Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts
Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts

Monday, March 4, 2019

মুক্তিযুদ্ধোত্তর জাতীয় সংহতির চেষ্টা ও বিভেদের প্রয়াস - আবুল আসাদ

    

        মুক্তিযুদ্ধোত্তর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এক পর্যায়ে জাতীয় সংহতি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা উপলক্ষে ‘বাঙালীরা ক্ষমা করতে জানে’-কথা দিয়েই তার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটা মানব ইতিহাসের চলমান সংস্কৃতির একটা অংশ। আজকের আধুনিক বিশ্ব যাকে বলা হয়, সেখানেও রয়েছে এর উজ্জ্বল অনেক দৃষ্টান্ত। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক অন্যায় যুদ্ধে হাজার হাজার ভিয়েতনামীকেই শুধু হত্যা করা হয়নি, বর্বর বোমা বর্ষণে হাজারো জনপদ, ফসলের মাঠ, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের গলাগলি ধরার ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার দাবী বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সবচেয়ে বড় আত্মঘাতি ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর দক্ষিণের মধ্যে এই গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়, অন্য অর্থে বলা যায় এই গৃহযুদ্ধ হয় ঐক্যপন্থী ও বিভেদ পন্থীদের মধ্যে। এই যুদ্ধে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হওয়ার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৬ হাজার। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্যপন্থীরা বিজয়ী হয়, পরাজিত হয় দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদিরা। যুদ্ধকালে যত রক্তই ঝরুক, দক্ষিণের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে দিন যুদ্ধ শেষ হয়, তারপর আর এক ফোটাও রক্ত ঝরেনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, বিচার তো দূরে, ফাঁসি তো আরও দূরে, কেউ অভিযুক্তই হয়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ঘোষণা করেন, “To get the deluded men of the rebel armies disarmed and back to their homes ......... Let them once surrender and reach their homes, they wan’t take arms again.... Let them all go, officers and all, I want submission, and no more bloodshed.... I want no one punished, treat them liberally all around” যার সারকথা হলো: বিদ্রোহী সৈনিক যারা অস্ত্র ত্যাগ করবে, আত্মসমর্পণ করবে এবং বাড়িতে ফিরে যাবে, আর অস্ত্র হাতে নেবে না, তাদের অফিসারসহ সকলকে ছেড়ে দাও। আমি আনুগত্য চাই, আর কোনো রক্তপাত চাই না। চাই না কেউ শাস্তি পাক। সর্বত্র সকলকে উদারভাবে দেখতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের এ ঘোষণা অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছে। ঐক্যপন্থী বিভেদপন্থী সকলেই যুদ্ধের পর একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরেছে। আজও গলা জড়িয়ে ধরেই রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ অপরাধীদের ছেড়ে দিলেও, যাদের যুদ্ধ অপরাধী কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধীর তালিকায় নাম ছিল না, তাদের জন্যে নতুন আইন করে, নতুন ট্রাইবুন্যাল করে, বিচারের কাঠ গড়ায় তুলে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৫ দশক পর। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এই বিচারে বাইরের হাত রয়েছে। সেই ‘বাহির’টা যদি ভারত হয়, তাহলে ব্যাপারটা বিস্ময়কর হয়ে দাড়ায়। কারণ ভারতের কারণেই বা ভারত চেয়েছিল বলেই ১৯২ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সৈন্যের বিচার বাংলাদেশ করতে পারেনি বিচারের জন্যে আইন তৈরি ও ট্রাইবুন্যাল গঠন করা সত্ত্বেও। ভারত তার স্বার্থেই তখন ওটা করেছিল। কারণ ভারত চায়নি যে, পাকিস্তানী সৈন্যের ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক। এর পিছনে রহস্য ছিল, সিমলা চুক্তি (২ জুলাই ১৯৭২) এবং দিল্লী এগ্রিমেন্ট (২৮ আগস্ট ১৯৭৩) অনুসারে ভারত ও পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশে ধৃত পরে ভারতে আশ্রয়ে যাওয়া পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরাও শামিল ছিল। এর বড় প্রমাণ হলো, দিল্লী এগ্রিমেন্ট ধারা-৩ এর ৩ ও ৫ উপধারায় যেখানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে আটকে পড়া মানুষ বিনিময়ের কথা আছে। সেখানে যুদ্ধবন্দীর উল্লেখ নেই। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের উল্লেখ আছে ধারা-৩ এর উপধারা ১ এবং ২-এ, কিন্তু এই বিনিময় সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ভূমিকার কোন উল্লেখ নেই। অন্যদিকে উপধারা ৬-এ ভারত-প্রতিশ্রুত পাকিস্তানী বন্দী বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচার না করার বাংলাদেশের সম্মতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ সম্মতি বাংলাদেশ কখন দিল সে কথার কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য, দিল্লী এগ্রিমেন্টটি সিমলা চুক্তির মতই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর পরিষ্কার অর্থ হলো, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত পাকিস্তানের সাথে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের চুক্তি করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে এইভাবে ভারতের ইচ্ছাটি প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে।
শেখ মুজিব সরকার ভারতীয় চাপে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য স্বাধীনতা উত্তর শেখ মুজিবের সরকার কিন্তু হঠাৎ করেই কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা করেননি। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদেরই যখন অবস্থার কারণে বা অবস্থার প্রয়োজনে নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে হলো, তখন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেশের যারা পাকিস্তানী সৈন্যের সহায়তা করেছেন বা তাদের সহযোগী হয়েছেন, তাদের শাস্তি দেয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি বলেই বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা করেন। ঘটনা কিন্তু মাত্র এটুকুই নয়। কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা মাত্র এ ধরনের কোন চিন্তা থেকে হয়নি। সাধারণ দাবি ও সাধারণ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকেই আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজলের মত দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে কলাবরেটরদের ছেড়ে দেবার আবেদন ও দাবি উত্থিত হতে থাকে। এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী একজন সর্বজনমান্য নেতা জনাব আতাউর  রহমান খান এই সময় এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতি পুনর্গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমাধা না করে সরকার সারা দেশে দালাল ও কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় রত আছেন। মনে হচ্ছে, এটাই যেন সরকারের সব চাইতে প্রধান কর্তব্য। যারা ভিন্ন রাজনৈতিক মত পোষণ করতেন, অথচ খুন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, কিংবা লুটপাটের মতো জঘন্য কার্যে প্রবৃত্ত হননি, তাদের উপর গুরুতর শাস্তি আরোপের মাধ্যমে দেশের কোন উপকার হবে না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যারা বেপরোয়াভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেকে সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, অথচ মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যারা পাক বাহিনীকে সমর্থন দান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা শরণার্থী হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই আইন জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে বিচার একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিচার ও সকল বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুপারিশ করছি।”
এই ধরনের বিভিন্ন বিবৃতি ও দাবির প্রেক্ষিতে এবং দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবের সরকার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে নিম্নোক্ত ‘প্রেস নোট’ প্রচার করেন :
“সরকার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশে (১৯৭২) সালের রাষ্ট্রপতির ৮ নং আদেশ মোতাবেক অপরাধের দায়ে দণ্ডিত অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদর্শনের প্রশ্নটি পুনরায় বিবেচনার পর ঘোষণা করিতেছেন :
১. এই আদেশের ২ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত (ক) উক্ত আদেশ মোতাবেক যে কোন অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দণ্ড ১৮৮৮ সালের ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক মওকুফ করা হইল এবং উক্ত আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইন বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধের সহিত জড়িত থাকার জন্য গ্রেফতারী পরওয়ানা না থাকিলে সেইসব ব্যক্তিকে কারাগার হইতে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। (খ) উক্ত আদেশ বলে যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন রহিয়াছে উল্লিখিত ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে সে সব প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং এই আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের হুলিয়া না থাকিলে তাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে। (গ) এই আদেশ বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে যে সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হইয়াছে অথবা তদন্ত চলিতেছে সেই সব মামলা ও তদন্ত কার্য বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং সব গ্রেফতারী পরওয়ানা অথবা আদালতের হাজির হওয়ার নির্দেশ এবং এই আদেশ বলে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে তাহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ থাকিলে ইহা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য না হইলে তাহাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে; তবে কোন ব্যক্তি অনুপস্থিতিতে দণ্ডিত হইয়া থাকিলে অথবা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা থাকিলে তাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত আদালতে হাজির হইয়া ক্ষমা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকিবে।
২. এই আদেশ বলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা (হত্যার চেষ্টা কিন্তু হত্যার শামিল নয়), ৩৬৭ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন), ৪৩৬ ধারা (ঘরবাড়ি ধ্বংসের অভিপ্রায়ে অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) এবং ৪৩৮ ধারা (জাহাজে অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) মোতাবেক অভিযুক্ত ও দ-িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।
মুজিব সরকারের এই ক্ষমা ঘোষণা সর্বমহল থেকে অভিনন্দিত হয়। মুজিব সরকারের প্রবল বিরোধী এবং বাম আন্দোলনের গুরু বলে পরিচিত, ভাসানী ন্যাপের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার এবং দলের সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ন্যাপ বহু আগে থেকেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করে আসছে।’ বিবৃতিতে বাংলাদেশ দালাল আইন সংক্রান্ত আইনের ৮ নং ও ৫০ নং ধারা বাতিল করার দাবি জানান। তিনি ১৫ ডিসেম্বর আরেক বিবৃতিতে বলেন, ‘ক্ষমা চাই, সমানাধিকার চাই। রাষ্ট্রপতি আদেশের ৫০ ও ৮ ধারা বাতিল চাই।’ বাংলাদেশ  জাতীয় লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আরো আগেই দেশের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এর ফলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে এবং মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেবেন।’ দেশের প্রবীণ রাজনীতিক ও চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাশিম প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে অভিনন্দিত করে বলেন, ‘জনগণের ভাগ্যকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার সঠিক পন্থাই বেছে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এ উদ্যম বজায় থাকলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা রয়েছে।’ সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বনামধন্য কলামিস্ট ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ (স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা) বলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সরকার যখন একবার অনুকম্পার দরজা খুলিয়াছেন, ষোল হাজারের মতো বন্দীকে মাফ করিয়া দিয়েছেন, তখন বাকী সবার ক্ষেত্রেও তেমনি উদারতা প্রদর্শন করুন। অন্যথায় দুই বছর পরে আজ  যেমন চারশ লোককে প্রমাণের অভাবে মুক্তি দিতে হলো, বার বছর পর (৩৭ হাজার দালালদের বিচারে ১২ বছর লাগবে) মানে গ্রেফতারের সময় হতে ১৪ বছর পর আরো অনেক লোককে তেমনি মুক্তি দিতে হইতে পারে।’ (ইত্তেফাক, ২ নভেম্বর, ১৯৭৩)। তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেখ মুজিব সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতি দেয়।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মত ১৯৭৬ সালে কলাবরেটর আইনের বাতিলও ছিল অবস্থার একটা স্বাভাবিক পরিণতি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছিল ১ লাখ লোককে এবং ৩৭৪৭১ জন দালালকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ২২ মাসে ২৮৪৮টি মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। এদের মধ্যে দণ্ডিত হয় মাত্র ৭৫২ জন, তাও প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছোট খাটো অপরাধের জন্য। অবশিষ্ট ২০৬ জন খালাস পেয়ে যান। এই পটভূমিতে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়। সাধারণ ক্ষমার অধীনে ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পেয়ে যায় ৩০ হাজার বন্দী। এখানে উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন অপরাধ ও অভিয়োগে স্বাধীনতা উত্তরকালের যাদের বন্দী রাখা হয়, বিচার করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী নাম করার মতো কেউ ছিলনা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিয়োগ দায়ের করা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশকের মাথায় জামায়াত নেতৃবৃন্দের অপরাধ খুঁজে পাওয়া কোনো যুক্তিতেই আসে না।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের  বিচার, গ্রেফতার ও শাস্তি বিধানের আইনী বিধান বহাল রাখা হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার ১৯৭৬ সালের দালাল আইন বাতিল হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময়ে উক্ত চার অপরাধের অভিযোগে একটিও মামলা দায়ের হয়নি। এই অবস্থার পটভূমিতেই ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে দালাল আইন বাতিল হয়ে যায়।
এখানে একটা বড় প্রশ্ন হলো ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে কোন মামলা দায়ের হলো না কেন? এর একটি জবাব হলো ঐ চারটি অপরাধের ক্ষেত্রে দায়েরযোগ্য কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। এই জবাবটি অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব নয়। কারণ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাতে দায়েরযোগ্য ঐ ধরনের কোন অপরাধ একেবারেই ছিল না তা হতে পারে না। অন্য আরেকটি জবাব এই হতে পারে যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও ছিল, অপরাধও ছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধরা অভিযোগ বা মামলা দায়েরে আগ্রহী হয়নি। এটাই অনেক ক্ষেত্রের বাস্তবতা বলে ধরে নেয়া যায়। কেন আগ্রহী হয়নি? কেন সংক্ষুব্ধ মানুষ অপরাধীর শাস্তি বিধানের জন্য মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি? খুব বড় একটা প্রশ্ন এটা। এক কথায় এর কোন জবাব মিলবে না। এই প্রশ্নের জবাব প্রকৃতপক্ষে সন্ধান করতে হবে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এবং বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয় চিন্তার মধ্যে। এই ক্ষেত্রে এই সময়ের সুন্দর একটা সমাজ বিশ্লেষণ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ড. তারেক মুহাম্মদ তওফীকুর রহমান তার “বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ : ভূমিকা ও প্রভাব (১৯৭২-২০০১)” শীর্ষক গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর অবস্থার উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে আসার সাথে সাথে দালাল আইনে ধৃত এবং বিচারের সম্মুখীন ব্যক্তিদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়টি সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জটিলতার সৃষ্টি করে চলছিল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে-এই সামাজিক চিত্রটি এক কথায় সামনে আনার পর তিনি লিখেছেন :
“আপাত: পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও শত্রুতার নেপথ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ হলো ‘কমপ্যাক্ট সোসাইটি।’ আবহমান কাল থেকে শাশ্বত গ্রাম্য সালিশ বিচার ব্যবস্থার প্রচলনে গ্রামীণ সমাজে যে ভারসাম্য বর্তমান ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা নতুন আঙ্গিকে ও নেতৃত্বে স্থিতিশীল হয়ে আসতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা কেটে যেতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাগণও সমাজের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে উত্তেজনা প্রশমনে রক্তের বন্ধন, আত্মীয় সূত্রতা এবং সমাজ গোষ্ঠীর বন্ধনে অপরাধকারী দালালদের আশ্রয় দেবার ব্যাপক প্রবণতা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ‘ক্ষমাই মহত্বের লক্ষণ’ এই মহানুভবতার চিরন্তনী আবহে লালিত বাংলার মানস গঠন শাস্তি বিধানের  পরিবর্তে সামাজিক সালিশ ও সমঝোতার পথেই অগ্রসর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই পরিবারের পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছে, অপরদিকে পুত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। পিতা ও পুত্রের এই বিপরীত অবস্থান দীর্ঘদিন আক্রোশ মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা পুত্র দালাল পিতাকে বাঁচানোর জন্য তদবির শুরু করতে কুণ্ঠিত হয়নি। অনেক দালাল এমনও ছিল যে, তারা গোপনে মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে এবং প্রয়োজনমত নিরাপত্তা দিয়েছে। দালালীর অভিযোগে অভিযুক্ত ঐ ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং আশ্রয় পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থায় বা ভিন্নভাবে যাই হোক না কেন, মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রায় দুই হাতে ধৃত ও অভিযুক্ত দালালদের ছেড়ে দেবার সুপারিশ করতে থাকে। যা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দপ্তরকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে তোলে। গ্রাম্য সালিশ, দেনদরবার, তদবির হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যকার কারণে পরবর্তীকালে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বাদীপক্ষগণ মামলা চালাতে উদ্যোগ গ্রহণ হতে পিছিয়ে আসে, এমনকি মামলার ন্যূনতম সাক্ষ্য জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
এটাই ঘটনা। সামাজিক রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বাঁধন স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর পক্ষ-বিপক্ষকে সমন্বয় ও সমঝোতার দিকে নিয়ে যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘প্রথম আলো’তে তার ‘সহজিয়া কড়চায়’ এই কথাই লিখেছেন এইভাবে, “কোন যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দালালদের বিচার না হওয়ার মূল কারণ, অনেক মন্ত্রী, সাংসদ নেতা ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। তাদের বাঁচাতে গিয়ে সকলকেই বাঁচিয়ে দেয়া হয়। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। শুধু বাঁচিয়ে দেয়া নয়, দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময় পর্যন্ত দালাল আইন বহাল তবিয়তে থাকলেও খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা কারণ।  আরেকটা কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান ছিল কিংবা পাকিস্তান বাহিনীর সহায়ক হিসেবে রাজাকার এর মত যে সব বাহিনী কাজ করেছে, যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই ছিল না অন্যান্য দল ও গ্রুপের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী ছিল। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন : ‘এখনকার পত্রিকা পড়লে মনে হয় শুধু মুসলিম লীগ, জামায়াত বা নেজামে ইসলামীর লোকেরাই পাকিস্তানীদের দালাল ছিল। বস্তুত সবশ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যেই পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। আব্দুল হক তার কম্যুনিস্ট পার্টির নামের সাথে বাংলাদেশ হবার পরও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে দেন। অত্যন্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করছেন। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের পরস্পরের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধ বা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বইয়ের বিভিন্ন বিবরণীতে এক দৃষ্টান্ত আছে। সম্প্রতি এটিএন-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী এক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী বলতে আমরা জানি একটা ইসলামী দলকে বোঝানো হচ্ছে যারা ডানপন্থী। আমি বলবো যুদ্ধাপরাধীতো সরকারী কর্মচারীও ছিল। আমি আপনাকে প্রমাণ দিতে পারি। কারণ আমি প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একজন বাঙালী ক্যাপ্টেন মারা যায় সরাইলে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করে। কিন্তু ঐ ক্যাপ্টেনকে পরে শহীদ উল্লেখ করা হয়। সুতরাং যখন যুদ্ধাপরাধী বলবেন তখন সবাইকে বলতে হবে।’
সবাইকে যুদ্ধাপরাধী বলতে হচ্ছে বলেই স্বাধীনতা উত্তরকালে অবশেষে বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি কেউ। দু’বছর সময়কালে দালাল আইনে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা বড় কারণ। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাসহ উপরোক্ত সব কারণ সম্মিলিতভাবে ১৯৭৬ সালে দালাল আইন বাতিল করার পটভূমি রচনা করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে বিষয়টা এইভাবে প্রতিভাত হবার সময়ের দাবী পূরণের অংশ হিসেবেই তিনি দালাল আইন বাতিল করেন। আওয়ামী লীগসহ যারা এ জন্য জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন, তারা নিছকই রাজনীতি করেন, বাংলাদেশের সমাজ ও জনগণের কথা, এমনটি তাদের মন কি বলে সেটাও বিবেচনা করেন না।
আসলে একশ্রেণীর সুবিধাবাদীরা এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধাচারণকে তাদের যে রাজনীতি, সে রাজনীতির খোরাক হিসাবেই ব্যবহার করছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও স্বাধীনতা বিরোধী শ্লোগানকে। এই মনোভাব এই শ্লোগান স্বাভাবিক নয়, সঙ্গতও নয়।
স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে যুদ্ধাপরাধ চ্যাপ্টার ক্লোজ করেছেন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে নিছক ‘কলাবরেটর’ হওয়াকে শাস্তিযোগ্য করার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত শেখ মুজিবুর রহমানের এসব সিদ্ধান্তকে আমরা যেন এখন অন্যায় অবাঞ্ছিত মনে করছি। এটা যদি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার রাজনীতি হয়, তাহলে আমাদের জানা দরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবই এই রাজনীতিকে অচল করে দিয়ে গেছেন। জনগণও এই সাথে একে সমাধিস্থ করেছে। এই কারণেই দালাল খান-এ-সবুর তিন আসন থেকে নির্বাচিত হন, শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, বিচারপতি নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি প্রার্থী হতে পেরেছিলেন, মাওলানা নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। হাজার বলেও যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধী বলে জামায়াতে ইসলামীকে খাটো করা যাবে না। স্বাধীনতা উত্তরকালে তদন্ত করে তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর কারও নাম ছিল না এবং দালাল আইনে যে ৭৫২ জনের শাস্তি কনফার্ম করা হয়েছিল, এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাদের মধ্যেও ছিল না জামায়াতে ইসলামীর কোনো লোক। 
জাতিকে ভাগ করার বিভেদাত্মক এই অভিযান শুধু স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি ও ইচ্ছার ব্যতিক্রম নয়, পৃথিবীর চলমান সংস্কৃতিরও ভায়োলেশন।  আন্তঃজাতি যেমন, তেমনি দেশ জাতির অভ্যন্তরেও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।  তেমনি আবার খুব স্বাভাবিক হলো তাদের সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও সমন্বয়ের ঘটনা।  জাতির স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। 
বিভেদের রাজনীতি, হিংসার রাজনীতি আমাদের দেশে তীব্র হোক, এটা বাইরের অনেকেই চায়, যারা চায় আমাদের ভাগ করে শাসন করতে এবং শোষণ করতে। আমরা তাদের  এ চাওয়ার শিকার হতে পারিনা।

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ-২


এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান : ॥ পূর্বপ্রকাশিতের পর

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে জটিলতা : ইসলামী শরীয়তে যেহেতু বাল্য বিবাহ পরিহার করার ক্ষেত্রে কোন গোনাহ নেই। সে কারনে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই বেশী যুক্তিযুক্ত। পৃথিবীর সব দেশের ছেলেমেয়েরা ছোট বেলায় একইভাবে বেড়ে উঠেনা। পৃথিবীর অনেক দেশের ছেলেমেয়েরা নয়, দশ, এগার বা বার বছর বয়সের মধ্যে বিশাল এক শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয়। যেমন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশ, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশ সমূহের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা ষোল থেকে আঠারো বৎসরের আগে এবং ছেলেরা আঠারো থেকে তেইশ বৎসরের আগে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিবাহের জন্য শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয় না। তাছাড়াও বিবাহের পর দাম্পত্য জীবন যাপন, সন্তান গ্রহণ এবং সন্তান প্রতিপালনের ন্যায় দায়িত্বপালনের জন্য মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হয় না। স্বল্প সংখ্যক ছেলে মেয়ে বার, তের, চৌদ্দ বৎসরের মধ্যেই সুস্থ সবল দেহের অধিকারী হতে দেখা যায়। কিন্তু সে সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আমাদের দেশের প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে নানারুপ জটিলতার সৃষ্টি করেছে। আমার জানা একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যা ও পুত্রের সাথে বিবাহ দেয়। এ ধরনের বিবাহকে কোলাকুলি বিবাহ বলা হত। ছেলে শিশুটি বেড়ে উঠার একপর্যায়ে খারাপ বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পড়াশোনায় ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু মেয়ে শিশুটি সুস্থ শরীরে বেড়ে উঠে। লেখাপড়াতেও ভাল ফলাফল করে। একপর্য়ায়ে বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হয়ে যায়। বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হবার কারনে দু বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়ে যায়।
মেয়েটি ভাল ছাত্রী হিসেবে স্নাতোকোত্তর পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে উত্তীর্ণ হলেও তার পরিবারকে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার জন্য মেয়েটি দায়ী ছিল না। বরং তার পিতার সম্পাদিত বাল্যবিবাহই জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। দুজন কিশোর কিশোরীর মধ্যে বা একজন পরিপূর্ণ সাবালক যুবক এবং একজন কিশোরীর মধ্যে বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।   ধরা যাক কোন নাবালিকা মেয়ে যাকে নাবালক অবস্থায় তার পিতা বা কোন অভিভাবক বিবাহ দিয়েছিল। সে যদি সাবালকত্ব অর্জনের পর দেখে যে তার স্বামী অশিক্ষিত বা মাদকাসক্ত বা কর্কশ স্বভাবের। তাহলে স্বামীর সাথে যৌনমিলনের পূর্বেই মেয়েটি তার বাল্যবিবাহ বাতিল করার অধিকার রাখে। ইসলামে এ ধরনের একটি সুন্দর নীতিমালা ইসলামে থাকার পরেও  বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবে না তা কোনভাবেই বলা  যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) এর যুগে এবং পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরামের যুগে তালাকপ্রাপ্তা বা বিবাহিতা কোন নারী অবিবাহিতা থাকত না। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের দেশের তালাকপ্রাপ্তা বিধবা মেয়েদের পরবর্তী বিবাহ সহজসাধ্য নয়। আমাদের দেশের স্বাভাবিক সংস্কার হলো একজন অবিবাহিত যুবক অবশ্যই একজন অবিাহিতা মেয়েকে বিবাহ করবে। আর তালাকপ্রাপ্তা বা বাধ্য হয়ে তালাক গ্রহণকারী এবং বিধবা মেয়েরা যত সুন্দরই হোক তাদের বিবাহ হবে বয়স্ক কোন পুরুষের সাথে বা যাদের স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে বা ঘড়ে পূর্বের স্ত্রী আছে এমন পুরুষের সাথে বিবাহ দিতে হয়। ইদানিংকালে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই হবে যুক্তিযুক্ত।  তবে উঠতি বয়সের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার ফলে যাতে কোন মেয়ে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ না করে, সেদিকে অভিভাবকদের কড়া নজর রাখতে হবে। শিশু বা কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেয়া হলে তারা একটা বন্দী বা শৃঙ্খলিত জীবন নিয়ে তারা পরিপূর্ণ সাবালকত্বের বয়সে পা দেয়। অনেক সময় এ ধরনের বিবাহের মাধ্যমে জুড়ে দেয়া স্বামী স্ত্রীর সংসার সুখের হয় না। দুটি পরিবারের সু সম্পর্কের কারণেই সাধারণতঃ এধরনের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোন কারনে এধরনের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে  দুটি পরিবার পরষ্পর শত্রুতে পরিণত হয়। বাল্যবিবাহ সম্পাদন এবং পরিহার দুটিই ইসলামে জায়েজ। যে জায়েজটি সমাজের জন্য বেশী কল্যাণকর সেটি গ্রহণ করা উচিৎ। ইসলামে এই নীতিমালাকে ইস্তিহ্সান বলা হয়। অর্থাৎ দুটি ভালর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালটিকে গ্রহন করা। বাল্য বিবাহ আইনের মাধ্যমে বন্ধ করার চাইতে এর কুফল তুলে ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই যথেষ্ঠ হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি হলে আইন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও আমাদের দেশের জনগনের বিরাট একটি অংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। অনেক সময় হতদরিদ্র ঘরের পিতা মাতারা তাদের তরুণী বা যুবতী মেয়েকে আর্থিকভাবে সচ্চল অতিবয়স্ক পুরুষদের সাথে বিবাহ দেন। এধরনের বিবাহ এখনও সংঘটিত হচ্ছে। এধরনের বিবাহে কিছুদিনের মধ্যে অনেক মেয়েই বিধবা হন। তাদের যৌবনের বিরাট একটি অংশ বৈধব্য জীবন নিয়ে কাটিয়ে দিতে হয়।
ইসলামী বিবাহ আইনের খিয়ারই বুলুগ নীতি : 
নাবালক বা নাবালিকার বিবাহ তাদের পিতা বা অভিভাবক কতৃক নাবালক অবস্থায় সম্পাদিত হইয়া থাকিলে সাবালকত্ব অর্জনের পর ঐ ধরনের বিবাহ বাতিল করার অধিকার ছেলেমেয়েদের রয়েছে। এই নীতিমালাটিকে ইসলামী আইনে খিয়ারই বুলুগ বলা হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (র.) এবং তার ছাত্ররা (আবু ইউসুফ র. ব্যতীত) অত্যন্ত উদার। আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অবর্তমানে দাদাসহ যেকোন ডিফ্যাক্টো গার্ডিয়ান কর্তৃক নাবালক নাবালিকার বিবাহ সাবালকত্ব অর্জনের পর বাতিল করিবার অধিকার আছে মর্মে তাহারা ফতোয়া দিয়েছেন। এই ফতোয়ার স্বপক্ষে দলিল হলো সহীহ বুখারীর হাদিস নং ৫৩৩৮ এবং ৫৩৩৯। খানসা বিনতে খিযামা আনসারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন তিনি যখন কুমারি ছিলেন তখন তার পিতা তাকে বিবাহ দেন। ঐ বিবাহ খানসার (রা.) পছন্দ ছিল না। রসুলুল্লাহ (দ.) তার নিকট সবকিছু শুনে বিবাহটি বাতিল ঘোষণা করেন। ইসলাম বিবাহযোগ্যা কুমারি, বিধবা এবং তালাক প্রাপ্তা সকল নারীর বিবাহ তার অনুমতি ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন কোন কুমারী মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার বিয়ে দেয়া যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কিভাবে (বিশেষতঃ কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে) অনুমতি নেয়া হবে। তিনি বললেন (অনুমতি চাওয়ার পর) চুপ থাকাই তার সম্মতি। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কুমারী মেয়েদের অনুমতি গ্রহনের ক্ষেত্রে তাদের লাজুকতার বিষয়ে উলেল্লখ করে তিনি রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞেস করলেন যে ইয়া রসুলুল্লাহ কুমারী মেয়েরা নিশ্চয়ই লজ্জা করে (বিবাহের অনুমতি দানের ক্ষেত্রে)। রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন তার চুপ থাকাটাই তার সম্মতি। সহীহ বুখারী হাদিস নং ৩১৩৭। ইসলামে নারী পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের সাবালকত্ব প্রাপ্তি হচ্ছে তাদেরসাধারন বয়স সীমা। উক্ত বয়সে পৌছার পরেই একজন যুবক যুবতী কেবল ইসলামের বিবাহ আইনের যাবতীয় শর্তাবলী যেমন ইজাব কবুল, মোহরানা, খোরপোশের বিধানসমূহ সরাসরি কার্যকর করা যায় সেই সাথে তালাকের বিধানসমূহ প্রয়োগ করা যায়।
গোটা বিশ্বের মুসলমান ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়সের মানদন্ড কত হওয়া উচিত : রসুলুল্লাহ (দ.) এবং মক্কায় ইসলাম গ্রহনকারী সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নবুয়তের তের তম বর্ষে স্বপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। রসুলুল্লাহ (দ.) এর নেতৃত্বে মদীনায় একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ বা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্র মদীনায় ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়। দ্বিতীয় হিজরী সনে তিনি তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়ে  ঊনিশ বৎসর বয়স্কা ফাতিমা (রা.) এর সহিত চব্বিশ বৎসর বয়স্ক চাচাতো ভাই আলী (রা.) এর বিবাহ দেন। মুসলীম উম্মাহ তাদের ছেলেমেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ফাতিমা (রা.) এবং আলী (রা.) এর বয়স কে আদর্শ বয়স হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী রসুলুল্লাহ (দ.) এর নবুয়ত লাভের সময় আলী (রা.) এর বয়স ছিল দশ বৎসর (তাবকাতে ইবনে সাদ)। আর ফাতেমা  (রা.) ছিলেন রসুলুল্লাহ (দ.) এবং খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এর ছোট মেয়ে। নবী করীম (দ.) এর ওহী লাভের পাঁচ বৎসর পূর্বে কাবা ঘর পূনঃনির্মাণের বছর ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সিয়ারুআলামআন্নুবালা দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ১১৯)। হিজরতের বৎসর ফাতেমা (রা.) এর বয়স ছিল আঠারো ছুঁই ছুঁই। আলী ও ফাতেমা (রা.) এর বিবাহের বয়স গণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণের আরো কিছু বর্ণনা আছে। বর্ণনাগুলি পরস্পর বিরোধী হওয়ায় সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। বিবাহের বয়সের এই সিমাটি মান্য করা ফরজ নয়। এই বয়স সীমার আগে বা পরেও বিবাহ হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ঊনিশ এবং ছেলেদের বিবাহের ক্ষেত্রে চব্বিশ বৎসরের বয়স সীমাকে সুন্নাহ সম্মত বয়স সীমা বলা যায়। নবী করিম (দ.) কখনই তাঁর উম্মতকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেননি। বরং তিনি একজন মুসলিম যুবকের সাথে একজন কাছাকাছি বয়সের মুসলমান যুবতীর বিবাহ হোক  সে বিষয়ে উৎসাহিত করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এ উল্লেখিত বিবাহের বয়স মেয়েদের জন্য কমপক্ষে আঠারো এবং ছেলেদের জন্য কমপক্ষে একুশ বৎসরের সীমাটি ইসলামী শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে আয়েশা (রা.) এর বিবাহ বাল্যবিবাহ ছিল কিনা : আধুনিক বিশ্বে মুসলমান তথা ইসলামী আদর্শকে হেয় করার জন্য এবং মহানবী (দ.) এর একাধিক বিবাহ ও অল্প বয়সী আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করা নিয়ে একধরনের মিথ্যাচার করে তাঁর চরিত্র হনন করে মুসলমানদের মনে কষ্ট দেয়ার একটা মহাপ্রচার যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। এই প্রচারণার ফলে আল্লাহর শত্রুরা বিশেষ করে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে মুহাম্মদ (দ.) এর সমস্ত কার্যক্রম ভালো বা প্রশংসনীয়। কিন্তু আয়েশা (রা.) এর সাথে তার বিবাহটি ব্যতিক্রম। আমার এক বন্ধু আমাকে একদিন বললেন বিষয়টির কারণে তিনি লজ্জাবোধ করেন (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি বলেছিলেন বিষয়টি নবী (দ.) এর অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খায় না। ইদানিং এ ধরনের একটি বিষয় কতিপয় নাস্তিক মুরতাদ ব্লগার অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ আলোচনার ভিডিও প্রস্তুত করে ইউটিউবে আপলোড করেছেন। পাশ্চাত্যের কার্টুন ছবি নির্মাতারা হযরত আয়েশা (রা.) এর সাথে রসুলুল্লাহর বিবাহের কাহিনীকে অবলম্বন করে বেশ কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছবি নির্মাণ করে গুগল ও ইউটিউবে আপলোড করেছেন। তাদের আশা ভবিষ্যতের মুসলিম প্রজন্ম এসব দেখে যেন রসুলুল্লাহ (দ.) কে চরিত্রহীন, শিশু ধর্ষণকারী হিসাবে জানে। এ বিষয়ে প্রথম যুগের ইসলামী আইনবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ কোন আলোচনা করেন নাই।
সে কারণে আধুনিক আলেম সমাজ ও ইসলামী বিশেষজ্ঞগণও এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ কোন আলোচনা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা সাধারন মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন নাই। ফলে নাস্তিক মুরতাদরা এক তরফা ডুগডুগি বাজানোর সুযোগ পেয়েছে। এ বিষয়ে একটি তথ্য নির্ভর বস্তুনিষ্ঠ জবাব সকল মুসলমানের নিকট থাকা উচিৎ। প্রাথমিক যুগের ইসলামী আইনবিদ, ঐতিহাসিক এবং রসুলুল্লাহ (দ.) এর জীবনী রচয়িতাগণের আলোচনায় দেখা যায় রসুলুল্লাহ (দ.) এর আপন ফুফাতো ভগ্নি যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.), যাকে তিনি তার পালিত পুত্র যায়িদ বিন হারেছা (রা.) এর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। পরে যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) (যায়িদ বিন হারেছা (রা.)) কে স্বামী হিসাবে মেনে না নেয়ায় যায়িদ বিন হারেছা (রা.)  তাকে তালাক দেন। পরে আল্লাহর হুকুমে রসুলুল্লাহ (দ.) যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) কে বিবাহ করেন। পালিত ছেলের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন সেই ধুয়া তুলে রসুলুল্লাহ (দ.) এর চরিত্র হননের ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায় তৎকালীন মুনাফিক ও ইসলামের শত্রুরা। একটি যুদ্ধে আয়েশা (রা.)  রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আয়েশা (রা.) উটের পিঠে স্থাপিত হাউদাজ ছেড়ে দূরে চলে যান। ইতিমধ্যে যোদ্ধা দলের কাফেলা রসুলুল্লাহ (দ.) সহ চলতে শুরু করে। আয়েশা (রা.) সেখানে এসে কাউকে না পেয়ে দুঃখ ভরা মন নিয়ে শরীর চাদরে ঢেকে বসে থাকেন। সৈন্যদলের কোন কিছু নেয়া বাদ পড়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়ে আয়েশা (রা.) কে দেখতে পান এবং তিনি নিজের উটের পিঠে তাকে উঠায়ে নিয়ে মদিনায় ফেরেন। ঘটনাটিকে নিয়ে মুনাফিকগণ আয়েশা (রা.) এর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে রসুলুল্লাহ (দ.) এর মনে কষ্ট দিতে থাকে। পরে হযরত আয়েশার (রা.) নির্দোষ হবার ব্যাপারে সুরা আন নুরের ২৩ নং আয়াত নাজিল হয়। এই আয়াতে আয়েশা (রা.) কে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। মিথ্যা অপবাদ দান কারীদের কোরআনের বিধানের নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.) কে রসুলুল্লাহ (দ.) যদি মাত্র ছয় বছর বয়সে বিবাহ করে থাকেন তাহলে সে যুগে কেন বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচার হল না ? অপপ্রচারটি শুরু হল রসুলুল্লাহ (দ.) এর ইন্তিকালের চৌদ্দ কিংবা পনের শত বৎসর পর। মনে হচ্ছে যেন আয়েশার (রা.) দরদে এদের কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রসুলুল্লাহ (দ.) ঠিক কত বছর বয়সে আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করেছেন নির্ভরযোগ্য হাদিছ গ্রন্থ বা তাবকাত ও রসুলুল্লাহ (দ.) সীরাত বা জীবনী রচয়িতা ইতিহাসবিদ এবং হাদিস বিশারদদের  সন্নিবেশিত একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যসমূহের মধ্যে একটি তথ্যমতে আয়েশা (রা)কে রসুলুল্লাহ (দ.) ছয় বছর বয়সে বিবাহ করেন। আর দৈহিক মিলন করেন নয় বছর বয়সে। যদি এই তথ্যটিকে সত্য বলে মেনে নেয়া যায় তাতে মুসলমানদের লজ্জিত হবার কোন কারন নাই। এর কারন মুসলমানদের ইসলামের জ্ঞান লাভের দুটি মূল উৎস আল কোরআন এবং আল হাদিস। হাদিস হচ্ছে রসুলুল্লাহ (দ.) এর বাণী,কর্ম এবং অনুমোদন। প্রায় সত্তরটির অধিক হাদিস গ্রন্থের নাম আমরা জানতে পেরেছি। সবগ্রন্থে বর্ণনাকারী গণের নাম বাদ দিলে এবং শুধুমাত্র হাদিস  অংশগুলো হিসেব করলে তা দশ হাজার অতিক্রম করে না। সিহাহ সিত্তাহ এবং মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থগুলির হাদিসগুলিকে বিষয়ভিত্তিক আলাদা করলে দেখা যাবে হাদিসের সংখ্যা আট হাজারের নীচে। ঐ হাদিসগুলির মধ্যে বিরাট সংখ্যক হাদিসের বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রা.)। তার পরের স্থান হযরত আয়েশা (রা.)।  হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিস সংখ্যা পাঁচ হাজার তিনশত চুয়াত্তর।  হযরত আয়েশা (রা.)  বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশত দশ। আর একটি বর্ণনামতে চার হাজারের কিছু বেশী। যাহোক  আয়েশা (রা.) কে যদি রসুলুল্লাহ বিবাহ না করতেন তাহলে কমপক্ষে দুই হাজার দুইশত দশটি  হাদিস থেকে মুসলমানরা বঞ্চিত হত। আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে রসুলুল্লাহ (দ.) এর সংসারে আরো নয়জন স্ত্রী একইসাথে বিদ্যমান ছিল।  কিন্তু অন্য নয় জনের মধ্যে উম্মে সালমা (রা.) ছাড়া বাকি অন্যান্য উম্মুল মুমীনীনগণের মাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) একাধারে হাদিস বর্ণনাকারী এবং ফকীহা অর্থাৎ ইসলামী আইন বেত্তাও ছিলেন।  অনেক বড়  বড় হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী ফিকহি মাসআলার সমাধান দানের ক্ষেত্রে তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেন নাই। আয়েশা (রা) এর যদি ছয় বছর বয়সে ৪৫ বা ৫০ বৎসর বয়সী মহানবী (দ.) এর সাথে বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে ঐ বিবাহ দ্বারা আয়েশা (রা.) কি হারিয়েছেন? তিনি হারিয়েছেন ১৮ বৎসর বয়স থেকে পরবর্তী ৩২ বৎসর এর যৌন চাহিদা পূরণের মধুময় সময়। (চলবে)

Monday, February 18, 2019

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ-১


-এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান
ভূমিকা : কোন ছেলে বা মেয়ের ঠিক কত বছর বয়সে বিয়ে হওয়া উচিৎ সে বিষয়টি আধুনিক বিশ্বের মানব সমাজের একটি নতুন ভাবনা। ভারতীয় উপমহাদেশের সকল ধর্মের ছেলে মেয়েদের বয়স নির্ধারণ করে তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৯২৯ সালে “পযরষফ সধৎৎরধমব ধপঃ”(১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন) প্রবর্তন করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ ই আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারতীয় ডমিনিয়ন নামে বিভক্ত করে স্বাধীনতা দেয়া হয়। পাকিস্তানের অংশ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বর্তমানের বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আইনটি বলবৎ ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই সালের ১৬ই ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নেয়। ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান জাতীয় পরিষদে পাশ হয়। ঐ সংবিধানে ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইনটিকে পূণরায় কার্যকরিতা দেয়া হয়। আইনটি কার্যকর থাকার পরেও বাংলাদেশের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে আইনটি মানা হচ্ছে কি না তার কোন কড়াকড়ি ছিল না। ২০১৭ সালের ২৪ শে নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটিকে বিলুপ্ত করে “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭” অনুমোদিত হয়। আইনটি তৎপূর্বে ২০১৭ সালের ৬ নং আইন হিসাবে ১১-০৩-২০১৭ ইং তারিখে জনসাধারনের জ্ঞাতার্থে গেজেট আকারে আইনটির খসড়া প্রকাশ করা হয়। নতুন আইনটির বৈশিষ্ট হলো পূর্বে বলবৎ থাকা ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ছেলেদের বিবাহের বয়স ছিল ২২ বছর এবং মেয়েদের বয়স ছিল ১৮ বছর।

 বর্তমান আইনে মেয়েদের বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং ছেলেদের বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন ২২ এর স্থলে ২১ বছর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে আরেকটি বৈশিষ্ট হলো আইনটির ১৯ ধারায় বলা হয়েছে যে “এই আইনে অন্যান্য বিধানে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন বিধি দ্বারা নির্ধারিত বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতামাতা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবেনা।

নতুন “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭” বাংলাদেশে বলবৎ হওয়ার ফলে ইসলামী আইনে বাল্যবিবাহ আইনের সাথে বর্তমান আইনের অসংগতি দূরীভূত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও ১৯৭১ সাল  পর্যন্ত ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনসহ বৃটিশ সরকারের প্রবর্তিত কোন আইনকেই ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্য করে সংশোধন করা হয়নি। যা গোটা পাকিস্তানের ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় সংসদ নতুন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাশ করায় এবং আইনটি ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্য হওয়ায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আনন্দিত। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর মত দেশে প্রচলিত আইন গুলিকেও ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করা হবে।
বাল্যবিবাহ বলতে কি বুঝায় : 
বাল্য বিবাহ সাধারণতঃ দুই প্রকার। এক.সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় নাই এমন একটি কন্যা শিশুকে অভিভাবক কর্তৃক বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বা তদুর্ধ্ব বয়সের কারো সাথে বিবাহ দেয়া। দুই. ছেলে বা মেয়ে উভয়ের মধ্যে বিবাহের বয়সে পৌছার আগে বা সাবালকত্ব লাভের পূর্বে উভয় পক্ষের অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ দেয়া।
ইসলামী আইনে বাল্য বিবাহ : ইসলামী আইন বিশেষেজ্ঞ (ফকিহ)গণ নাবালক নাবালিকা ছেলেমেয়েদের উল্লেখিত দু ধরনের পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়ার বিষয়ে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে ফতোয়া প্রদান করেছেন। একদল সাধারণভাবে বাল্যবিবাহ নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হনিফা (র.) এর সমসাময়িক ইরাকী ফকিহ (ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ) ইমাম ইবনে শুবরুমা এবং কাজি আকুবকর আল আছাম। যে সমস্ত ফকিহ বাল্যবিবাহ সম্পাদন নিষিদ্ধ করার পক্ষে তাদের শরয়ী দলিল হলো কুরআন মজিদের সুরা আন নিসার ৬ নং আয়াতের প্রথম অংশ। “ওবতালুল ইয়াতামা হাত্তা ইযা বালাগুন্নিকাহা” অর্থাৎ তোমরা এতিমদের কে পরীক্ষা করতে থাক যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে যায়। আয়াতংশটি আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অভাবে দাদা বা বিকল্প অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে থাকা সম্পদ এতিমদের দায়িত্বে কখন প্রত্যার্পণ করা যাবে সে বিষয়ে নাজিল হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ হলো এতিমরা বিবাহের বয়সে না পৌছা পর্যন্ত তাদেরকে সম্পত্তির দেখা শোনার দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না। উদ্ধৃত আয়াতাংশটিতে ছেলে মেয়েদের  বিবাহের জন্য একটি বয়স নির্ধারিত আছে মর্মে বুঝা যায়। আর সেটা হলো বুলুগ বা সাবালকত্ব। ছেলেরা যখন এমন বয়সে উপনীত হয় যে সময়ে তাদের ইহ্তিলাম বা স্বপ্নদোষ হয়। এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে যখন তাদের মাসিক হায়িয বা মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়। ইসলামী শরিয়তে সেটাই হলো ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়স। এই ধারার ফকিহগণের আর একটি যুক্তি হলো আরবী নিকাহ্ (বিবাহ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো যৌনমিলন শব্দটি নিয়ে। যেহেতু বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈধ যৌন মিলন। একজন নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে  বা একজন সাবালক বা সাবালিকার সাথে আরেকজন নাবালিকা বা নাবালকের মধ্যে বিবাহ সম্পাদন করা হলে বিবাহের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। ফলে বিবাহটি  গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। নাবালক ও নাবলিকার বিবাহ সম্পাদন করা গেলেও তারা সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাদের উপর শরয়ী আইন প্রয়োগ করা যায় না। সে কারণে এ ধরনের বিয়ে অপ্রয়োজনীয় বা পরিত্যক্ত।
উল্লিখিত মতামতটির বিপরীতে ফকিহগণের অধিকাংশের ফতোয়া বা মতামত হলো নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে বা কোন নাবালিকা মেয়ের সাথে যে কোন বয়সের সাবালক পুরুষের সাথে সম্পূর্ণরুপে জায়েজ বা বৈধ। এ মতটির সাথে যেসব ইসলামী আইনবিদ ঐক্যমত পোষণ করেছেন তারা হলেন ইমাম আবু হানিফা (র.), ইমাম শাফেয়ী (র.), ইমাম মালিক বিন আনাস (র.), ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (র.) এবং তাদের অনুসারী পরবর্তী যুগের ইসলামী আইনবিদগণ। শীয়াহ্ বা জাফরী ফিকহের অনুসারীগণও এ মতের সাথে ঐক্যমত পোষন করেন। এই ধারার ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদগণের অভিমত হলো ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক নাবালক ছেলেমেয়েদের বিবাহ তাদের পক্ষে অভিভাবকগণ সম্পাদন করতে পারেন। ইসলামী শরীয়তে এধরনের বিবাহ সম্পূর্ণরুপে জায়েজ মর্মে তারা মত দিয়েছেন।
তাদের এ মতের স্বপক্ষে তারা পবিত্র কুরআনের সুরা আত তালাকের ৪ নং আয়াত এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণের কতিপয় আসার (কর্মধারা বা আমল) দলিল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সুরা আত তালাকের ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন“ওল্লায়ী ইয়াইস্না মিনাল মাহিদ্বি মিন নিসায়ীকুম ইনির তাবতুম ফাইদ্দাতুহুন্না ছালাছাতা আশহুরিন ওল্লায়ী লামইয়া হিদ্বনা” অর্থাৎ যেসব স্ত্রীলোকের মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে তোমাদের যদি সন্দেহ হয় (জেনে নাও) তাদের ইদ্দতকাল হলো তিন মাস(পরবর্তী বিবাহের জন্য বা স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য)। আর  যাদের মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়নি তাদের জন্যও একই নির্দেশ। যেসব আসার (কর্মধারা) এ মতের স্বপক্ষে পেশ করা হয়েছে তা হলো এক.কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) যুবাইর (রা.) এর সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। বিবাহের পর কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) ঘোষনা দেন যে তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে যুবাইর (রা.) এর উক্ত কন্যা তাহার ত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিশ বা মালিক হবে। দুই.হযরত ওমর (রা.) তার এক নাবালিকা কন্যার সাথেসাবালক ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) এর বিবাহ দেন। তিন. ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) তার এক ভাইয়ের তরফের নাবালক পুত্রের সাথে অপর এক ভাইয়ের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন। চার.এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান (র.) এর সাথে তার নাবালিকা কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেয়। তিনি ঐ প্রস্তাব জায়েজ হিসাবে গ্রহনপূর্বক উক্ত নাবালিকাকে গ্রহন করেন। পাঁচ.আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সাথে একজন মহিলা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঐ মহিলার প্রথম স্বামীর তরফের নাবালিকা কন্যার সাথে সাবালক মুসাইব ইবনে নাখবার সাথে বিবাহ দেন। আব্দুলল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বিবাহটিকে জায়েজ বা বৈধ ঘোষনা করেন। উল্লেখিত দুটি ধারার ফকিহগণের মতামত পর্য়ালোচনার পর দ্বিতীয় ধারার ফকিহগণের মতামত শরয়ী দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী।
রসুলুল্লাহ (দ.) মুসলীম উম্মাহকে তাদের ছেলেমেয়েদের যৌবনকালে বিবাহ দেয়ার বা করার বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রসুলুল্লাহ (দ.)  এর সাথে একটি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রসুলুল্লাহ (দ.) জাবেরকে জিজ্ঞেস করলেন যে তুমি কি বিবাহ করেছ? জাবের (রা.) বলেন যে আমি বললাম হ্যা। রসুলুল্লাহ (দ.) জিজ্ঞেস করলেন তোমার স্ত্রী কি কুমারী না পূর্ব বিবাহিতা? জাবের (রা.) উত্তর দিলেন পূর্ব বিবাহিতা। রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন তুমি কেন একজন কুমারী যুবতী মেয়েকে বিয়ে করলে না। যার সাথে তুমি আনন্দ উপভোগ করতে এবং সেও তোমার সাথে আনন্দ উপভোগ করত। (সুনানে আবু দাউদ,হাদিস নং ২০৪৪)। কুমারী যুবতীদের সাথে যুবকদের বিয়ে হোক নবী করিম (দ.) সেটাই পছন্দ করতেন।
জাবের (রা.) এর পিতা হযরত আব্দুলল্লাহ (রা.) উহুদের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। ঐ সময়ে জাবের (রা.) অবিবাহিত যুবক ছিলেন। তার ৭ জন অবিবাহিতা ভগ্নি ছিল। তাদের দেখাশোনার জন্য জাবের (রা.) একজন বয়স্কা পূর্ববিবাহিতা মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। এ বিষয়ে রসুলুলল্লাহ (দ.) আরো বলেন পূর্বে বিবাহ হয়নি এমন মেয়ে বিয়ে করাই তোমাদের জন্য উচিত হবে কেননা তারা মিষ্টি মুখের অধিকারী ও নির্মল জরায়ুধারী এবং অল্পে তুষ্ট চিত্তের হয়ে থাকে। (সুনানে ইবনে মাযাহ,হাদিছ নং ১৮৬১)। আরেকটি হাদিসে দেখা যায় রসুলুলল্লাহ (দ.) তার উম্মতের যুবকদেরকে পূর্বে বিবাহ হয়নি এমন সুন্দরী ধর্মপরায়ণা যুবতী স্ত্রী গ্রহণে উৎসাহ দিতেন। (যাদুল মায়াদ, ৩য় খন্ড)।
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব : 
ইসলামে সাধারণভাবে নাবালক ও নাবালিকাদের বিবাহ দেয়া বা করানো বৈধ বা জায়েয। কিন্তু এ ধরনের বাল্যবিবাহ সম্পাদন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কোনটিই নয়। সাবালক পুরুষদের বিবাহ করা কোন কোন ক্ষেত্রে ফরজ। আবার কোন ক্ষেত্রে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। সুরা আন্ নিসার ৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন“ফানকিহু মা ত্ববা লাকুম মিনান নিসায়ী” অর্থাৎ তোমরা বিবাহ কর মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে তোমার ভাল লাগে। বিবাহ করার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করীম (দ.) বলেন যে, হে যুবকদল তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। আর যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোজা রাখে। রোজা যৌন মিলনের ইচ্ছাকে দমন করে। সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৫২৯২। সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৪৬৯২। রসুলুল্লাহ (দ.) পুরুষদের যৌন মিলনের  ইচ্ছাকে দমন করার জন্য খাশি (াধংবপঃড়সু) হতে নিষেধ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (দ.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমরা রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের সাথে স্ত্রীরা থাকত না।
তাই আমরা রসুলুল্লাহ (দ.)কে বলতাম আমরা কি খাশি হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে খাশি হতে নিষেধ করলেন। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৫০৭১) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন তিনজন সাহাবীর একটি দল রসুলুল্লাহ (দ.) এর স্ত্রীদের নিকট আসলেন (এবং নবী করীম (দ.) এর স্ত্রীর নিকট তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন)। জিজ্ঞাসার জবাবে নবী করীম (দ.) এর ইবাদত সম্পর্কে তাদেরকে জানানো  হলে তারা (নবী দঃ) এর ইবাদতকে কম মনে করলেন এবং মন্তব্য করলেন যে আমাদের সাথে রসুলুল্লাহ (দ.) এর তুলনা হয় না। কারন তাঁর আগের এবং পরের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। তাদের একজন বলল আমি আমার বাকী জীবন সমস্ত রাত জুড়ে এবাদত করব। আর একজন বলল আমি সব সময় রোজা রাখব। আর একজন বলল আমি নারী সঙ্গ ত্যাগ করব (এধরনের কথোপ কথন চলা অবস্থায় রসুলুল্লাহ (দ.) তাদের মাঝে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তোমরাই কি তারা যারা এসব কথা বলেছ ?)। (তারা হ্যা বললে) রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন আল্লাহর শপথ আমি তোমাদের থেকে অনেক বেশী আলল্লাহকে ভয় করি এবং তোমাদের থেকে আল্লাহর প্রতি বেশী অনুগত।
আমি রোজা রাখি (নফল) আবার তা থেকে বিরতও থাকি। নামাজ (নফল) আদায় করি। আবার ঘুমিয়ে পড়ি এবং আমি মেয়েদেরকে বিবাহ করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ ভাব পোষণ করবে সে আমার উম্মাত (দলভুক্ত) নয়। সহীহ বুখারী হাদিস নং ৫০৬৩, সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১৪০১। এই হাদীসে রসুলুল্লাহ (দ.) বিবাহ করাকে অবশ্য পালনীয় সুন্নাত হিসাবে ঘোষনা করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও  সুন্নাতটি পালন না করলে উম্মতে মুহাম্মদী হিসাবে গণ্য হবে না মর্মেও ঘোষণা করেছেন। বিবাহ করার বিষয়ে সমস্ত তাগিদ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর নারীদের প্রতি দেয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহ ফরজ বা সুন্নাত এই মর্মে কোন ঘোষনা কুরআন মজীদ কিংবা হাদীসে রসুলে বর্ণিত হয়নি। কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের মুসলমানরা যদি সম্পূর্ণরুপে বাল্যবিবাহ সম্পাদন থেকে বিরত থাকে তাতে গোনাহ হবে বা ইসলামী শরীয়া লংঘন হবে এমন কোন কথাও কোরআন হাদীসে বর্ণিত হয় নাই।
ইসলামী আইনে বিবাহ কোন পবিত্র বন্ধন বা sacrament নয় বরং ইসলামী আইনে বিবাহ এক ধরনের সোস্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক, পারিবারিক চুক্তি মাত্র। এ বিবাহ চুক্তির অধীনে কোন সমাজের দুজন নারী এবং পুরুষ একত্রে বসবাস এবং সন্তান গ্রহন ও পরষ্পরের উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য শরীয়তের বিধান মোতাবেক এ ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যা যে কোন সময় খন্ডনযোগ্য। (চলবে)

Tuesday, February 12, 2019

পশ্চিমা সাহিত্যে ধর্ম ও রসূল (স.) প্রসঙ্গ


আহমদ মনসুর :
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবনী রচিত হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন ও বিভিন্ন টেকনিক্যাল জ্ঞানের জন্য পশ্চিমা জ্ঞান - বিজ্ঞান মন্দিরে ধর্ণা দেই তখন আমাদের খেয়াল থাকে না যে, পশ্চিমা জগৎ আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। আমরা যখন সাহিত্যে নীতিবোধ বা ধর্মের উপস্থিতিকে সাহিত্য গুণের পরিপন্থী মনে করি তখন পশ্চিমা জগতের অনেক শীর্ষ স্থানীয় সাহিত্য- শিল্পী ধর্মকে সাহিত্যের কেন্দ্র শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সাহিত্য সম্ভার বিশ^কে উপহার দিয়ে থাকেন। তারা শুধু ধর্মের জয়গান গেয়েই থেমে থাকেন না বরং ইসলামের নবী প্রসঙ্গ নিয়ে সাহিত্য রচনা করে তৃপ্তি লাভ করে ধন্য হন। 
পশ্চিমা জগতের অনেকেই ধর্মাশ্রয়ী লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। যেমন, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক জুলিয়াস গ্রিণ। ১৯০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্যারিসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা মাতা ছিলেন আমেরিকান, কিন্তু গ্রিন জীবনের বেশির ভাগ সময় ফ্রান্সে কাটিয়েছেন এবং প্যারিসকেই তিনি নিজের শহর বলে মনে করেছেন। 
জুলিয়াস গ্রিন শতাব্দীর তিন -চতুর্থাংশ সময় জুড়ে এমন এক বিশাল সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন যার ব্যাপ্তি তলস্টয়-এর শিল্পকর্ম থেকে বিস্তৃত। টি, এস. ইলিয়ট, আন্দ্রেজিঁদ, ম্যালকম লাউরী, জর্জ অরওয়েল এবং রাইনের মারিয়া লিরকের মত বিশ্ব বিশ্রুত কবি সাহিত্যিকগণ গ্রিনের অনুরক্ত পাঠক।
 পারলৌকিক বিশ্বাস ছিল গ্রিনের জীবনের প্রধান অবলম্বন। আন্দ্রেজিঁদ ধর্মীয় গোড়ামীর অভিযোগ এনে গ্রিনকে প্রায়ই সমালোচনা করতেন। জিঁদের ধর্ম চেতনার সমালোচনা করে ম্যুরিয়াক লিখেছিলেন, তিনি শয়তানের পথ বেছে নিয়েছেন। এ মন্তব্যে গ্রিন মর্মাহত হয়ে তার জার্নালে লিখেছিলেন’। ‘অদৃষ্টের ব্যাপারে ম্যুরিয়াক কি জানেন? শেষ বিচারের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ।’
গ্রিনের চিন্তার মধ্যে ধর্মের প্রগাঢ়তা কত গভীর ছিল তা তাঁর কয়েকটি বাণী থেকে উপলদ্ধি করা সম্ভব। যেমন তিনি বলেন, Faith means walkink in water-  বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে পানির উপর দিয়ে হেটে চলা। তিনি আল্লাহর রহমতের উপর বেশি আশা করে লিখেছেন, Even I go down as far as Hell, God’s arm is long enough to pull me up again - এমনকি আমি যদি জাহান্নামে নেমে যাই, স্রাষ্টার হাত এত দীর্ঘ যে, তিনি আমাকে আবার টেনে তুলবেন। 
আল্লাহর পথে মৃত্যুকেই ধর্মের সার বিবেচনা করে গ্রিন লিখেছন : To be ready to die, for some one, you have never seen, whose Voice you have never heard that is the whole of Christianity-
তুমি যাকে কখনো দেখনি, যার কথা কখনো শোননি তাঁর জন্য মরতে প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে ধর্মের সার কথা। গ্রিনের এ কথার মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। 
গ্রিন যখন Christianity- এর জন্য মরণ বরণ করতে প্রস্তুত তখনই দেখতে পাই নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোকে ধর্মের মূল কথাকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করতে। পর্তুগালের দক্ষিণ অঞ্চলে ১৯২২ সনের ১৬ নভেম্বর এই ঔপন্যাসিক জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে সারামাগো নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বিতর্কিত উপন্যাস হচ্ছেThe Gospel according to Jesus Christ (1991)। এই উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন যে, অতি সাধারণ মানুষের ন্যায় আল্লাহ যীশু খৃষ্টকে বলেছেন যে, পৃথিবীতে তুমি একটি নতুন ধর্ম স্থাপন করবে কিংবা ঐ একই কথা, তোমার নামে তা স্থাপিত হবে। এবং হানাহানি অসহিষ্ণুতা হিংসা অর্থাৎ সব ধরনের অশ্রুরক্ত আত্মহুতির শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে ঐ ধর্ম। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র পৃথিবীর সব দুঃখ দুর্দশা, অবিচার অনাচারের জন্য দোষী করা হয় স্রাষ্টাকে। ফলে পর্তুগালের রাজনীতিকরা এই বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রি বন্ধ করে দেন এবং European literary award for fiction এ এই বইয়ের নাম পাঠান থেকে বিরত থাকেন।
শুধু হোসে সারা মোগেই নন, এমন আরও দুই একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ধর্মের ব্যাপারে মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে তুলতে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। ২০০১ সালে  নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ভি. এস. নাইপল এ বিষয়ে কম পিছিয়ে নেই। তাঁর বিখ্যাত বই ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ইসলামের কাছে নিজকে সঁপে দেয়ার মানে চরম নির্বুদ্ধিতা ’। তিনি নিজের শেকড়ের প্রতি অনুরক্ত থেকে লেগেছেন ইসলামের পেছনে। তিনি আবিস্কার করেছেন তৃতীয় বিশে^র অপরাপর সমস্যার চেয়ে বড় আপদ হচ্ছে ইসলাম। নাইপল উক্ত বইয়ে লেখেন, “পশ্চিম হচ্ছে জ্ঞান- বিজ্ঞান সমালোচনা, কারিগরী বিদ্যা, আর যাবতীয় হিতকর কেজো প্রতিষ্ঠানের আধার। আর ইসলাম হচ্ছে এর উপর ভয়ানকভাবে ক্ষিপ্ত আর নির্ভরশীল এক প্রতিবন্ধী, যে কিনা ক্রমশ নতুন আর অপ্রতিরোধ্য এক শক্তির অস্তিত্ব আঁচ করতে পারছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে কতই না ভালো জিনিস উপহার দিয়েছে। আর যারা ইসলামর কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিল তারা তা ভিতরের তাগিদ থেকে করেনি”। ইসলামের প্রতি এ ধরনের মন্তব্য নাইপলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় ব্যতিত কিছু নয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদ নাইপলের ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ এর সমালোচনা করে যে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন তা শান্তিকামী ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীর চিত্তের মানুষদের হৃদয়ে চিন্তার ঝড় তোলে। এডওয়ার্ড সাইদ বলেন, “বড় খেদের কথা হচ্ছে, ইসলামকে নিয়ে লেখা নাইপলের সর্বশেষ বইটিকে বৃহৎ একটি ধর্ম সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা বলে বিশ^াস করা হবে। এর ফলে আরো বেশি সংখ্যক মুসলমান দুর্ভোগ আর অপমানের শিকার হবেন। আর পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে তাদের ফারাকটা আরও বাড়বে ও গভীর হবে।”
ধর্মবোধ ও ইসলামকে যখন কোন কোন সাহিত্যিক এভাবে মানুষের জন্য বিকৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান তখন আমরা দেখি কিছু কিছু সাহিত্যসেবী এহেন বিভ্রম এড়িয়ে কর্পুরধর্মী মেধা বর্জিত রস সম্ভোগ পরিত্যাগ করে ধর্মের সশ্রদ্ধ অধ্যয়নে লিপ্ত হন। ধর্ম পাঠে যারা মেধা সমৃদ্ধ তারাই ধর্মীয় ভাবধারায় সাহিত্যের একটা নতুন যুগ গড়ে তোলার প্রয়াসে সন্ধানশীল। এ সব সন্ধানশীল সাহিত্যিকগণ রসুলের জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন সহিত্য সৌধের উঁচু মিনার। 
আলোচনা করা যাক এজরা পাউন্ডের কথা। মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তাঁর বিরাট কাব্যগ্রন্থ, একটি মাত্র কবিতায় তিনি লিখেছেন আজীবন, সেটা হচ্ছে Cantoes মানে অংশ। সে দীর্ঘ কবিতাটি বর্তমান কালের একটি জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিশ্রুতি। 
Thrones ক্যানটোজের একটি অধ্যায়। যেখানে তিনি একটি জায়গায় রসূলে খোদার উল্লেখ করে ইউরোপের লোকদেরকে বলেছেন, তোমরা তো সব সময় হাতই পাতলে এবং হাত পেতে কেবল গ্রাস করতে চাচ্ছ, গ্রহণ করতে চাচ্ছ, কিন্তু পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি অনবরত দানই করেছেন। তিনি মানুষের কাছে কোন কিছু চাননি। রসূলে খোদা সম্পর্কে এই অসাধারণ উক্তি - এ নিয়ে কেউ কখনো আলোচনা করে না। Thrones -এর মধ্য্যে এ উক্তিটি যে আছে তাও অনেকে জানে না। বলার এক মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হবে।(১) 
সুইডেনের মনীষী লেখক জি. ওয়াইডেন গ্রেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘পয়গম্বরের স্বর্গারোহন ও স্বর্গীয় গ্রন্থ নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, কয়েকজন পয়গম্বর তাঁদের নির্ধারিত কর্তব্য পালনের পর হয় একটি ঐশীগ্রন্থ কিংবা একটি ব্যবস্থাপত্র অথবা হজরত মুসার মতো কতগুলো বিধান- লিপি লাভ করেছেন। অবশ্য মুসলিম জাহানে রসূলুল্লাহর ‘মেরাজ’ -এর যে ভূমিকা, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর হার্টম্যান তাঁর এক গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন, রহস্যবাদী ও কবি, উভয় শ্রেণীর লেখকদের রচিত কতিপয় গ্রন্থের যে বিষয় বস্তু, তার আদর্শ হচ্ছে রসূলুল্লাহর এই ‘মেরাজ।’ প-িত বুসেট এই সমস্যাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচন্ করেছেন।(২)
পৃথিবীতে এমন কোন মানব নাই যাঁহার সাথে সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব রসূলুল্লাহর তুলনা হইতে পারে।
...উইনউড্ বলিয়াছেন, “মুহম্মদ (স.) অধিক করেন নাই বলিয়া দুঃখ না করিয়া আমাদের উচিত তিনি যে এত করিয়াছেন তাহার জন্য অবাক হওয়া। ইতিহাসের উপর ব্যক্তি বিশেষের প্রভাবের উদাহরণ হিসাবে তাঁহার জীবন হইল যোগ্যতম উদাহরণ। এই একক ব্যক্তি তাঁহার জাতিকে গৌরাবান্বিত করিয়াছেন, অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে তাঁহার ভাষা ব্যাপ্ত করিয়াছেন। বারো শত বৎসর পূর্বে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মুখে তিনি মানুষের কাছে যে বাণী প্রচার করিয়াছেন, আজ তাহাই লন্ডনে, প্যারিসে, বার্লিনে, মক্কায় -যেখানে তিনি কাজ করিয়াছেন, মদীনায়- যেখানে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন, কনস্ট্যান্টিনোপলে, কায়রোতে, ফেজে টিমবুকটুতে, জেরুজালেমে, দামেস্কে, বসরায়, বাগদাদে, বোখারায়, কাবুলে, কলিকাতায়, পিকিং-এ, মধ্য-এশিয়ার উচ্চ ভূমিতে, ভারতীয় দ্বীপ পুঞ্জের দ্বীপসমূহে, মানচিত্রে স্থান পায়নি এমন সব স্থানে, তৃষ্ণার্ত মরুর মরুদ্যানে, অজানা নদীর তীরবর্তী গন্ডগ্রামে, পন্ডিত অথবা অনুগামিগণ গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন।(৩) 
“রোমান্টিক যুগের কবি (১৭৯৪- ১৮৩২ গ্যেটে। রোমান্টিক যুগের কাজ হল এমন কোনো নতুন সূত্র বা তত্ত্ব বা শক্তির কিংবা তাদের নূতন কোনো সম্বন্ধ বিন্যাসের আবিষ্কার যার দ্বারা আবার ঐ ভেঙ্গে ছত্রাকার হয়ে যাওয়া জীবনকে কোন একটি মূল দ্যোতনা ও প্রবেগের মধ্যে গেঁথে নেওয়া যায়।
গ্যেটে যা সমাধান দিলেন তাকে বলা যায় বুদ্ধি মুক্তি বিশোধন, বিশ্বব্যাপী প্রসারণ। “গ্যেটে এই প্রকাশিত জগতের বস্তু প্রাণ- মনকে তার চেতনার দ্বারা আয়ত্ব বা উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। একটা অধ্যয়ন তত্ত্বের বুদ্ধিগত প্রতিফলন ছিল তাঁর চেতনায়, যা ফুটে উঠেছিল তাঁর ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক এক অপূর্ব কবিতায়। গ্যেটে এই কবিতায় রসুলুল্লাহর জীবনকে একটি নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে নদী অন্য মস্ত উপনদী, প্রবাহ ইত্যাদির জলধারা বহন করে সমুদ্র বক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। 
রসূলুল্লাহর মহৎ ব্যক্তিত্বের কালজয়ী স্তুতিবাদ ধ্বণিত হয়েছে তার ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক কবিতায়। কবিতাটির শুরু ছিল নিম্নরূপ : 
প্রস্তরগাত্র থেকে প্রবাহমান
নির্ঝরটির দিকে তাকিয়ে দেখ। 
কী তার দীপ্তি, 
আসমানের নক্ষত্রপূঞ্জকে হার মানায়।
মেঘমালারও ঊর্ধ্ব দেশে
যে সহৃদয় ফেরেশতারা বিচরণ করেন 
তারাই লালন করেছেন,
গড়ে তুলেছেন 
এই প্রাণবন্ত শিশুকে 
পাহাড় চূড়াবলীর কঠোর অথচ দয়ার্দ পরিবেশে।” 
 ‘গ্যেটের উপরে কোরআনের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আমাদের লভ্য। তিনি এ মহাগ্রন্থের দ্বিতীয় সূরাতে ইসলামের অন্তর্নিহিত বাণীর সন্ধান লাভ করেন। এই কিতাব, “এতে সন্দেহের কোন আবকাশ নেই.” এ ধরনের বর্ণনা তাঁকে একান্তভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন: এভাবে সুরার পর সুরা বিবৃত হয়ে চলেছে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে পরিষ্কার ভাষায় পৃথক করে দেখান হয়েছে। বিশ্বাসীর স্থান উঁচুতে আর অবিশ্বাসীদের স্থান নীচুতে। বেহেশত্ অপেক্ষা করছে বিশ্বাসীর জন্যে, আর দোযখ অবিশ্বাসীর জন্যে। এই পবিত্র গ্রন্থের বিশাল বক্ষে রয়েছে বিধিসিদ্ধ এবং অবিধেয় বস্তু ও বিষয়াবলী সম্বন্ধে বিস্তৃত নির্দেশ, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যাশ্রিত পৌরাণিক কাহিনী সমষ্টি, ব্যাখ্যা, পুনরুক্তি, অন্তহীন অতিভাষণ - এমন কত কি! কিন্তু আপনি একবার অভিনিবেশ সহকারে এ-গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করলে আর ছাড়া পাবেন না। বারবার আপনি ত্যক্ত হয়ে এ বই তুলে রাখবেন, কিন্তু আবার নামিয়ে হাতে নিতে হবে। এমনি বিকর্ষণ ও আকর্ষণের মধ্য দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন যে আপনার অন্তর গভীর প্রশংসায় ভরে উঠছে এবং শেষতক্ ভক্তিতে নুয়ে পড়েছে। ... ইসলামী একেশ্বর বাদের প্রতি গ্যেটে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মতে “আল্লাহর এই নিরঙ্কুশ হাতিয়ার দিয়েই মুহাম্মদ (স.) বিশ্ব বিজয়ী হয়েছিলেন।”
গ্যেটের নিম্নোক্ত বাণী সুপ্রসিদ্ধ : 
“ইসলামের অর্থ যদি হয় আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ, তবে আমরা সকলেই ইসলামী নীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকি এবং ইসলামী নীতি অনুযায়ীই মৃত্যুবরণ করি।”(৪) 
গ্যেটের সমসাময়িক বিলাতের বিখ্যাত কবি উইলিয়ম ব্লেক ( ১৭৫৭- ১৮২৭)। কবি ধর্মের বিজয় বার্তা প্রচার করতে চেয়েছেন। কবি লিখলেন:
Bring me my bow of burning gold! 
Bring me my arrows of desire! 
Bring me my spear! oh clouds unfold!
Bring me my chariot of fire!
I will not erase from mental flight. 
কবি তাঁর এ লেখার মধ্য দিয়ে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যতদিন না ইংল্যাণ্ডের ভূমিতে পবিত্র জেরুজারেনমের অবস্থান তথা ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়বে না আর হৃদয়ের বাসনা থাকবে জাগরুক। 
 উইলিয়ম ব্লেক একজন অতীয়ন্দ্রবাদী বিশ্বাসী কবি ছিলেন। কবি তার প্রভাব বিস্তার করেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ জাতীয়তাবাদী কবি উইলিযম বাটলার ইয়েটস-এর উপর। ইয়েটস এ সত্য স্বীকার করে বলেছেন, ব্লেকের প্রফেটিক বই আমার মনোরাজ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ইয়েটস ছিলেন অলৌকিকতায় বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিক জড়বাদ বিরোধী অপ্রাকৃত ও থিওসফিতে আকৃষ্ট কবি। ইয়েটস সন্ধান করেছেন চিরন্তনকে, যা তাঁর ‘সেইলিং টু বাইজেন্টাইন’ (Sailing to Byzantium) কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। 
কবি সত্তা ব্যক্তিত্ব নিরালম্ব বস্তু নয়, অর্থাৎ দেশ ও কাল গত পরিবেশ নিরপেক্ষ নয়। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা তাদের পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু অন্তরের সুর স্থান কালের সীমারেখা না মেনে সব দেশে সবকালে একই রকম বেজে উঠেছে। তাই সাহিত্যে ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন সব দেশে সব কালে কম বেশি ছিল, আজও আছে। কিন্তু সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারায় যারা সাহিত্য থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শুধু রসের চর্চায় মেতে থাকতে চান তারা অন্তরের ডাক শোনেন না বা শোনলেও বুঝতে অক্ষম। আজ বাংলা সাহিত্যে যারা অন্তরের বেজে ওঠা সুরকে বধিরতার ভনিতায় শুনতে না রাজ তাদের উচিত পাশ্চাত্য সাহিত্যের আঙ্গিনায় হাজির হয়ে গ্যেটে, ব্লেক, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, ইয়েটস প্রমুখদের সাথে তাল মিলিয়ে সাহিত্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
তথ্যসূত্র :
(১) সাহিত্য ও বিশ্বাস-সৈয়দ আলী আহসান 
(২) ড.এ্যানমেরী শিমেল-তারী
(৩) নতুন আলোকে ইকবালের চিন্তাধারা - লেঃ কর্ণেল কে . এ রশীদ
(৪) ইকবাল ও গ্যেটে-মুমতাজ হাসান। 

Monday, January 21, 2019

পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আগ্রাসন : আমাদের করণীয়


খুরশীদ আলম বাবু : বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার এখন সত্যিই দুঃসময়ের মুখোমুখি। পশ্চিমবঙ্গের বাজারী লেখকদের বাজার দখলের প্রাণান্তর প্রচেষ্টার সাথে এ দেশীয় এক শ্রেণির প্রকাশকদের সহযোগিতা রীতিমত ভয়ংকর শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এর জন্য কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঢালাও ভাবে দোষারোপ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। প্রথমতঃ পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের গল্প উপন্যাস এদেশের সাধারণ পাঠক পড়তে আগ্রহী। আমার অনেকের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে, যারা এদেশের গল্প-ঔপন্যাসিকদের খুব একটা গুরুত্ব দেবার পক্ষপাতি নন; এমনকি হিসেবের মধ্যেও আনেন না। আবার এও সত্যিকার ভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তাঁদের প্রিয় লেখকদের মধ্যে অনেক ভালো ঔপন্যাসিক রয়েছে। এটাও আবার স্বীকার্য যে, আমাদের সাহিত্যের মানটাও আশানুরূপ ভালো না। দ্বিতীয়তঃ এখানে ভালো ও সৎ প্রকাশকের অভাব সব সময় ছিলো, উপরন্তু আমাদের সাহিত্য এখনও শিবিরে বিভক্ত। রাজনীতি এসে সর্বনাশ অনেক আগেই ঘটিয়েছিল; এখন সেটাই চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। এখন লেখকের পরিচয় নির্ধারিত হয় উনি বামপন্থী আর উনি মৌলবাদী। সেই সাথে রয়েছে আমাদের দূর্বল রাষ্ট্রনীতি। কারণ আমাদের দেশে সত্যিকার ভাবে এখন অবধি খাঁটি দেশপ্রেমিক সরকার আসেনি। আসলে হয়তো এই নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন হতো না। ভারত বিশাল শক্তিধর দেশ, তার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আমাদের রাজনীতিবীদরা নিজেদের মর্যাদা হারাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যে যে অসমতা দেখা দিয়েছে তার রীতিমত প্রভাবও আমাদের সাহিত্য বাজারে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তথাকথিত উদারবাদী বুদ্ধিজীবীরা এখনো প্রকাশ্যে বলেই বসেন- বইয়ের বিষয়ে-কোন রকম বাধা প্রদান করাটা ঠিক হবে না। কেন করেন? তাঁদের বদ উদ্দেশ্যের হাঁড়ির খবর আমাদের অজানা নেই। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় সামান্যতম একটি লেখা প্রকাশের সুযোগের কেল্লাফতে দান মারার কারণে নিজের দেশ প্রেমিকতাবোধ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাদের দেশপ্রীতির নজির আমাদের জানা আছে। আমাদের দেশে এই রকম বুদ্ধিজীবী কারা, নাম না বললেও খুব একটা বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না। মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও বই এখনো গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের বই আমদানী-রফতানী বাণিজ্যিক ঘাটতি এখনো অত্যন্ত বেশি। আত্মবিস্মৃতি জাতি হিসেবে আমরা আবার খ্যাতি উপার্জন করেছি, সেটা বারবার প্রমাণিত হয়। কবি জসিম উদদীন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরই আমাদের সর্ব প্রথম স্মরণ করিয়ে দেন, এই সমস্যাটির কথা। কারণ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের প্রকাশকদের চরিত্র সম্পর্কে জানতেন। আমাদের সচেতন করার জন্য লিখেছিলেন-
“পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমরা প্রতি বছর ৬০/৭০ লাখ টাকার বই-পুস্তক আনাইয়া থাকি। কিন্তু আমাদের লিখিত বই পশ্চিমবঙ্গে যাইতে পারে না। আমাদের এখানে কত টাকার বই আনিব তাহার অংক নির্দিষ্ট করা আছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গে তেমনটি নাই। প্রতিদান না হইলে সখ্য বেশি দিন টেকে না। একমুখী পথে যাওয়া আসা চলে তা না, ওদেশের ভালোবাসার যাহারা অন্তরঙ্গ করিতে চান তাহারা যেন এই কথাটি ভালো করে ভাবিয়া দেখেন।” 
আমার  দেশের প্রচলিত আইনকে লংঘন করে তারা এই সমস্ত গল্প-উপন্যাস ক্রমাগত ছাপিয়ে চলেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে কবি জসীম উদদীন যখন এই নিবন্ধটি সৃজন করেন তখন সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে, আর সেই সমস্যা আজকে বিশাল থেকে বিশালাকার ধারণ করেছে। আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাসের পাঠক আমাদের দেশে অনেক রয়েছে। অনেকে বলেন পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি আছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা চর্চা করার লোকজনেরই অভাব ক্রমশ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তারই আভাসই পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক আশোক মিত্রের ভাষ্যে। আমি তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। -
“কে জানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চৌহদ্দির মধ্যে হয়তো বাংলা 
ভাষা তথা সাহিত্য আর তেমন বেশীদিন টিকবে না, কতিপয় পূর্ব লক্ষণ দেখে অন্তত : সেই রকম সন্দেহ হয়।”
আবার পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের কথা স্মরণে রেখেই বলেছেন,
“তাছাড়া একটু সংকোচ এর সাথে বলতেই হচ্ছে, রাজনৈতিক সীমান্তের ওপারে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত; এই প্রান্তে যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় ব্রত হবেন, তাদের কাছে এই সংকলনের(চতুরঙ্গ থেকে-১ম খণ্ড) মূল্য অপরিসীম।” (সম্পাদকীয় নিবেদন, চতুরঙ্গ থেকে-১ম খণ্ড)
অবশ্য এই মন্তব্যের মধ্যে কতখানি সত্যতা রয়েছে সেই সম্পর্কে আমার ঘোরতর সন্দেহ বিদ্যমান, কারণ আজকাল প্রায়শ; বাংলাদেশের পাঠককে তোষামোদ করার জন্য এই রকম কথাবার্তা প্রয়াত কবি ও কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও বলে থাকতেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে। আর এই কারণে তার সাহিত্যও সৃজিত হবে আলাদা ভাবধারায় এবং আলাদা আংগীকে। আমাদের দেশে সুনীল-শীর্ষেন্দুরা এলে যে মনোহর সংবর্ধনা পান; তার এক কণাও বাংলাদেশের কবিরা ও দেশে পান না। এটা পরীক্ষিত সত্য যে, আমাদের সাহিত্য তাঁদের  কাছে অপাংতেয় অষ্পৃশ্য। অবশ্য একশ্রেণির সমালোচকরা সেটা স্বীকার করতে নারাজ। কারণ তারা পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবধারার সাথে বরাবরই আমাদের সাহিত্যকে মেলাতে চান। আর সেখানেই বেধেছে যত মুশকিল। ইদানীং ভিসিডি ও চ্যানেলে হিন্দি ছবির মত পশ্চিমবঙ্গীয় কবি সাহিত্যিকদের লেখা গল্প উপন্যাস বাংলাদেশের বাজারে জোয়ারের মত ভাসতে শুরু করেছে। আর এর সাথে যোগ হয়েছে আমাদের দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সুলভ পাঠকদের উদাসীনতা। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের লেখকদের বই প্রায়শ অবিক্রিত অবস্থায় থাকছে। এই শ্রেণির পাঠকরা পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকদের নামে মূর্ছা যাবার উপক্রম হন। আমাদের অধিকাংশ তরুণ লেখকরা তাদের প্রভাবের দ্বারা প্রভাবান্বিত। 
আমি অবশ্য তাদের প্রভাবের বিষয়টিকে সমালোচনার নজরে দেখছি না, কারণ এটাই স্বাভাবিক। বাজারী লেখকদের সাফল্য দরুন নতুন লেখকরা প্রভাবিত হবেন। আমি অবশ্য এও মনে করি সুনীল-শীর্ষেন্দু এরা শক্তিমান কথা-সাহিত্যিক। তারা এখানেও পশ্চিমবঙ্গের মতন স্বীকৃত মর্যাদা পাচ্ছেন। তবে আপাতত আমার সমালোচনার জায়গাটি একটু অন্য জায়গায় রাখতে চাই। কারণ আমাদের পাঠকরা অমিয় ভূষণ মজুমদার, দেবেশ রায়ের বই কিংবা নাম কোনটাই শুনতে পারেন না। আসলে বাজারী উপন্যাসের ভিড়ে তাদের নাম হারিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। কারণ এই দুইজন লেখক আনন্দবাজার কিংবা যুগান্তর গোষ্ঠীর লেখক নন। ফলশ্রুতিতে আমাদের পাঠক গোষ্ঠীর কাছেও খুব বেশি পরিচিত নন। তাদের লেখা নিরলস কঠোর সাধনার মধ্যে দিয়েই এই সাফল্য উপার্জন করা সম্ভব। স্বীকার করি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু লেখক এই কাজটি নিপুণতার সাথে করছেন। তার মানে এই নয় যে, তাদের লেখার গতি-প্রকৃতি আমাদের দেশের লেখকদের আদর্শ হতে পারে। তাদের দেশেও এই ধরনের লেখক সত্যিকার ভাবে সমালোচনা যোগ্য। অকাল প্রয়াত প্রখ্যাত কথাশিল্পী দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৭৫ সালে এক সাক্ষাতকার নেওয়া হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে অসামান্য কৌতুকর মন্তব্য করেছিলেন। সেই সাক্ষাতকারে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছিলেন, এমনকি শিল্প সাহিত্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট পার্টির সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। আবার পাশাপাশি সমরেশ বসুর বিবর এর প্রশংসাও করেছেন। শুধু তাই নয় বাজারী লেখকদের ‘ইয়েস স্যার’ এ কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেননি। এদের লেখক মানসিকতাকে কটাক্ষ করে তাঁর মূল্যবান মতামত ছিল এই রকম- 
‘সাহিত্যে বাজারটা প্রায় সিনেমা স্টারদের অবস্থায় পরিণত হয়েছে। ফিল্মস্টাররা যেমন তাদের বয়সের ভাবনায় ভাবিত থাকেন তেমনি আমাদের সাহিত্যকূলের একাংশ ভাবিত হলেন কি পরিমাণে উপস্থিতির প্রমাণ দিতে পারছেন। রচনায় মানের উপর নয়।’ দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য তুলে ধরলাম বলে কেউ যেন মনে না করে আমি এই মন্তব্য পুরোপুরি বিশ্বাস করে বসে আছি। সাহিত্যে উচ্চমানের সাহিত্যিকদের আগ্রাসন এমন নতুন কোন ঘটনা নয়। আরবের সাহিত্যিক আক্রমণ ইরানীরা অত্যন্ত সুকৌশলে রক্ষা করেছিল। বিগত শতাব্দীতে আইরিশ সাহিত্যের নবজাগরণ কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের বিরুদ্ধেই হয়েছিল, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের নেতৃত্বে। কারণ তারতো কোন সময় বার্নাডশোর  সাহিত্যকে আইরিশ সাহিত্য বলে মনে করেনি। অথচ আইরিশদেরও মাতৃভাষা ইংরেজি। আমি এই আন্দোলনের কথা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে সেই রীতি অবলম্বন করা দরকার। তবে আমরা সৌভাগ্যবান, বয়স ভাবনায় ভাবিত লেখকদের সংখ্যা কম হলেও পাঠকরা তাদের ধরতে পেরেছেন। তবে আমাদের দেশের প্রকাশকরাও কম দায়ী নয়। নতুন লেখকদের উৎসাহ দান করাটা তারা একেবারে ভুলে গিয়েছেন। কবিতার বই বের করতে হলে আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান ছাড়া যেন প্রকাশকদের কোন গত্যন্তর নেই। এই মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে মতি নন্দী ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত বড় বড় সাহিত্যিকরা বেরিয়ে এসেছিল। আমাদের দেশে প্রকাশকরা এই দায়িত্ব নিতে কি পারবেন? আর প্রকাশকরা এখন অবধি প্রচার বিমুখ পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে আছেন। প্রকাশকরা যদি বইয়ের প্রচার না করেন তাহলে সাধারণ পাঠকরা কিভাবে বইয়ের খবর জানবেন। লেখক লিখবেন আর প্রকাশক প্রকাশ করবেন কথাটা যতটায় সরলীকরণ হোকনা কেন-প্রমথ চৌধুরী যেমন মনে করতেন- ভালো বই খোঁজার অর্থই হলো খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মত।

সাম্প্রতিককালে আর একটি প্রচলতার যোগ হয়েছে সেটা হলো, দৈনিক পত্রিকার মালিকদের দ্বারা ঈদসংখ্যা বের করা, আমার জানামতে কেবলমাত্র নয়াদিগন্ত, প্রথম আলো এবং সাপ্তাহিক ২০০০ ছাড়া সমস্ত পত্রপত্রিকার প্রকাশকদের ধারা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের উপন্যাস-গল্প না হলে ঈদসংখ্যার মর্যাদাই থাকে না। লক্ষ্য করা গেছে যে পত্রিকা একসময় সবচেয়ে বেশি ভারত বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকায় একবার সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা গল্প-উপন্যাস বেরিয়েছে। আমার জানামতে সেই পত্রিকার কয়েকজন মনোযোগী পাঠক মৃদু অনুযোগও জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই পত্রিকার সম্পাদকের মতিগতির পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আনন্দবাজার গোষ্ঠীর দেশ পত্রিকার বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠীই কিন্তু আমাদের দেশেই অবস্থান করছে। সোজাসাপ্টা উত্তর হলো তাদের পত্রিকার ভূত ভবিষ্যৎ আমাদরে দেশের পাঠকদের উপরেই এখনো নির্ভর করছে। কারণটা স্বাভাবিক। আমরা যতটা সাহিত্য বিমুখ, তারা কিন্তু ততটা নয়। পার্থক্যটা সৃজিত হয়েছে এখানেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য উর্দুর পরেই সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচাইতে সমৃদ্ধশালী সাহিত্য। আমাদের মত দেশের পক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে সেই রকম সাহিত্য সৃজন করাটা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে তার সামনে নতজানু হওয়াটাও বেমানান। আর একটি বিষয় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সাহিত্যিক বাজার বাংলাদেশি পাঠকদের উপরেই নির্ভরশীল, তার প্রামাণিক তথ্য দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আনন্দ বাগচীর লিখিত নিবন্ধেই সরাসরি পাওয়া যাচ্ছে। ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে,
“বাঙালির উপর চাপ আসছিল নানা ভাবে। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের(১৯৬৫) পর বাংলা বইয়ের বাজার দ্বি-খণ্ডিত। বাংলা সাহিত্যে আদি পর্বে প্রথম পর্বের  প্রথম বলি হলো ছোটগল্প।” (ছোটগল্পের রূপান্তর) 
পৃথিবীর সব সাহিত্যের জনপ্রিয় বহুলপ্রজ লেখকরা পাঠকদের মনোরঞ্জনের দিকটিই লক্ষ্য করেই সাহিত্যচর্চা করে থাকেন। হিট লেখক ও ফ্লপ লেখক ইত্যাদি দুটি বিশেষণকে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রথমটি অর্জন করতে পারলে যেন ইহকাল ধন্য হবার মত দশা হয়। নোবেল বিজয়ী হাইনরিস বোলের কাছে আর্থিক মর্যাদার রহস্য উপন্যাস লেখক হেডলি চেজ অনেক উচ্চ অবস্থান করেন। আমাদের দেশের অনেক লেখকই রয়েছেন, বিষয় হিসেবে নারী ও প্রেমের বিশেষত কিশোর প্রেম ও যৌনতাকে পুঁজি করে সফল ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন। কোথায় কমিটমেন্ট, কোথায় সামাজিক চেতনা? এসব খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সমকালের ক্লাসিক লেখকদের সেটাই পরম আরাধ্য। আমাদের দেশে এই রকম লেখক যে নেই সেটা আমার বলার উদ্দেশ্য না। মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করা যায়। ইদানীং আল মাহমুদ বড় বেশি বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে, কি লিখছেন তিনিই নিজেই জানেন না। টি এস এলিয়ট বরাবরই মনে করতেন কেবলমাত্র দশটি উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ থেকে সমকালীনকে ধরে রাখা সম্ভব। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ের ‘চিহ্ন’ উপন্যাসদ্বয় পড়লে তৎকালীন সংঘময় পরিবেশকে বুঝতে সহায়তা করে। লেখকও যেমন বই প্রকাশ করতে বাধ্য নয়, তেমনি ভাবে পাঠকও সব বই পড়তে বাধ্য নয়। প্রমথ চৌধুরীর এই মন্তব্যের মত, আমিও মনে করি। পাশাপাশি  আমাদের ভাষারীতিকে ক্রমশ পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তরুণ সাহিত্যিনুবিসীদের কবিতার উপর দুর্দান্ত আসক্তি পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। কবিতার পাশাপাশি লেখাও প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে গদ্য। পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা বলছেন : তোমাদের কবিতা সুন্দর। কিন্তু উপন্যাস-গল্প ভালো নয়। অতএব আমাদের গদ্য পড়। তার মানে এই নয় যে, আমাদের দেশে কোন গদ্যশিল্পী নেই। রয়েছে। তবে যে দুঃখটি সর্বাগ্রে স্মরণ করলে আমাদের ব্যথিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না সেটি হলো এই যে, উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য পত্রিকার অভাব, যা দুএকটা প্রকাশিত হয় তাও ক্ষণজীবী। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরাও যে মুসলমান লেখক বিদ্বেষী তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর প্রতি দারুণ অবহেলা। এই বিদ্বেষ প্রবণতা কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের নজর এড়িয়ে যায় নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
হুমায়ূনের উপন্যাস দেশ শারদীয়াতে কয়েকবছর পর পর ছাপা হয়েছিল। বইও বেরিয়েছিল কলেজ স্ট্রিট থেকে। কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা তেমন উৎসাহিত হননি ওর সম্পর্কে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দুঃখিত হয়েছি। এখনও এই বাংলায় উপন্যাসে পাঠকরা মুসলমান না, রীতিনীতি বা ধর্মীয় আচার উপন্যাসে থাকলে রসগ্রহণে অনাসক্ত হয়ে পড়েন। আমার মতে এটাও এক ধরনের মৌলবাদ। (সমরেশ মজুমদার, ছদ্মবেশী সম্রাট, ভারত বিচিত্রা, আগস্ট ২০১২) 
কারণ আমাদের সাহিত্য জগৎ এখন অবধি নানা ভাবে বিভক্ত, যদিও বামধারা আগের মত শক্তিশালী অবস্থানে নেই। তবুও বেশির ভাগ জায়গায় যে পরিত্যাজ্য-করার নীতি কৌশলের বিষ বপন করে গেছেন। তার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। অতি বামপন্থী মনোভাব সম্পন্ন সাহিত্য সম্পাদক সর্বপ্রথমে যাচাই বাছাই করতে শুরু করেন, কে কোন পন্থী আর কে মৌলবাদী। এছাড়াও কর্পোরেট বাণিজ্যকে আশ্রয় করে নিয়েছেন সাহিত্যিকরা।
আমাদের দেশের সাহিত্যিকরা যে ভাবে এই সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তার চেঁচামেচি করে থাকেন, পৃথিবীর অন্য কোন জায়গায় এমনটি হয় না। আমাদের পার্শ¦বর্তী পশ্চিমবঙ্গে কট্টর বামবাদী কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক অনুষ্ঠানে বসে আলোচনা করতে পারেন, আমাদের এখানে এটা কল্পনা করা যায় না।
ঐতিহ্যপন্থীদের হাতে ভাল সাহিত্য সৃষ্টি হবে না, আমাদের দেশে বামপন্থীরা আগে ভাগেই ভেবে বসে থাকেন। হুমায়ুন কবীর ও বুদ্ধদেব বসু তাদের সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় ফররুখ আহমদ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা গল্প ছেপেছিলেন। কে কোন পন্থী তারা সেটা বিচার-বিবেচনার আওতায় আনেন নি। এসব করলে কি আমাদের হুমায়ুন কবীর ও বুদ্ধদেব বসু স্মৃতি সত্তার মধ্যে থাকতেন? মোটেও না। কাল তাদের সেই ভাবেই চিত্রিত করত। আমাদের সাহিত্য সম্পাদকদের হতে হবে উদার মানসিকতা সম্পন্ন। ভাল লেখা শুধু নয়, লেখক খোঁজার দায়িত্বও রয়েছে তাদের। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। তরুণ লেখকদের মধ্যে প্রতিভার পরিচয় পেলে তাকেই বেশি করে আশ্রয় প্রশয় দিতে হবে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে বসে আছি। আর সেই কারণে এখন দরকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তরতাজা, অজস্র সুফলপ্রসু সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ। আশা করি সেইদিন আর সুদূর পরাহত নয়। 

Saturday, January 19, 2019

মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থাকে না


আবুল আসাদ : সেই ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম শুনি যে, ধর্ম আসলে জ্ঞান, গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী। তারপর এই কথা নানাভাবে আরও অনেকের কাছে শুনেছি। লেখাপড়া যাদের মূর্খ বানিয়েছে, তারা সুযোগ পেলেই এখনও এসব কথা বলে থাকেন সুযোগ পেলেই। এদের রাগ ইসলামের উপরই বেশি। খ্রিস্টধর্ম প্রধানত পাশ্চাত্যের এবং হিন্দুধর্ম পশ্চিম থেকে আসা আর্যদের, তাই এসব ধর্ম তাদের কাছে প্রগতিশীল। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র বলে ইসলামকেও ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ ও অনুন্নয়নের প্রতীক বলে চলছে। ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই।  Prof. Joseph Hell বলেন, “মানব জাতির ইতিহাসে স্বীয় ছাপ মুদ্রিত করা সব ধর্মেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। .... কিন্তু ইসলাম যতটা দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্ব মানবের হৃদয় স্পর্শকারী মহা পরিবর্তন সাধন করেছে, জগতের অন্য কোন ধর্ম তা পারেনি।”১ এই কথায় আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ঐতিহাসিক O.J.Thatcher Ph. D Ges F.Schwill Ph. D তাদের ইতিহাস গ্রন্থে, “পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশ বছর তাঁর অনুগামিরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।২ আর Mayers তার Mediaeval and Modern History-তে বলেন, “সেখানে এমন এক সভ্যতার উত্থান ঘটে, দুনিয়া যা দেখেছে এমন সব কিছুকেই তা অতিক্রম করে যায়।”৩
সত্যই ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামন্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন সবদিক থেকেই মানব জাতিকে ইসলাম এক অনন্য সভ্যতা দান করে। পাশ্চাত্যের ওরা এখন গণতন্ত্রের সাংঘাতিক প্রবক্তা সেজেছেন। আর ইসলামকে বলা হচ্ছে মানবতা বিরোধী, অসহিষ্ণু ইত্যাদি। এসব কথা বলার সময় তারা অতীতের দিকে তাকায় না এবং নিজের চেহারার উপর একবারও নজর ফেলে না। যে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সে সভ্যতায় গণতন্ত্রতো দূরের কথা কোনপ্রকার সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের কোন স্থান নেই। অভ্যন্তরীণভাবে তাদের নীতি ছিল ‘সারভাইভেল অব দ্য ফিটেস্ট’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা অনুসারী ছিল ‘মাইট ইজ রাইট’ এর। গ্রীকরা বলতো ‘যারা গ্রীক নয় তারা গ্রীকদের ক্রীতদাস হবে এটা প্রকৃতির ইচ্ছা।’ আর রোমানরা মনে করতো, তারাই পৃথিবীর মালিক, পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের জন্যই। ইউরোপের এই অন্ধকার যুগে মানবাধিকার বলতে কোন ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। পরাজিত ও ভাগ্যাহতদের নিহত হওয়া অথবা চিরতরে দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হওয়াই ছিল ভবিতব্য। নারীদের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ অধিকার থাকা দূরের কথা তারা পূর্ণ মানুষ কিনা তাই নিয়ে ছিল বিতর্ক। শত্রু ও বাদী জাতীয় লোকদের কোন মানবিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এই দুঃসহ অন্ধকার হতে ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে, পৃথিবীকে নিয়ে আসে আইনের শাসনের আলোকে।
চৌদ্দশ বছর আগে ইসলাম ঘোষণা করে বংশ, বর্ণ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এই নীতি হিসেবে ইসলাম সব মানুষকেই আইনের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে রক্ষা করেছে যথেচ্ছার থেকে। শত্রু ও পরাজিত বন্দীদেরও ইসলাম মানুষ হিসেবে দেখতে বলে। কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের সাথে মানবতাসুলভ মেহমানসুলভ ব্যবহার করতে বলেছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বন্দীদের সুখাদ্য দিতে হবে, বন্দীদের উত্তাপ ও শৈত্য হতে রক্ষা করতে হবে, কোন কষ্ট অনুভব করলে তা দ্রুত দূর করতে হবে, বন্দীদের মধ্যে কোন মাতাকে তার সন্তান হতে, কোন আত্মীয়কে অন্য আত্মীয় হতে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের কাছ হতে জবরদস্তী কোন কাজ নেয়া যাবে না। যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এই নীতিমালা ইসলাম দেয় ১৪শ বছর আগে, পাশ্চাত্য এই শিক্ষা আংশিকভাবে গ্রহণ করে মাত্র ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব আকারে। ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর আগে বিধান দেয় যে, চিকিৎসা পুরোপুরি মানবীয় সেবা। চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কোন অনিষ্ট করা যাবে না। ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করেই মাত্র ১৮৬৪ সালে রেডক্রস গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সুযোগকে শত্রু মিত্র বিবেচনার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মানবতাবিরোধী দাস প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর আগে করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ইসলামে পুরুষের মতই নারীশিক্ষা বাধ্যতামূলক। ইসলামের এই শিক্ষার পরও ১১শ’ বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য নারীদের শিক্ষার উপযুক্ত ভাবেনি। অবশেষে ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা প্রথম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর নিজ নামে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় ১৮৪৮ সালে। অথচ ইসলাম নারীদের এ অধিকার দেয় চৌদ্দশ’ বছর আগে। পাশ্চাত্য যেখানে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের আগ পর্যন্ত বিজিত দেশের মানুষকে দাস মনে করতো এবং এখনও লুটতরাজের যোগ্য মনে করে, সেখানে ইসলাম বিজিত দেশের মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দেখে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোন নতুন ভূখন্ড মুসলমানদের দখলে এলে সেখানকার মানুষকে আর শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হতো না। মুক্ত মানুষ হিসেবে তাদের এ অধিকার দেয়া হতো যে, তারা একবছর সময়কালের মধ্যে যেন সিদ্ধান্ত নেয় যে. তারা পছন্দের কোন দেশে চলে যাবে, না মুসলিম দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করবে।
মানবতাকে ইসলাম সম্মান করে বলেই ইসলাম ও মুসলমানরা সহিষ্ণুতার প্রতীক। একটা উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত হতে জেরুজালেম দখল করে, তখন তারা ৭০ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। আর মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের হাত হতে জেরুজালেম উদ্ধার করে, তখন একজন খ্রিস্টানের গায়েও হাত দেয়া হয়নি। চৌদ্দশ’ বছর আগে ইসলাম যে বিচার ব্যবস্থা পত্তন করে, বিশ্ব সভ্যতায় তা অনন্য সংযোজন। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুরু থেকেই ইসলাম শাসন ব্যবস্থা হতে বিচার বিভাগকে আলাদা করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন, কিন্তু বিচারপতিরা শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হতেন না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে তারা সাধারণ আসামীদের মতই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখীন হতেন। অনেক মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাবে খলিফারা হেরেছেন। এবং এই হেরে যাওয়াকে তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।
মানবাধিকারের মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম বিশ্ব সভ্যতায় এক অনন্য কল্যাণ ধারার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিস্বার্থ সমূহের পদতলে সামষ্টিক স্বার্থ নিক্ষেপ হতো। ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থ ও সামষ্টিক স্বার্থ উভয়কেই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করে এবং উভয়ের মধ্যে কল্যাণকর এক ভারসাম্য বিধান করে। সমাজের একক ইউনিট হিসেবে ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারপর পরিচয় ও সহযোগিতার জন্য বংশ ও সামাজিকতাকে এবং শাসন ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করেছে। আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিতরণধর্মীতা ও পুঁজিগঠন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ইসলামে ম্যাক্রো অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো অর্থনীতি। ব্যক্তিগত বৈধ সম্পত্তির ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ ইসলাম করেনি, কিন্তু শর্ত দিয়েছে প্রতিবেশি কেউ যেন না খেয়ে না থাকে এবং সঞ্চয়ের বদলে সম্পদ যেন বিনিয়োগমুখী হয়। চৌদ্দশত বছর আগের ইসলামের এই অর্থনীতি আজকের আধুনিক অর্থনীতির চেয়েও আধুনিক ও কল্যাণকর।
সবশেষে আগে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের কথা। ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর ধর্ম বলেই জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে নতুন সাজে সজ্জিত করেছে। খ্রিষ্টীয় এগার শতক হতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে পাশ্চাত্য যেখানে ৩৫ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে অষ্টম শতক হতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত কাল ছিল মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মার্টন তাঁর পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও আবিষ্কার ইসলামের অবদানকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন।৪ তাঁর এই ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ-নিরবচ্ছিন্ন এই ৩৫০ বছর জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের চূড়ান্ত আধিপত্যের যুগ। এই সময় যেসব মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জারীর, খাওয়ারিজম, রাজী, মাসুদী, ওয়াফা, বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইয়াম এবং ওমর খৈয়াম। এই বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীকে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সে আলোতে স্নাত হচ্ছিল অন্ধকার ও ঘুমন্ত ইউরোপ। ইউরোপীয় ছাত্ররা তখন স্পেন ও বাগদাদের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালগুলিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের পদতলে বসে জ্ঞান আহরণ করছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই ইউরোপীয় ছাত্ররাই জ্ঞানের আলোক নিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফল হিসেবে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে ক্রিমোনার জেরার্ড, রজার বেকন এর মত বিজ্ঞানীদের নাম সামনে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মাটনের মতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশ’ পঞ্চাশ বছরের এ সময়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার সম্মানটা মুসলমানরা ও ইউরোপ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে নাসিরউদ্দীন তুসি, ইবনে রুশদ এবং ইবনে নাফিস এর মত বিজ্ঞানীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় গৌরবময় সূর্য অস্তমিত হয় এবং পাশ্চাত্যের কাছে হারতে শুরু করে মুসলমানরা। অবশ্য এর পরেও মুসলমানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চমক কখনও কখনও দেখা গেলেও (যেমন ১৪৩৭ সালে সমরখন্দে আমির তাইমুর পৌত্র উলুগ বেগের দরবার এবং ১৭২০ সালে মোগল স¤্রাটের দরবারে জীজ মোহাম্মদ শাহীর সংকলন) তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।
তবে বিজ্ঞানে ছয়শ’ বছরের যে মুসলিম অবদান তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং বিজ্ঞান রেনেসাঁর জনক। মুসলমানরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও জনক। ‘ইউরোপ যখন গির্জা ও মঠ ব্যতীত অপর সকল শিক্ষালয়ের কথা কল্পনাও করে নি, তার শত শত বছর আগে মুসলমানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, যেখানে হাজারো ছাত্র উন্নত পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতো।’৫ গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নও ইসলামি সভ্যতার অবদান। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল লাখো গ্রন্থে ঠাসা। ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর তখন ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক Dozy এর মতে স্পেনের আলমেরিয়ার ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অসংখ্য পুস্তিকা ছাড়া শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ।৬ এসব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারটি ছিল বিজ্ঞান চর্চা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির সুতিকাগৃহ।
বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের গৌরবজনক বিচরণ। গণিত শাস্ত্রে রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। আমরা যে ৯ পর্যন্ত নয়টি সংখ্যা ব্যবহার করি, তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। কিন্তু শূণ্য (Zero) এর বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা সর্বপ্রথম ‘শূণ্য’ আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে ইনিই সর্বপ্রথম দশমিক বিন্দু (decimal notation) ব্যবহার করেন। সংখ্যার স্থানীয় মান (value of position) তারই আবিষ্কার। বীজগণিত বা ‘এলজেব্রা’ মুসলমানদের সৃষ্টি। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল-জাবের এর নাম অনুসারে ‘এলজেব্রা’ নামকরণ হয়। শিঞ্জিনী (sine), সার্শ-জ্যা (tangent), প্রতি স্পর্শ ক্যক (co-tangent) প্রভৃতি আবিষ্কার করে বর্তুলাকার ক্রিকোণমিতির উন্নতি করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আলোক বিজ্ঞানে focus নির্ণয়, চশমা আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজানের কীর্তি। কিন্তু রজার বেকন এই আবিষ্কার পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কারক সেজেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘মানমন্দির’ (observatory) ব্যবহার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। এর আগে মানমন্দির সম্পর্কে কোন ধারণা কারও ছিল না। গণনা দ্বারা রাশিচক্রের কোণ (angle of the ecliptic), সমরাত্রি দিনের প্রাগয়ণ (pre-cission of the equinoxes), Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মস্ত্রকোর্দ্ধ নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু) প্রভৃতির উদ্ভাবন মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চিকিৎসার বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দান করেন।৭ ইউরোপে যখন খ্রিস্টান গির্জা ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা রোগের ব্যবস্থা নিতেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান মুসলমানদের হাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল রাজীর চিকিৎসা বিষয়ক ‘বিশ্বকোষ’ দশখন্ডে সমাপ্ত। এই চিকিৎসা বিশ্বকোষ ও ইবনে সিনা’র ব্যবস্থা ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা কেমিষ্ট্রির নামকরণই হয় মুসলিম বিজ্ঞানী ‘আল কেমী’র নামানুসারে। কেমিষ্ট্রি এর সুবাসার (Alcohol), কাঠ ভস্ম ক্ষারের ধাতার্বকমুল (potassium), পারদবিশেষ (corrosive sublimate), কার্ষকি (Nitrate of silver), যবক্ষার দ্রাবক (Nitric Acid), গন্ধব দ্রাবক (Sulphuric Acid), জুলাপ (Julep), অন্তসার (Elixer), কর্পুর (Caurphar) এবং সোনামুখী (senna) প্রভৃতি মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ভূগোল শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইউরোপ যখন মনে করতো পৃথিবী সমতল, তখন বাগদাদে গোলাকার পৃথিবীর পরিধি নির্ণিত হয়েছিল। চন্দ্র যে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, একথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা জানতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের কক্ষ নির্ধারণ করেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ কম্পাস যন্ত্র মুসলিম বিজ্ঞানীর আবিষ্কার। মুসলমানরা নকশার বৈচিত্র্য ও সৌন্দয এবং শিল্প কৌশলের পূর্ণতা বিধানে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, লৌহ, ইস্পাত প্রভৃতির কাজে তারা ছিল দক্ষ। বস্ত্র শিল্পে এখনো মুসলমানদের কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। উত্তম কাঁচ, কালী, মাটির পাত্র, নানা প্রকার উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুত করা সহ রং পাকা করার কৌশল ও চর্ম সংস্কারের বহুবিধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম কৌশলীরা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। তাদের এসব কাজ ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল। সিরাপ ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিত মুসলমানদের ছিল একাধিপত্য। মুসলমানদের কৃষি পদ্ধতি ছিল খুবই উন্নত। তারা স্পেনে যে কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করেন, ইউরোপের জন্য তা তখনও বিস্ময়। পানি সেচ পদ্ধতি তাদের উৎকৃষ্ট ছিল। মাটির গুণাগুণ বিচার করে তারা ফসল বপণ করতেন। সারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা জানতেন। ‘কলম’ করার ও নানা প্রকার ফল-ফুলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে তারা ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ।
বহু শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বাণিজ্য জগতের ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। নৌ যুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ছিলেন অতুলনীয় সমুদ্রচারী। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগার, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত সাগর ও চীন সাগরে এককভাবে চষে ফিরত। মুসলিম নাবিকদের ছাত্র হিসেবেই ইউরোপীয়রা গভীর সমুদ্রে প্রথম পদচারণা করে। ভন ক্রেমার বলেন, আরব নৌবহর ছিল বহু বিষয়ে খৃস্টানদের আদর্শ।’ মুসলমানদের যুদ্ধ পদ্ধতি ও যুদ্ধ বিদ্যাও ইউরোপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ইউরোপের Chivalry স্পেনীয় মুসলিম বাহিনীর অনুকরণ।
মোট কথা, বলা যায়, মুসলমান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় যে অবদান রাখেন, তা এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, বিশ্ব সভ্যতাকে করে নতুন এক রূপে রূপময় যা চিন্তা, চেতনা, আচার আচরণ, জীবন যাপন, জীবনাপোকরণ সব দিক দিয়েই আধুনিক। ১৩৫০ খৃস্টাব্দে সভ্যতার নতুন এই উত্থান যাত্রা থেমে না গেলে আরও কয়েকশ’ বছর আগেই বিশ্ব আধুনিক বিজ্ঞান যুগে প্রবেশ করতো। কিন্তু তা হয়নি। না হলেও তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকশ বছর পরে হলেও মুসলমানদের কাজ সম্পন্ন করেছে। ইসলামি সভ্যতাকে বাদ দিলে বা মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আর থাকে না, তার সভ্যতাও অন্ধকারে তলিয়ে যায়।
লিওনার্দো এজন্যই লিখেছেন, “আরবদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও মানসিক সমৃদ্ধি এবং অভ্রান্ত শিক্ষা প্রথা বিদ্যমান না থাকলে ইউরোপকে আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকতে হতো।”৯

রেফারেন্স :
১। S. Khuda Bakhsh. M.A. BCL. Bar-at-Law প্রণীত Arab civiliztion  গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৬
২। ‘A general History of Europe, Vol-1, Page-172
৩। Mayers, `Mediaeval and Modern History’ Page-54
৪। নোবেল বিজ্ঞানী আবদুস সালাম’-এর Ideas and Realities’ গ্রন্থে উদ্ধৃত (বাংলা অনুবাদ : ‘আদর্শ ও বাস্তবতা’, পৃষ্ঠা-২৬৮
৫। Mayers, `Mediaeval and Modern History’ Page-56
৬। Dozy, Spanish Islam’, Page-610
৭। Thateher, Ph. D and F.Schwill Ph.D, `A General History Europe’, Vol-1, Page 173
৮। Von Kremer  এই উক্তি S.Khuda Bakhsh  এর Arab civilization’ এর Page, 72
৯। Thateher, and F. Schwill, `A General History of Europe’, Vol-1, Page 174-188
Source: http://www.dailysangram.com

Popular Posts