেলিত মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলিষ্ঠ ভাষায় আইন পরিষদে তুলে ধরেন এবং মুসলমানদের অধিকার আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এসময় ইস্টেট পার্টিশন বিল ১৯৩৩, বেঙ্গল মোটর ভেহিকল ট্যাক্স বিল ১৯২৬, বেঙ্গল চিলড্রেন বিল ১৯২১, আগ্রা এবং আসাম সিভিল কোর্ট এ্যামেন্ডমেন্ট বিল ১৯৩৪, বেঙ্গল ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট বিল ১৯৩৪, বেঙ্গল মোহামেডান ম্যারেজ এন্ড ডিভোর্ড রেজিস্ট্র্রেশন বিল, ১৯২১ বেঙ্গল টেনান্সি বিল ১৯২৮ প্রভৃতির উপর তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান : ব্রিটিশ শাসনকালে ‘বেঙ্গল লোকাল সেলফ এ্যাক্ট-১৮৮৫’ অনুযায়ী জেলা বোর্ড গঠিত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর মি: এ. এইচ. রড্ক। বঙ্গীয় স্বায়ত্বশাসন বিধান অনুসারে তখন পদাধিকার বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বেই জেলাবোর্ডগুলো পরিচালিত হয়। এমাদুদ্দীন আহম্মদ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজশাহী জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বায়ত্বশাসিত আইন সংশোধিত হওয়ার পরে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসরকারী ব্যক্তি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার অধিকার লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম নির্বাচনে এমাদুদ্দীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় নির্বাচনেও তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তৃতীয় নির্বাচনে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নাটোরের রাজা (ছোট তরফ) বীরেন্দ্রনাথ রায়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাজশাহী জেলাবোর্ডের পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করেন দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায়।
পৌরসভা চেয়ারম্যান : রাজশাহী পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল। এই পৌরসভার সর্বপ্রথম বেসরকারী চেয়ারম্যান ছিলেন বাবু হরগোবিন্দ সেন। তাঁর পূর্বে সরকারী কর্মকর্তারাই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। এমাদুদ্দীন আহম্মদ ছিলেন রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম মুসলমান বেসরকারী চেয়ারম্যান। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ অবধি তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে অর্থাৎ এমাদুদ্দীন আহম্মদের পূর্বে কোন (২৩-এর পাতায় দেখুন)
(২১-এর পাতার পর)
মুসলমান রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেননি। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলা বোর্ড ও পৌরসভার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
খানবাহাদুর উপাধি লাভ : রাজশাহী জেলা বোর্ড ও পৌরসভার নির্বাচনে এমাদুদ্দীন আহম্মদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাজশাহীতে প্রথম মুসলিম নেতৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। মুসলিম জাগরণে নেতৃত্ব দান করলেও তিনি ছিলেন উদার ও মুক্তমনের অধিকারী। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁর অসাধারণ কর্মদক্ষতা এবং ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার তাঁকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের লাভ বা লোভ-লালসার উর্দ্ধে থেকে তিনি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সে কারণে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ছিল জনগণের পরম বিশ^াস ও আস্থা। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং প্রভাবে অত্র অঞ্চলের অনগ্রসর জনপদের মাঝে নবজীবনের সঞ্চার ঘটে।
সমাজসেবায় অবদান : এমাদুদ্দীন আহম্মদ ছিলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজসচেতন এক স্মরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই জনহিতৈষী নেতা জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মকা-ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই অঞ্চলে তৎকালীন মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা তাঁকে পীড়িত করে। ফলে তিনি মুসলিম জাগরণে নেতৃত্ব দান করেন। ক্রমে বিভিন্ন সমাজসেবকদের প্রচেষ্টায় রাজশাহীতে রাজশাহীতে গড়ে ওঠে ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম সমিতি’ (১৯০৬ খ্রি:), ‘মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ (১৯১৮ খ্রি:), ‘মুসলিম ক্লাব’ (১৯২৯ খ্রি:), ‘খাদেমুল ইসলাম সমিতি’ (১৯৩২ খ্রি:) প্রভৃতি। মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধনে এসব সংগঠন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এসব প্রতিষ্ঠান ও সমিতির সঙ্গে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। একারণে তিনি জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত রাজশাহী গালর্স মাদ্রাসা (পরে হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তাঁর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। এসময়ে রাজশাহী শহরে পি.এন. বালিকা বিদ্যালয় ছাড়া আর কোন বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। উক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের কারণে এবং ইসলামী রীতি-নীতি বা ধর্মীয় শিক্ষালাভের কোন সুযোগ না থাকায় পর্দানশীন মুসলিম পরিবারের মেয়েরা ভর্তি হতে আগ্রহী ছিল না। এছাড়া নি¤œমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মুসলিম পরিবারের মেয়েদের পক্ষে সেখানে ভর্তির সুযোগ লাভ করাও ছিল বেশ কঠিন ব্যাপার। শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী রীতি-নীতি বা ধর্মীয় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হাতেম খাঁন মহল্লায় স্থাপিত হয় ‘রাজশাহী জুনিয়র বালিকা মাদ্রাসা।’ বিশিষ্ট সমাজ হিতৈষী মৌলবী মো: পারভেজ আলীর বৈঠকখানায় তাঁর নিজস্ব চেয়ার, টেবিল ও বেঞ্চ নিয়ে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর বসির উদ্দীন আহমেদ এবং সেক্রেটারি ছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী মৌলবী মো: পারভেজ আলী। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয় হাতেম খান মহল্লায় মির্জা মোহাম্মদ ইউসফের উদ্যোগে এবং মুসলিম জনগণের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত ‘রাজশাহী মোহামেডান এসোসিয়েশন’ এর নিজস্ব ভবনে। ভবনটিতে তখন ভাড়া থাকতেন খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন। তিন কক্ষ বিশিষ্ট উক্ত ভবনে চলতো সভা। সম্মিলিত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের মুক্ত আলোচনা। শিক্ষায় অনগ্রসর নারী সমাজের শিক্ষা প্রসারকল্পে তথা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ভবনটি বিদ্যালয়ের জন্য ছেড়ে দিয়ে খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন এরই অপর পাশের্^ একটি খড়ের আটচালা কামরায় নিজে অবস্থান করতে থাকেন। মোহামেডান এসোসিয়েশন-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত তিনকক্ষ বিশিষ্ট এই ভবনকে কেন্দ্র করেই বিদ্যালয়টির সম্প্রসারণ ঘটে। খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন কর্মকা-ে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে এটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে তা ‘রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে অত্র অঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। রাজশাহীর এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব দীর্ঘদিন যাবত রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, লোকনাথ স্কুল এবং রাজশাহী হাই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। রাজশাহী মুসলিম গার্লস মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এর পূর্বে বঙ্গদেশে কোন গার্লস মাদ্রাসা ছিল না। রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
তিনি ১৯০৭ থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ মখদুম ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। এসময় শিক্ষা দীক্ষার উন্নয়ন, ছাত্রবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি, ছাত্রভর্তি ও ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, গ্রামীণ প্রাইমারী স্কুল স্থাপন, কৃষির উৎকর্ষ সাধন, কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্থাপন, কৃষি ঋণ সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, খাবার পানি সরবরাহের জন্য কূপ ও পুকুর খনন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রশাসনের সকল স্তরে মুসলিম প্রতিনিধি প্রেরণে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। রাজশাহীর বর্তমান বিদ্যুৎ ভবনটি ছয় বিঘা জমির উপর নির্মিত। এর সবটুকুই খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ তাঁর নিজস্ব জমি দান করেন।
অনাড়ম্বর জীবন : সুঠাম দেহের অধিকারী এই প্রতিভাদীপ্ত কর্মীপুরুষের জীবনযাপন প্রণালী ছিল আড়ম্বর বর্জিত-নিতান্তই সহজ সরল। তিনি ছিলেন কর্তব্যে নিষ্ঠাবান, সদালাপী এবং অন্যায়ের প্রতি আপসহীন এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় খানবাহাদুর এমাদউদ্দীন আহম্মদ রাজশাহী শহরের হাতেম খান মহল্লায় অবস্থিত তাঁর নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ কন্যা ও দুই পুত্র রেখে যান। রাজশাহী হিন্দু-মুসলিমসহ সর্বস্তরের মানুষের শোকাকুল পরিবেশে শাহ মুখদুম (র:) এর মাজার সংলগ্ন মসজিদের ওজুখানার পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তারপর কয়েকদিন ধরে শহরের বিভিন্ন স্থানে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভুবন মোহন পার্কে হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলিত হয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বাংলার মুসলিম সমাজের উন্নয়নে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই মহৎ ব্যক্তির নামানুসারে রাজশাহী পৌরসভার একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন রোড।’ এছাড়া আর কোথাও তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। হাতেম খান মহল্লার ‘এমাদুদ্দীন লজ’ তাঁর বসত ভিটার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
তথ্যসূত্র : ১. রাজশাহীর প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধি খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ : মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। ২. শহর রাজশাহীর আদিপর্ব : মাহবুব সিদ্দিকী, ৩. প্রবন্ধ : রাজশাহীর পাঁচ স্বনামধন্য শিক্ষাহিতৈষী, মোহাম্মদ জুলফিকার।