Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts
Showing posts with label Dailysangram's Article. Show all posts

Wednesday, September 26, 2018

স্টিফেন হকিংসকে বিজ্ঞানী বলা যাবে না



আবু মহি মুসা : শুরুতেই একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, আমাদের এ সভ্যতার দর্শনের শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতক থেকে। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছে গ্রিক। যে কারণে গ্রিককে বলা হয় ‘মাদার অব ফিলোসফি।’ খ্রীস্টপূর্ব ৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়-কাল হচ্ছে ছাব্বিশ শত বছর। যেখনে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শত ভাগের কাছাকাছি, সেখানে এই ছাব্বিশ শত বছরে দর্শনের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। এই সময়ে মধ্যে আমরা  দার্শনিক কোনো বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাইনি। যেমন প্রেম, দেশপ্রেম,  মানবিক মূল্যবোধ, সততা, দর্শন, দর্শনের উৎপত্তি ইত্যাদি, কোন্ বিষয়ে আমরা ধারণা পেয়েছি?   
উল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত একটি বিষয় রয়েছে।  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বহু আলোচিত এবং আলোড়িত যে মতবাদ, তা হচ্ছে স্টিফেন হকিংসের ‘বিগ ব্যাং থিওরী।’ বিগ ব্যাং থিওরী সম্পর্কে আমি বলবো, it is bogus and absolutely bogus. Not only that Stepehen Halkings neither philosopher, nor Scientiest. অর্থাৎ স্টিফেন হকিংস বিজ্ঞানীও ছিলেন না, দার্শনিকও ছিলেন না।  এ বক্তব্যটি শুনে অনেকের বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। সমগ্র বিশ্ব  টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যেভাবে তাকে সপ্তম আস্মানে নিয়ে গেছে, সেখানে উল্লেখিত বক্তব্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য করে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। তিনি যে বিজ্ঞানী নন, এখানে তিনটি যুক্তি রয়েছে।
প্রথম যুক্তি : লক্ষ্য করা গেছে,  অনেক সময় অনেকেই নিজেকে দার্শনিক হিসেবে দাবি করে থাকেন। কে দার্শনিক এটা  কেউ নিজে দাবি করলেও হবে না, বা অন্য কেউ বললেও হবে না। কে দার্শনিক এটা বলবে দর্শনের সংজ্ঞা। আমরা কি  দর্শনের সেই সংজ্ঞা পেয়েছি? আমি ‘দেশপ্রেমিক’, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বলবে আমি দেশপ্রেমিক কিনা? ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বলবে কে বিজ্ঞানী। আমরা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সঠিক কোনো সংজ্ঞা পাইনি। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,  বিজ্ঞান হচ্ছে, ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমি দর্শনকেও বিশেষ জ্ঞান  বলতে পারি । এ দিয়ে কি বুঝা যাবে বিজ্ঞান কি অথবা কে বিজ্ঞানী? বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা বইর মধ্যে পাওয়া যায় তা হচ্ছে, ‘কোনো বিষয়ের সুসংঘবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান।’ বিজ্ঞানের এ সংজ্ঞাকে গ্রহণযোগ্য বলে  মনে করা হয় না।
আমরা জানি যে,  বিশ্বজগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগৎ, অন্যটি ভাবজগৎ। বস্তুজগতের কোনো কিছুর সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। যেমন, তাল গাছ, নারকেল গাছ। আমরা নামেই তাকে চিনতে পারি। কিন্তু ভাবের ক্ষেত্রে সংজ্ঞার প্রয়োজন হয়। কারণ, শুধু নাম দিয়ে কিছুই বুঝা যায় না। যেমন, প্রেম, মানবিক মূল্যবোধ সততা, ন্যায়পরয়ণতা ইত্যাদি । এ জন্য এর সংজ্ঞার প্রয়োজন। সংজ্ঞারও  একটি সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞার সংজ্ঞা হচ্ছে ‘brief description’ অর্থাৎ যে বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হবে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এরপর উদঘাটন করতে  হবে ঐ বিষয়ের সাথে আর কি কি বিষয় জড়িত। যেমন, ভালোবাসা, একটি শব্দ। এই একটি শব্দ দিয়ে কিন্তু বুঝা যায় না ভালোবাসা কি। ৭টি বিষয়ের সমষ্টি হচ্ছে  ভালোবাসা (প্রেম-ভালোবাসা অধ্যায় : সৃষ্টি থেকে ধ্বংস)। যেমন, মানসিক আকর্ষণ, কল্যাণ কামনা, স্বার্থ, জ্ঞান, আবেগ, ইচ্ছা এবং অনুভুতি। জ্ঞানটা এর মধ্যে কেন রয়েছে। যেমন, দশটি মেয়ে একই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যায়। এর মধ্যে একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগলো, যে মেয়েটি দেখতে কুৎসিৎ। এই কুৎসিৎ মেয়েটিকে ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, এ মেয়েটির এমন একটি গুণ আছে, যা আর কারো মধ্যে নেই। এখানে জ্ঞান এনালাইসিস করবে, মেয়ের রূপ সৌন্দর্য ভালো লাগবে না গুণ ভালো লাগবে। উল্লেখিত বিষয়ের  প্রত্যেকটির ভূমিকা রয়েছে। ঠিক তেমনি কি কি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান এটা জানতে হবে। বিজ্ঞান বলতে দুটো বিষয়। একটি জ্ঞান, অন্যটি বস্তু। জ্ঞান ছাড়া বিজ্ঞান হবে না, বস্তু ছাড়াও বিজ্ঞান হবে না। (যদিও অতিন্দ্রি বিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বস্তুর উপস্থিতি নেই, এটা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ)। রাইট ব্রাদার্স বিমান সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন গ্লাইডিংয়ের মাধ্যমে। এর জ্ঞান তাঁরা কোথায় পেয়েছেন? আকাশে পাখি উড়তে দেখে। পরবর্তীকালে যান্ত্রিক বিমান আবিস্কৃত হয়েছে। এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। এর জ্ঞান তারা পেয়েছে আকাশে পাখি উড়তে দেখে। এরা যদি কোনো কালেই আকাশে পাখি উড়তে না দেখতেন, তাহলে তাদের পক্ষে বিমান আবিস্কার করা সম্ভব ছিল না। এটাই হচ্ছে ভাব বা জ্ঞান। পাখি দেখে বিমানের নক্সা করলেন। এই নক্সা নিয়ে গেলেন বস্তুর কাছে। বস্তু দিয়ে বিমানের বডি তৈরী করলেন, ডানা দিলেন, লেজ দিলেন। এরপর ইঞ্জিন ফিট করলেন। আকাশে উড়লেন। এবার বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হবে এভাবে, ‘ যে জ্ঞান বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা বস্তু মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এটা হচ্ছে বিজ্ঞান। প্রশ্ন হচ্ছে, স্টিফেন হকিংসের কোনো জ্ঞান সরাসরি বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত? এটাই যথেষ্ট যে তিনি বিজ্ঞানী নন।  
দ্বিতীয় যুক্তি : দর্শনের উৎপত্তির পর দর্শন দুই ভাগে বিভক্ত। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। তৃতীয় স্তরে দর্শন চারভাগে বিভক্ত । যেমন, ভাববাদী ক্ষেত্র, বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ধর্মীয় ক্ষেত্র এবং দার্শনিক সাধারণ ক্ষেত্র।  কিন্তু, মতবাদ দেয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে তিনটি। বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ভাববাদী ক্ষেত্র এবং মিশ্রক্ষেত্র। বস্তুবাদী ক্ষেত্র বলতে যেমন, একজন ডাক্তার-বিজ্ঞানী একটি রোগের ঔষধ অবিস্কার করেছেন, এটা হচ্ছে বস্তুবাদী ক্ষেত্র। এখানে তার সাথে কোনো দার্শনিকের দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। তাদের দুজনের পথ এবং মত ভিন্ন। কিন্তু মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেবেন প্রমাণ, দার্শনিকরা দেবেন যুক্তি। প্রমাণ এবং যুক্তি এক হতে হবে।  মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ৯৯ ভাগ প্রমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ। অনেক প্রমাণ দেখানো হয়েছে। শেষে বলা হয়েছে মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল প্রাইমেট। শিক্ষিত সমাজের অনেকে এখনও মনে করেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল বানর। এটা সম্পূর্ণ একটি বোগাস মতবাদ। কতগুলো যুক্তি চান মানুষ মানুষ আকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে? বানর যদি মাটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে, মানুষর সৃষ্টি মাটি হতে বাধা কোথায়? কাজেই এই মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা যতগুলো বিষয়ে মতবাদ দিয়েছেন, যেমন, বিগ ব্যাং, ব্লাক হোল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, বিশ্ব্সৃষ্টি, আকাশ অসীম না সসীম, পৃথিবী ধ্বংস, সবগুলো বোগাস। এর মধ্যে বস্তুগত প্রমাণ, দার্শনিক যুক্তি, বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা নেই। এর পর টাইম ট্রাভেলের কথা বলা হয়েছে। এলিয়েন নামক প্রাণীরা পৃথিবীতে আসে। অনেকে দেখেছেও। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
তৃতীয় যুক্তি : স্টিফেন হকিংস বলেছেন, জমাটবদ্ধ বস্তুতে মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি । প্রশ্ন হচ্ছে, জমাটবদ্ধ বস্তু কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এর ভর কত? তরল না সলিড? মহাবিস্ফোরণের ফলে যে বস্তুপুঞ্জ ছুটে এসে সূর্যের সৃষ্টি করেছে, বিস্ফোরণ স্থল থেকে এর দূরত্ব কত? এর মাঝে অনেক গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ রয়েছে। সে সব সৌরজগৎ অতিক্রম করে সূর্যের সৃষ্টি করা কি সম্ভব? বস্তুপুঞ্জ ছুটে আসার শক্তি কোথায় পেয়েছে, নাকি জেট ইঞ্জিল ফিট করা ছিল? ভারতের দুজন বিজ্ঞানী বলেছেন, মহাবিশ্ব এত সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি,  বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি  সম্ভব নয়। কাজেই তার এ মতবাদ সম্পূর্ণ মনগড়া কল্পকাহিনী।
প্রশ্ন হতে পারে যে, মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? জার্মান দার্শনিক ইমনুয়েল কান্ট বলেছেন, ‘বিশ্ব কখনো সৃষ্টি হয়নি, কখনো ধ্বংস হবে না। ছিল, আছে, থাকবে। বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মের সাথে এর তুলনা করা যাবে না। ধর্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য । অন্য দিকে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার। জ্ঞানীদের জন্য  সূরা ইমরানের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই গ্রন্থের কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন, অন্যগুলো রূপক। অর্থৎ কাল্পনিক। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, যারা নাস্তিক, তারা এসব নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি করে।’ কাজেই এমন কিছু বলা যাবে না যা বললে ধর্মের ভিত দুর্বল হতে পারে।  যেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মের সাথে একটি সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, এবং বহু আলোচিত। আমরা কখনো ধর্মীয় বিষয়ের সাথে দার্শনিক বিষয়ের তুলনা করবো না। এ ক্ষেত্রে আমরা বলবো, ইমানুয়েল কান্টের এ বক্তব্য যথার্থ। তিনি এতটুকুই বলে থেমে গেছেন। আমরা এখান থেকে আরও সামনের দিকে নিয়ে গেছি। আমরা বলেছি, বিশ্বের অনেক গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে, অনেক গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গ্রহ ধ্বংস হয়েছে? এবার আমরা ফর্মুলায় যাবো। বলা হয়েছে, যে গ্রহের সৃষ্টি আছে, কেবল সেই গ্রহের ধ্বংস আছে। যে গ্রহের সৃষ্টি এবং ধ্বংস আছে, সে গ্রহের সময় আছে। যে গ্রহের সময় আছে সে গ্রহটাই ধ্বংস হবে। যেমন, পৃথিবী একটি ধ্বংস হবে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে সকাল, বিকাল, রাত্রি আছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শো কোটি বছর। সময় সম্পর্কেই তো তাদের কোনো ধারণা  নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রা- রাসেল প্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেম হলো সিগারেটের মতো, যার শুরু অগ্নি দিয়ে, শেষ ছাইয়ে।’ মানুষের জীবনে মানবিক মুল্যবোধের পর যে বিষয়টি মূল্যবান সেটি হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা। মানুষের মধ্যে যেদিন ভালোবাসা থাকবে না, সেদিন সভ্যতাও থাকবে না। আদি রাষ্ট্রের উৎপত্তির একটি কারণ হচ্ছে প্রেম। অথচ বার্ট্রা- রাসেল কি বললেন। ওই সব বিজ্ঞানীরা সময় সম্পর্কে ঠিক তেমনি যুক্তিহীন ভিত্তিহীন কথা বলেছে। সময়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। সময় হচ্ছে পৃথিবীর ব্যাপার। দুটো কারণে সময়ের উৎপত্তি।  সূর্য আলো দিচ্ছে, পৃথিবী ঘুরছে, ফলে আমরা একটি দিন এবং একটি রাত পাচ্ছি। এই দিন রাত্রিকে যান্ত্রিক উপায়ে ২৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় এক দিন। এটাকে মিনিট, সেকেন্ডে ভাগ করা হয়েছে। কাজেই পৃথিবীর সময় দিয়ে কি বিশ্বের বয়স নির্ণয় করা যাবে?
স্টিফিন হকিংসের বিগ ব্যাং থিওরী যে একটি বোগাস মতবাদ, এর পর আর কোনো যুক্তির প্রয়োজন আছে। তার মতবাদ যদি বোগাস বলা হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি বিজ্ঞানী নন। তার এই মতবাদ ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো একদিন কোল্ডস্টোরেজে চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : দার্শনিক।

Friday, May 25, 2018

নজরুল সঙ্গীতের বিষয়-বৈচিত্র্য

আখতার হামিদ খান: চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের বাংলা গান রচয়িতাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের গানে বিষয়ের যে বৈচিত্র্য, অন্য কারও গানে তা নেই। যুগের প্রয়োজনে এক এক কালে এক এক বিষয় প্রাধান্য বিস্তার করে। চর্যাগানের মূল বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। বৈষ্ণব পদাবলীতে পৌরাণিক বিষয় স্থান পেয়েছে। তার সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রেমরস মিশ্রিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ের গানে লৌকিক ধ্যান ধারণা প্রবেশ করেছে। পরাধীনতার যুগে এসে গানের বিষয় হয়েছে দেশাত্মবোধ ও বিদ্রোহ চেতনা। এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য বিস্তার করেছে মানবীয় প্রেম।
বাংলা গানের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ধারায় অন্যতম প্রধান হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়াও বাংলা গানকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, নতুন সুর ও রীতির প্রবর্তন করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, হাসন রাজা, লালন ফকির, বিজয় সরকার প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের গানেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। গানের বিষয়, সুর, আবদনে  রয়েছে স্বকীয়তা। কিন্তু অনেকের গানেই বিষয়-বৈচিত্র্য নেই। কেউ শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন তো অন্য কোন বিষয়ে লেখেননি। কেউ শুধু অধ্যাত্মিক ভাবের গান রচনা করেছেন। কেউ বাউল বা কেউ আধুনিক প্রেমমূলক গান। আবার কেউ কেউ নানা বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন। কিন্তু এত ব্যাপক বিষয়ের অবতারণা নজরুল ছাড়া শ্যামাসঙ্গীতও রচনা করেছেন। রামনিধি গুপ্ত টপ্পা অঙ্গের গান। দাশরথি রায় পাঁচালি গান রচনা করেছেন। হাসন রাজা-লালন ফকির লোকসঙ্গীত, বাউল গান রচনা করেছেন। বিজয় সরকারের গানের বিষয় আধ্যাত্মিকতা। এঁদের প্রত্যেকের গানেই যে কোন একটি বিষয় নির্ভর করেছে। একই বিষয় ও ভাবের গান রচনা করেছেন সারা জীবন ধরে। ব্যতিক্রম রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্ত,। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ এবং রজনীকান্ত মূলত ভক্তিমূলক, দেশাত্মকবোধক এবং প্রেম বিষয়ক গান রচনা করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য হাস্যরস বিষয়ে কিছু গান রচনা করেছেন। কিন্তু এ তিন জনের গানেই খুব বেশি বিষয় বৈচিত্র্য নেই। বিষয় বৈচিত্র্য রয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের গানে বেশি। এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলার আর কোন গীতিকার সঙ্গীত রচনা করেননি। নানা বিষয় সঙ্গীত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল লিখেছেন তারও বেশি বিষয় নিয়ে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, গানের বিষয় বলতে আমি গানের মর্মবাণীকে যেমন বুঝাচ্ছি, তেমনি বুঝাচ্ছি সঙ্গীতের ধারা বা শ্রেণীকে। অর্থাৎ কথার অন্তর্নিহিত ভাব কোন আবেদন প্রকাশ করছে, সে অনুসারেই সঙ্গীতের শ্রেণীকরণ করছি। যেমন ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মিক, বৈষ্ণব, পদাবলী, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গজল, প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি। সঙ্গীতের এই নানা শাখায় বিচরণ করেছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন, বহু বিষয়ে গান লিখেছেন। যেমনস ব্রহ্মসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, কীর্তন, পদাবলী, প্রেম, প্রকৃতি, সম্প্রীতি, সমাজসচেতনা, আধ্যাত্মিকতা, বাউল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন সুরে। রামপ্রসাদী, কীর্তন, বাউল সুরের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। কিন্তু নজরুল আর একটু এগিয়ে বাংলায় গজল রচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ আরবীয় সুরে সঙ্গীত রচনা করেছেন। জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি, ভাটিয়ালি, গান যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন ইত্যাদি গান; আবার আধুনিক মানবীয় প্রেমসঙ্গীত, রাগসঙ্গীত, বিদ্রোহ ও দেশাত্মকবোধক গানও লিখেছেন নজরুল। 
গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নজরুল অজ¯্রভারে গান লিখে যাচ্ছিলেন। সেই গানের ভা-ার পরিমাণে যেমন বিপুল, শ্রেণী বিভাগেও তেমনি বিচিত্র। লঘু বাংলা গান থেকেও গুরুগম্ভীর ধ্রুপদ পর্যন্ত বাংলা গানের হেন শাখা নেই যাতে তিনি গান রচনা করেননি। বিদেশি গানের অনুকরণে বিদেশি সুর বসিয়েও অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। বৈচিত্র্য ও বিপুলতা এ দুইই নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভার প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে।’
প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন নজরুল। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর নজরুলের গানের কথা, সুর ও বিষয়-বৈচিত্র্য সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে। বৈষ্ণব যারা তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা ও গোষ্ঠিলীলায় সুর-চিত্র দর্শনের দুর্লভ সুযোগ লাভ করবেন নজরুলের রচনায়। শাক্ত যিনি, তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকেও একটি রাঙা জবা করে ধরে দিতে পারেন নজরুলের শ্যামসঙ্গীতের খেয়ায় ভেসে। মুসলমান যিনি, তিনি ঈদের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হবার ভাষা খুঁজে পাবেন এই নজরুল গীতির ভা-ার থেকেই। প্রেমিক যিনি, তিনি প্রেমের বিভিন্ন স্তরের সুখের ও শোকের সাড়া পাবেন নজরুলের গানে। তাঁর হাসির  গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তর মথিত বাণী।
সারা জীবন নজরুল নানা জায়গা ঘুরছেন, বিচিত্র পেশা গ্রহণ করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। নিজে ছিলেন শিল্পী এবং সুর¯্রষ্টা। আর তাই অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ই তার সঙ্গীতের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কর্ম এবং অভিজ্ঞতা যেমন বিচিত্র ছিল; তেমনি তাঁর গানের বিষয়ও বিচিত্র ছিল। সঙ্গীত ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতির পরিম-ল। সঙ্গীত রচনাতেই সম্ভবত তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। আর এ কারণেই তার সঙ্গীত এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময়। জাত-পাতে তাঁর বিশ^াস ছিল না। তিনি মানুষ। তিনি সর্ব জাতির, সর্ব ধর্মের। আর এ বোধেরই প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বিচিত্র বিষয়ের গানে। এদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামসঙ্গীত, অন্যদিকে তেমনি লিখেছেন ইসলামি ভক্তিমূলক গান, জারি, সারি, মুর্শিদি মারফতি।
লেটোর দলকে কেন্দ্র করেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এখানেই একই সঙ্গে বহু বিচিত্র বিষয়ে গান রচনায় তাঁর হাতে খড়ি হয়। লেটোর দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে মুসলিম ও হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনী ও গীত রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন, অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন। তাঁর সে সময়কার রচনাতেই এই দুই ঐতিহ্য¯্রােতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের পরবর্তীকালের বহু রচনায় মুসলিম ও হিন্দু ঐতিহ্যের যে অসামান্য সহাবস্থিত রূপটি প্রকাশ পেয়েছিল, তার সূচনা ঘটে এই পর্বে। তাছাড়া লেটোর দলের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে তিনি বর্ধমান অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়েও সুযোগ পেয়েছিলেন। সে অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত ঝুমুর গানের সঙ্গে সে সময়ই নজরুলের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে ঝুমুর অঙ্গে বহু গান রচনা করেছিলেন তিনি। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রকাশই তাঁর নানা গানে। এমন কোন বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করেননি।
নজরুলের এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, বিশাল বিষয়-বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত ভা-ার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলা গানে যে সব ধারা প্রচলিত রয়েছে, নজরুলের গানেও সে সব ধারা রয়েছে। নজরুলের  গানের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে- ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, হামদ, নাত, আধুনিক প্রেমসঙ্গীত, গজল, রাগসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, বাউল সঙ্গীত, ঝুমুর, বিদ্রোহমূলক, হাসির গান ইত্যাদি। বাংলার আর কোন সঙ্গীত রচয়িতা এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গান রচনা করেননি। নজরুল গানের এই প্রত্যেকটি শাখায় সফলতা লাভ করেছেন।  এখানেই নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব। 
নজরুলের গানে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ভজন গান। ভজন এক জাতীয় আরাধনা সঙ্গীত বা ভক্তিগীতি। ঈশ্বর বন্দনাই এ গানের উদ্দেশ্য। অন্য কোন বাংলা গান রচয়িতা নজরুলের মত এত উৎকৃষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিপুল ভজন রচনা করতে সক্ষম হননি। তাঁর ভজন তথা হিন্দুধর্মীয় সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ। ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’, ‘সখি সে হরি কেমন বল,’ ‘খেলছি এ বিশ্ব লয়ে,’ ‘অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক গাহে তোমারি জয়’, ‘আহার দিবেন তিনি রে মন, জিভ দিয়াছেন যিনি,’ ‘অঞ্জলি লহৈা মোর সঙ্গীতে’, ‘কোথা তুই খুঁজিস ভগবান’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গানসহ বহু ভজন লিখেছেন নজরুল।
বুলবুলের মৃত্যু নজরুলের জীবনে এক গভীর পরিবর্তনের বীজ বপন করে। অগ্নিগর্ভ কবিতা ও গীত রচয়িতা বিদ্রোহী নজরুল এই শোকের আঘাতে অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা তাঁকে গভীরভাবে পেয়ে বসে। অন্তর্গত বিষাদ ও আধ্যাত্মিকতাই যেন ছিল তার চৈতন্যের বাদীস্বর। সেই সময় থেকেই নজরুলের ভেতরে ভক্তিমূলক গান লেখার প্রবণতা দানা বাঁধতে থাকে। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলাম ও হিন্দু ধর্মীয় আবেগের পটভূমিতে প্রচুর গান রচনা করেন। ভজনগুলো সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। নজরুলের গানের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই ভজন জাতীয় গানগুলো। কোন কোন ভজন গানে শিবের আরাধনা ব্যক্ত হয়েছে। কোনটায় কৃষ্ণের কথা। পদাবলী কীর্তনের ঢঙে নজরুল প্রচুর কীর্তন রচনা করেছেন। কথা ও সুরে পুরোপুরি কীর্তন। কিছু গান ভজনও বলা চলে, আবার কীর্তনও বলা চলে; দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে। যেমন: ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো, বাঁকা ঘনশ্যাম; গোষ্ঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন ইত্যাদি।
পদাবলী কীর্তন বা কীর্তন গান বাঙালির বহু কালের ঐতিহ্যের ধারক। এগুলো বাঙালির অন্তর-সম্পদে পূর্ণ। বাংলার নিজস্ব ঢঙ, চিরায়ত সুর এ গানে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথও বহু কীর্তনাঙ্গের গান রচনা করেছেন। নজরুলের কীর্তন খুবই ঋদ্ধ। কথা ও সুরের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে নজরুলের কীর্তনে। আধুনিককালে যাঁরা কীর্তন গান রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে নজরুলের কীর্তনই শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য কীর্তনগুলো হচ্ছে- ‘বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর’, ‘সখি আমিই না হয় মান করেছিনু; ‘ওরে নীল যমুনার জল, আমি সুখে লো গৃহে রব, ‘না মিটিতে মনোসাধ, ‘মন মানস মাধবী ফুটিল কুঞ্জে, মণি মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে, ‘এলো নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে নজরুলের এ কীর্তনগুলো শিল্প সফরতায় কোন অংশেই কম নয়।
নজরুলের গানের একটা বিশাল অংশ জুড়ে যেমন রয়েছে ভজন এবং কীর্তন গান; তেমিন ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। এত বিপুল পরিমাণ শ্যামাসঙ্গীত নজরুল ছাড়া আর কেউই লেখেননি। নজরুল ইসলামি ভাবধারার গানের থেকে অনেক অনেক বেশি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। রামপ্রসাদ শ্যামাসঙ্গীত রচনার সূত্রপাত করেন। নজরুল শ্যামাসঙ্গীতে কোথাও শ্যামা মাতৃরূপিণী, কোথাও কালীর রৌদ্রী রূপের ভয়ঙ্কর বর্ণনা, আবার কোথাও দেশাত্মবোধের প্রেরণা প্রকাশিত। অন্যান্য গানের চেয়ে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং পরিমাণের প্রচুর বেশি। তাঁর উল্লেখযোগ্য শ্যামাসঙ্গীত হচ্ছে- ‘বলরে জবা বল;’ ‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা; শ্মশানে জাগিছে শ্যামা, ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা; ‘ভারত শ্মশান হলো মা তুই; আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশি শ্যামা কালী; শ্যামা তোর নাম যার জপমালা; ওমা খড়গ নিয়ে মাতিস রণে।
নজরুল প্রচুর পরিমাণে জারি, সারি, ভাটিয়ালি এবং পল্লীগীতি রচনা করেছেন। এসব গানেও বাঙালির, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আবেগ যেন এসব গানে স্থির হয়ে রয়েছে। ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে, যা যারে, এ বিখ্যাত গানটি ভাটিয়ালি গানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রয়েছে- ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা; আমার গহীন জলের নদী; নদীর নাম সই অঞ্জনা; বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়, ওগো ললিতে, পথভোলা কোন রাখাল ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান।
ভক্তিমূলক গান রচনায় নজরুল অদ্বিতীয়। নজরুলের ইসলামি ভাবধারায় গানগুলোতে মুসলিম ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। মুর্শিদি মারফতি হামদ নাত প্রভৃতি বিষয়ে নজরুল ইসলামি ভাবধারায় প্রচুর গান লিখেছেন। ভক্তি, শরণাগতি ও মাহাত্মবোধের প্রেরণা থেকে নজরুল ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে ুদই শতাধিক গান রচনা করেছেন। এই সব গান নজরুলের ইসলামি গান রূপে খ্যাত। বাংলায় ইসলামি ভক্তিগীতির প্রবর্তন নজরুলই প্রথম করেন। তাঁর রচিত ইসলামি গান বাংলা গানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলায় ইসলামি গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকারও নজরুল। আল্লাহর প্রশস্তি, রসূল প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা, উপাসনালয় প্রভৃতি নানা বিষয় অবলম্বনে নজরুলের ইসলামি গানগুলো রচিত। নজরুলের উল্লেখযোগ্য ইসলামি গানগুলো হচ্ছে- ‘মহম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে; খোদার প্রেমেরর শরাব পিয়ে; শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত; মওলা আমার সালাম লহ; ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়; মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই; মরু সাহারা আজ মাতোয়ারা; মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি; তোমার নুরের রোশনী মাখা; রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।’
আধুনিক বাংলা প্রেমগানের বিশিষ্ট রূপকার নজরুল। তৎকালীন ছায়াছবির একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল নজরুলের গান। আধুনিক গানকে নজরুলই জনপ্রিয়তা দান করেছেন। তাঁর আধুনিক গানের আবেদন আজকে এতটুকু হ্রাস পায়নি। আধুনিক গানের পরিমাণও নজরুলের কম নয়। নজরুলের আধুনিক গানের সুর বৈচিত্র্য আশ্চর্যভাবে বিস্ময়কর। কালজয়ী কিছু গান গভীর নিশীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়; তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, প্রিয়, জনম জনম গেল আশা পথ চাহি; মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম; আজো মধুর বাঁশরী বাজে; আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো; তবু আমারে দেবো না ভুলিতে; যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে; আমি চাঁদ নহি অভিশাপ; মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে, বিদায় সন্ধ্যা আসিল; মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী; ভীরু এ মনের কলি; মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা ইত্যাদি।
বাংলায় গজল গানের প্রচলন মূলত নজরুলই করেন। গজল মূলত পারস্য প্রেম সঙ্গীত। ফার্সি কবিরা গজল রচনা করতেন। এ প্রেম ঐশী প্রেমপ্রার্থী। অন্য সকল প্রকার কাব্যগীতির মত জগলেরও সঙ্গীতাদর্শ হচ্ছে সুরের সাহায্যে গানের বাণীকে ধ্বনিত করে তোলা, যেন পদবাহিত ব্যঞ্চনা সুরের স্পর্শে প্রমূর্ত হয়ে উঠতে পারে। 

Wednesday, May 24, 2017

মরক্কোয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের বিপুল বিজয়

রাবাত থেকে এএফপি : মরক্কোর মধ্যপন্থী ইসলামী দল গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মত বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। গত শনিবারে প্রকাশিত আংশিক নির্বাচনী ফলাফলে আরব বিপ্লবের সূত্র ধরে এই অভাবিতপূর্ব বিজয় লাভ করেছে।  গত এক মাস পূর্বেকার নিউনিশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিপ্লবোত্তর নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলের বিজয় এবং মিসরে বিপ্লবের মাতাল হাওয়া বয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মরক্কোর ইসলামী দলের এ বিপুল বিজয় অর্জিত হলো। মোট ৩৯৫ আসনের মধ্যে ২৮৮টির ফলাফলে শনিবার এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) এর প্রধান আব্দেল্লাহ বেনকিরানে বলেছেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্য দলগুলোকে নিয়ে জোট সরকার গঠন করা হবে। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ বিজয়ী দলের পক্ষ থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করবেন। গতকালের এ নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা ছিল এক কোটি ৩৬ লাখ এবং এতে শতকরা ৪৫ ভাগ ভোট পড়েছে। নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন সাত হাজার।
পিজেডি সরকার গঠন করলে এটা হবে উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর দ্বিতীয় কোনো দেশে ইসলামী দলের শাসন ক্ষমতায় আসার ঘটনা। এর আগে তিউনিশিয়ায় ইসলামী আন-নেহদাহ দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে।
মরক্কোর ইসলামী দল পিজেডি'র বেশিরভাগ সমর্থক তুলনামূলক গরিব শ্রেণীর এবং দলটি ক্ষমতায় গেলে ইসলামী অর্থনীতি এবং সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মরক্কোয় এ নিয়ে নয়বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০০৭ সালে সর্বশেষ নির্বাচন হয় এবং সেবার শতকরা ৩৭ ভাগ ভোট পড়েছিল।
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ তার দেশে সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকানোর কৌশল হিসেবে শাসন ব্যবস্থায় তড়িঘড়ি কিছু সংস্কার আনেন।  তবে, এখনো তিনিই দেশটির অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার মালিক।  মরক্কোর বেশ কয়েকটি দল এ সংস্কারকে যথেষ্ট নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নির্বাচনেও অংশ নেয়নি।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তৈয়ব চেরকাউই নির্বাচনোত্তর আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ইসলামপন্থী জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ৮০টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। দলটি ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী আববাস আল ফাসির ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আসন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দল জিতেছে ৪৫টি আসনে। এ দলটি গত ২০০৭ সাল থেকে পাঁচ দলীয় জোট সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে। গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের কথা। পিজেডির সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল্লাহ বেনকিরানে সাংবাদিকদের জানান, আমরা মরক্কোবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, তারাই ভোট দিয়ে আমাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করেছেন। আমরা এতে দারুণ সন্তুষ্ট।
আংশিক ফলাফল ঘোষণার পরপরই প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম সাগর সৈকতবিধৌত রাজধানী শহর রাবাতের রাস্তায় রাস্তায় ব্যাপক আলোকসজ্জা, আতশবাজি, গাড়ির হর্ন বাজিয়ে এবং পার্টির প্রতীক সম্বলিত বর্ণিল ফেস্টুন উড়িয়ে সমর্থকরা আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে।
গত জুলাইয়ে একটি নতুন সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফাভাবে গণভোট নাটকের মাধ্যমে বাদশাহ ৬ষ্ঠ মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর আসন পাকাপোক্ত করেন অধিকাংশ আসন কব্জা করে। গত মার্চে তিনি সংবিধান পরিবর্তনের ঘোষণা দিলে তিউনিশিয়ায় মিসর ও লিবিয়ার মত গণজাগরণের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। অবসান ঘটে দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রের। প্রায় সাড়ে তিনশ' বছরের সুপ্রাচীন একনায়কতন্ত্রের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজা ৬ষ্ঠ মোহাম্মদের পতন ঘটে। নয়া সংবিধানে তার বিশাল ক্ষমতার অনেকগুলোর ওপর কার্যত নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। পিজেডি প্রধান বলেন, তারা অন্যান্য দলের সাথে জোটবদ্ধ হবার পর দলের সদস্যপদ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
বেনকিরানে দ্য ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর টিভি চ্যানেলকে বলেন, আমাদের দলীয় কর্মসূচি এবং ভবিষ্যৎ সরকারে যারা আমাদের সাথে জোটবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরকে নিয়ে আমরা গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, পিজেডি মরক্কোয় তার স্পেভাটার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করে এতদাঞ্চলে দেশটিকে একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দৃঢ় অবস্থানে উন্নীত করবে। পিজেডি তাদের সামাজিক কর্মসূচির মধ্যে গ্রীষ্মকালীন সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং মদ বিক্রির ওপর আপত্তি উত্থাপন করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা বৃহত্তর জনমতের বিষয় বিবেচনা করে এবং বেকারত্ব ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। এবারের নির্বাচনী প্রচারণাকালে সাধারণ ভোটারদের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, দারিদ্র্যকে অন্তত অর্ধেকে হ্রাস করে এবং চাকরির ক্ষেত্রে বেতন কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ বাড়ানো হবে।
প্রকাশিত: সোমবার ২৮ নবেম্বর ২০১১ | প্রিন্ট সংস্করণ

Tuesday, March 28, 2017

বরেন্দ্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম নেতৃত্ব খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ


সরদার আবদুর রহমান : বাংলাদেশের উত্তর জনপদ তথা বরেন্দ্রভূমির এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম নেতৃত্বের নাম খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ। বিংশ শতাব্দীর বিশ-ত্রিশ দশকজুড়ে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলকে বলতে গেলে একক নেতৃত্ব দিয়ে সেসময়ের অনগ্রসর মুসলিম সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন তিনি। একাধারে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য ডেপুটি স্পিকার, রাজশাহী জেলা বোর্ড এবং রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি এক গৌরবময় সময়কাল অতিবাহিত করেন। একই সময়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠত থেকে তিনি বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তৎকালীন সময়ে বঙ্গে অন্য কোন নেতার জীবন-ইতিহাস এরূপ দেখা যায় না।
খ্যাতিমান সমাজসেবক, রাজনীতিক ও আইনজীবী খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ তৎকালীন মালদহ জেলার  (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা) অন্তর্ভুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার রাজারামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হেমায়েতুল্লা বিশ্বাস। এমাদুদ্দীন স্থানীয় স্কুল থেকে বৃত্তিসহ প্রাইমারি পাস করে কিছুকাল নবাবগঞ্জ হরিমোহন সরকারী হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে রাজশাহী সরকারী কলেজে ভর্তি হন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে এফ.এ. এবং ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পাস করার পর তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে এমাদুদ্দীন আহম্মদ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী শহরে ফিরে এসে রাজশাহী জজকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং স্বল্পকালের মধ্যেই আইন ব্যবসায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এসময় তিনি রাজশাহীর একডালা হাট লুট, হিন্দু গৃহবধূ পঙ্কজিনী অপহরণ, সরদহের নিকটে খোর্দ গোবিন্দপুর গ্রামের ডাকাতি প্রভৃতি কয়েকটি বিখ্যাত মামলায় একজন আইনজীবী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। 
রাজনৈতিক জীবন : খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদের সময়কাল (১৮৭৫-১৯৩৬) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা এদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে ভারতীয় কংগ্রেস ও সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়া কাউন্সিল এ্যাক্ট, ১৯০৫ সালের বাংলা বিভাগ ও ১৯১১ সালের বাংলাবিভাগ রদ্, ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন, ১৯১৬ সালের লক্ষেèৗ-চুক্তি, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এসময়ে বাংলার মুসলমানগণ তাদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একই সময়ে রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বহু ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের সমাবেশ ঘটে। এঁদের মধ্যে বিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজনৈতিক কর্মকা-ের  সঙ্গে খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আইন ব্যবসায় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রাজশাহী পৌরসভা চেয়ারম্যান, জেলা বোর্ড চেয়ারম্যান, বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার হিসেবে প্রায় তিনদশক রাজনৈতিক উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে পশ্চাদপদ মুসলমানদের অগ্রগতি সাধনে সর্বাত্মœক চেষ্টা করেন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন মুসলিম স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন সমগ্র বাংলার আন্তরিক হিতাকাংখী। তাঁর মধ্যে আইনের পারদর্শীতা, রাজনীতিজ্ঞান ও দেশহিতৈষণার সমাবেশ ঘটে। উপমহাদেশের পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আজীবন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম বাংলায় তাঁর নেতৃত্ব যথেষ্ট গুরুত্বের অধিকারী। সমকালের সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর কর্মকা- ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে। 
ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত : খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ রাজশাহীর (দক্ষিণ) মুসলমান নির্বাচকম-লীর প্রতিনিধিরূপে পরপর তিনবার বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার রাজশাহীর (দক্ষিণ) মুসলমান নির্বাচকম-লীর প্রতিনিধিরূপে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে (১৯২৭-২৯ খ্রি.) আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দীর্ঘ দশ বছর আইন পরিষদে রাজশাহীর গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বাংলার অবহেলিত মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলিষ্ঠ ভাষায় আইন পরিষদে তুলে ধরেন এবং মুসলমানদের অধিকার আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এসময় ইস্টেট পার্টিশন বিল ১৯৩৩, বেঙ্গল মোটর ভেহিকল ট্যাক্স বিল ১৯২৬, বেঙ্গল চিলড্রেন বিল ১৯২১, আগ্রা এবং আসাম সিভিল কোর্ট এ্যামেন্ডমেন্ট বিল ১৯৩৪, বেঙ্গল ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট বিল ১৯৩৪, বেঙ্গল মোহামেডান ম্যারেজ এন্ড ডিভোর্ড রেজিস্ট্র্রেশন বিল, ১৯২১ বেঙ্গল টেনান্সি বিল ১৯২৮ প্রভৃতির উপর তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান : ব্রিটিশ শাসনকালে ‘বেঙ্গল লোকাল সেলফ এ্যাক্ট-১৮৮৫’ অনুযায়ী জেলা বোর্ড গঠিত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর মি: এ. এইচ. রড্ক। বঙ্গীয় স্বায়ত্বশাসন বিধান অনুসারে তখন পদাধিকার বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বেই জেলাবোর্ডগুলো পরিচালিত হয়। এমাদুদ্দীন আহম্মদ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজশাহী জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বায়ত্বশাসিত আইন সংশোধিত হওয়ার পরে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসরকারী ব্যক্তি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার অধিকার লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম নির্বাচনে এমাদুদ্দীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় নির্বাচনেও তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলা বোর্ডের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তৃতীয় নির্বাচনে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নাটোরের রাজা (ছোট তরফ) বীরেন্দ্রনাথ রায়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাজশাহী জেলাবোর্ডের পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করেন দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায়।
পৌরসভা চেয়ারম্যান : রাজশাহী পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল। এই পৌরসভার সর্বপ্রথম বেসরকারী চেয়ারম্যান ছিলেন বাবু হরগোবিন্দ সেন। তাঁর পূর্বে সরকারী কর্মকর্তারাই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। এমাদুদ্দীন আহম্মদ ছিলেন রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম মুসলমান বেসরকারী চেয়ারম্যান। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ অবধি তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে অর্থাৎ এমাদুদ্দীন আহম্মদের পূর্বে কোন (২৩-এর পাতায় দেখুন)
(২১-এর পাতার পর)
মুসলমান রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেননি। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলা বোর্ড ও পৌরসভার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
খানবাহাদুর উপাধি লাভ : রাজশাহী জেলা বোর্ড ও পৌরসভার নির্বাচনে এমাদুদ্দীন আহম্মদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাজশাহীতে প্রথম মুসলিম নেতৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। মুসলিম জাগরণে নেতৃত্ব দান করলেও তিনি ছিলেন উদার ও মুক্তমনের অধিকারী। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁর অসাধারণ কর্মদক্ষতা এবং ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার তাঁকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের লাভ বা লোভ-লালসার উর্দ্ধে থেকে তিনি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সে কারণে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ছিল জনগণের পরম বিশ^াস ও আস্থা। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং প্রভাবে অত্র অঞ্চলের অনগ্রসর জনপদের মাঝে নবজীবনের সঞ্চার ঘটে। 
সমাজসেবায় অবদান : এমাদুদ্দীন আহম্মদ ছিলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজসচেতন এক স্মরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই জনহিতৈষী নেতা জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মকা-ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই অঞ্চলে তৎকালীন মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা তাঁকে পীড়িত করে। ফলে তিনি মুসলিম জাগরণে নেতৃত্ব দান করেন। ক্রমে বিভিন্ন সমাজসেবকদের প্রচেষ্টায় রাজশাহীতে রাজশাহীতে গড়ে ওঠে ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম সমিতি’ (১৯০৬ খ্রি:), ‘মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ (১৯১৮ খ্রি:), ‘মুসলিম ক্লাব’ (১৯২৯ খ্রি:), ‘খাদেমুল ইসলাম সমিতি’ (১৯৩২ খ্রি:) প্রভৃতি। মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধনে এসব সংগঠন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এসব প্রতিষ্ঠান ও সমিতির সঙ্গে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। একারণে তিনি জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত রাজশাহী গালর্স মাদ্রাসা (পরে হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তাঁর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। এসময়ে রাজশাহী শহরে পি.এন. বালিকা বিদ্যালয় ছাড়া আর কোন বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। উক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের কারণে এবং ইসলামী রীতি-নীতি বা ধর্মীয় শিক্ষালাভের কোন সুযোগ না থাকায় পর্দানশীন মুসলিম পরিবারের মেয়েরা ভর্তি হতে আগ্রহী ছিল না। এছাড়া নি¤œমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মুসলিম পরিবারের মেয়েদের পক্ষে সেখানে ভর্তির সুযোগ লাভ করাও ছিল বেশ কঠিন ব্যাপার। শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী রীতি-নীতি বা ধর্মীয় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হাতেম খাঁন মহল্লায় স্থাপিত হয় ‘রাজশাহী জুনিয়র বালিকা মাদ্রাসা।’ বিশিষ্ট সমাজ হিতৈষী মৌলবী মো: পারভেজ আলীর বৈঠকখানায় তাঁর নিজস্ব চেয়ার, টেবিল ও বেঞ্চ নিয়ে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর বসির উদ্দীন আহমেদ এবং সেক্রেটারি ছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী মৌলবী মো: পারভেজ আলী। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয় হাতেম খান মহল্লায় মির্জা মোহাম্মদ ইউসফের উদ্যোগে এবং মুসলিম জনগণের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত ‘রাজশাহী মোহামেডান এসোসিয়েশন’ এর নিজস্ব ভবনে। ভবনটিতে তখন ভাড়া থাকতেন খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন। তিন কক্ষ বিশিষ্ট উক্ত ভবনে চলতো সভা। সম্মিলিত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের মুক্ত আলোচনা। শিক্ষায় অনগ্রসর নারী সমাজের শিক্ষা প্রসারকল্পে তথা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ভবনটি বিদ্যালয়ের জন্য ছেড়ে দিয়ে খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন এরই অপর পাশের্^ একটি খড়ের আটচালা কামরায় নিজে অবস্থান করতে থাকেন। মোহামেডান এসোসিয়েশন-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত তিনকক্ষ বিশিষ্ট এই ভবনকে কেন্দ্র করেই বিদ্যালয়টির সম্প্রসারণ ঘটে। খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন কর্মকা-ে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে এটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে তা ‘রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে অত্র অঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। রাজশাহীর এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব দীর্ঘদিন যাবত রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, লোকনাথ স্কুল এবং রাজশাহী হাই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। রাজশাহী মুসলিম গার্লস মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এর পূর্বে বঙ্গদেশে কোন গার্লস মাদ্রাসা ছিল না। রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
তিনি ১৯০৭ থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ মখদুম ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। এসময় শিক্ষা দীক্ষার উন্নয়ন, ছাত্রবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি, ছাত্রভর্তি ও ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, গ্রামীণ প্রাইমারী স্কুল স্থাপন, কৃষির উৎকর্ষ সাধন, কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্থাপন, কৃষি ঋণ সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, খাবার পানি সরবরাহের জন্য কূপ ও পুকুর খনন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রশাসনের সকল স্তরে মুসলিম প্রতিনিধি প্রেরণে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। রাজশাহীর বর্তমান বিদ্যুৎ ভবনটি ছয় বিঘা জমির উপর নির্মিত। এর সবটুকুই খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ তাঁর নিজস্ব জমি দান করেন। 
অনাড়ম্বর জীবন : সুঠাম দেহের অধিকারী এই প্রতিভাদীপ্ত কর্মীপুরুষের জীবনযাপন প্রণালী ছিল আড়ম্বর বর্জিত-নিতান্তই সহজ সরল। তিনি ছিলেন কর্তব্যে নিষ্ঠাবান, সদালাপী এবং অন্যায়ের প্রতি আপসহীন এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় খানবাহাদুর এমাদউদ্দীন আহম্মদ রাজশাহী শহরের হাতেম খান মহল্লায় অবস্থিত তাঁর নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ কন্যা ও দুই পুত্র রেখে যান। রাজশাহী হিন্দু-মুসলিমসহ সর্বস্তরের মানুষের শোকাকুল পরিবেশে শাহ মুখদুম (র:) এর মাজার সংলগ্ন মসজিদের ওজুখানার পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তারপর কয়েকদিন ধরে শহরের বিভিন্ন স্থানে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভুবন মোহন পার্কে হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলিত হয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বাংলার মুসলিম সমাজের উন্নয়নে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই মহৎ ব্যক্তির নামানুসারে রাজশাহী পৌরসভার একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘খানবাহাদুর এমাদুদ্দীন রোড।’ এছাড়া আর কোথাও তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। হাতেম খান মহল্লার ‘এমাদুদ্দীন লজ’ তাঁর বসত ভিটার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
তথ্যসূত্র : ১. রাজশাহীর প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধি খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ : মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। ২. শহর রাজশাহীর আদিপর্ব : মাহবুব সিদ্দিকী, ৩. প্রবন্ধ : রাজশাহীর পাঁচ স্বনামধন্য শিক্ষাহিতৈষী, মোহাম্মদ জুলফিকার।

Tuesday, March 7, 2017

কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা ও আওয়ামী লীগের ডিগবাজি -মো. নূরুল আমিন

স্বাধীনতা উত্তরকালে বিশেষ করে নববই-এর দশকের শুরুতে স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর থেকে বিগত দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে যে ইস্যুটি বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়ে এসেছে তা হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি, সরকার গঠনের জন্য কিভাবে, কার অধীনে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের আওতায় নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যরা বাংলাদেশ আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। বলাবাহুল্য, আইনসভার গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংবিধান গৃহীত ও সত্যায়িত হবার পর এই সংবিধান মোতাবেকই ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন যেমন অবাধ হয়নি তেমনি সুষ্ঠুও হয়নি। জাতীয় লীগ প্রধান প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদের ভাষায়, ‘এই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার' চরম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, মিডিয়া ক্যু, দলীয় বাহিনীর যথেচ্ছ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও ঢালাও হুমকির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন দখল করেন। ফলাফলে জঘন্য কারসাজি ও কারচুপি, মিডিয়া ক্যু, ব্যালট বাক্স এমনকি প্রিজাইডিং অফিসারদের ছিনতাই, অপহরণ ছিল এই নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক কণ্ঠকে স্তব্ধ করার সরকারি তৎপরতা ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, জেল-জুলুম এবং সরকারি দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশবাসী জীবন ও রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আচরণ এবং প্রথম নির্বাচনে সেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দুর্দশা দেখে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং দলটির উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। বিষয়টি অাঁচ করতে পেরে পরবর্তী নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাওয়া ও ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এসে আওয়ামী লীগ দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও চারটি দলীয় ও সরকারি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্র-পত্রিকা বেআইনি ঘোষণা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বিদ্যমান জাতীয় সংসদকে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী ঐ বছরের ২৫ জানুয়ারি থেকে ৫ বছরের বৈধতা দিয়ে অতিরিক্ত দুই বছরের মেয়াদ প্রদান করা হয়। এটা ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী প্রয়াসের একটি অংশ, গণতন্ত্র প্রয়াসী লাখ লাখ শহীদের লাশের প্রতি ছিল এটি একটি অবমাননা। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগেরই কিছুসংখ্যক শীর্ষ নেতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয় এবং মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার ফেরত পায়। জেনারেল জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচনের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোন আপত্তিও উত্থাপিত হয়নি। তবে জেনারেল এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে ব্যাপক কারসাজি, কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভুয়া ভোট এবং পেশীশক্তির বলে ভোটকেন্দ্র দখল ও অস্ত্রবাজি পরিলক্ষিত হয়। এই সময় সরকার ও সরকারি দল ব্যাপকভাবে মিডিয়া ক্যুর আশ্রয় নেয়। এমনও দেখা গেছে যে, ক্ষমতাসীন দল সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে নির্বাচন কেন্দ্রমুখী সকল রাস্তায় বোমাবাজি ও অস্ত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসা এবং ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রে দলীয় ক্যাডাররা ব্যালট পেপারে সীল মেরে বাক্স ভর্তি করে সরকারি দলের বিশেষ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। কারচুপি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যের এই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপকতা তখন এতই বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল যে, বিরোধী দলসমূহ জেনারেল এরশাদের অধীনে কোন প্রকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ঐ পর্যায়ে নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সরকারি প্রভাবমুক্ত করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তরফ থেকে প্রথমবারের মতো কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা পেশ করা হয়। এই ফর্মুলাটি পরবর্তীকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন আন্দোলনের প্রথম সাফল্য। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাটিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রূপান্তরিত না করায় জটিলতা দেখা দেয় এবং বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলো এই সময় ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার মূল প্রবক্তা জামায়াত হলেও আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থাটিকে তার মূল কর্মসূচির অংশ বানিয়ে নেয়। শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতৃবৃন্দ এর মূল প্রবক্তায় পরিণত হন।
এই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ‘‘কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন’’ এই শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এ নিবন্ধটির প্রথম কিস্তি ২৩/১০/৯৪ এবং শেষ কিস্তি ২৪/১০/৯৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে তিনি  তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন :
‘‘আজকে যদি দেশ ও জাতির স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী ৩/৪/৫টা নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করাই তা হলে আমার মনে হয় আমরা একটা সিস্টেমে যেতে পারবো অর্থাৎ আমাদের এই আন্দোলন হচ্ছে সাংবিধানিক একটি ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য। আজকাল যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন তারা দ্বিতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, তৃতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, চতুর্থবার কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন সে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রশাসনকে দলীয়করণ করেন। তারা দলকে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত করেন। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে নষ্ট করেন। দলতত্ত্ব কায়েম করতে গিয়ে এমনভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেন, সরকার তখন আর জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে চান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলকথা জবাবদিহিতা। আজকে পার্লামেন্টে আমরা যখন দুর্নীতির প্রশ্ন তুলি, অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপন করি কিন্তু তার কোনও অর্থবহ আলোচনা হয় না। সেখানে কোনও জবাবদিহিতা নেই। কারণ এ সরকার মনে করে আগামী নির্বাচন যেহেতু তাদের অধীনে হবে, সেহেতু বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রশ্ন করবে না ক্ষমতায় গিয়ে ভাল করেছে কি করেনি, ওয়াদা রক্ষা করেছে কি করেনি। কিন্তু কোন সরকার যদি দেখে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তা হলে অবশ্যই সে সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কারণ তখন সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিতে, নিজের পরিবার-পরিজনকে বিত্তশালী করতে প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে ভয় পাবেন এবং এমন কতগুলো কাজ সরকার করবেন যা ভাল কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। যার ফলে জনগণ তাকে ভোট দেবে। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন আমরা তুলেছি।’’
কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও এক ও অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আশির দশকের শেষ ভাগ এবং নববইয়ের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তিনি এই সরকারের পক্ষে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন সর্বত্র একটি কথাই বলেছেন এবং তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে দলীয়করণ করে সর্বদাই ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তার ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনে। তিনি সর্বদা এ কথাই বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নাই এবং কেয়ারটেকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন কখনো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। তিনি সর্বদা জোর দিয়ে বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকারের যেহেতু ক্ষমতায় যাবার অভিলাষ নেই সেহেতু এই ব্যবস্থাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি। ১৯৯৪ সালের ১৫ জুন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থার সম্পাদকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এতে তার দলীয় নেতাদের মধ্যে জনাব আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ, আমীর হোসেন আমু ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উপস্থিত ছিলেন। এতে দৈনিক ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ অবজারভার, ফাইন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং ইউএনবি'র প্রধান সম্পাদক/সম্পাদকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৬-০৬-১৯৯৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী, মতবিনিময়কালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি প্রধানমন্ত্রী হব এই ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই। প্রয়োজনে আমি নির্বাচন করবো না। তবুও যতদিন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করবে ততদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হোক না কেন তাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন অহিংস থাকেনি। সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল। বন্দর অচল হবার ফলে আমদানি-রফতানি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা এসেছিল। যানবাহন তথা বাস, ট্রাক, ট্রেন ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সম্পদ হানি ছাড়াও সারাদেশে মোট ৭১ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে এবং পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল কয়েক সহস্র। এই সম্পদ ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করে  নেয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে শেখ হাসিনার দল এবং একটিতে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়।
সন্দেহ নেই সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকার ও তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল প্রহসনমূলক। সাংবিধানিক বিধান মেনে এই কেয়ারটেকার সরকারটি গঠিত হয়নি এবং তা ছিল এক এগারোর সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার। এই সরকারকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা স্বয়ং তার আন্দোলনের ফসল তথা আওয়ামী লীগের ‘সন্তান বলে' ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই সন্তানের বদৌলতে এবং প্রতিবেশী দেশের টাকার বস্তা, পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শের বলে ক্ষমতায় এসে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেছেন। তার দল এবং জোটের জনসমর্থনহীন কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের এই পদক্ষেপকে মেনে নেয়নি। তারা বলেছেন যে, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য কোন নির্বাচনে তারা যাবেন না এবং নির্বাচন হতেও দিবেন না। মহাজোট সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশবাসী এখন তাদের পেছনে রয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করার পেছনে যে যুক্তি প্রদর্শন করছেন তা হচ্ছে এই ব্যবস্থাকে বেআইনী ঘোষণা করে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের রায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে রায়কে অজুহাত বানিয়ে এই ব্যবস্থাটিকে বাতিল করা হয়েছে সেই রায়টি অদ্যাবধি লিখিত ও স্বাক্ষরিত হয়নি। রায়ের যে সারাংশ আদালতের তরফ থেকে পড়ে শোনানো হয়েছিল তার দুটি অংশ ছিল। প্রথম অংশে বলা হয়েছিল যে, কেয়ারটেকার সরকারের ধারণা গণতান্ত্রিক নীতিমালার পরিপন্থী এবং এই প্রেক্ষিতে তা বাতিলযোগ্য। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছিল বিদ্যমান অবস্থায় আরো দুটি জাতীয় নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে। সরকার রায়ের লিখিত কপির অপেক্ষা না করে সংক্ষিপ্ত ও মৌখিক রায়ের প্রথমাংশ গ্রহণ করে তাড়াহুড়া করে কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করায় জনগণের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে, সরকারের এই পদক্ষেপটি ছিলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং তারা ক্ষমতায় এসে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্য এ ধরনের একটি সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে ছিলেন। এই সুযোগটি কিভাবে এসেছে সে সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। দৈনিক ডেইলী স্টার পত্রিকার একটি রিপোর্টের বরাত দিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টম্যান্ট থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক এক রিপোর্টে বিচারবিভাগ দলীয়করণের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পূর্বে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে দশ লাখ সাঁইত্রিশ হাজার টাকার একটি তহবিল গ্রহণ করেছিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী জনাব হকের সাথে হাইকোর্টের আরো কয়েকজন বিচারপতিও অনুরূপ তহবিল গ্রহণ করেছেন। তাদের এই তহবিল গ্রহণের সাথে রুলিং ও রায় দেয়ার বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিল যা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে সহজতর করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এও জানা গেছে যে, যে সম্প্রসারিত বেঞ্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উপর মামলাটি নিত্তি হয়েছে সে বেঞ্চের সদস্য বিচারপতিরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে রায় দেননি। বাতিলের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানসংখ্যক বিচারপতি থাকায় সভাপতিত্বকারী বিচারপতি তথা মাননীয় প্রধান বিচারপতি কাস্টিং ভোট দিয়ে রায়টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে পরিণত করেছেন। তবে রায়টি যেহেতু এখনো পর্যন্ত লিখিত আকারে পাওয়া যায়নি সেহেতু বিস্তারিত জানার জন্য দেশবাসীকে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের বিরোধী দলীয় দাবি সম্পূর্ণভাবে এখন প্রত্যাখ্যান করছেন। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য অতীতে তিনি কি বলেছেন, কি করেছেন সম্ভবত তিনি এখন তার সবকিছুই ভুলে গেছেন। যেমন তার সরকার ভুলে গেছেন ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোও। তিনি কয়েকদিন আগে আবারো জোর দিয়ে বলেছেন যে, আগামী সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। এবং বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন হবে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এই কমিশনের অধীনেই ন্যস্ত থাকবে। তার বর্তমান যুক্তির সাথে অতীতের অবস্থান ও যুক্তির কোন মিল নেই। তিনি বিগত কেয়ারটেকার সরকারকে ডেমন (Demon) বা অসুর বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই অসুর যে তাদেরই আন্দোলনের ফসল এবং তাদেরই সন্তান এ কথাটি কি বারবার তারা ঘোষণা করেননি? আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার বর্তমানে যে শাসন কায়েম করেছেন তাতো ১/১১'র সেনা সমর্থিত Demon সরকারের ধারাবাহিকতা মাত্র।  এই সরকারের সাথে Democracy বা গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এইটাকে দেশের মানুষ Demoncracy বলেই জানে যা অসুরতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা অসুরের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী তাদের কি বলা হবে? দেশবাসী বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারেন। ১/১১'র কেয়ারটেকার সরকার আওয়ামী লীগের সন্তান হলেও প্রধানমন্ত্রী তাকে চক্ষুশূল মনে করেন এ জন্যই যে, এই সরকারই তাকে এবং অন্য রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বিচারের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। ঐ সরকার তাকে দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক আখ্যায়িত করে প্রেসনোট জারি করেছিল। যদিও অজ্ঞাত কারণে পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এই সরকারই আবার তাকে এবং বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে দেশান্তরী করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, রাস্তায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা, বাস-ট্রেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের নামে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রাত্যহিক বাজার ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া প্রভৃতি খুব ভালো কাজ ছিল না। এই কাজগুলো তার দল করেছে এবং এজন্য তারা কেউই অনুতপ্ত হননি। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিচারের সম্মুখীনও করা হয়নি। এখন যখন হরতালে অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে দু'একটি গাড়ি জ্বলে কিংবা ককটেল নিক্ষিপ্ত হয় তখন অগ্নিসংযোগ ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পিতা আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেন। তখন সম্ভবত তাদের কিছুটা হলেও বিবেকের দংশন অনুভব করা প্রয়োজন। যে কাজ আমার জন্য বৈধ, সে কাজ অন্যের জন্য অবৈধ হতে পারে না। যদি অবৈধ হতে হয় তা সকলের জন্যই অবৈধ হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কেয়ারটেকার সরকারকে অসুর আখ্যায়িত করা ছাড়াও এ সরকার কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন এবং বলেছেন যে, এর প্রেক্ষিতে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন কাম্য নয়। তিনি ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কেয়ারটেকার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন যে, এই সরকার ক্ষমতায় এসে রাতারাতি ১৩ জন সচিবকে চাকরিচ্যুত করেছেন। চাকরিচ্যুতির অভিযোগটি আসলে সত্য নয়। বিচারপতি লতিফুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৩ জন সচিবকে বদলি করেছিলেন যাদের পূর্ববর্তী সরকার তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনী ফলাফল হারভেস্ট করার পরিকল্পনা করেছিলেন। শুধু ১৩ জন সচিব নয়, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর-অধিদফতরসমূহে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোস্টিং দিয়ে এমন একটি আবহের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যাতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে সহজে তারা জিততে পারেন। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কেয়ারটেকার সরকার আওয়ামী লীগের এই জালটি ছিঁড়ে ফেলায় তারা দলটির শত্রুতে পরিণত হন। এখানে শুধু ১৩ সচিবের বদলির বিষয়টি ছিল না। তাদের বদলি করার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগপন্থী আরো চারজন চুক্তিভিত্তিক সচিব প্রধান উপদেষ্টাকে ডিঙ্গিয়ে প্রোটকল ভেঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছেও ধরনা দিয়েছিলেন এবং এই চারজনের সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগে সক্রিয়। একজন এখনো বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা  (ড. মশিউর রহমান) হিসেবে কাজ করছেন। কাজেই চিহ্নিত দলীয় লোকদের সরিয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমান নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তাতে কোন অন্যায় বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। কোন বিশেষ দলকে বিশেষ সুবিধা না দিয়ে সকল দলকে সমান সুযোগ দেয়া, কেয়ারটেকার দর্শনের এটিইতো মূলকথা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনির্বাচিত সরকারের স্থান নেই। কেয়ারটেকার আন্দোলনের সময় তিনি নিজেই এর জবাব দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এটি ৯০ দিনের একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য এটা প্রয়োজন। এখন তিনি তার বিপরীত কথা বলছেন। তার সরকারে অনির্বাচিত মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা আছেন যারা নির্বাচিত মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী। আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি দলীয় লোকদের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের গত তিন বছর ধরে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। জেলা পরিষদে অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতারাই এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের কাছে এর জবাব কি? তারা গোটা প্রশাসন, আইন-শৃক্মখলা বাহিনী, বিচার বিভাগ- শিক্ষা বিভাগ, সর্বত্র দলীয়করণের যে জাল বিস্তৃত করে রেখেছেন, তাতে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। দেশে যে সংঘাত, সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উদ্ধারের জন্য কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিকল্প আর কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। আর যদি সরকার অব্যাহতভাবে গণদাবি প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন তাহলে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতারণা থেকে মুক্ত হবার পথ অবশ্যই বেছে নেবেন।
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২৯ মে ২০১২ | প্রিন্ট সংস্করণ

Popular Posts