কেয়ারটেকার (নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা এক সময় বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম প্রধান উপাদান হিবাবে গৃহীত হয়েছিল। সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশেই এর প্রয়োগ হয়। এই ব্যবস্থার আবিষ্কারক অধ্যাপক গোলাম আজম। দ্য নিউ এজের সম্পাদক সাংবাদিক নুরুল কবির বলেন: “গোলাম আজমের রুপরেখা বাস্তবায়ন হল বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, তিউনিশিয়ার পর তুরস্কেও।” তিনি বলেন: “১৯৮০’র দশকে এবং ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিল । একটি সুষ্ঠু পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য যখন কোন ফর্মুলাই কাজে আসছিল না । তখন গোলাম আজম কেয়ারটেকার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন । কিছুটা বিরোধীতা থাকলেও একটা পর্যায় সকলেই বলতে বাধ্য হন এর থেকে ভাল দ্বিতীয় কোন পথ নেই । দেশে-বিদেশে উচ্ছসিত প্রশংসা পায় । যারা একটা সময় এক সাথে আন্দোলন করে কেয়ারটোকার পদ্ধতি চালু করলেন আবার সেই তারাই তাদের স্বার্থে সেটার বিলুপ্তি করে দেন । যার খেসারত আজো দিচ্ছে বাংলাদেশ । যে গণতন্ত্র উত্তরণে ৯০-এ তার কেযারটেকার পদ্ধতি জাতিকে দিয়েছিল মুক্তির দিশা । কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথিকৃৎ মনে করা হয় বাংলাদেশকে। এ ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থার জন্য কৃতিত্ব দাবি করলেও এই দলটিই আবার ব্যবস্থাটি বাতিল করে দিয়েছে, যার জের ধরে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেও নেপাল, পাকিস্তান, তিউনিশিয়া সহ বহু দেশই এখন এ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হচ্ছে তুরস্কের নাম ” ।
কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বৃটেনের হাউজ অব কমন্সের সাবেক স্পীকার মি: লর্ড ওয়েদারিল (Lord Weatherill) বার্তা সংস্থা ইউএনপির সাথে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি এই ধারনাকে (কেয়ারটেকার সরকার) সমর্থন করি। ইহা চালু করতে পারলে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি মডেল হবে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপেরই নয়, অন্যত্র বহু নতুন গণতান্ত্রিক দেশ রয়েছে যাদের বেলায় এটি খুবই উপযুক্ত বিজ্ঞ ধারণা হতে পারে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের এর প্রয়োগের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে এর প্রয়োগ হয়। ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানে মঈন কোরেশীর নেতৃত্ব কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংসদ ভেংগে দেয়ার পর কেয়ারটেকার কেবিনেট গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। একই বছরে কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধরত বিভিন্ন পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৪ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং নির্বাচন হওয়ার পর ইহা স্থায়ী আইনে পরিণত হয়। ১৯৯৫ সালের আফ্রিকার মোজাম্বিক ও আমেরিকার হাইতিতে তত্তাবধায়ক করকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। গ্রীসেও নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। আফগানিস্তানে একসময় তৎকালীন সর্ববৃহৎ দল হেজবে ইসলামীর প্রধান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এক বিদেশী পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে আফগান গৃহযুদ্ধ সমস্যার সামাধানের জন্য বাংলাদেশের মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার গঠনের দৃষ্টান্তটি বহু আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে সাফল্যজনক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
উক্ত কেয়ারটেকার সরকারের ধারণা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রদান করেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির অধ্যাপক গোলাম আজম। তিনি এই কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ ফোরাম কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদে ১৯৭৯ সালে পেশ করেন। সেখানে বিস্তারিত আলোচনাক্রমে উক্ত ফর্মুলা গৃতীত হয়। তারপর ১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান ঢাকার রমনা রেস্তোরায় আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসাবে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি উপস্থাপন করেন। ১৯৮০ সালের ৮ই ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে সংক্ষিপ্তাকারে উক্ত সংবাদ পরিবেশন করে বলা হয়- এই দাবীকে নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসাবে জামায়াত আখ্যায়িত করে । ঐ তারিখে দৈনিক সংগ্রামে খবরটি বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮৩ সালের ২০শে ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আয়োজিত এক গণজমায়েতে আব্বাস আলী খান কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী জানান। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে জেনারেল এরশাদের সাথে যে সংলাপ চলে সেখানেও জামায়াতে ইসলামী উক্ত ফর্মুলা পেশ করে। তখন প্রধান প্রধান দলগুলো উক্ত দাবীর সাথে একমত হয়নি। পরে ১৯৯০ সালে যখন অন্যান্য বিরোধীদল নিজস্ব পরিভাষাসহ জামায়াতে ইসলামীর উক্ত দাবীর সাথে একমত হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে তখন এক গন-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। ফলে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ পরিচালিত নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৯৯১ সালের ৫ই এপ্রিল ৫ম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ৬ই আগষ্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল ২০৭-০ ভোটে পাস হয়। দ্বাদশ সংশোধনীর সময় সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংযোজনের জন্য জামায়ত প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু তৎকালীন সরকারী ও বিরোধী দল কোনটিই সেই প্রস্তাব সমর্থন করে নাই। পরে সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৯শে জানু., ১৯৯১ সালে জামায়তে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারী জেনারেল ও জামায়াতের সংসদীয় দলের নেতা মওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার বিল সংসদে উত্থাপন করেন। পরে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বিএনপি সরকারের মাধ্যমে সংসদে পাশ হয়ে বাংলাদেশের সংবিধানসম্মত ব্যবস্খা হিসাবে গৃহীত হয়। অতএব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে গৃহীত ও বহুবিধ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সফল নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার উদ্ভাবক ও অগ্রবর্তী বাস্তবায়নকারী হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর অবদান অনস্বীকার্য।
No comments:
Post a Comment